ভুল পথে ক্ষুদ্রঋণ by মুহাম্মদ ইউনূস
১৯৭০-এর দশকে আমি যখন এখানে কাজ শরু করি, যা শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বলে পরিচিতি লাভ করে, তখন আমার একটি লক্ষ্য ছিল সুদখোর মহাজনি প্রথা বিলোপ করা। কর্জদাতা মহাজনেরা ছিল একেকটা হাঙরের মতো, গরিব মানুষকে ঋণের জালে আটক করে খেয়ে ফেলে তারা ধনী হতো। ১৯৮৩ সালে আমি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলাম গরিব মানুষকে, বিশেষত দরিদ্র নারীদের স্বল্প অঙ্কের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে, যাঁরা ওই ঋণের অর্থ কাজে লাগিয়ে নিজেদের দারিদ্র্য ঘোচাতে পারবেন। সে সময় আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে ভবিষ্যতে কখনো আমাদের ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থায়ও নিজস্ব ধরনের ঋণদাতা হাঙরদের সৃষ্টি হতে পারে।
কিন্তু তা হয়েছে। এবং এ কারণে ভারতে অনেক গরিব মানুষ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তা শোধ করতে পারছে না, আর এতে ক্ষুদ্র ঋণদাতাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে এ সমস্যা থেকে পরিষ্কারভাবে এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সমস্যার শুরু হয় ২০০৫ সালের দিকে, যখন অনেক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থাকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে লাভজনক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের উপায় খুঁজতে শুরু করে। ২০০৭ সালে ‘কমপারতামোস’ নামের মেক্সিকান একটি ব্যাংক লাতিন আমেরিকার প্রথম ক্ষুদ্রঋণদাতা ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর গত বছরের আগস্ট মাসে ভারতের বৃহত্তম ক্ষুদ্রঋণদাতা ব্যাংক ‘এসকেএস মাইক্রোফিন্যান্স’ তাদের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (পাবলিক অফারিং) মাধ্যমে ৩৫ কোটি ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলেছে।
ক্ষুদ্রঋণকে তার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লাভজনক করতে এ ধরনের ব্যাংকগুলোকে সুদের হার বাড়াতে হয়, প্রবল মার্কেটিং তৎপরতা চালাতে হয় এবং ঋণ সংগ্রহে অত্যন্ত তৎপর হতে হয়। ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন অলাভজনক ছিল, তখন ঋণগ্রহীতাদের প্রতি তাদের যে এক ধরনের সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, এই প্রক্রিয়ায় তা হারিয়ে যায়। ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে যেসব মানুষের উপকার করার কথা ছিল, এভাবে তাঁরা উল্টো ক্ষতিগস্ত হতে শুরু করেন। তাই ভারতে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের মনে হতে থাকে যে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের ওপর সুযোগ নিচ্ছে; ফলে তাঁরা ঋণ পরিশোধ করা বন্ধ করে দেন।
বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা এক ভয়ংকর দিকে মোড় নিয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে গরিব মানুষকে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক উদ্বেগজনক লক্ষ্যচুতির ইঙ্গিত স্পষ্ট হচ্ছে। দারিদ্র্য দূর করতে হবে, দারিদ্র্যকে টাকা বানানোর সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত নয়। ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থাকে যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণ মুনাফা অর্জনের একটি ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে কিছু গুরুতর প্রায়োগিক সমস্যা আছে। বাংলাদেশ যেমনটি করেছে, ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ ধার দেওয়ার জন্য বড় তহবিল সৃষ্টি করার পরিবর্তে ওই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থ তুলে থাকে এবং তারপর আর্থিক ঝুঁকিগুলো পরিব মানুষের মধ্যে সঞ্চালন করে। উপরন্তু এর অর্থ দাঁড়ায়, বাণিজ্যিক ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত আরও বেশি পরিমাণে মুনাফা অর্জন করতে চায়। আর সেটা হতে পারে গরিব মানুষের কাছ থেকে আরও উচ্চহারে সুদ আদায় করার মধ্য দিয়ে। এভাবে আসলে ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার মূল্য উদ্দেশ্যই বিফলে যায়।
ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণের সমর্থকদের কেউ কেউ বলেন, ক্ষুদ্রঋণকে সহজলভ্য করার পরিধি বাড়নোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের এবং ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থাকে দাতাদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনার এটাই একমাত্র উপায়। কিন্তু দাতাদের দান বা আন্তর্জাতিক অর্থবাজারের ওপর নির্ভর না করেই ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থায় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, এমনকি মুনাফা করাও সম্ভব।
বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা রয়েছে আড়াই হাজার; আমি এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মাসে ১০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ ঋণ দেওয়া হয় এ প্রতিষ্ঠান থেকে। ‘সংগ্রামী সদস্য’ কর্মসূচির আওতায় ভিক্ষুকদের জন্য ৭০০ টাকা (১০ মার্কিন ডলার) থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ৭০ হাজার টাকা (এক হাজার মার্কিন ডলার) পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। আমাদের অধিকাংশ শাখাই আর্থিকভাবে স্বনির্ভর; তাদের নির্ভরতা শুধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের ওপর। যখন কোনো ঋণগ্রহীতা গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তিনি একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। এই ব্যাংকের সব গ্রহীতারই সঞ্চয়ী হিসাব আছে। তাঁদের অনেকেরই ব্যালান্স তাঁদের নেওয়া ঋণের পরিমাণের চেয়ে বেশি। এবং প্রতিবছর গ্রামীণ ব্যাংকের অর্জিত মুনাফা লভ্যাংশ হিসেবে আবার ওই ঋণগ্রহীতাদের কাছেই ফিরে যায়, যাঁদের ৯৭ শতাংশই দরিদ্র নারী।
এই মডেল অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুসরণীয় হওয়া উচিত। ক্ষুদ্রঋণের আসল স্বরূপটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, বাণিজ্যিকীকরণ পরিত্যাগ করে গরিবের সেবায় ফিরে যাওয়া প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ সহায়ক হতে পারে। সর্বোচ্চ সুদের হার তহবিলের মূল্যের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয়। অর্থাৎ ব্যাংক যে অর্থ ঋণ দেবে, তা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়ায় যে খরচ হয়, তার সঙ্গে তহবিলের ১৫ শতাংশ। এই ১৫ শতাংশ ব্যয় হয় কর্মসূচি পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং তা মুনাফা অর্জনে সহায়ক হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে তহবিল ব্যয় ১০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদের হার হতে পারত ২৫ শতাংশ। কিন্তু আমরা আমাদের ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ২০ শতাংশ নিই। আসলে তহবিল ব্যয় ও ঋণের হারের মধ্যকার পার্থক্য ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেই ভালো হয়।
এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর করতে বিশ্বের যেসব দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত। বাংলাদেশে প্রতি বর্গমাইলে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতার সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, এখানে কয়েক বছর ধরে তেমন একটি কর্তৃপক্ষ আছে। এই কর্তৃপক্ষ ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে এবং অত্যধিক সুদের হার ও সুদ আদায়ের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি প্রতিহত করেছে। এই কর্তৃপক্ষ ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দিতে পারে। এ ধরনের একটি সংস্থা অত্যন্ত প্রয়োজন ভারতে, যেখানে ক্ষুদ্রঋণ খাত দ্রুত বাড়ছে।
অসহায় ও দুর্বলের ওপর সুযোগ নিতে চায়, এমন মানুষ সব কালেই থাকে। কিন্তু যেসব ঋণ কর্মসূচি গরিব মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে পুঁজি করে মুনাফা করতে চায়, সেগুলোকে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ বলে বর্ণনা করা উচিত নয়। আর যেসব বিনিয়োগকারীর এ রকম কর্মসূচি আছে, তারা যেন ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকগুলোর সংগতভাবে অর্জিত আস্থার সুযোগ নিয়ে লাভবান হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এ ধরনের অনিয়ম, অনাচার প্রতিরোধ করার দায়িত্ব সরকারগুলোর। ১৯৯৭ সালে সে সময়ের মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিন্টন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যান্য নেতার সঙ্গে মিলিত হয়ে অঙ্গীকার করেছিলেন যে ২০০৫ সালের মধ্যে ১০ কোটি গরিব মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য আর্থিক সেবার ব্যবস্থা করবেন। সে সময় মনে হয়েছিল, এটা একেবারেই অসম্ভব একটা কাজ। কিন্তু ২০০৬ সালের মধ্যে আমরা তা করতে সক্ষম হয়েছি। ক্ষুদ্রঋণ কর্মকাণ্ডকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে বিশ্বনেতাদের আবারও ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
মুহাম্মদ ইউনূস: শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গ্রামীণ ব্যাংক।
কিন্তু তা হয়েছে। এবং এ কারণে ভারতে অনেক গরিব মানুষ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তা শোধ করতে পারছে না, আর এতে ক্ষুদ্র ঋণদাতাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে এ সমস্যা থেকে পরিষ্কারভাবে এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সমস্যার শুরু হয় ২০০৫ সালের দিকে, যখন অনেক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থাকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে লাভজনক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের উপায় খুঁজতে শুরু করে। ২০০৭ সালে ‘কমপারতামোস’ নামের মেক্সিকান একটি ব্যাংক লাতিন আমেরিকার প্রথম ক্ষুদ্রঋণদাতা ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর গত বছরের আগস্ট মাসে ভারতের বৃহত্তম ক্ষুদ্রঋণদাতা ব্যাংক ‘এসকেএস মাইক্রোফিন্যান্স’ তাদের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (পাবলিক অফারিং) মাধ্যমে ৩৫ কোটি ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলেছে।
ক্ষুদ্রঋণকে তার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লাভজনক করতে এ ধরনের ব্যাংকগুলোকে সুদের হার বাড়াতে হয়, প্রবল মার্কেটিং তৎপরতা চালাতে হয় এবং ঋণ সংগ্রহে অত্যন্ত তৎপর হতে হয়। ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন অলাভজনক ছিল, তখন ঋণগ্রহীতাদের প্রতি তাদের যে এক ধরনের সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, এই প্রক্রিয়ায় তা হারিয়ে যায়। ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে যেসব মানুষের উপকার করার কথা ছিল, এভাবে তাঁরা উল্টো ক্ষতিগস্ত হতে শুরু করেন। তাই ভারতে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের মনে হতে থাকে যে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের ওপর সুযোগ নিচ্ছে; ফলে তাঁরা ঋণ পরিশোধ করা বন্ধ করে দেন।
বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থা এক ভয়ংকর দিকে মোড় নিয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে গরিব মানুষকে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক উদ্বেগজনক লক্ষ্যচুতির ইঙ্গিত স্পষ্ট হচ্ছে। দারিদ্র্য দূর করতে হবে, দারিদ্র্যকে টাকা বানানোর সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত নয়। ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থাকে যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণ মুনাফা অর্জনের একটি ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে কিছু গুরুতর প্রায়োগিক সমস্যা আছে। বাংলাদেশ যেমনটি করেছে, ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ ধার দেওয়ার জন্য বড় তহবিল সৃষ্টি করার পরিবর্তে ওই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো অস্থিতিশীল আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থ তুলে থাকে এবং তারপর আর্থিক ঝুঁকিগুলো পরিব মানুষের মধ্যে সঞ্চালন করে। উপরন্তু এর অর্থ দাঁড়ায়, বাণিজ্যিক ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত আরও বেশি পরিমাণে মুনাফা অর্জন করতে চায়। আর সেটা হতে পারে গরিব মানুষের কাছ থেকে আরও উচ্চহারে সুদ আদায় করার মধ্য দিয়ে। এভাবে আসলে ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার মূল্য উদ্দেশ্যই বিফলে যায়।
ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণের সমর্থকদের কেউ কেউ বলেন, ক্ষুদ্রঋণকে সহজলভ্য করার পরিধি বাড়নোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের এবং ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থাকে দাতাদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনার এটাই একমাত্র উপায়। কিন্তু দাতাদের দান বা আন্তর্জাতিক অর্থবাজারের ওপর নির্ভর না করেই ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থায় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, এমনকি মুনাফা করাও সম্ভব।
বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা রয়েছে আড়াই হাজার; আমি এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মাসে ১০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ ঋণ দেওয়া হয় এ প্রতিষ্ঠান থেকে। ‘সংগ্রামী সদস্য’ কর্মসূচির আওতায় ভিক্ষুকদের জন্য ৭০০ টাকা (১০ মার্কিন ডলার) থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ৭০ হাজার টাকা (এক হাজার মার্কিন ডলার) পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। আমাদের অধিকাংশ শাখাই আর্থিকভাবে স্বনির্ভর; তাদের নির্ভরতা শুধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের ওপর। যখন কোনো ঋণগ্রহীতা গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তিনি একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। এই ব্যাংকের সব গ্রহীতারই সঞ্চয়ী হিসাব আছে। তাঁদের অনেকেরই ব্যালান্স তাঁদের নেওয়া ঋণের পরিমাণের চেয়ে বেশি। এবং প্রতিবছর গ্রামীণ ব্যাংকের অর্জিত মুনাফা লভ্যাংশ হিসেবে আবার ওই ঋণগ্রহীতাদের কাছেই ফিরে যায়, যাঁদের ৯৭ শতাংশই দরিদ্র নারী।
এই মডেল অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুসরণীয় হওয়া উচিত। ক্ষুদ্রঋণের আসল স্বরূপটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, বাণিজ্যিকীকরণ পরিত্যাগ করে গরিবের সেবায় ফিরে যাওয়া প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ সহায়ক হতে পারে। সর্বোচ্চ সুদের হার তহবিলের মূল্যের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয়। অর্থাৎ ব্যাংক যে অর্থ ঋণ দেবে, তা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়ায় যে খরচ হয়, তার সঙ্গে তহবিলের ১৫ শতাংশ। এই ১৫ শতাংশ ব্যয় হয় কর্মসূচি পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং তা মুনাফা অর্জনে সহায়ক হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে তহবিল ব্যয় ১০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদের হার হতে পারত ২৫ শতাংশ। কিন্তু আমরা আমাদের ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ২০ শতাংশ নিই। আসলে তহবিল ব্যয় ও ঋণের হারের মধ্যকার পার্থক্য ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেই ভালো হয়।
এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর করতে বিশ্বের যেসব দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত। বাংলাদেশে প্রতি বর্গমাইলে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতার সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, এখানে কয়েক বছর ধরে তেমন একটি কর্তৃপক্ষ আছে। এই কর্তৃপক্ষ ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে এবং অত্যধিক সুদের হার ও সুদ আদায়ের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি প্রতিহত করেছে। এই কর্তৃপক্ষ ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দিতে পারে। এ ধরনের একটি সংস্থা অত্যন্ত প্রয়োজন ভারতে, যেখানে ক্ষুদ্রঋণ খাত দ্রুত বাড়ছে।
অসহায় ও দুর্বলের ওপর সুযোগ নিতে চায়, এমন মানুষ সব কালেই থাকে। কিন্তু যেসব ঋণ কর্মসূচি গরিব মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে পুঁজি করে মুনাফা করতে চায়, সেগুলোকে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ বলে বর্ণনা করা উচিত নয়। আর যেসব বিনিয়োগকারীর এ রকম কর্মসূচি আছে, তারা যেন ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকগুলোর সংগতভাবে অর্জিত আস্থার সুযোগ নিয়ে লাভবান হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এ ধরনের অনিয়ম, অনাচার প্রতিরোধ করার দায়িত্ব সরকারগুলোর। ১৯৯৭ সালে সে সময়ের মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিন্টন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যান্য নেতার সঙ্গে মিলিত হয়ে অঙ্গীকার করেছিলেন যে ২০০৫ সালের মধ্যে ১০ কোটি গরিব মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য আর্থিক সেবার ব্যবস্থা করবেন। সে সময় মনে হয়েছিল, এটা একেবারেই অসম্ভব একটা কাজ। কিন্তু ২০০৬ সালের মধ্যে আমরা তা করতে সক্ষম হয়েছি। ক্ষুদ্রঋণ কর্মকাণ্ডকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে বিশ্বনেতাদের আবারও ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
মুহাম্মদ ইউনূস: শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গ্রামীণ ব্যাংক।
No comments