শাহবাগ আন্দোলন নষ্ট রাজনীতির শিকার

শাহবাগের জাগরণ জাতিকে এক ক্রান্তি-মুহূর্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। করেছে রক্তাক্ত ইতিহাসের মুখোমুখি। জনতার সরব বিক্ষোভে একাত্তরের অসমাপ্ত ঋণ শোধের দাবিতে গর্জন করে ওঠে দেশ। কিন্তু দেড় মাসের মাথায় অন্য হিসাব-নিকাশ চলছে।
বলা হচ্ছে, এ আন্দোলন এখন কোন পথে? এ আন্দোলনের যবনিকা কোথায়? এমন প্রশ্ন দিনে দিনে বেড়ে চলেছে আরও। বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী এ আন্দোলন কি জড়িয়ে পড়েছে জটিল রাজনীতির কুটিল ঘূর্ণাবর্তে? নাকি এক নষ্ট সময় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠাবিরোধী এ উদ্যত জাগরণ আন্দোলনের? উত্থানপর্বেই ফুঁসে ওঠা স্রোতধারায় মিশেছিল বেনো জল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক, গত ৯ই মার্চ একটি অনলাইন এজেন্সিতে  বিষয়টি বিশদ করেছেন অল্প কথাতেই। তিনি লিখেছেন, “...৫ই ফেব্রুয়ারি বিকালে যে শ’ খানেক মানুষ (শাহবাগের জাতীয়) জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিল তারা সরকারের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল। তারা মনে করেছিল, সরকার ও জামায়াতের মধ্যে সম্ভবত একটা আঁতাত হয়েছে, নইলে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগের ৫টি প্রমাণ হলেও ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন কেমন করে রায় হয়? অন্য সবার মতো সরকারও হতভম্ব হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাবেশের প্রকৃতি বুঝতে প্রথম দু-তিন দিন পার করে দিয়েছে। সরকারের সাজানো নাটক হলে আওয়ামী লীগ নেতা হানিফকে প্রজন্ম চত্বরে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। এরপর সরকার বুঝতে পেরেছে এ আন্দোলনকে সমর্থন দেয়া দরকার, আখেরে তাদেরই লাভ। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি! মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদির প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ ইতিবাচক নম্বর পাবেই- ঐতিহাসিক বাস্তবতা তাকে এ সুবিধা দেয়। চার বছর ধরে বহুল অপশাসনের পরও শাহবাগ আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি-ব্যর্থতার ইস্যুগুলোকে আপাতত পর্দার আড়ালে লুকাতে সাহায্য করেছে। ফলে প্রকাশ্য না হলেও, অপ্রকাশ্য সমর্থন সরকার প্রথম দু’সপ্তাহ দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশের পর থেকে ছাত্রলীগ সামনের সারিতে চলে আসে, এবং সরকারপক্ষের অংশগ্রহণ প্রকাশ্য হয়ে ওঠে।...”
এর পর সেতুর নিচে বয়ে গেছে অনেক পানি। নিভৃত কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়েছে অনেক কঙ্কাল। গত ১৭ই মার্চ ‘পথ হারাচ্ছে আন্দোলন, জাগরণ মঞ্চ শক্তি হারিয়েছে বিভক্তি ও দলীয়করণে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে একটি সহযোগী দৈনিক জানিয়েছে, “...আন্দোলন যারা শুরু করেছিলেন তারা জানিয়েছেন, ডা. ইমরান এইচ সরকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা; বর্তমানে তিনি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদেরও নেতা। এছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের মিডিয়া সেলের ‘সরাসরি কর্মী’। দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য প্রথমে যৌথ নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালনা করার কথা থাকলেও সরকারদলীয় প্রভাবে তা করা যায়নি। আন্দোলনের কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ তো করেইনি, বরং তারা আদালতের ওপর বিষয়টি ছেড়ে দিয়ে সুবিধা আদায় করতে চাইছে।” ওই প্রতিবেদনে ২১শে ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশের চিত্র তুলে ধরা হয় এভাবে, “...ওই সমাবেশেই মূলত মঞ্চের দলীয়করণ স্পষ্ট হয়। এদিন জাগরণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডা. ইমরান এইচ সরকার যখন কর্মসূচি পড়ছিলেন, তখন তার বাঁ পাশে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, তার পাশে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফ। ডা. ইমরানের ডান পাশে ছিলেন চলচ্চিত্রকার ও আওয়ামীপন্থি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। এদিন বামপন্থি ছাত্রনেতাদের মঞ্চের পেছনে রাখা হয়েছিল, দেখা যায়নি আন্দোলনের শুরুতে যারা ছিলেন তাদের কাউকে। ওইদিন ডা. ইমরান তিন পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পাঠ করছিলেন, তখন পাশ থেকে বেশ জোরে জোরে নাজমুল নির্দেশ দিচ্ছিলেন তাকে। এমনকি ‘একটু আবেগ দিয়ে কর্মসূচি পড়ার জন্য ডা. ইমরান এইচ সরকারকে নির্দেশ দেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল। ...রায়েরবাজার বধ্যভূমি, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাহাদুর শাহ পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চট্টগ্রাম, আশুলিয়ায় যেখানেই জাগরণ মঞ্চ সমাবেশ করেছে, সেখানেই আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের প্রকট উপস্থিতি দেখা গেছে।” প্রতিবেদনটিতে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনও একইভাবে দলীয়করণের শিকার হওয়ায় অসমাপ্ত রয়ে যায়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দলীয়করণের বৃত্ত থেকে গণজাগরণ মঞ্চ বেরোতে না পারলে তৈরি হবে আরও বড় কোনও হতাশার ইতিহাস। উল্লেখ করা যায়, সে বারের আন্দোলনের নিট ফল হয়েছিল জামায়াত নেতা গোলাম আযমের নাগরিকত্ব লাভ। এবার কি হবে তা নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ এরই মধ্যে ছড়াতে শুরু করেছে ব্লগ, অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে। একজন সুপরিচিত অ্যাকটিভিস্ট ১৯শে মার্চ লিখেছেন, “শাহবাগ এখন বিপ্লব-সম্ভাবনার বিরানভূমি। প্রথমত, এ দেশের অনূর্ধ্ব-৪০ এখানে এসে আত্মঘাতী হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অনূর্ধ্ব-২০কে এখানে এনে কিল্‌ করা হয়েছে।...”
এসবই কি নষ্ট রাজনীতির খেলা? জাগরণ মঞ্চ কি এ খেলার শিকার?
সামনে নির্বাচন। বিএনপি হয়তো যাবে না, কিন্তু তাই বলে বাদ যাবে না খেলা। এ খেলা হলো, নির্বাচনের আগেই এক পক্ষকে সাইজ করে ফেলা। ওই সাইজ করা না গেলে বাদ দিতে হয় নির্বাচনে জয়ের আশা। সে খেলা একটু আগেভাগেই শুরু হয়েছে এবার। আর সে খেলার টানাহেঁচড়াতেই কি আটকে গেছে জাগরণ মঞ্চ?
নির্বাচন প্রতিবেশী ভারতেও। সেখানেও নির্বাচনের আগে নানা খেলা চলে, আর সে খেলা শুরু হয়েও গেছে। এর মধ্যেই সে খেলা শুরু করে দিয়েছে এবারকার নির্বাচনী দৌড়ে অনেকখানি এগিয়ে থাকা ভারতীয় জনতা পার্টি। তাদের খেলা সংখ্যালঘু ও বাংলাদেশ নিয়ে। বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশী বলে অমানবিক পুশব্যাকের পাঁয়তারা শুরু করেছে তারা, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ইস্যুতে বাংলাদেশমুখী লংমার্চের কর্মসূচিও নিয়েছে হাতে। তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি ও ছিটমহল বিনিময়ের বিরুদ্ধে তো জোরেশোরে মাঠেই নেমে পড়েছে। এছাড়া ভারত হয়তো ভুলে গেছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করেছে তারাই।
সময় তাই নষ্ট। আর এ নষ্ট সময়ের নষ্ট রাজনীতির অনেক কিছু যুক্ত হয়ে চলেছে জাগরণ আন্দোলনের সঙ্গে। ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’ থেকে ‘জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করো’ পর্যন্ত অনেক ইস্যু ঘটিয়েছে বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি। অহিংস আন্দোলন হলেও সহিংস ভাষা বর্ষিত হয়েছে অকাতরে। ব্যক্তি থেকে দল, প্রতিষ্ঠান, শেষে ভিন্নমতের সবাই হয়েছেন আক্রান্ত। ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা হাসপাতাল, রেটিনা, নয়া দিগন্ত, দিগন্ত টিভি, আমার দেশ, মুহাম্মদ ইউনূস, মাহমুদুর রহমান, কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, ফরহাদ মজহার, পিয়াস করিম, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, এবং আরও অনেকে হয়েছেন আক্রমণের শিকার। তারপর এসেছে নাস্তিক-মুরতাদ ইস্যু। এ ইস্যুতে আক্রান্ত হয়েছেন সাধারণ মুসল্লিরা, ইসলামি সংস্কৃতির ধারক-বাহকরা। তাদের লক্ষ্য করে বিকৃত ভাষা ছড়িয়ে সমাজদূষণ করা হয়েছে সাইবার যুদ্ধের নামে। এ ইস্যুতেই এখন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে হেফাজত ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামি দল। এর মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলেছে জামায়াত-শিবিরের মারমুখো আন্দোলন, সন্ত্রাস-সহিংসতা এবং এর বিপরীতে পুলিশি দমন নির্যাতন নৃশংসতা। প্রকাশ্য ও গোপন হত্যার শিকার হয়েছে দু’শতাধিক রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ নর-নারী-শিশু, পুলিশ। রাজপথ আজ রক্তাক্ত, ঘরে ঘরে শঙ্কা। সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার ইস্যু। হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি মন্দির হয়েছে হামলার শিকার। মসজিদে তালা পড়েছে, অবমানিত হয়েছে শহীদ মিনার, জাতীয় পতাকা। ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রদায়িক ধূম্রজালের। নানা জটিল ঘূর্ণি দেশের বাইরেও। জাগরণ মঞ্চের সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টতার খবর ভারতীয় গণমাধ্যমই দিয়েছে, সে সংহতি ও একাত্মতা এখন প্রকাশ্যেই স্পষ্ট। ওদিকে আন্তর্জাতিক সমাজে পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিশ্লেষণ দিলেও ‘ফাঁসি চাই, জবাই করো’ সমর্থন করেনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার দাবি যেখানে প্রবল হয়ে উঠেছে সেখানে অমন স্লোগান অস্বীকার করে আদালত ও বিচারব্যবস্থার যথার্থতাকেই। তারপর এ আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা দাবি রাখে বিশদ ব্যাখ্যার। স্বাধীন দেশে কি মুক্তিযুদ্ধ সংগত? আরও আছে। একটি প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্র, দু’টি বড় হাসপাতাল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান অবরোধ করে এমন ভয়াবহ জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা কেন? নিরাপত্তা-প্রহরা, অঢেল খাদ্য, সাংস্কৃতিক বিনোদন ও অন্যান্য উপযোগিতা সেবা নিয়ে এ কেমন আন্দোলন? শিশুদের কেন উদ্বুদ্ধকরণ জিঘাংসায়? শেয়ারবাজার, ব্যাংক, বিদ্যুৎ, পদ্মা সেতু, বাজার সিন্ডিকেটসহ বিধ্বংসী দুর্নীতির ব্যাপারে চোখ-কান বুজে থাকা কেন?
আসলে এক নষ্ট সময়ের নানা দায় ও বোঝা ঘাড়ে চেপে বসেছে জাগরণ আন্দোলনের। তাই বলে কি ফের রুদ্ধ হয়ে পড়বে জাতির আত্মার এ উন্মোচন? বিভ্রান্তিতে ঘুরপাক খাবে ভুল পথে-পথে?
না।
কোনও আন্দোলনই বৃথা যায়নি কোনও দিন। শাহবাগ চত্বরের জাগরণ আন্দোলন আসলে শুরু করে দিয়েছে এক বৃহৎ জাতীয় আন্দোলনের প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আর এড়াতে পারবে না কেউ। একাত্তরের ও গত বিয়াল্লিশ বছরের সকল অপরাধ আসবে বিচারের আওতায়। আর সরকার যখনই কোন জনবিরোধী খেলায় নামবে তখনই গড়ে উঠবে জাতির গর্জনে মুখরিত জাগরণ মঞ্চ।
একটিই সমস্যা।
জাতি আজ বিভাজিত। দু’পক্ষই মরিয়া। এ বিভাজনকে এবার তীক্ষ্ণ তীব্র করেছে জাগরণ মঞ্চ, তবে একদিন এ মঞ্চই হয়তো শান্তি, সত্য, সমঝোতায় বাঁধবে দুই বৈরী পক্ষকে। সেদিনই প্রকৃত জয় হবে জাগ্রত তারুণ্যের। তারাই বলবে শেষ কথা। তারাই বলুক।

No comments

Powered by Blogger.