ধোনির প্রেস কনফারেন্সে...
মহেন্দ্র সিং ধোনির কথার মাঝখানে হঠাৎ গমগম করে উঠল সাউন্ড বক্স। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম—ক্রিস গেইল, রামনরেশ সারওয়ান...। পাবলিক অ্যানাউন্স সিস্টেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের খেলোয়াড়দের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর অস্ট্রেলিয়া। ধোনি যে-ই আবার কথা বলতে শুরু করেছেন, আবারও সেটি সরব। এবার যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং করলে সেটি যে তুলে নেওয়া হবে—সেই ঘোষণা।
সংবাদ সম্মেলনকক্ষে সাউন্ড বক্সটা লাগানোর আইডিয়াটা যাঁর, ধোনি তাঁকে ডিনার-টিনার করিয়েছেন কি না খোঁজ নিলে হতো! ওটাই তো অস্বস্তিকর প্রেস কনফারেন্সটার মেজাজ বদলে দিল। সাংবাদিকেরা হাসছেন। ধোনিও হাসলেন। পরিবেশটাও একটু হালকা হয়ে গেল। এর আগ পর্যন্ত এটিকে যত না প্রেস কনফারেন্স বলে মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি আদালত!
কোনো টুর্নামেন্ট থেকে ভারত বিদায় নেওয়ার পর ভারতীয় অধিনায়কের প্রেস কনফারেন্সগুলো খুব ‘মজার’ হয়। ভারতীয় সাংবাদিক সব সময়ই সংখ্যায় বেশি থাকেন। তাঁদের চোখমুখে শোক-দুঃখ-ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার। ক্রিকেটাররা যে খেলার চেয়ে টাকার চিন্তাই বেশি করেন—এ ব্যাপারে সবাইকে একমত দেখা যায়। সাংবাদিকেরা যত কষ্ট পাচ্ছেন, খেলোয়াড়েরা তার এক শতাংশও নয়, এ ব্যাপারেও সবাই খুব দ্রুতই মতৈক্যে পৌঁছে যায়।
কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নগুলোয় সেই ঝাঁজ খুব একটা টের পাওয়া যায় না। শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেওয়ার পর ধোনির দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলনে যেমন সে অর্থে কড়া প্রশ্ন হলো মাত্র দুটি। তার একটি করলেন কলকাতার শীর্ষস্থানীয় বাংলা কাগজ-এর সাংবাদিক। সংবাদ সম্মেলন শেষে আমাকে দুঃখ করে বললেন, ‘দেখলে তো, ভারতীয় ক্রিকেট প্রেস কেমন নির্বীর্য। আড়ালে এত কথা বলে, সামনে বলার সাহস নাই। যদি সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়!’
আধুনিক ক্রিকেট সাংবাদিকতার এই এক জ্বালা। আগে ক্রিকেট সাংবাদিকদের ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও চলত। শুধু খেলা নিয়ে লিখলেই যে হতো। এখন টেলিভিশন-ইন্টারনেটের এই যুগে শুধু ম্যাচ রিপোর্টে পাঠকদের মন ভরে না। দলের ভেতরের খবর চাই, ড্রেসিংরুমের খবর। যে সবের ভারতীয় নাম ‘মাশালা নিউজ’ এবং ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকলে তা পাওয়ার উপায় নেই। সংবাদ সম্মেলনের আগে-পরে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়া সাংবাদিকের প্রশ্নেও তাই মধু মাখা থাকে। পাছে উনি রাগ করেন!
ইংল্যান্ডে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর ধোনির প্রেস কনফারেন্সটা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ২৭ মিনিট! এ দিনেরটা অত দীর্ঘ না হলেও মিনিট বিশেক তো হলোই। আগের রেকর্ড ভেঙেও যেতে পারত, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরের ম্যাচের আগে দুই দলের জাতীয় সংগীত বাজতে শুরু করেছে বলেই এত ‘তাড়াতাড়ি’ শেষ।
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজকে ধোনির পাশে বসে হাই তুলতে তুলতে পুরোটা শুনতে হলো। কুমার সাঙ্গাকারা আসেননি। ধোনি আর ম্যান অব দ্য ম্যাচ ম্যাথুজ এসেছেন একই সঙ্গে। একটা মাত্র প্রশ্নের উত্তর দিতে বেচারাকে এতক্ষণ বসে থাকতে হলো!
তার পরও তো ধোনিকে প্রশ্ন করার সুযোগ না পেয়ে আইসিসির মিডিয়া কর্মকর্তার সঙ্গে এক টিভি রিপোর্টারের তুমুল ঝগড়া-ই লেগে গেল। ধোনির প্রেস কনফারেন্স ইংরেজি-হিন্দি দুই ভাষাতেই হয়। এদিন ইংরেজি অংশটাতেই এত সময় চলে গেছে যে, হিন্দির জন্য আর বেশি সময় নেই। এটাই ওই টিভি রিপোর্টারের উত্তেজনার পক্ষে যুক্তি। তর্কাতর্কির একপর্যায়ে ‘আর হবে না’ বলে দিয়েও তাঁর উত্তেজনা দেখে আইসিসির পাকিস্তানি মিডিয়া কর্মকর্তা হার মানতে বাধ্য হলেন।
এত লড়াই করে পাওয়া সুযোগ, একসঙ্গে তাই দুটি প্রশ্ন করে ফেললেন ওই রিপোর্টার। প্রশ্ন এক. ভারতের মানুষের উদ্দেশে ধোনি কী বলবেন? প্রশ্ন দুই. ভারত থেকে খবর আসছে, রাস্তায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে, এ ব্যাপারে কী মন্তব্য?
দ্বিতীয় প্রশ্নটা শুনে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই আরেক ভারতীয় অধিনায়কের টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়ী প্রেস কনফারেন্সের কথা মনে পড়ে গেল। এদিন আমি ভারতের দুঃখে দুঃখীও নই, শ্রীলঙ্কার সুখে সুখীও নই। কিন্তু ২০০৭ বিশ্বকাপে ত্রিনিদাদে রাহুল দ্রাবিড়ের সংবাদ সম্মেলন প্রভূত আনন্দ দিচ্ছে। ভারত নেই বলেই তো বাংলাদেশ সুপার এইটে!
ভারত একটা কিছু হারলেই যে দেশে সমর্থকদের দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়, সে জন্য মিডিয়াকেও দোষ দিয়েছিলেন দ্রাবিড়। ভারতীয় টিভি মিডিয়ার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। ভারতের পরাজয়ের পর ম্যাচে যে খারাপ খেলেছে, তাঁর মুন্ডুপাত করার জন্য ‘ম্যাচ কা মুজরিম’ নামে অনুষ্ঠান; রাস্তায় এর-ওর উত্তেজক ইন্টারভিউ, চার-পাঁচজনের হইহল্লাকে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ বলে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া—ক্রিকেটারদের বাড়ি-টাড়িতেও হামলায় এসব তো ইন্ধন জোগায়ই।
ওই সাংবাদিকই যেমন শেষ বলে শেষ হওয়া ম্যাচ থেকে সরাসরি সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন। এর মধ্যে ভারতের রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভের খবরটা পেলেন কখন? ভারতে তখন রাত দুইটা। এত রাতে মানুষ রাস্তায় নেমে গেছে! ভারতীয়দের যত ক্রিকেট-প্রেমই থাকুক, এটা একটু কষ্টকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে। নাকি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ওই রিপোর্টার জানেন, এমন কিছু তো হবেই। ধোনির প্রতিক্রিয়া নেওয়ার সুযোগ তো পরে পাব না। এখনই তা নিয়ে রাখি।
সেন্ট লুসিয়া, ১১ মে
সংবাদ সম্মেলনকক্ষে সাউন্ড বক্সটা লাগানোর আইডিয়াটা যাঁর, ধোনি তাঁকে ডিনার-টিনার করিয়েছেন কি না খোঁজ নিলে হতো! ওটাই তো অস্বস্তিকর প্রেস কনফারেন্সটার মেজাজ বদলে দিল। সাংবাদিকেরা হাসছেন। ধোনিও হাসলেন। পরিবেশটাও একটু হালকা হয়ে গেল। এর আগ পর্যন্ত এটিকে যত না প্রেস কনফারেন্স বলে মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি আদালত!
কোনো টুর্নামেন্ট থেকে ভারত বিদায় নেওয়ার পর ভারতীয় অধিনায়কের প্রেস কনফারেন্সগুলো খুব ‘মজার’ হয়। ভারতীয় সাংবাদিক সব সময়ই সংখ্যায় বেশি থাকেন। তাঁদের চোখমুখে শোক-দুঃখ-ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার। ক্রিকেটাররা যে খেলার চেয়ে টাকার চিন্তাই বেশি করেন—এ ব্যাপারে সবাইকে একমত দেখা যায়। সাংবাদিকেরা যত কষ্ট পাচ্ছেন, খেলোয়াড়েরা তার এক শতাংশও নয়, এ ব্যাপারেও সবাই খুব দ্রুতই মতৈক্যে পৌঁছে যায়।
কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নগুলোয় সেই ঝাঁজ খুব একটা টের পাওয়া যায় না। শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেওয়ার পর ধোনির দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলনে যেমন সে অর্থে কড়া প্রশ্ন হলো মাত্র দুটি। তার একটি করলেন কলকাতার শীর্ষস্থানীয় বাংলা কাগজ-এর সাংবাদিক। সংবাদ সম্মেলন শেষে আমাকে দুঃখ করে বললেন, ‘দেখলে তো, ভারতীয় ক্রিকেট প্রেস কেমন নির্বীর্য। আড়ালে এত কথা বলে, সামনে বলার সাহস নাই। যদি সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়!’
আধুনিক ক্রিকেট সাংবাদিকতার এই এক জ্বালা। আগে ক্রিকেট সাংবাদিকদের ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও চলত। শুধু খেলা নিয়ে লিখলেই যে হতো। এখন টেলিভিশন-ইন্টারনেটের এই যুগে শুধু ম্যাচ রিপোর্টে পাঠকদের মন ভরে না। দলের ভেতরের খবর চাই, ড্রেসিংরুমের খবর। যে সবের ভারতীয় নাম ‘মাশালা নিউজ’ এবং ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকলে তা পাওয়ার উপায় নেই। সংবাদ সম্মেলনের আগে-পরে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়া সাংবাদিকের প্রশ্নেও তাই মধু মাখা থাকে। পাছে উনি রাগ করেন!
ইংল্যান্ডে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর ধোনির প্রেস কনফারেন্সটা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ২৭ মিনিট! এ দিনেরটা অত দীর্ঘ না হলেও মিনিট বিশেক তো হলোই। আগের রেকর্ড ভেঙেও যেতে পারত, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরের ম্যাচের আগে দুই দলের জাতীয় সংগীত বাজতে শুরু করেছে বলেই এত ‘তাড়াতাড়ি’ শেষ।
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজকে ধোনির পাশে বসে হাই তুলতে তুলতে পুরোটা শুনতে হলো। কুমার সাঙ্গাকারা আসেননি। ধোনি আর ম্যান অব দ্য ম্যাচ ম্যাথুজ এসেছেন একই সঙ্গে। একটা মাত্র প্রশ্নের উত্তর দিতে বেচারাকে এতক্ষণ বসে থাকতে হলো!
তার পরও তো ধোনিকে প্রশ্ন করার সুযোগ না পেয়ে আইসিসির মিডিয়া কর্মকর্তার সঙ্গে এক টিভি রিপোর্টারের তুমুল ঝগড়া-ই লেগে গেল। ধোনির প্রেস কনফারেন্স ইংরেজি-হিন্দি দুই ভাষাতেই হয়। এদিন ইংরেজি অংশটাতেই এত সময় চলে গেছে যে, হিন্দির জন্য আর বেশি সময় নেই। এটাই ওই টিভি রিপোর্টারের উত্তেজনার পক্ষে যুক্তি। তর্কাতর্কির একপর্যায়ে ‘আর হবে না’ বলে দিয়েও তাঁর উত্তেজনা দেখে আইসিসির পাকিস্তানি মিডিয়া কর্মকর্তা হার মানতে বাধ্য হলেন।
এত লড়াই করে পাওয়া সুযোগ, একসঙ্গে তাই দুটি প্রশ্ন করে ফেললেন ওই রিপোর্টার। প্রশ্ন এক. ভারতের মানুষের উদ্দেশে ধোনি কী বলবেন? প্রশ্ন দুই. ভারত থেকে খবর আসছে, রাস্তায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে, এ ব্যাপারে কী মন্তব্য?
দ্বিতীয় প্রশ্নটা শুনে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই আরেক ভারতীয় অধিনায়কের টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়ী প্রেস কনফারেন্সের কথা মনে পড়ে গেল। এদিন আমি ভারতের দুঃখে দুঃখীও নই, শ্রীলঙ্কার সুখে সুখীও নই। কিন্তু ২০০৭ বিশ্বকাপে ত্রিনিদাদে রাহুল দ্রাবিড়ের সংবাদ সম্মেলন প্রভূত আনন্দ দিচ্ছে। ভারত নেই বলেই তো বাংলাদেশ সুপার এইটে!
ভারত একটা কিছু হারলেই যে দেশে সমর্থকদের দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়, সে জন্য মিডিয়াকেও দোষ দিয়েছিলেন দ্রাবিড়। ভারতীয় টিভি মিডিয়ার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। ভারতের পরাজয়ের পর ম্যাচে যে খারাপ খেলেছে, তাঁর মুন্ডুপাত করার জন্য ‘ম্যাচ কা মুজরিম’ নামে অনুষ্ঠান; রাস্তায় এর-ওর উত্তেজক ইন্টারভিউ, চার-পাঁচজনের হইহল্লাকে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ বলে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া—ক্রিকেটারদের বাড়ি-টাড়িতেও হামলায় এসব তো ইন্ধন জোগায়ই।
ওই সাংবাদিকই যেমন শেষ বলে শেষ হওয়া ম্যাচ থেকে সরাসরি সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন। এর মধ্যে ভারতের রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভের খবরটা পেলেন কখন? ভারতে তখন রাত দুইটা। এত রাতে মানুষ রাস্তায় নেমে গেছে! ভারতীয়দের যত ক্রিকেট-প্রেমই থাকুক, এটা একটু কষ্টকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে। নাকি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ওই রিপোর্টার জানেন, এমন কিছু তো হবেই। ধোনির প্রতিক্রিয়া নেওয়ার সুযোগ তো পরে পাব না। এখনই তা নিয়ে রাখি।
সেন্ট লুসিয়া, ১১ মে
No comments