কেন এবার অগ্রগতি হলো না? by ইফতেখারুজ্জামান
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) তাদের ২০১০-এর দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশ করেছে ২৬ অক্টোবর। সূচকের ০-১০-এর স্কেলে ২০০৯-এর সমান ২.৪ পেয়ে ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১৩৪তম অবস্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। সমান স্কোর পেয়ে সূচকের নিম্নক্রম অনুযায়ী দ্বাদশ স্থান পেয়েছে আরও আটটি দেশ—আজারবাইজান, হন্ডুরাস, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, সিয়েরা লিওন, টোগো, ইউক্রেন ও জিম্বাবুয়ে। গত বছর বাংলাদেশ বেলারুশ, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে একত্র নিম্নক্রম অনুযায়ী ত্রয়োদশ স্থান পেয়েছিল।
ত্রয়োদশ থেকে দ্বাদশ স্থানে নেমে যাওয়া খুব একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নয়, কারণ এই স্থান নির্ধারণের (র্যা ঙ্কিং) ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রাপ্ত স্কোরের পাশাপাশি অন্য দেশের তুলনামূলক অবস্থান এবং তালিকায় কতগুলো দেশ অন্তর্ভুক্ত হলো বা কতগুলো দেশ বাদ পড়ল—এরূপ বিষয়ের প্রভাব পড়ে থাকে।
এই সূচকে মূলত কোন দেশ কত স্কোর পেল, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের এবারের স্কোর গতবারের সমপর্যায়ে থাকাটা নিরাশাব্যঞ্জক এই কারণে যে ২০০৮-এর তুলনায় ২০০৯-এ আমরা ০.৩ পয়েন্ট বেশি পেয়েছিলাম। এক বছরে ০.৩ পয়েন্ট বেশি স্কোর পাওয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিল, এবং সেবার বাংলাদেশ বিশ্বের ১৮০ দেশের মধ্যে মাত্র নয়টি দেশের একটি ছিল, যাদের অর্জনকে এভাবে মূল্যায়িত করা হয়েছিল।
অতএব, সংগত কারণেই প্রত্যাশা ছিল যে অর্জনের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকবে, এবং বাংলাদেশ হয়তো গতবারের তুলনায় অন্তত কিছুটা হলেও বেশি স্কোর পাবে, বিশেষ করে এমন পরিপ্রেক্ষিত্রেযখন দেশে এমন একটি সরকার রয়েছে যাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতিবিরোধী দৃঢ় অবস্থান প্রাধান্য পেয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবে তা হলো না।
দুর্নীতির ধারণাসূচক বা সিপিআই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের একটি তুলনামূলক চিত্র প্রদান করে থাকে। ১৯৯৫ সাল থেকে এই সূচকটি প্রণীত হয়ে আসছে। শুরুর বছর এতে ৪৫টি দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল, আর ২০০৯ সালে এতে সর্বোচ্চ ১৮০টি দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়।
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভুটান, ভারত ও শ্রীলঙ্কা এবারও বাংলাদেশের তুলনায় উন্নততর অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে ভুটানের কথা বলতে হয়, যারা ৫.৭ স্কোর পেয়ে ইতালি (৩.৯), থাইল্যান্ড (৩.৫), চীন (৩), মালয়েশিয়া (৪.৪) এবং দক্ষিণ কোরিয়ার (৫.৪) মতো দেশের চেয়ে ভালো ফল করেছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কা যথাক্রমে ৩.৩ ও ৩.২ স্কোর পেয়েছে। মালদ্বীপ ও পাকিস্তান ২.৩ স্কোর পেয়েছে, আর নেপাল পেয়েছে ২.২। উল্লেখ্য, ভুটান গতবারের ৫.০ স্কোর থেকে ৫.৭ পেয়ে সর্বোচ্চ স্কোর অর্জনকারী দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, আর শ্রীলঙ্কা গতবারের তুলনায় ০.১ বেশি পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ্রঅন্য দেশগুলো ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল ও পাকিস্তান ২০০৯-এর তুলনায় কম স্কোর পেয়েছে। ভুটানের উৎকৃষ্ট অর্জনের পেছনে রয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনমনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনের শাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো জাতীয় সততা ব্যবস্থার মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা।
বাংলাদেশের গত বছরের ইতিবাচক অগ্রগতি আমাদের জন্য সুসংবাদ ছিল। যদিও ৩-এর কম স্কোর প্রাপ্ত দেশ হিসেবে আমাদের দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতার মাপকাঠিতে ্র‘উদ্বেগজনক’ অবস্থানেই থাকতে হয়েছে।
সিপিআই পরপর দুই বছরের তথ্যের একটি চলমান হিসাব এ বছরের সূচকে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১০ পর্যন্ত সময়ের তথ্যের প্রতিফলন ঘটেছে।্রঅতএব, বাংলাদেশের এবারের ফল ২০০৮-৯-এর তুলনায় অগ্রগতিতে ব্যর্থতারই পরিচায়ক।
২০০৯-এর সূচক প্রকাশের সময় আমাদের সেবারের অগ্রগতির পেছনে মূলত তিনটি উপাদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রথমত, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করা ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি যে-ই হোক না কেন বিচারের মুখোমুখি করার প্রয়াস; দ্বিতীয়ত, উল্লিখিত সময়ে দেশে বেশকিছু মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ্রও আইনি পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল; আর তৃতীয়ত, সূচকে নতুন সরকারের দুর্নীতিবিরোধী নির্বাচনী অঙ্গীকারের একটা ইতিবাচক মূল্যায়নের প্রতিফলন ঘটেছিল।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ্রদৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট প্রত্যয় ব্যক্ত হয়। কমপক্ষে ডজন খানেক সুস্পষ্ট নীতিমালার উল্লেখ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে, যার বাস্তবায়ন বাংলাদেশে দুর্নীতিকে কার্যকর ও স্থায়ীভাব্রেনিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য।
সরকার গঠনের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিশ্রুতিগুলো মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে কিছু সম্ভাবনাময় পদক্ষেপও গৃহীত হয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের কতিপয় সংশোধনীর প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিপরিষদ কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠার পথে বড় ধরনের নৈরাশ্যজনক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। টিআইবিসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থগিত রয়েছে, তবে সুরাহা হয়নি, যা উদ্বেগের কারণ।
প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ ক্ষমতাবানদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশের অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি। এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তাঁর অন্য সহকর্মীরা কবে অনুসরণ করবেন—তার কোনো ইঙ্গিত নেই। জাতীয় বাজেটে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট নির্বাচনী অঙ্গীকার থেকে সরে এসে কর ন্যায়পাল পদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার’ নিষ্পত্তিকরণের উদ্যোগও ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এরূপ বিতর্কিত পদক্ষেপের পাশাপাশি তথ্য অধিকার আইনের মতো দুর্নীতি প্রতিরোধে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টিকারী আইনটি সংসদে অনুমোদনের মাধ্যমে সরকার জনগণের প্রতি অঙ্গীকার পূরণের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সম্পূরক অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি নতুন আইন—তথ্য প্রদানকারীর সুরক্ষা আইন সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে, যা উৎসাহব্যঞ্জক।
সরকার সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে নাগরিক সনদ কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হচ্ছে। জাতিসংঘে দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন অনুযায়ী অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে সরকার কৌশলপত্র অনুমোদন করেছে, যা আশার উদ্রেক করে, যদিও এর কার্যকর বাস্তবায়নে বাস্তব পদক্ষেপ এখনো বিরল।
ভূমি দস্যুতা প্রতিরোধে ড্যাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ ও এ-সংক্রান্ত সংসদে গৃহীত নতুন আইন অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। অন্যদিকে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা তাঁদের সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিরা সাম্প্রতিককালে যেভাবে স্থানীয় পর্যায়ে টেন্ডারবাজি, নদী-বনাঞ্চল-ভূমি দখল ও টোলবাজিসহ আইনের শাসনপরিপন্থী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে অপরিহার্য প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়ার আশঙ্কা বেড়েই চলেছে।
সরকারি ক্রয় খাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সাম্প্রতিক সংস্কার, বিশেষ করে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অবমূল্যায়ন, কোনো অবস্থায়ই সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে না। একইভাবে টেলিযোগাযোগ আইন, ২০১০ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) বিল, ২০১০ সংশ্লিষ্ট খাতে ্রস্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে— এরূপ আশা করা কঠিন।
দুর্নীতি, তা যে পর্যায়েই ঘটুক না কেন, কারও প্রতি কোনো প্রকার ভয় বা করুণা না করে, সব ধরনের্রদলীয় বা রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে তার বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে, আইন প্রয়োগে আদালতকে কোনো অবস্থাতেই প্রভাবিত না করা দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে তখনই সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে, যখন বিচার-প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হবে। অন্যদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তখনই সুফল আনবে, যখন এই বিভাগে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, পেশাগত উৎকর্ষ ও সততার সঙ্গে কার্য পরিচালনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা যেকোনো সংসদীয় গণতন্ত্রে দুর্নীতিবিরোধী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। বেশ কিছু কমিটি তুলনামূলক সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় হাত দিয়েছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সংসদীয় কমিটির সদস্যদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমিটির কার্যক্রম ও কার্যকারিতাকে ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে জনপ্রশাসন তথা সরকারি কর্মকর্তারা। পৃথিবীর যেসব দেশে সাফল্যের সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে সেসব দেশে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশাসনকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রণোদনার সমন্বয়নির্ভর সংস্কারের পাশাপাশি নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করা অপরিহার্য। সরকার পরিবর্তনের পর এ ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তাতে উৎসাহিত হওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ব্যক্তি কর্তৃক স্বাস্থ্য খাতে সরকারি পদে শুধু দলীয় সমর্থনপুষ্ট কর্মীদের নিয়োগের ঘোষণা ও পাবনায় নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নৈরাজ্যের দৃষ্টান্ত দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক ভাবা কঠিন।
এতদসত্ত্বেও আমরা আশা ছেড়ে দিতে চাই না। এ বছরের সিপিআই সরকার ও অন্যান্য সব স্টেকহোল্ডারদের জন্য সময়োপযোগী ্রইঙ্গিত এই মর্মে যে, দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা অদূর ভবিষ্যতে ্রআরও নেতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
ত্রয়োদশ থেকে দ্বাদশ স্থানে নেমে যাওয়া খুব একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নয়, কারণ এই স্থান নির্ধারণের (র্যা ঙ্কিং) ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রাপ্ত স্কোরের পাশাপাশি অন্য দেশের তুলনামূলক অবস্থান এবং তালিকায় কতগুলো দেশ অন্তর্ভুক্ত হলো বা কতগুলো দেশ বাদ পড়ল—এরূপ বিষয়ের প্রভাব পড়ে থাকে।
এই সূচকে মূলত কোন দেশ কত স্কোর পেল, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের এবারের স্কোর গতবারের সমপর্যায়ে থাকাটা নিরাশাব্যঞ্জক এই কারণে যে ২০০৮-এর তুলনায় ২০০৯-এ আমরা ০.৩ পয়েন্ট বেশি পেয়েছিলাম। এক বছরে ০.৩ পয়েন্ট বেশি স্কোর পাওয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিল, এবং সেবার বাংলাদেশ বিশ্বের ১৮০ দেশের মধ্যে মাত্র নয়টি দেশের একটি ছিল, যাদের অর্জনকে এভাবে মূল্যায়িত করা হয়েছিল।
অতএব, সংগত কারণেই প্রত্যাশা ছিল যে অর্জনের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকবে, এবং বাংলাদেশ হয়তো গতবারের তুলনায় অন্তত কিছুটা হলেও বেশি স্কোর পাবে, বিশেষ করে এমন পরিপ্রেক্ষিত্রেযখন দেশে এমন একটি সরকার রয়েছে যাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতিবিরোধী দৃঢ় অবস্থান প্রাধান্য পেয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবে তা হলো না।
দুর্নীতির ধারণাসূচক বা সিপিআই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের একটি তুলনামূলক চিত্র প্রদান করে থাকে। ১৯৯৫ সাল থেকে এই সূচকটি প্রণীত হয়ে আসছে। শুরুর বছর এতে ৪৫টি দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল, আর ২০০৯ সালে এতে সর্বোচ্চ ১৮০টি দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়।
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভুটান, ভারত ও শ্রীলঙ্কা এবারও বাংলাদেশের তুলনায় উন্নততর অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে ভুটানের কথা বলতে হয়, যারা ৫.৭ স্কোর পেয়ে ইতালি (৩.৯), থাইল্যান্ড (৩.৫), চীন (৩), মালয়েশিয়া (৪.৪) এবং দক্ষিণ কোরিয়ার (৫.৪) মতো দেশের চেয়ে ভালো ফল করেছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কা যথাক্রমে ৩.৩ ও ৩.২ স্কোর পেয়েছে। মালদ্বীপ ও পাকিস্তান ২.৩ স্কোর পেয়েছে, আর নেপাল পেয়েছে ২.২। উল্লেখ্য, ভুটান গতবারের ৫.০ স্কোর থেকে ৫.৭ পেয়ে সর্বোচ্চ স্কোর অর্জনকারী দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, আর শ্রীলঙ্কা গতবারের তুলনায় ০.১ বেশি পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ্রঅন্য দেশগুলো ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল ও পাকিস্তান ২০০৯-এর তুলনায় কম স্কোর পেয়েছে। ভুটানের উৎকৃষ্ট অর্জনের পেছনে রয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনমনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনের শাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো জাতীয় সততা ব্যবস্থার মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা।
বাংলাদেশের গত বছরের ইতিবাচক অগ্রগতি আমাদের জন্য সুসংবাদ ছিল। যদিও ৩-এর কম স্কোর প্রাপ্ত দেশ হিসেবে আমাদের দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতার মাপকাঠিতে ্র‘উদ্বেগজনক’ অবস্থানেই থাকতে হয়েছে।
সিপিআই পরপর দুই বছরের তথ্যের একটি চলমান হিসাব এ বছরের সূচকে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১০ পর্যন্ত সময়ের তথ্যের প্রতিফলন ঘটেছে।্রঅতএব, বাংলাদেশের এবারের ফল ২০০৮-৯-এর তুলনায় অগ্রগতিতে ব্যর্থতারই পরিচায়ক।
২০০৯-এর সূচক প্রকাশের সময় আমাদের সেবারের অগ্রগতির পেছনে মূলত তিনটি উপাদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রথমত, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করা ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি যে-ই হোক না কেন বিচারের মুখোমুখি করার প্রয়াস; দ্বিতীয়ত, উল্লিখিত সময়ে দেশে বেশকিছু মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ্রও আইনি পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল; আর তৃতীয়ত, সূচকে নতুন সরকারের দুর্নীতিবিরোধী নির্বাচনী অঙ্গীকারের একটা ইতিবাচক মূল্যায়নের প্রতিফলন ঘটেছিল।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ্রদৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট প্রত্যয় ব্যক্ত হয়। কমপক্ষে ডজন খানেক সুস্পষ্ট নীতিমালার উল্লেখ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে, যার বাস্তবায়ন বাংলাদেশে দুর্নীতিকে কার্যকর ও স্থায়ীভাব্রেনিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য।
সরকার গঠনের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিশ্রুতিগুলো মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে কিছু সম্ভাবনাময় পদক্ষেপও গৃহীত হয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের কতিপয় সংশোধনীর প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিপরিষদ কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠার পথে বড় ধরনের নৈরাশ্যজনক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। টিআইবিসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থগিত রয়েছে, তবে সুরাহা হয়নি, যা উদ্বেগের কারণ।
প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ ক্ষমতাবানদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশের অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি। এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তাঁর অন্য সহকর্মীরা কবে অনুসরণ করবেন—তার কোনো ইঙ্গিত নেই। জাতীয় বাজেটে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট নির্বাচনী অঙ্গীকার থেকে সরে এসে কর ন্যায়পাল পদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার’ নিষ্পত্তিকরণের উদ্যোগও ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এরূপ বিতর্কিত পদক্ষেপের পাশাপাশি তথ্য অধিকার আইনের মতো দুর্নীতি প্রতিরোধে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টিকারী আইনটি সংসদে অনুমোদনের মাধ্যমে সরকার জনগণের প্রতি অঙ্গীকার পূরণের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সম্পূরক অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি নতুন আইন—তথ্য প্রদানকারীর সুরক্ষা আইন সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে, যা উৎসাহব্যঞ্জক।
সরকার সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে নাগরিক সনদ কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হচ্ছে। জাতিসংঘে দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন অনুযায়ী অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে সরকার কৌশলপত্র অনুমোদন করেছে, যা আশার উদ্রেক করে, যদিও এর কার্যকর বাস্তবায়নে বাস্তব পদক্ষেপ এখনো বিরল।
ভূমি দস্যুতা প্রতিরোধে ড্যাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ ও এ-সংক্রান্ত সংসদে গৃহীত নতুন আইন অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। অন্যদিকে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা তাঁদের সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিরা সাম্প্রতিককালে যেভাবে স্থানীয় পর্যায়ে টেন্ডারবাজি, নদী-বনাঞ্চল-ভূমি দখল ও টোলবাজিসহ আইনের শাসনপরিপন্থী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে অপরিহার্য প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ক্রমান্বয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়ার আশঙ্কা বেড়েই চলেছে।
সরকারি ক্রয় খাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সাম্প্রতিক সংস্কার, বিশেষ করে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অবমূল্যায়ন, কোনো অবস্থায়ই সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে না। একইভাবে টেলিযোগাযোগ আইন, ২০১০ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) বিল, ২০১০ সংশ্লিষ্ট খাতে ্রস্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে— এরূপ আশা করা কঠিন।
দুর্নীতি, তা যে পর্যায়েই ঘটুক না কেন, কারও প্রতি কোনো প্রকার ভয় বা করুণা না করে, সব ধরনের্রদলীয় বা রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে তার বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে, আইন প্রয়োগে আদালতকে কোনো অবস্থাতেই প্রভাবিত না করা দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে তখনই সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে, যখন বিচার-প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হবে। অন্যদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তখনই সুফল আনবে, যখন এই বিভাগে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, পেশাগত উৎকর্ষ ও সততার সঙ্গে কার্য পরিচালনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা যেকোনো সংসদীয় গণতন্ত্রে দুর্নীতিবিরোধী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। বেশ কিছু কমিটি তুলনামূলক সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় হাত দিয়েছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সংসদীয় কমিটির সদস্যদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমিটির কার্যক্রম ও কার্যকারিতাকে ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে জনপ্রশাসন তথা সরকারি কর্মকর্তারা। পৃথিবীর যেসব দেশে সাফল্যের সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে সেসব দেশে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশাসনকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রণোদনার সমন্বয়নির্ভর সংস্কারের পাশাপাশি নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করা অপরিহার্য। সরকার পরিবর্তনের পর এ ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তাতে উৎসাহিত হওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ব্যক্তি কর্তৃক স্বাস্থ্য খাতে সরকারি পদে শুধু দলীয় সমর্থনপুষ্ট কর্মীদের নিয়োগের ঘোষণা ও পাবনায় নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নৈরাজ্যের দৃষ্টান্ত দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক ভাবা কঠিন।
এতদসত্ত্বেও আমরা আশা ছেড়ে দিতে চাই না। এ বছরের সিপিআই সরকার ও অন্যান্য সব স্টেকহোল্ডারদের জন্য সময়োপযোগী ্রইঙ্গিত এই মর্মে যে, দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা অদূর ভবিষ্যতে ্রআরও নেতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
No comments