সাহিত্যালোচনা- পুস্তক সম্পাদনা ও আমাদের প্রকাশনা জগৎ by রাখাল রাহা
প্রকাশনা জগতে অন্তত দুই দশক বিচরণ করে যে জিনিসটা বোঝা গেছে, তা হচ্ছে আমাদের প্রকাশকদের বেশির ভাগ কোনো সম্পাদক নেই; সম্পাদনা কী ও কেন, সম্পাদনার পরিধি কত দূর বিস্তৃত_এ বিষয়ে প্রায় কারোরই কোনো ধারণা নেই। যে দু-একজনের এ বিষয়ে ধারণা আছে, তাঁরা সেটা না নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, না বাইরে ছড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
সে কারণে এ দেশের প্রকাশনাক্ষেত্রের বয়সের তুলনায় এর বিষয়গত ও গুণগত মানের প্রায় কোনো উন্নতিই হয়নি। তবে লেখক তাঁর পাণ্ডুলিপি নিয়ে উপস্থিত হলে অনেকেই সদম্ভে বলতে পছন্দ করেন_রেখে যান, আমাদের সম্পাদকমণ্ডলী দেখবেন, তারপর জানাব।
সে কারণে এ দেশের প্রকাশনাক্ষেত্রের বয়সের তুলনায় এর বিষয়গত ও গুণগত মানের প্রায় কোনো উন্নতিই হয়নি। তবে লেখক তাঁর পাণ্ডুলিপি নিয়ে উপস্থিত হলে অনেকেই সদম্ভে বলতে পছন্দ করেন_রেখে যান, আমাদের সম্পাদকমণ্ডলী দেখবেন, তারপর জানাব।
আমাদের মতো অনুন্নত ও অরাজক দেশের প্রকাশনার উন্নয়নকে সামনে রেখে ১৯৬৬ সালে R. R. Bowker কম্পানি New York থেকে Datus C. Smith-এর লেখা ‘A Guide to Book-Publishing’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল Franklin Book Programs, Inc. ওহপ. এবং Ford Foundation-এর আর্থিক সহযোগিতায়। সেই গ্রন্থের Acknowledgments-এ ঢাকার দুজন ব্যক্তির নাম ছিল : আলহাজ এ টি এম আবদুল মতিন এবং এম এ আজম; যাঁরা Franklin Book Programs, Inc.-এর ঢাকা শাখায় কাজ করতেন। তাঁরা বেঁচে আছেন কি না বা কোথায় আছেন তা জানা যায় না।
Smith-এর বইয়ে পাঁচটি অংশ ও ২১টি অধ্যায় রয়েছে। ২১টি অধ্যায়ের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম অনুচ্ছেদটিই আমাদের প্রকাশক, লেখক ও প্রশাসক_যাঁরা প্রকাশনা ও এই ক্ষেত্রের উন্নয়নের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত আছেন, তাঁদের কাজের গুরুত্ব উপলব্ধির জন্য যথেষ্ট। অনুচ্ছেদটি হলো :
'উন্নত-অনুন্নত যেকোনো দেশেই আর্থিক বিচারে প্রকাশনা-শিল্পটি একটি অতিনগণ্য ক্ষেত্র। কিন্তু একটা ক্ষুদ্র সুইচ গতি সঞ্চার করে যেমন একটা বিশালাকায় যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারে অথবা একটা বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা শক্তি পরিবহনের মাধ্যমে যেমন দূর-দূরান্তের সব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; তেমনি হচ্ছে প্রকাশনা ক্ষেত্রে। প্রকাশনা ক্ষেত্রের বাইরের লোক এটা খুব একটা বুঝতে পারে না এবং এটাকে গুরুত্বও দিতে চায় না। সুতরাং যেকোনো দেশের গ্রন্থ উন্নয়নের সামগ্রিক পরিকল্পনার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রকাশনা যে শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের, তথা সত্যিকার অর্থে জাতি গঠনের চাবিকাঠি তা সাধারণ মানুষকে জানানো, না হলেও অন্তত জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিদের নিয়মিত জানান দিয়ে যাওয়া।'
ঢাকার নীলক্ষেতের ফুটপাত থেকে বইটির একটি পোকা-খাওয়া কপি প্রায় বছরদশেক আগে নামমাত্র মূল্যে পাওয়া গিয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে দেখা গেল, প্রকাশনা ও সম্পাদনাবিষয়ক বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা গ্রন্থে সেই বইয়ের রেফারেন্স রয়েছে। আরো জানা গেল যে পরবর্তী পর্যায়ে গ্রন্থটির পরিমার্জিত সংস্করণ ১৯৮৯ সালে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই মূল্যবান গ্রন্থটি এ দেশের গ্রন্থজগতের প্রায় কোনো পরিবর্তন সাধন না করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফিরেছে।
আগে যেটা উল্লেখ করা হলো, লেখকরা নতুন পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলে প্রকাশকরা তাঁর 'সম্পাদকমণ্ডলী'র সিদ্ধান্তের কথা বলেন, এ থেকে স্পষ্ট যে তাঁরা বোঝেন 'সম্পাদক আছেন'_এটা উল্লেখ করার মতো একটি বিষয়। কিন্তু সম্পাদক আসলে কে? একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কয়েক রকমের সম্পাদক থাকতে পারেন। এক হচ্ছে, সংগ্রহ বা উৎসাহ প্রদানকারী সম্পাদক (acquiring or sponsoring editor); দুই হচ্ছে, পাণ্ডুলিপি সম্পাদক (working or manuscript editor); তিন হচ্ছে, কপি-এডিটর (copy editor এবং চার হচ্ছে, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক (managing editor)। আরো এক ধরনের সম্পাদক আছেন, যাঁদের বলা হয় প্রডাকশন এডিটর। প্রথমেই একেবারে কোমর বেঁধে সব এডিটর নিয়ে শুরু করতে হবে তা তো নয়, কারণ স্মিথের বইয়েই রয়েছে_'ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক বড় বড় প্রকাশনা সংস্থারই শুরুটা ছিল সামান্য পুঁজি, ছোট্ট একটা খুপরি ঘর এবং একজন ব্যক্তিকে দিয়ে, যার একমাত্র স্টাফ ছিল ওই ব্যক্তির স্ত্রী।' .
কিন্তু একা একা শুরু করলেও সম্পাদকদের কার কী কাজ এবং সেই কাজের প্রয়োজনটা বোঝা দরকার। সংগ্রহ বা উৎসাহ প্রদানকারী সম্পাদক প্রকাশনা সংস্থার চরিত্র, লক্ষ্য ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বুঝে পাণ্ডুলিপির সন্ধান করবেন এবং যে লেখক এ ধরনের লেখা লিখতে সক্ষম, তাঁকে রাজি করিয়ে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতে সহায়তা করবেন। পাণ্ডুলিপি সম্পাদক প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপি অপরিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ হলে তার উন্নয়নমূলক সম্পাদনা (developmental editing) করবেন; অর্থাৎ যেভাবে পাণ্ডুলিপিকে লেখক পুনর্বিন্যাস, সংযোজন-পরিমার্জন ও প্রয়োজন হলে পুনর্লিখন করতে পারেন; সে বিষয়ে লেখককে সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করবেন। পাণ্ডুলিপি পরিপূর্ণ ও প্রকাশযোগ্য হলে তিনি লেখকের প্রবণতা ও মৌলিকত্ব বুঝে তার ভাষা, স্টাইল, অনুচ্ছেদ-বিভাজন, বিন্যাস, ধারাবাহিকতা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি যথাযথ ও সুসমঞ্জস করে তাঁর উদ্দিষ্ট পাঠকের উপযোগী করবেন, যেটাকে বলা হয় substantive editing। কপি এডিটর পাণ্ডুলিপির বাক্য, ব্যাকরণ, বানান, শৈলী, টেবিল, ছবি, তথ্যসূত্র, উদ্ধৃতি, যতিচিহ্ন ইত্যাদি নির্ভুল ও সুসমঞ্জস করবেন, যেটাকে বলা হয় mechanical editing। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক লেখক, অন্যান্য সম্পাদক, চিত্রশিল্পী, গ্রাফিঙ্ ডিজাইনার, বিক্রয় বিভাগ, অর্থ বিভাগ ও অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে পাণ্ডুলিপিকে দ্রুত বই হওয়ার পথ করে দেবেন।
ফিকশন বা সৃজনশীল বই এবং নন-ফিকশন বা মননশীল বইয়ের ক্ষেত্রে সম্পাদনার মাত্রা অবশ্যই ভিন্ন হবে। তবে সম্পাদনা ছাড়া বই প্রকাশ বিশ্বের নামিদামি প্রকাশনা থেকে প্রায় অসম্ভব ও অকল্পনীয় ব্যাপার।
এ দেশে পুস্তক-সম্পাদক না থাকা এবং প্রকাশক ও লেখকদের অধিকাংশ তা না বোঝা ও বোঝার প্রয়োজন বোধ না করায় অধিকাংশ পাণ্ডুলিপিই, যার উন্নয়নমূলক সম্পাদনা করা প্রয়োজন সেটিও, সরাসরি প্রুফ রিডারের কাছে চলে যায় এবং প্রকাশিত হয়। পাণ্ডুলিপির উন্নয়নমূলক সম্পাদনার পর আসলে সেটি ওয়ার্কিং বা ম্যানুস্ক্রিপ্ট এডিটরের কাছে যায়। প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নমূলক সম্পাদনার কাজ বিশ্বের কোনো নামি প্রকাশক নেন না, ব্যতিক্রম ছাড়া। যে পাণ্ডুলিপির এ ধরনের কাজ করতে হবে, সেটাকে ধরেই নেওয়া হয় তা প্রকাশযোগ্য নয়। প্রকাশের উপযোগী ধরে নেওয়ার অর্থ হলো, এটা ম্যানস্ক্রিপ্ট এডিটরের কাছে যাবে। প্রকৃতপক্ষে প্রকাশনা সংস্থায় ম্যানুস্ক্রিপ্ট এডিটরকেই এডিটর বলা হয়।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এ দেশের অধিকাংশ প্রকাশক ও লেখক প্রুফ রিডিংকেই সম্পাদনা মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে কপি এডিটরের কাজের একটি ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে প্রুফ রিডিং। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার পর প্রুফ রিডার তার বানান ও স্টাইলের একটা প্রমিত রীতি বা প্রকাশকের রীতি অনুসরণ করে তাকে চূড়ান্ত করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিকেও এ দেশের প্রকাশকরা এমন স্তরে নামিয়ে রেখেছেন, যে নূ্যনতম কাণ্ডজ্ঞান ও মেধা থাকলে এই কাজটি মোটামুটি দক্ষভাবে করা সম্ভব; তেমন কোনো ছেলেমেয়ে এতে যুক্ত হচ্ছে না। এ বিষয়ে আমাদের লেখক-প্রকাশকের রয়েছে নিদারুণ উদাসীনতা।
সত্য যে যেসব দেশ প্রকাশনাক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করেছে, সেসব দেশেও সম্পাদনার কথায় ভীত হয়ে ওঠেন এমন লেখকের সংখ্যা কম নয়। তবে প্রকাশক তাঁর প্রকাশনামান, সুনাম ও ব্যবসাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য প্রায় অনমনীয় থাকায় নবীন ও না-জানা লেখকরাও বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে একটা পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করতে করতে লেখকের তাঁর লেখার প্রতি এক ধরনের মোহ বা অন্ধ দৃষ্টি চলে আসে, যখন তিনি তাঁর লেখার কোনো দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা বা অসংগতি ধরতে পারেন না। সব দেশের সব লেখকের ক্ষেত্রেই এটা কম-বেশি সত্য। সে জন্য যেসব দেশ প্রকাশনায় উন্নতি লাভ করেছে, সেসব দেশে লেখকরাই সম্পাদক খুঁজে বেড়ান; অনেক বড় লেখকেরও এক বা একাধিক নির্ধারিত সম্পাদক রয়েছেন। কিন্তু লেখকের দিক থেকে আমাদের দেশে প্রশ্ন_এটা লিখে আমি কয় টাকা পাব যে বাড়তি টাকা খরচ করব? আবার প্রকাশকের দিক থেকে প্রশ্ন_এটা বিক্রি করে আমার খরচ উঠবে তার কী নিশ্চয়তা আছে? কিন্তু একটি সুসম্পাদিত গ্রন্থ যে একজন লেখক ও প্রকাশককে ভবিষ্যতে অনেক বড় অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে, তাঁর আর্থিক অর্জনও বিশাল হতে পারে_এটি বোঝা প্রয়োজন। আর জ্ঞানের জগতের এই উন্নয়ন যেহেতু একটা দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত, সে কারণে রাষ্ট্রের তা বুঝে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
================================
দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ রাখাল রাহা
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ রাখাল রাহা
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
No comments