দেশ অচল করে দেয়ার রাজনীতি by একেএম শাহনাওয়াজ
আওয়ামী
লীগ ও বিএনপির মতো বড় দল এবং আদালতের ভাষায় সন্ত্রাসী দল জামায়াতে ইসলামীর
নেতা-নেত্রীদের কাছে আমার একটি নিবেদন আছে। আপনারা যেহেতু জনগণের রাজনীতি
করেন না- করেন ক্ষমতার এবং ক্ষমতার সঙ্গে থাকার রাজনীতি, সেহেতু তা সততার
সঙ্গে ঘোষণা দিয়েই মাঠে নামুন। আমরা সাধারণ মানুষ একটি বড় দীর্ঘশ্বাস
লুকিয়ে মেনে নেব এমন ললাট লিখন। মেনে নেব, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য
থাকলেও আমাদের কপালে গণতন্ত্র পাওয়া নেই। গণতন্ত্র তো আসবে রাজনীতিকদের হাত
ধরে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা
ক্ষমতা প্রাপ্তির জন্য গণতন্ত্রের পথ কণ্টকাকীর্ণ করতে কিছুমাত্র দ্বিধা
করেন না। অবলীলায় বিবদমান দলগুলো ক্ষমতার জন্য বিবাদ করছে আর তার কঠিন
মাশুল দিতে হচ্ছে রাজনীতিকদের হাতে জিম্মি অসহায় জনগণকে। রাজনীতিকরা এতটাই
ক্ষমতান্ধ হয়ে গেছেন, সাধারণ মানুষের ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার
রণদামামা বাজাচ্ছেন। সব পক্ষের আচরণ থেকেই এর উদাহরণ টানা যায়। তবে এ
মুহূর্তে আমার উল্লেখ করতে ইচ্ছা করছে সম্প্রতি বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদের
একটি বক্তব্য। ২ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে সরকারকে সতর্ক করে তিনি বলেছেন,
‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে লাগাতার হরতালসহ
নানা কর্মসূচি দিয়ে দেশ অচল করে দেয়া হবে।’
পাঠক একবার লক্ষ্য করুন, কতটা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীর ভূমিকায় আছেন আমাদের রাজনীতিকরা। দেশ অচল করার কর্মসূচিতে হয়তো লাভ হবে মওদুদ আহমদদের। শক্তির ভারসাম্যে হেরে গিয়ে সরকার পক্ষ হয়তো দাবি মেনে নেবে। তাতে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে বিএনপির। অন্যদিকে এসব পাটা-পুতার ঘর্ষণে পিষে মরবে দেশবাসী।
যখন বড় কোনো দাবি আদায়ে সর্বাত্মক ধর্মঘটের কর্মসূচি হিসেবে লাগাতার হরতাল-অবরোধ ডাকা হয়, তখন সাময়িক কষ্ট মাথা পেতে নিয়েও সাধারণ মানুষ তাতে সমর্থন জানায়। কারণ তারা বিশ্বাস করতে চায়, এই ত্যাগের বিনিময়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে বড় কিছু অর্জিত হবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো তখনই লাগাতার হরতালের মতো কর্মসূচিতে যায়, যখন তা গণদাবিতে রূপান্তরিত হয়। আর এ ধারার কর্মসূচির ডাক দেয়া হয় আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে। এখন তো হরতাল-অস্ত্র ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিরোধী দল মুড়ি-মুড়কির মতো ব্যবহার করছে। অস্ত্র ভোঁতা হয়ে যাওয়ায় তা আর ধারে কাটে না। এখন ভারে কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই হরতালের আগের দিন থেকে হরতাল ডাকিয়ে দল ও তাদের জোট বন্ধুরা সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। হামলে পড়ে সাধারণ নাগরিকের গাড়ির ওপর। নিরীহ গাড়িগুলো হামলার শিকার হয়। পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। যাত্রীরা আহত হয়। আগুনে পুড়ে ট্রাক ড্রাইভার, ট্যাক্সি যাত্রী নিহত হওয়ার খবরও বেরোয়। এমন সন্ত্রাসে ছড়ানো ভীতির স্বাভাবিক রেশ থাকে হরতালের দিনেও। ভীত মানুষ গাড়ি বের করতে, দোকান খুলতে সাহস পায় না। কেউ সাহস দেখালেও সেক্ষেত্রে চেষ্টা করা হয় তার জীবন বিপন্ন করার। আহত-নিহত নিরীহ মানুষের স্বজনদের কান্নায় টেলিভিশনের পর্দা ভারাক্রান্ত হয়। লক্ষ কোটি দর্শক বিষণ্ন হয়। অভিসম্পাদ দেয় হরতাল ডাকিয়ে সন্ত্রাসীদের। আর মুদ্রার অন্য পিঠে এসব রাজনীতিক সাংবাদিকদের ডেকে হরতাল সফল করার জন্য বিপন্ন জনগণকেই চরম বিদ্রুপের সঙ্গে ধন্যবাদ জানান। এই নষ্ট চরিত্রের কারণেই নিজেদের ক্ষমতার কাড়াকাড়ির যুদ্ধে জেতার জন্য নেতারা নির্দ্বিধায় দেশদ্রোহীর মতো দেশ অচল করে দেয়ার কথা বলতে পারেন!
কীভাবে এসব নেতা বুঝতে পারলেন, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ানো এবং দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়া লাগাতার হরতাল কর্মসূচিকে মানুষ সমর্থন দিচ্ছে? আর কেনই বা দেবে? একথা সত্য, বর্তমান সরকার যাপিত জীবনে সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা স্বস্তি এনে দিতে পারেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখকে বিবেচনা করতে পারেনি। তাই দলীয় সন্ত্রাস অব্যাহত থেকেছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ তাদের উন্মাত্ততা একইভাবে প্রদর্শন করছে। প্রশাসনিক দুর্নীতি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনি সরকার। দলীয়করণের অস্বস্তিকর থাবা মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু শাসক দলের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেবল বক্তৃতার মঞ্চে নিজেদের ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে। এই সত্য আবার বিএনপি-জামায়াতের কৃতকর্মের সত্যকেও মিথ্যা করে দেবে না। বিগত দিনে দুঃশাসন উপহার দেয়া বিএনপি-জামায়াত আজ হঠাৎ করে জনমন অধিকারী হয়ে যাবে কোন জাদুমন্ত্রে? কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নেগেটিভ ভোটে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হওয়ার অর্থ এই নয় যে, বিশেষ মন্ত্রবলে বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। যদি আওয়ামী লীগ তার ব্যর্থতা অব্যাহত রাখে, তবে হয়তো এসব নেগেটিভ ভোটে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে, বিএনপি নিজ ভোটে বিজয়ী হয়নি। বড় সত্যটি হচ্ছে, নেগেটিভ ভোটের ওপর শতভাগ ভরসা করা যায় না। এমন অবস্থায় বিএনপি যদি জনদুর্ভোগ বাড়ানোর কর্মসূচি দিয়ে বিজয়ী হতে চায়, তবে পদস্খলনের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।
এটি সত্য, আওয়ামী লীগের নানা ভুলের কারণে এখন বিএনপির বৃহস্পতি তুঙ্গে। একে ধরে রাখতে হলে আচরণে-বক্তব্যে বিএনপি নেতাদের আরও অনেক সংযত ও মানবিক হতে হবে। বিএনপি নিশ্চয়ই জানে, এদেশের সর্বস্তরের মানুষ এখন হরতালের মতো জনদুর্ভোগ বাড়ানোর কর্মসূচি চায় না। আজ যদি কোনো দল হরতাল ডেকে ভীতি ছড়ানোর সংস্কৃতি ত্যাগ করে এবং কোনো পিকেটিংয়ে না যায়, তবে সে হরতাল সুপার ফ্লপ করবে। যে কোনো দলের হরতালের পরিণতি একই হবে। তাহলে মানতেই হবে, হরতালের প্রতি মানুষের কোনো সমর্থন নেই। আছে বিতৃষ্ণা। এমন বাস্তবতায় বিএনপির মতো একটি দল, যার নেতা-নেত্রীরা কট্টর দলান্ধ কর্মী-সমর্থক ছাড়া জনসমর্থন বাড়ানোর মতো তেমন কোনো গুণাবলী প্রদর্শন করতে পারেননি, তারা যখন লাগাতার হরতাল ডেকে দেশ অচল করার কথা বলেন, তখন তা দেশবাসীর বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে সন্ত্রাস করার নামান্তর বলেই মনে হবে।
ঠিক এমন বাস্তবতায় এইচএসসি পরীক্ষায় কিছুটা ফল বিপর্যয়ের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন এর প্রধান কারণ হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতালকে দায়ী করেন, তখন তার সঙ্গে ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থী পরিবারসহ দেশবাসী সে বক্তব্যকে সমর্থন জানাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিয়মমাফিক প্রতিপক্ষের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে দাঁড়িয়ে গেলেন বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল। তিনি স্বভাবসুলভ নাটুকে ও শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে সমালোচনা করলেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের। রবীন্দ্রনাথ আউড়ে বললেন, ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর।’ কিন্তু একবারও ভাবলেন না, সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়ে কেষ্টা বেটাদের চিনতে ভুল করেনি। এ সত্য লুকানো যাবে না যে, হরতালের কারণে একটি পরীক্ষা ছাড়া বাকি পরীক্ষার তারিখ বারবার পেছাতে হয়েছে। চট্টগ্রামে নাকি একটি পরীক্ষাকে চারবার পেছাতে হয়েছে। এমন অবস্থায় পরীক্ষার্থীর পক্ষে স্বাভাবিক পরীক্ষা দেয়া কঠিন। যে দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা ক্ষমতাপ্রেমী রাজনীতিকদের স্বার্থের কাছে লাঞ্ছিত হতে পারে, আবার তার জন্য কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দায়িত্বশীল নেতারা রসাত্মক বক্তব্য রাখতে পারেন, সে দেশে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী আছে!
বিএনপির বন্ধু জামায়াত তো এবার রেকর্ড ভঙ্গ করল। তারা নিয়ম করে ফেলেছে, নিজ দলীয় নেতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের দিন এবং পরদিন হরতাল চাপিয়ে দেবেই। এতে আইনের শাসনকে কতটা লাঞ্ছিত করা হচ্ছে আর সাধারণ মানুষকে কতটা দুর্ভোগে ফেলা হচ্ছে, তা বিবেচনায় নেয়ার মতো কোনো প্রয়োজন মনে করছে না দলটি। তাই ইসলাম ধর্মের নাম মুখে রেখে পবিত্র রমজান মাসেও একাধিক হরতাল দিতে এবং সন্ত্রাসের আগুন ছড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেনি। আবার ঈদের ছুটিতে ঘর ফেরা লাখ লাখ মানুষকে বিপদে ফেলে ১৩ ও ১৪ তারিখ দুই দিনের হরতাল ডেকেছে জামায়াত। বরাবর বিএনপি-জামায়াত একে অন্যের হরতালকে সমর্থন জানায়। এবার কিছুটা চক্ষুলজ্জা হয়েছে বিএনপির। জামায়াতের স্পর্শকাতর হরতালকে সমর্থন না জানিয়ে মৌনব্রত পালন করেছে। আমরা মনে করি, এ সময়ে হরতাল ডাকা থেকে জামায়াতকে বিরত রাখতে অথবা প্রকাশ্যে হরতাল না ডাকতে বলে বিএনপি নেতৃত্ব জনগণের সামনে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারতেন। কিন্তু জনগণের ঘাড়ে পা রেখে যারা ক্ষমতায় যেতে চায়, তাদের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করা বৃথা।
সাধারণ মানুষের সংকট লাঘবে সরকারি দলই কি কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছে? বিরোধী দলের হরতাল উন্মাদনা অনেকটা লাঘব করা যেত নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে ফয়সালায় আসতে পারলে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, সরকারি দলের অসহযোগিতা এক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রেক্ষাপট তো রচিত হয়েছে সরকারি দল ও সরকার পক্ষের ইচ্ছাতেই। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি বিষয়টিকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে গেছে। আবার এই শক্তি নিয়েই তা অবমুক্ত করা যেত। কিন্তু জনকল্যাণ ও দেশকল্যাণ কোনো পক্ষের ভাবনাতে নেই বলে ক্ষমতাপ্রিয় দলগুলো একইভাবে নীরব থেকে নৈরাজ্য উস্কে দেয়। তাই যারা এককালে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন অবাধ হবে না বলে বিশ্বাস করতেন, তারা এখন সুবিধার আসনে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মঞ্চ গরম করছেন। আবার এককালে সরকারি মসনদে বসে যারা পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না বলে বাণী দিয়েছিলেন, এখন তারা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি কায়েমের জন্য দেশ ও দেশবাসীকে জিম্মি করে ফেলেছেন।
আমাদের তাৎক্ষণিক ফল লাভে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের কাছে এরপরও মানুষ দূরদর্শিতা ও দায়িত্বশীলতা আশা করে। দেশ অচল করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি হয়তো হতে পারে, কিন্তু দেশবাসী যে তাতে বিপন্ন হবে এবং দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সে বিবেচনা কি তারা করবেন না? নির্বাচনের ময়দানে এসব হিসাব নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষ করবে। তাই ক্ষমতার রাজনীতির স্থূলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও বলব, কোনো পক্ষেরই উচিত হবে না তীরে এসে তরী ডোবানোর দায় নেয়া।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক একবার লক্ষ্য করুন, কতটা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীর ভূমিকায় আছেন আমাদের রাজনীতিকরা। দেশ অচল করার কর্মসূচিতে হয়তো লাভ হবে মওদুদ আহমদদের। শক্তির ভারসাম্যে হেরে গিয়ে সরকার পক্ষ হয়তো দাবি মেনে নেবে। তাতে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে বিএনপির। অন্যদিকে এসব পাটা-পুতার ঘর্ষণে পিষে মরবে দেশবাসী।
যখন বড় কোনো দাবি আদায়ে সর্বাত্মক ধর্মঘটের কর্মসূচি হিসেবে লাগাতার হরতাল-অবরোধ ডাকা হয়, তখন সাময়িক কষ্ট মাথা পেতে নিয়েও সাধারণ মানুষ তাতে সমর্থন জানায়। কারণ তারা বিশ্বাস করতে চায়, এই ত্যাগের বিনিময়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে বড় কিছু অর্জিত হবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো তখনই লাগাতার হরতালের মতো কর্মসূচিতে যায়, যখন তা গণদাবিতে রূপান্তরিত হয়। আর এ ধারার কর্মসূচির ডাক দেয়া হয় আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে। এখন তো হরতাল-অস্ত্র ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিরোধী দল মুড়ি-মুড়কির মতো ব্যবহার করছে। অস্ত্র ভোঁতা হয়ে যাওয়ায় তা আর ধারে কাটে না। এখন ভারে কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই হরতালের আগের দিন থেকে হরতাল ডাকিয়ে দল ও তাদের জোট বন্ধুরা সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। হামলে পড়ে সাধারণ নাগরিকের গাড়ির ওপর। নিরীহ গাড়িগুলো হামলার শিকার হয়। পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। যাত্রীরা আহত হয়। আগুনে পুড়ে ট্রাক ড্রাইভার, ট্যাক্সি যাত্রী নিহত হওয়ার খবরও বেরোয়। এমন সন্ত্রাসে ছড়ানো ভীতির স্বাভাবিক রেশ থাকে হরতালের দিনেও। ভীত মানুষ গাড়ি বের করতে, দোকান খুলতে সাহস পায় না। কেউ সাহস দেখালেও সেক্ষেত্রে চেষ্টা করা হয় তার জীবন বিপন্ন করার। আহত-নিহত নিরীহ মানুষের স্বজনদের কান্নায় টেলিভিশনের পর্দা ভারাক্রান্ত হয়। লক্ষ কোটি দর্শক বিষণ্ন হয়। অভিসম্পাদ দেয় হরতাল ডাকিয়ে সন্ত্রাসীদের। আর মুদ্রার অন্য পিঠে এসব রাজনীতিক সাংবাদিকদের ডেকে হরতাল সফল করার জন্য বিপন্ন জনগণকেই চরম বিদ্রুপের সঙ্গে ধন্যবাদ জানান। এই নষ্ট চরিত্রের কারণেই নিজেদের ক্ষমতার কাড়াকাড়ির যুদ্ধে জেতার জন্য নেতারা নির্দ্বিধায় দেশদ্রোহীর মতো দেশ অচল করে দেয়ার কথা বলতে পারেন!
কীভাবে এসব নেতা বুঝতে পারলেন, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ানো এবং দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়া লাগাতার হরতাল কর্মসূচিকে মানুষ সমর্থন দিচ্ছে? আর কেনই বা দেবে? একথা সত্য, বর্তমান সরকার যাপিত জীবনে সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা স্বস্তি এনে দিতে পারেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখকে বিবেচনা করতে পারেনি। তাই দলীয় সন্ত্রাস অব্যাহত থেকেছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ তাদের উন্মাত্ততা একইভাবে প্রদর্শন করছে। প্রশাসনিক দুর্নীতি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনি সরকার। দলীয়করণের অস্বস্তিকর থাবা মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু শাসক দলের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেবল বক্তৃতার মঞ্চে নিজেদের ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে। এই সত্য আবার বিএনপি-জামায়াতের কৃতকর্মের সত্যকেও মিথ্যা করে দেবে না। বিগত দিনে দুঃশাসন উপহার দেয়া বিএনপি-জামায়াত আজ হঠাৎ করে জনমন অধিকারী হয়ে যাবে কোন জাদুমন্ত্রে? কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নেগেটিভ ভোটে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হওয়ার অর্থ এই নয় যে, বিশেষ মন্ত্রবলে বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। যদি আওয়ামী লীগ তার ব্যর্থতা অব্যাহত রাখে, তবে হয়তো এসব নেগেটিভ ভোটে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে, বিএনপি নিজ ভোটে বিজয়ী হয়নি। বড় সত্যটি হচ্ছে, নেগেটিভ ভোটের ওপর শতভাগ ভরসা করা যায় না। এমন অবস্থায় বিএনপি যদি জনদুর্ভোগ বাড়ানোর কর্মসূচি দিয়ে বিজয়ী হতে চায়, তবে পদস্খলনের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।
এটি সত্য, আওয়ামী লীগের নানা ভুলের কারণে এখন বিএনপির বৃহস্পতি তুঙ্গে। একে ধরে রাখতে হলে আচরণে-বক্তব্যে বিএনপি নেতাদের আরও অনেক সংযত ও মানবিক হতে হবে। বিএনপি নিশ্চয়ই জানে, এদেশের সর্বস্তরের মানুষ এখন হরতালের মতো জনদুর্ভোগ বাড়ানোর কর্মসূচি চায় না। আজ যদি কোনো দল হরতাল ডেকে ভীতি ছড়ানোর সংস্কৃতি ত্যাগ করে এবং কোনো পিকেটিংয়ে না যায়, তবে সে হরতাল সুপার ফ্লপ করবে। যে কোনো দলের হরতালের পরিণতি একই হবে। তাহলে মানতেই হবে, হরতালের প্রতি মানুষের কোনো সমর্থন নেই। আছে বিতৃষ্ণা। এমন বাস্তবতায় বিএনপির মতো একটি দল, যার নেতা-নেত্রীরা কট্টর দলান্ধ কর্মী-সমর্থক ছাড়া জনসমর্থন বাড়ানোর মতো তেমন কোনো গুণাবলী প্রদর্শন করতে পারেননি, তারা যখন লাগাতার হরতাল ডেকে দেশ অচল করার কথা বলেন, তখন তা দেশবাসীর বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে সন্ত্রাস করার নামান্তর বলেই মনে হবে।
ঠিক এমন বাস্তবতায় এইচএসসি পরীক্ষায় কিছুটা ফল বিপর্যয়ের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন এর প্রধান কারণ হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতালকে দায়ী করেন, তখন তার সঙ্গে ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থী পরিবারসহ দেশবাসী সে বক্তব্যকে সমর্থন জানাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিয়মমাফিক প্রতিপক্ষের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে দাঁড়িয়ে গেলেন বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল। তিনি স্বভাবসুলভ নাটুকে ও শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে সমালোচনা করলেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের। রবীন্দ্রনাথ আউড়ে বললেন, ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর।’ কিন্তু একবারও ভাবলেন না, সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়ে কেষ্টা বেটাদের চিনতে ভুল করেনি। এ সত্য লুকানো যাবে না যে, হরতালের কারণে একটি পরীক্ষা ছাড়া বাকি পরীক্ষার তারিখ বারবার পেছাতে হয়েছে। চট্টগ্রামে নাকি একটি পরীক্ষাকে চারবার পেছাতে হয়েছে। এমন অবস্থায় পরীক্ষার্থীর পক্ষে স্বাভাবিক পরীক্ষা দেয়া কঠিন। যে দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা ক্ষমতাপ্রেমী রাজনীতিকদের স্বার্থের কাছে লাঞ্ছিত হতে পারে, আবার তার জন্য কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দায়িত্বশীল নেতারা রসাত্মক বক্তব্য রাখতে পারেন, সে দেশে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী আছে!
বিএনপির বন্ধু জামায়াত তো এবার রেকর্ড ভঙ্গ করল। তারা নিয়ম করে ফেলেছে, নিজ দলীয় নেতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের দিন এবং পরদিন হরতাল চাপিয়ে দেবেই। এতে আইনের শাসনকে কতটা লাঞ্ছিত করা হচ্ছে আর সাধারণ মানুষকে কতটা দুর্ভোগে ফেলা হচ্ছে, তা বিবেচনায় নেয়ার মতো কোনো প্রয়োজন মনে করছে না দলটি। তাই ইসলাম ধর্মের নাম মুখে রেখে পবিত্র রমজান মাসেও একাধিক হরতাল দিতে এবং সন্ত্রাসের আগুন ছড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেনি। আবার ঈদের ছুটিতে ঘর ফেরা লাখ লাখ মানুষকে বিপদে ফেলে ১৩ ও ১৪ তারিখ দুই দিনের হরতাল ডেকেছে জামায়াত। বরাবর বিএনপি-জামায়াত একে অন্যের হরতালকে সমর্থন জানায়। এবার কিছুটা চক্ষুলজ্জা হয়েছে বিএনপির। জামায়াতের স্পর্শকাতর হরতালকে সমর্থন না জানিয়ে মৌনব্রত পালন করেছে। আমরা মনে করি, এ সময়ে হরতাল ডাকা থেকে জামায়াতকে বিরত রাখতে অথবা প্রকাশ্যে হরতাল না ডাকতে বলে বিএনপি নেতৃত্ব জনগণের সামনে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারতেন। কিন্তু জনগণের ঘাড়ে পা রেখে যারা ক্ষমতায় যেতে চায়, তাদের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করা বৃথা।
সাধারণ মানুষের সংকট লাঘবে সরকারি দলই কি কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছে? বিরোধী দলের হরতাল উন্মাদনা অনেকটা লাঘব করা যেত নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে ফয়সালায় আসতে পারলে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, সরকারি দলের অসহযোগিতা এক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রেক্ষাপট তো রচিত হয়েছে সরকারি দল ও সরকার পক্ষের ইচ্ছাতেই। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি বিষয়টিকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে গেছে। আবার এই শক্তি নিয়েই তা অবমুক্ত করা যেত। কিন্তু জনকল্যাণ ও দেশকল্যাণ কোনো পক্ষের ভাবনাতে নেই বলে ক্ষমতাপ্রিয় দলগুলো একইভাবে নীরব থেকে নৈরাজ্য উস্কে দেয়। তাই যারা এককালে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন অবাধ হবে না বলে বিশ্বাস করতেন, তারা এখন সুবিধার আসনে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মঞ্চ গরম করছেন। আবার এককালে সরকারি মসনদে বসে যারা পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না বলে বাণী দিয়েছিলেন, এখন তারা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি কায়েমের জন্য দেশ ও দেশবাসীকে জিম্মি করে ফেলেছেন।
আমাদের তাৎক্ষণিক ফল লাভে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের কাছে এরপরও মানুষ দূরদর্শিতা ও দায়িত্বশীলতা আশা করে। দেশ অচল করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি হয়তো হতে পারে, কিন্তু দেশবাসী যে তাতে বিপন্ন হবে এবং দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সে বিবেচনা কি তারা করবেন না? নির্বাচনের ময়দানে এসব হিসাব নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষ করবে। তাই ক্ষমতার রাজনীতির স্থূলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও বলব, কোনো পক্ষেরই উচিত হবে না তীরে এসে তরী ডোবানোর দায় নেয়া।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments