বিদেশি বৃক্ষ বনাম আমাদের দেশপ্রেম by মোকারম হোসেন

বন বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের বলছি, বিদেশি বৃক্ষের প্রতি কেন আপনাদের এত পক্ষপাত? কেন সারা দেশে বিদেশি গাছের এত ছড়াছড়ি? আমরা বরাবর বলতে চেয়েছি, এখানকার বন-পাহাড়ে ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া কিংবা মেহগনির চেয়ে অনেক মূল্যবান বৃক্ষ পাওয়া যায়। সেগুলোর বীজ ও চারা কেন সহজলভ্য নয়? অথচ আমাদের এই গাছগুলো এখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে, তা ছাড়া এসব গাছের চারা তৈরি করাও সহজ। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গাছ হচ্ছে—চাপালিশ (চম্বল), গামারি, বিভিন্ন জাতের কড়ই, জাম, স্বর্ণচাঁপা, গর্জন, তেলশুর ইত্যাদি। কিন্তু নার্সারিগুলোতে এসব গাছের চারা সহজলভ্য নয়—সহজে পাওয়া যায় ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া, মেহগনির চারা। বন বিভাগ বা বন গবেষণাকেন্দ্র কি এ প্রসঙ্গে কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারবে? কেন বিদেশি গাছের প্রতি এত আসক্তি? কেন দেশি গাছগুলো উপেক্ষিত। মহানগর থেকে শুরু করে একটি প্রান্তিক নার্সারি পর্যন্ত সর্বত্রই বিদেশি গাছের চারা সহজলভ্য। আমরা যতই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছি, বিদেশি গাছ নয়, দেশি গাছগুলো নিয়ে গবেষণা করুন, উন্নত জাতের গাছ তৈরি করুন, দেশের উদ্ভিদ প্রজাতি বাঁচিয়ে রাখুন। কিন্তু সেসব শোনার যেন কেউ নেই। একটি খবর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে গাছের জন্য বিনিয়োগে আকৃষ্ট করছে। আর সেই গাছ বা বীজ নাকি সরাসরি আফ্রিকা থেকে আমদানি করা হচ্ছে। আরও দুঃসংবাদ হচ্ছে, আমদানি করা গাছগুলো রোপণ করা হবে বন্দোবস্ত নেওয়া পাহাড়ি জমিতে। এমনিতেই পাহাড়গুলো ন্যাড়া হয়ে পড়েছে। কে এই আগ্রাসন ঠেকাবে!
যেখানে দীর্ঘ ৩০ থেকে ৪০ বছরে আমদানি করা জঞ্জালগুলো সরানোর কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে আবার নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে। দেশে অনুমতি ব্যতিরেকে এক টুকরো ঘাসও আমদানি নিষিদ্ধ। তাহলে এত দিন ধরে এসব আগ্রাসী প্রজাতি দেশে এল কীভাবে? যাঁরা এনেছেন, তাঁরা নিশ্চয় অপরাধ করেছেন। এসব আত্মঘাতী ও হঠকারী কর্মকাণ্ডের কারণেই সারা দেশের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। কোনো অবস্থায়ই চাষাবাদ বা বৃক্ষ রোপণের জন্য আর কোনো নতুন জাতের গাছ আমদানি করা যাবে না। প্রয়োজনে স্থানীয় গাছগুলোকে উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
শুরু হয়েছে জাতীয় বৃক্ষমেলা। দেখতে ভালোই লাগে, মানুষ নিত্যদিনের সওদাপাতির মতো দু-একটি গাছও কিনে নিয়ে যাচ্ছে। শহর ও গ্রাম সর্বত্রই এমন দৃশ্য দেখা যায়। আজকাল মানুষ বৃক্ষ-দরদিও হয়ে উঠছে। অনেকেই ছাদ কিংবা বাড়ির এক টুকরো স্থানে বাগান করার কথা ভাবছে। বৃক্ষ নিধন কিংবা বন উজাড়ের খবর পেলে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু শহর কিংবা গ্রামের একজন অনভিজ্ঞ সাধারণ মানুষ কি জানেন, তিনি শখ করে বৃক্ষমেলা থেকে যে চারাটি কিনেছেন, তা কীভাবে রোপণ করতে হয় বা তার জন্য কতটুকু জায়গা প্রয়োজন? গাছটি জলসহিষ্ণু কি না, কীভাবে এর পরিচর্যা করতে হবে? সব জায়গায় সব ধরনের গাছ রোপণ করা যায় না। স্থানভেদে গাছের প্রকারভেদও বদলে যেতে পারে। তা ছাড়া ভবিষ্যতের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে বন বিভাগ দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে কিছু যৌথ কর্মসূচি পালন করতে পারে। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে অন্তত ইউনিয়ন পর্যায়ের স্থানীয় মানুষকে কিছু ‘কমন’ গাছ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া যেতে পারে। কাজটি দ্রুত করে ফেলা সম্ভব, তা-ও নয়। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে একবার শুরু করতে পারলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব কিছু নয়। তাহলে প্রত্যেকটি মানুষ যেমন উপকৃত হবে, আমাদের বৃক্ষায়নের কাজটিও একটি নান্দনিক ও বৈষয়িক রূপ পাবে। আজকাল বন বিভাগের মাধ্যমে অনেক দেশি-বিদেশি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এমন একটি দরকারি প্রকল্প হাতে নিলে ক্ষতি কী?

প্রধানমন্ত্রী সমীপে
বিগত দিনগুলোতে বিদেশি প্রজাতির আগ্রাসন এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস নিয়ে অসংখ্যবার লেখালেখি করে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারণা চালিয়েও কোনো ফল হয়নি। সুতরাং নিচের বিষয়গুলোতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আশা করি, আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে আলোচ্য বিষয়েও তিনি যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন। যেসব বিষয়ে সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি তা হচ্ছে—কোনো নার্সারিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার উদ্দেশ্যে যেন বিদেশি গাছ উৎপাদন ও বিপণন করা না হয়। সামাজিক বনায়নের নামে কোনো বিদেশি গাছ চাষ করা যাবে না। বন-পাহাড়ের নিজস্ব গাছ ধ্বংস করে কোনো আগ্রাসী প্রজাতির গাছ লাগানো যাবে না। পাহাড়গুলো অপ্রয়োজনে ভূমিদস্যুদের কাছে বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের উদ্দেশ্যে আর কোনো বিদেশি গাছ আমদানি করা যাবে না। এ ব্যাপারে আইন অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আনতে হবে।
আমরা দেশে একটি পুষ্পোৎসব করতে চাই, আর তা অবশ্যই গ্রীষ্মকালে। কারণ এই মৌসুমে সবচেয়ে উঁচু গাছের দীর্ঘস্থায়ী বর্ণিল ফুলগুলো ফোটে। উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পথের বিন্যাসটা এমন হবে যে প্রথমে একটি কৃষ্ণচূড়া, তারপর সোনালু, সোনালুর পর জারুল—এভাবেই তৈরি করা যায় তিন রঙের সুসজ্জিত বীথি। জারুলের রং উজ্জ্বল বেগুনি, সোনালুর রং হলুদ সোনালি আর কৃষ্ণচূড়ার প্রধান রং টকটকে লাল। জাপানে শুধু চেরি ফুল ফোটার মৌসুমে ওরা প্রতিবছর মস্ত বড় উৎসব করে। তাহলে কেন আমরা বঞ্চিত হচ্ছি এমন একটি নান্দনিক উৎসব থেকে? সরকারিভাবে ঢাকার অদূরে কোনো একটি সড়ক কি পুষ্পোৎসবের জন্য বরাদ্দ করা যায় না? সড়কের মালিকানা কর্তৃপক্ষেরই থাকবে, আমরা শুধু সেখানে পথের দুই পাশে উল্লিখিত গাছগুলো রোপণ করব। আশা করি, আমাদের এই প্রত্যাশা একদিন অবশ্যই পূরণ হবে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
tarupallab@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.