হারিয়ে যাওয়া দলিল, তাড়িয়ে ফেরা ঘাতক by সোহরাব হাসান

টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরটি আমাদের আহত করলেও অবাক করেনি। খবরটি নতুনও নয়।
৯ মে পত্রিকটি ‘ট্রুথ লস্ট, মোস্ট মিলিটারি রেকর্ডস অব বাংলাদেশ ওয়ার মিসিং’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপে। এতে বলা হয়, ‘ভারতের সামরিক বাহিনীর কাছে থাকা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ধ্বংস করা হয়েছে। এসব নথিপত্রের মধ্যে ছিল যুদ্ধের সময় তৈরি করা মুক্তিবাহিনী গঠনের ব্যাপারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পর্যালোচনা ও প্রশংসা-সংবলিত দলিল, যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা ও অন্যান্য স্পর্শকাতর তথ্য। কলকাতার ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে এসব দলিল রক্ষিত ছিল। কিন্তু একাত্তরে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই তা ধ্বংস করে ফেলা হয়।’
তখন ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, যিনি ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ বাহিনীর পক্ষে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হয়ে এসেছিলেন জেনারেল জ্যাকব। এই দুই জেনারেলের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো ছিল না, সে কথাও আমরা জানি। জ্যাকব একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা লিখলেও অরোরা কিছু লেখেননি। এ ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকায় অরোরা বলেছিলেন, ‘অনেকেই বিজয়ের ভাগীদার হতে চান। পরাজয়ের দায় কেউ নিতে চান না।’
ভারত যদি সত্যি সত্যি বিজয়ের ভাগীদার হতে চাইত, তাহলে তারা কেন একাত্তরের দলিলপত্র ধ্বংস করে দিল? বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশেই সম্ভবত দলিলগুলো নষ্ট করা হয়েছিল। এতে পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের উন্নতি হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হলো বাংলাদেশ। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছে, এ জন্য আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু সেই গৌরবজনক ইতিহাস ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আড়ালে পড়ে যেতে পারে না। একাত্তরের দলিলপত্র পাকিস্তান ধ্বংস করতে পারে, কেননা, তারা ছিল বিজিত শক্তি। কিন্তু যুদ্ধে বিজয়ী ভারত বা বাংলাদেশ কেন দলিলপত্র ধ্বংস করল? অনেকে যুক্তি দেখাবেন, আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার আগে ভারত যে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প তৈরি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, সেসব হয়তো তারা গোপন রাখতে চেয়েছে। কেন সেটি গোপন রাখতে হবে?
সে সময় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর ছিল কলকাতার থিয়েটার রোডে। এখন ভারত সরকার কি সেই জায়গাটিও মুছে ফেলবে? ভারতের বিরোধী দল বিজেপি একাত্তরের দলিল ধ্বংসের ব্যাপারে তদন্ত দাবি করলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, ভারতের মতো বাংলাদেশও একাত্তরের দলিলপত্র সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে? আমরা সরকারের অবস্থান জানতে চাই।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র এবং যুদ্ধবন্দীরা ভারত ও পাকিস্তানের দরকষাকষির বিষয় হিসেবে গণ্য হয়েছিল, যা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু জয়ী হয়েছিল যুদ্ধ-পরবর্তী কূটনীতিতে। এর দায় ভারতও এড়াতে পারে না।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ধ্বংসের কাজ যে শুধু ভারতে হয়েছে তা নয়; বাংলাদেশের ভেতরেও আমরা অনেক দলিলপত্র নষ্ট করে ফেলেছি। মুজিবনগর সরকারের যেসব কাগজপত্র ট্রাক ভর্তি করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল, তা কোথায় রাখা হয়েছিল? কারা সেসব নষ্ট করে ফেলেছেন? ২০০৮ সালের জুন মাসে জানানো হয়, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়েছিল, তার মূল কপি সরকারি হেফাজতখানা থেকে হারিয়ে গেছে। এখন জাতীয় হেফাজতখানায় ঘোষণাপত্রের ফটোকপি আছে। কীভাবে এ রকম একটি মূল্যবান দলিল নষ্ট হলো, সে ব্যাপারে কোনো তদন্ত হয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের এ রকম অনেক দলিলপত্র ও প্রমাণ নষ্ট হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর বাংলা একাডেমী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, পঁচাত্তরের পর তা বন্ধ হয়ে যায় বা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানের আমলে হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প’ নামে পৃথক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এরপর ১৫ খণ্ডে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস: দলিলপত্র’ প্রকাশিত হলেও অসংখ্য দলিল অপ্রকাশিত থেকে যায়। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেন। কিন্তু অপ্রকাশিত দলিলপত্রগুলোর ভাগ্যে কী ঘটেছে আমরা জানি না।
স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, তা দেশেই হোক আর বিদেশেই হোক, হারিয়ে যেতে শুরু করে। ডিসেম্বরের বিজয়ের পর বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তে একটি গণকমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশন নাকি অনেক তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করেছিল। সরকারিভাবেও তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপর কী হয়েছে? পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন ছাড়া কারও কাছে উল্লেখযোগ্য তথ্য-প্রমাণ আছে বলে জানা নেই। এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি। যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য লাভে সবাই ব্যস্ত ছিলেন। কেউ বা ‘রুশ-ভারতের সহায়তায় পাওয়া স্বাধীনতা’কে অসার প্রমাণ করতে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়েন।
আবার এর বিপরীত চিত্রও আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সমগ্র জাতির। কতিপয় আলবদর, রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্য ছাড়া সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে এতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন, অগ্রাহ্য করলেন অন্যান্য দলের ভূমিকা ও অবদানকে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তৈরি হলো নানা উপদল, গোষ্ঠী ও বিভক্তি। পঁচাত্তরের আগে যেটি ‘খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা ও অখাঁটি মুক্তিযোদ্ধা’র লড়াই ছিল, পঁচাত্তরের পর সেটিই ‘স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের’ সংঘাতে রূপ নেয়। সেই সংঘাত এখনো চলছে। হয়তো ভবিষ্যতেও চলবে।

২.
আমরা যখন হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস নিয়ে মনোবেদনা প্রকাশ করছি, তখন একাত্তরের ঘাতক-দালালরাও বসে নেই। দেশে-বিদেশে সক্রিয় রয়েছে তারা। পাকিস্তান যতই বলুক তারা যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধী নয়, সেখানকার পত্রপত্রিকায় এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছেই। গত ২৯ মার্চ ডন-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, ইন্টারনেট সংস্করণে লেখকের নাম ছাপা না হলেও তিনি নিজেকে পাকিস্তানের প্রথম যুদ্ধবন্দী হিসেবে দাবি করেন। তিনি লিখেছেন, ২০০৮ সালে ‘ধাপ্পাবাজি’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ‘অপরাধ বিচার’-এর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা বিরোধীদের প্রতি বৈষম্য তৈরি করবে এবং দেশে উত্তেজনা বাড়াবে। এরপর লেখক যোগ করেন, ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট (প্রকৃত তারিখ ১৫ আগস্ট) দেশপ্রেমিক বাঙালিরা ‘স্বৈরশাসক’ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে এবং তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতাকে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করে। এমন অনেক পাকিস্তানি রয়েছেন যাঁরা এখনো বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বিষ্ট। এর সঙ্গে আশ্চর্য মিল আছে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানপন্থীদের।
সম্প্রতি এক সেমিনারে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, ‘পারলে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ করুক।’ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়েও দম্ভোক্তি করেছেন তিনি। এর আগে জামায়াতের নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধ হয়নি। এখানে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। দুর্ভাগ্য, এই অস্বীকারের অপরাজনীতিতে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াও যোগ দিয়েছেন। কয়েক দিন আগে তিনি আইনজীবীদের এক সমাবেশে বলেছেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে সরকার জাতিকে বিভক্ত করতে চাইছে।’ সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ না নিয়ে খালেদা জিয়া বিচার-প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার কথা বললে দেশবাসীর সমর্থন পেতেন। আওয়ামী লীগের দলীয় মাস্তানি-সন্ত্রাসেরও বিরোধিতা আমরা করব। তাদের কর্মসূচি আমাদের পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধের মতো জঘন্য অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করতে পারি না।
অনেকে যুক্তি দেখাচ্ছেন, যেহেতু আমরা একাত্তরে অপরাধের মূল হোতা পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের বিচার করতে পারিনি, সেহেতু এ দেশীয় অপরাধীদের বিচার করে কী হবে? অপরাধী কোন দেশের, কী তার ধর্ম বা গোত্র পরিচয়, বিচারের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচ্য হতে পারে না। বিচার্য হলো, সে অপরাধ করেছে কি না। এত দিন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারিনি বলে ভবিষ্যতে করা যাবে না, তারও যুক্তি নেই। বরং দেশীয় অপরাধীদের বিচারের সওয়াল-জবাবে পাকিস্তানি সেনা ও সিভিলিয়ানদের অপরাধও উন্মোচিত হবে। তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলা যাবে, পাকিস্তানিরা এই অপরাধ করেছে, তাদের বিচারের ব্যবস্থা করো। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার অন্যতম কারণ ছিল, ১৯৭৪ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তান সরকার ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করে বলেছিল, অভিযুক্তরা যেহেতু পাকিস্তানের নাগরিক এবং পাকিস্তানি ভূখণ্ডে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে কারণে তারাই ১৯৫ জন অভিযুক্তের বিচার করবে। পাকিস্তান অতীতের ভুলের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল। কিন্তু গত ৩৫ বছরেও তারা সেই বিচার করেনি। এমনকি অপরাধ তদন্তে গঠিত হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টও পুরো প্রকাশ করেনি। আমরা তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে বিচারের দায়টি তাদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা কোথায়?
খালেদা জিয়া বলেছেন, বিচারের মাধ্যমে জাতিকে বিভক্ত করা যাবে না। প্রকৃত সত্য হলো, গত ৩৯ বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ার কারণেই জাতি বিভক্ত । বিভক্ত রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোও। এখন সুযোগ এসেছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার। ৩৯ বছর ধরে ঘাতকেরা তাড়া করে ফিরছে। সময় এসেছে তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর।
সব ধরনের দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে সরকার কি সেই কাজটি করতে প্রস্তুত আছে? পারলে সাধুবাদ জানাব, না পারলে ইতিহাস তাদেরও ক্ষমা করবেনা।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohৎab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.