ছোট দেশ বলে কি মনমানসিকতাও ছোট হবে by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম অবশেষে স্বীকার করে নিয়েছেন যে জেনারেল জিয়াউর রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এটা খুবই আনন্দের কথা যে তিনি তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, জিয়া সম্বন্ধে ওই কটূক্তি না করলেই কি হতো না? এই কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে জিয়া যখন ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তিনি গোটা বাঙালি জাতির মানসপটে একটি উদ্দীপনা ও চেতনার উদ্রেক করেন। ওই প্রথম আমরা জানতে পারি যে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দ্বারা গণহত্যার সূচনার পর শত্রুকবলিত বাংলাদেশে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে চলেছে। এবং এই প্রতিরোধের ফলেই বছর শেষে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এই ইতিহাস নতুন করে তুলে ধরার আর বোধকরি প্রয়োজন নেই। আমাদের সকলেরই সবকিছু জানা আছে। বর্তমান বাংলাদেশে আমরা সবাই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে ভিন্ন অবস্থানে রয়েছি না কেন, আমাদের সকলেরই মেনে নিতে হবে ১৯৭১ সালে প্রকৃতভাবে যা কিছু ঘটেছিল। কারা সেই যুদ্ধে আমাদের অণুপ্রাণিত করেছিলেন এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এবং এই সকল সাহসী মানুষের দলে ছিলেন জিয়াউর রহমান।
হ্যাঁ, এতে কোনো সন্দেহ নেই, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও তার ইতিহাসের ওপর প্রচুর আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক হিসেবে যে ক্ষতি জিয়া করেছেন, আমাদের সকলের জীবনে সেই বাস্তবতা ভোলার নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে আঘাত করেছেন দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা করে। তাঁর রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল আর সেটা আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করা এবং এ কাজটি করেছেন তিনি সেই পুরোনো রাজাকার ও পাকিস্তানি অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে, যারা ১৯৭১ সালে বাঙালি নিধন অভিযানে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সাহায্য করেছিল। তিনি অত্যন্ত নৈতিকতাবিরোধী কাজ করেন, যখন তিনি সংবিধানে অন্তর্গত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে আঘাত করেন। এই বিষয়গুলোও আজ আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা এই সত্যগুলো স্বীকার করতে পারে না, তাদের ইতিহাস-সংক্রান্ত জ্ঞান দুঃখজনকভাবে অতি নগণ্য। এবং ইতিহাসের আরেকটি সত্য হলো যে জিয়াউর রহমান এবং তাঁর মতো আরও অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে ফেলেন। এবং এই সব কারণেই আমাদের অবাক হতে হয়, যখন আমরা দেখি যে একজন মন্ত্রী একজন সামরিক নেতার দেশাত্মবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম কিসের ভিত্তিতে জিয়াকে পাকিস্তানের গুপ্তচর বলে আখ্যায়িত করলেন, সেই বিষয়টির ব্যাপারে আমরা অবগত নই। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি সরকারের একটি উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত রয়েছেন এবং এই আসনে থেকে তিনি কেন সাবেক একজন নেতার—হোক সে একজন সামরিক শাসক—এমন কঠোর সমালোচনা করে বসলেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তিনি কেন একজন মুক্তিযোদ্ধার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। তিনি কি জানতেন না যে এমন ধরনের মন্তব্য দেশ ও জাতিকে এক নতুন বিতর্কে জড়িয়ে ফেলবে? আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায় এখানে—তিনি যে এ রকম মন্তব্য করবেন, এ বিষয়ে কি সরকারি দলের অন্যান্য নেতা আগে থেকেই অবগত ছিলেন?
দেশপ্রেম একটি গভীর বিষয়। আমাদের কারও কোনো অধিকার নেই কোনো ব্যক্তির দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করার। আপনার সঙ্গে আমার রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকবে, তবে এই মতপার্থক্যকে ভিত্তি করে আমরা একে অপরকে দেশের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য নিয়ে আক্রমণ করব, এ কেমন কথা? হ্যাঁ, যেই শ্রেণীর মানুষের দেশদ্রোহিতার ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, তারা হলো ওই সকল ব্যক্তি, যারা ১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে এবং রাজাকার হিসেবে কাজ করেছে। ওই সকল মানুষ ছাড়া এ দেশের প্রত্যেক নাগরিক বাঙালি এবং বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেই নীতি, সেই বিশ্বাস আমরা আমাদের জীবনে কতটা ধরে রেখেছি? একটু ভেবে দেখুন। এই বাংলাদেশে এখনো এমন মানুষ আছেন, যাঁরা নির্দ্বিধায় বলে বেড়ান, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এঁরা এত নির্বোধ কেন? নাকি আমরা ধরে নেব যে জাতির জনকের প্রতি তাঁদের ঘৃণা এতই প্রকট যে তাঁরা যেকোনোভাবেই হোক তাঁর চরিত্র হনন করতে বদ্ধপরিকর? বঙ্গবন্ধু তো ছিলেন নির্বাচিত নেতা। তিনি তো জীবনে কোনো দিন আপস করেননি এবং করেননি বলেই আমাদের এমন সুন্দর ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন। ২৫ মার্চ তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে গেছেন—তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের যা যা করণীয়, দেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে যা করা দরকার, সবই করে গেছেন। এবং যাঁরা ইতিহাসের এই দিকটা বোঝেন না অথবা বুঝতে চান না, কেবল তাঁরাই সেই আত্মসমর্পণের কথা বলেন। এতে করে কেবল তাঁদের আত্মসম্মানেই ভাটা পড়ে।
এ দেশে অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার বিষয়টি আমরা প্রায় নিয়মিতভাবে ভুলে যাই। ১৯৭৫-এর তথাকথিত সিপাহি-জনতা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যখন জেনারেল খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয়, তখন একশ্রেণীর মানুষ অত্যন্ত উল্লসিত হয়েছিলেন। তাদের ছোট চিন্তা এবং তাদের ঠুনকো দেশপ্রেম তাদের মনে এ ধারণা জন্মায় যে খালেদ মোশাররফ ছিলেন একজন ভারতীয় চর, যাঁর এমন করুণ মৃত্যু হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এবং জিয়াউর রহমান যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন তিনি জাতিকে কখনো স্মরণ করিয়ে দেননি যে মোশাররফ ছিলেন একজন বড় মাপের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে হত্যা করা ছিল একটি জাতির মূল্যবোধকে ধ্বংস করা। একইভাবে লক্ষ করে থাকবেন যে বাংলাদেশে এমন একশ্রেণীর মানুষ রয়েছে, যাদের নজরে আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন ভারতপ্রেমী বাঙালি রাজনৈতিক নেতা। এই শ্রেণীর মানুষকে বোকা বললে ভুল হবে। প্রকৃত অর্থে এরাই হচ্ছে বাংলাদেশের শত্রু এই জন্য যে এরা সর্বদাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত রয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে শুধু এরাই ছিল না, তাঁকে সেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই হেয় করার অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয়। এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদেরাই বঙ্গবন্ধুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন কীভাবে তাজউদ্দীন একচ্ছত্রভাবে নিজেকে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন। আমাদের জাতীয় জীবনে একটি চরম দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক বিরোধ। এবং যাঁরা সেদিন এ বিরোধটা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁরা বুঝলেন না বাংলাদেশের তাঁরা কী বিরাট একটি ক্ষতি করছেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারালাম, তাজউদ্দীনকে হারালাম, গোটা মুজিবনগর সরকারকে হারালাম।
কোনো ব্যক্তির কোনো নেতা বা নেত্রীর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে ভাবা দরকার যে এর ফলাফল কী হতে পারে। আমরা লক্ষ করছি, বছরের পর বছর যখন খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন, তিনি প্রায় সব সময়ই অনায়াসে বলে ফেলেন যে এ দলটি বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দিচ্ছে। আমরা এখনো পর্যন্ত উন্নত এবং আধুনিক দেশ ও জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারিনি বলে বেগম জিয়া ও তাঁর সহকর্মীরা এসব ঢালাও মন্তব্য করে পার পেয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। বিশ্বের যেকোনো উন্নত সমাজে এ ধরনের মন্তব্য এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করত, যা অবশেষে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াত। আওয়ামী লীগ অথবা আওয়ামী লীগ সরকার দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে—এ কথা কে বিশ্বাস করবে? এ প্রশ্নের উত্তর খালেদা জিয়া ও বিএনপি একবারও কি দেওয়ার চেষ্টা করেছে? অন্যদিকে আবার এই সেদিন আওয়ামী লীগের সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী অত্যন্ত সরলভাবে কিন্তু কঠোর ভাষায় আমাদের সবাইকে অপ্রস্তুত করে দিলেন এই বলে যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আহূত ২৭ জুনের হরতালের পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এই গুরুতর অভিযোগটি করলেন, সেটা আর জানা গেল না। কোনো এক সময় স্বয়ং শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রশ্ন তুললেন, চন্দ্রিমা উদ্যানের কবরে আসলেও কি জিয়াউর রহমানের মরদেহ সমাহিত করা হয়েছিল? এর কয়েক দিন পর শেখ সেলিম বিষয়টি আবারও উত্থাপন করলেন এই মন্তব্য করে যে সেই কবরে জেনারেল জিয়ার মরদেহ রয়েছে কি না তা যাচাই করতে হবে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে।
আমাদের দেশটা ছোট। আমাদের ছোট ছোট স্বপ্ন ও আশা। কিন্তু আমাদের মনমানসিকতাও ছোট ও ক্ষুদ্র হতে হবে এটা কে বলল? আমাদের ইতিহাসকে আমরা খণ্ডিত করে ফেলব এই কথা কে বলল? আমাদের দেশে রাজনীতি দুটি ক্ষেত্রে বা tribe-এ পরিণত হবে, সেটাই বা হবে কেন? বাংলাদেশ তো রুয়ান্ডা কিংবা বুরুন্ডি নয় যে এখানেও হুতু ও তুতসির ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্ব দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমাদের বর্তমানকে গুঁড়িয়ে দেবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎকে বাক্সবন্দী করে রাখবে।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
হ্যাঁ, এতে কোনো সন্দেহ নেই, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও তার ইতিহাসের ওপর প্রচুর আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক হিসেবে যে ক্ষতি জিয়া করেছেন, আমাদের সকলের জীবনে সেই বাস্তবতা ভোলার নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে আঘাত করেছেন দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা করে। তাঁর রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল আর সেটা আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করা এবং এ কাজটি করেছেন তিনি সেই পুরোনো রাজাকার ও পাকিস্তানি অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে, যারা ১৯৭১ সালে বাঙালি নিধন অভিযানে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সাহায্য করেছিল। তিনি অত্যন্ত নৈতিকতাবিরোধী কাজ করেন, যখন তিনি সংবিধানে অন্তর্গত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে আঘাত করেন। এই বিষয়গুলোও আজ আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা এই সত্যগুলো স্বীকার করতে পারে না, তাদের ইতিহাস-সংক্রান্ত জ্ঞান দুঃখজনকভাবে অতি নগণ্য। এবং ইতিহাসের আরেকটি সত্য হলো যে জিয়াউর রহমান এবং তাঁর মতো আরও অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে ফেলেন। এবং এই সব কারণেই আমাদের অবাক হতে হয়, যখন আমরা দেখি যে একজন মন্ত্রী একজন সামরিক নেতার দেশাত্মবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম কিসের ভিত্তিতে জিয়াকে পাকিস্তানের গুপ্তচর বলে আখ্যায়িত করলেন, সেই বিষয়টির ব্যাপারে আমরা অবগত নই। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি সরকারের একটি উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত রয়েছেন এবং এই আসনে থেকে তিনি কেন সাবেক একজন নেতার—হোক সে একজন সামরিক শাসক—এমন কঠোর সমালোচনা করে বসলেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তিনি কেন একজন মুক্তিযোদ্ধার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। তিনি কি জানতেন না যে এমন ধরনের মন্তব্য দেশ ও জাতিকে এক নতুন বিতর্কে জড়িয়ে ফেলবে? আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায় এখানে—তিনি যে এ রকম মন্তব্য করবেন, এ বিষয়ে কি সরকারি দলের অন্যান্য নেতা আগে থেকেই অবগত ছিলেন?
দেশপ্রেম একটি গভীর বিষয়। আমাদের কারও কোনো অধিকার নেই কোনো ব্যক্তির দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করার। আপনার সঙ্গে আমার রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকবে, তবে এই মতপার্থক্যকে ভিত্তি করে আমরা একে অপরকে দেশের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য নিয়ে আক্রমণ করব, এ কেমন কথা? হ্যাঁ, যেই শ্রেণীর মানুষের দেশদ্রোহিতার ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, তারা হলো ওই সকল ব্যক্তি, যারা ১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে এবং রাজাকার হিসেবে কাজ করেছে। ওই সকল মানুষ ছাড়া এ দেশের প্রত্যেক নাগরিক বাঙালি এবং বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেই নীতি, সেই বিশ্বাস আমরা আমাদের জীবনে কতটা ধরে রেখেছি? একটু ভেবে দেখুন। এই বাংলাদেশে এখনো এমন মানুষ আছেন, যাঁরা নির্দ্বিধায় বলে বেড়ান, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এঁরা এত নির্বোধ কেন? নাকি আমরা ধরে নেব যে জাতির জনকের প্রতি তাঁদের ঘৃণা এতই প্রকট যে তাঁরা যেকোনোভাবেই হোক তাঁর চরিত্র হনন করতে বদ্ধপরিকর? বঙ্গবন্ধু তো ছিলেন নির্বাচিত নেতা। তিনি তো জীবনে কোনো দিন আপস করেননি এবং করেননি বলেই আমাদের এমন সুন্দর ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন। ২৫ মার্চ তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে গেছেন—তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের যা যা করণীয়, দেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে যা করা দরকার, সবই করে গেছেন। এবং যাঁরা ইতিহাসের এই দিকটা বোঝেন না অথবা বুঝতে চান না, কেবল তাঁরাই সেই আত্মসমর্পণের কথা বলেন। এতে করে কেবল তাঁদের আত্মসম্মানেই ভাটা পড়ে।
এ দেশে অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার বিষয়টি আমরা প্রায় নিয়মিতভাবে ভুলে যাই। ১৯৭৫-এর তথাকথিত সিপাহি-জনতা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যখন জেনারেল খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয়, তখন একশ্রেণীর মানুষ অত্যন্ত উল্লসিত হয়েছিলেন। তাদের ছোট চিন্তা এবং তাদের ঠুনকো দেশপ্রেম তাদের মনে এ ধারণা জন্মায় যে খালেদ মোশাররফ ছিলেন একজন ভারতীয় চর, যাঁর এমন করুণ মৃত্যু হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এবং জিয়াউর রহমান যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন তিনি জাতিকে কখনো স্মরণ করিয়ে দেননি যে মোশাররফ ছিলেন একজন বড় মাপের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে হত্যা করা ছিল একটি জাতির মূল্যবোধকে ধ্বংস করা। একইভাবে লক্ষ করে থাকবেন যে বাংলাদেশে এমন একশ্রেণীর মানুষ রয়েছে, যাদের নজরে আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন ভারতপ্রেমী বাঙালি রাজনৈতিক নেতা। এই শ্রেণীর মানুষকে বোকা বললে ভুল হবে। প্রকৃত অর্থে এরাই হচ্ছে বাংলাদেশের শত্রু এই জন্য যে এরা সর্বদাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত রয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে শুধু এরাই ছিল না, তাঁকে সেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই হেয় করার অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয়। এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদেরাই বঙ্গবন্ধুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন কীভাবে তাজউদ্দীন একচ্ছত্রভাবে নিজেকে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন। আমাদের জাতীয় জীবনে একটি চরম দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক বিরোধ। এবং যাঁরা সেদিন এ বিরোধটা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁরা বুঝলেন না বাংলাদেশের তাঁরা কী বিরাট একটি ক্ষতি করছেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারালাম, তাজউদ্দীনকে হারালাম, গোটা মুজিবনগর সরকারকে হারালাম।
কোনো ব্যক্তির কোনো নেতা বা নেত্রীর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে ভাবা দরকার যে এর ফলাফল কী হতে পারে। আমরা লক্ষ করছি, বছরের পর বছর যখন খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন, তিনি প্রায় সব সময়ই অনায়াসে বলে ফেলেন যে এ দলটি বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দিচ্ছে। আমরা এখনো পর্যন্ত উন্নত এবং আধুনিক দেশ ও জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারিনি বলে বেগম জিয়া ও তাঁর সহকর্মীরা এসব ঢালাও মন্তব্য করে পার পেয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। বিশ্বের যেকোনো উন্নত সমাজে এ ধরনের মন্তব্য এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করত, যা অবশেষে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াত। আওয়ামী লীগ অথবা আওয়ামী লীগ সরকার দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে—এ কথা কে বিশ্বাস করবে? এ প্রশ্নের উত্তর খালেদা জিয়া ও বিএনপি একবারও কি দেওয়ার চেষ্টা করেছে? অন্যদিকে আবার এই সেদিন আওয়ামী লীগের সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী অত্যন্ত সরলভাবে কিন্তু কঠোর ভাষায় আমাদের সবাইকে অপ্রস্তুত করে দিলেন এই বলে যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আহূত ২৭ জুনের হরতালের পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এই গুরুতর অভিযোগটি করলেন, সেটা আর জানা গেল না। কোনো এক সময় স্বয়ং শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রশ্ন তুললেন, চন্দ্রিমা উদ্যানের কবরে আসলেও কি জিয়াউর রহমানের মরদেহ সমাহিত করা হয়েছিল? এর কয়েক দিন পর শেখ সেলিম বিষয়টি আবারও উত্থাপন করলেন এই মন্তব্য করে যে সেই কবরে জেনারেল জিয়ার মরদেহ রয়েছে কি না তা যাচাই করতে হবে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে।
আমাদের দেশটা ছোট। আমাদের ছোট ছোট স্বপ্ন ও আশা। কিন্তু আমাদের মনমানসিকতাও ছোট ও ক্ষুদ্র হতে হবে এটা কে বলল? আমাদের ইতিহাসকে আমরা খণ্ডিত করে ফেলব এই কথা কে বলল? আমাদের দেশে রাজনীতি দুটি ক্ষেত্রে বা tribe-এ পরিণত হবে, সেটাই বা হবে কেন? বাংলাদেশ তো রুয়ান্ডা কিংবা বুরুন্ডি নয় যে এখানেও হুতু ও তুতসির ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্ব দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমাদের বর্তমানকে গুঁড়িয়ে দেবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎকে বাক্সবন্দী করে রাখবে।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments