স্বাধীনতা- প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর by বাপ্পু সিদ্দিকী

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং এটিই ছিল তখন বাংলার জনগণের প্রত্যাশা। বলাই বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে ১০ মাসের মধ্যেই একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। যোগাযোগব্যবস্থার পুনঃস্থাপন করে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর থেকে
মাইন অপসারণ করেছিলেন। শরণার্থীদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি নির্যাতিত মা-বোনদের পুনর্বাসন ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সাহায্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে দেশে ফেরত পাঠান, জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী পুনর্গঠন করেন। গণমুখী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কাজ শুরু করেন। ১৪০টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জনের পাশাপাশি তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন বিশ্ব সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ড. ভিক্টর মুজিব সরকারের সাফল্যের একটি বিবরণ দিয়ে বলেন, '১২ মাস ধরে দেশের অর্থনীতির বিরাট উন্নতি ঘটেছিল, খাদ্য পরিস্থিতির ভালো অবস্থা, বৃহত্তর খাদ্য মজুদ, ব্যাপক রপ্তানি ও ঘাটতিবিহীন বাজেটও ছিল।' জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে যখন তিনি জোর কদমে এগিয়ে চলছিলেন ঠিক তখনই চিলির আলেন্দের মতো, ভারতের মহাত্মা গান্ধীর মতো, মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো, প্যাট্রিক লুমুম্বার মতো তাঁকেও হত্যা করা হয়। জনগণের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিতে রচিত হয় এক বিরাট ফারাক। দেশ চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির করালগ্রাসে। শুরু হয়, শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির পুনরুত্থান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা, দমন-পীড়ন ও নির্যাতনে আওয়ামী লীগে নেতৃত্বশূন্যতা সৃষ্টি হলে ১৯৮১ সালে দেশে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ভোট ও ভাতের অধিকার তথা সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনিও পূর্বসূরিদের মতো স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী নীতি গ্রহণ করলে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিলে ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। শুরু হয় সংসদীয় সরকারের পদযাত্রা। ১৯৯১ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে সংসদে বসে। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বিএনপি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। উপনির্বাচনে চরম কারচুপি ও জালিয়াতি হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় প্রহসনের নির্বাচন। জনগণ ভোটারবিহীন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলে ১৯৯৬ সালে ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২১ বছর পর জনগণের রায় পেয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়, কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করা হয়। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, আশ্রয়ণ প্রকল্প, খাস জমি বিতরণ, বিনা মূল্যে দুস্থদের খাদ্য সরবরাহ, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, নারীসমাজের ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী, বিডিআর-পুলিশ ও আনসারদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, গঙ্গার পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি, পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে জননেত্রী শেখ হাসিনা ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার, ফাও'র সেরেস পদক লাভ করেন। এত সব অর্জন সত্ত্বেও ২০০১-এর নির্বাচনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ। এর পরের ইতিহাস শুধুই হতাশা, বঞ্চনা, নির্যাতন, হত্যা, দুর্নীতি আর ষড়যন্ত্রের। প্রাপ্তি বলতে সংখ্যালঘু হত্যা, দুর্নীতি চ্যাম্পিয়ন, জঙ্গি উত্থান, গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্বারের মতো জঘন্য ঘৃণ্য মামলাগুলো সরকারি প্রচেষ্টায় ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়। অধিকন্তু এ দেশের জনগণ পেয়েছে ইয়াজউদ্দিনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এম এ আজিজের নেতৃত্বে গঠিত মোসাহেব মার্কা নির্বাচন কমিশন আর রাজপুত্রের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয় হাওয়া ভবন। পরিণতিতে প্রাপ্তি ১/১১ এবং দুই বছরের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে জোট আমলের সব অপরাধের বিচার না হলেও অনেক অপরাধী সাজা পেয়েছিল, আবার অনেকে মিথ্যা মামলায় হয়রানিও হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বড় যে কাজটি তারা করতে পেরেছিল তা হলো, ভুয়া ভোটার বাদ দিয়ে একটি ছবিযুক্ত প্রায় নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি করে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই নির্বাচনকে যে যেভাবেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করুন না কেন, নির্বাচনটি যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছিল, তা প্রায় সব দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকই মনে করেন। দিনবদলের হাওয়ায় নৌকার পালে বিস্তর হাওয়া লেগেছিল এবং মহাজোট ২৬৩ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
'৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর থেকে অদ্যাবধি ৩৯ বছরের মধ্যে ২৯ বছর দেশ শাসন করেছে বিএনপি ও সেনা শাসকরা। আওয়ামী লীগের শাসনামল ছিল বর্তমানের দুই বছরসহ সর্বসাকল্যে ১০ বছর।
বর্তমান সরকারের জন্য আজ বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি এবং এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। জনগণ এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রত্যাশা করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। অনেক ঝানু রাজনীতিবিদকে সাইড লাইনে বসিয়ে যে চমকপ্রদ মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রী গঠন করেছেন, সেখানে বেশ কয়েক মন্ত্রী ইতিমধ্যে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম উল্লেখযোগ্য। আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এমআইটিতে তথ্য-উপাত্তসহ যখন পজিটিভ বাংলাদেশকে তুলে ধরেন তখন প্রতিক্রিয়াশীলদের মাথা ঠিক থাকে না। বিদেশে দিন দিন বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল ঘটাতে চাইলে বিরোধী দলকে ব্যক্তিস্বার্থে সংকীর্ণ দলীয় ও গোষ্ঠীপ্রীতি পরিহার করে সংসদে গিয়ে কথা বলতে হবে গঠনমূলক ও বাস্তবোচিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তাদের বুঝতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা, ব্যক্তিসম্পত্তি রক্ষার প্রচেষ্টা বা বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার ব্যাপারে কূট-তর্ক তাদের নিজেদের রাজনীতির জন্যই দুর্ভাগ্যজনক হবে। মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে মানুষকে বারবার ধোঁকা দেওয়া যায় না। তাই আসুন, সবাই সম্মিলিতভাবে সচেতন হয়ে আমাদের কাজকর্মে, আচার-আচরণে জনকল্যাণের জন্য গণতন্ত্রের চর্চা করি, গণতন্ত্রকে সুসংহত করে, জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হই। তবেই এই দুর্ভাগা দেশের অভাগা জাতি তার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবমান হবে আর আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তিযোগ ঘটবে।
=======================
স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন  এরশাদের বিচার হওয়া উচিত  ছোটদের বড় সাফল্য  প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাঃ পাস ৯২%, প্রথম বিভাগ বেশি  বাংলাদেশের বন্ধুঃ জুলিয়ান ফ্রান্সিস  নিষ্ফল উদ্ধার অভিযানঃ দখলচক্রে ২৭ খাল  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ভ টিজিং : জরুরি ভিত্তিতে যা করণীয়  প্রতিশ্রুতির দিন  শোকের মাস, বিজয়ের মাস  চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাক-ভারত সফর  দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন মন্তব্য  নতুন প্রজন্ম ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা  খিলক্ষেতে আগুনঃ কয়েলের গুদামে রাতে কাজ হতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে  ভারতে বিহার রাজ্যের নির্বাচন  স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ বাপ্পু সিদ্দিকী
শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.