অস্ত্র দেখে যায় চেনা... by ফারুক ওয়াসিফ
গোঁফ দেখে বিড়াল চেনা যায়, এখন অস্ত্র দেখে চেনা যায় কে কোন দলের ক্যাডার। দলীয় ক্যাডারদের ব্র্যান্ড বা প্রচার-প্রতীক এখন নানান জাতের অস্ত্র। ছাত্রলীগের রামদা-চাপাতি, ছাত্রদলের কাটা রাইফেল-পাইপগান, শিবিরের রগ কাটা ক্ষুর-কুড়াল। (অবশ্য পাইপগান খুব গরম হয়ে যায় বলে এর ব্যবহার ক্রমশ কমে এসেছে, তার জায়গা নিয়েছে সর্বদলীয়, সর্ব-অপরাধীদের প্রিয় অস্ত্র পিস্তল) বলা যায়, এগুলোই এখন যার যার দলীয় ট্রেডমার্ক, দলীয় ব্র্যান্ড। অস্ত্র যেখানে ঝনঝন করে, রক্ত যেখানে যখন-তখন যার-তার দেহ থেকে ঝরে, সেখানে ন্যায়নীতি-মনুষ্যত্ব কর্পূরের মতো উবে যায়। বলপ্রয়োগ যেখানে রাজনীতির উপায়, সেখানে সাধারণ মানুষ নিরুপায়।
তাহলে নৌকা, ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লা বা লাঙ্গল মার্কার কী হবে? এগুলো দেখেই তো আগে দল চেনা যেত; ব্যালট পেপারে তো আর রামদা-কাটা রাইফেল-ক্ষুরের ছবি থাকে না? কে না জানে বিজ্ঞাপন আর বাস্তবের মধ্যে মেঘ আর মাটির তফাৎ। একটা কৌতুক মনে পড়ে। মৃত্যুর পর এক লোকের পাপ আর পুণ্য পরিমাপে দেখা গেল দুটোই কাঁটায় কাঁটায় সমান। ঈশ্বর ভাবলেন, এ তো মহামুসিবত। একে কোথায় ফেলা যায় স্বর্গে না নরকে? একটা বুদ্ধি বের হলো। প্রহরীদের সঙ্গে লোকটাকে দিয়ে বলে দিলেন, তোমার ব্যক্তিস্বাধীনতা আমি সম্মান করি, তাই চোখে দেখে নিজেই ঠিক করো কোথায় থাকবে। প্রহরীরা প্রথমে তাকে এক অনিন্দ্যসুন্দর উদ্যানে নিয়ে গেল। দুনিয়ার যত নায়ক-নায়িকা, খ্যাতিমান-ধনবান সবাই সেখানে শুয়ে-বসে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আনন্দের ফোয়ারা ছুটছে। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো আরেকটি জায়গায়। সেখানে দুনিয়ার গরিব-দুঃখী, নির্যাতিত ও দুস্থ লোকেরা নানান কাজ-কারবার করে খেটে খাচ্ছে। আর দেখার দরকার হলো না। লোকটি সাফ জানিয়ে দিল, সে প্রথম জায়গাটিতেই থাকতে চায়। ঈশ্বর মুচকি হাসলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রহরীরা তাকে সাঁড়াশিতে আটকে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে ফেলল। হতভম্ব লোকটি চিৎকার করে, আরে! আমি তো এটা চাইনি!!! প্রহরী হেসে উত্তর দেয়, আরে গর্দভ, ওটা তো ছিল বিজ্ঞাপন! দিনবদলের প্রতিশ্রুতিও ছিল তেমন বিজ্ঞাপন। আর বাস্তব তো প্রতিদিন সশস্ত্র চেহারায় দেখা দিচ্ছে। সন্ত্রাসের তোড়ে জনজীবনের আর কোনো সমস্যার দিকে তাকানোরও সময় মিলছে না।
শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ‘ছিল একটা বেড়াল হয়ে গেল রুমাল’। এভাবেই ছাত্রদলের সোনার ছেলেদের আমরা সোনালি সন্ত্রাস চালাতে দেখেছি। আঙুল ফুলে কলাগাছ আর বিদ্যুতের খুঁটি পুঁতে মহারাজও হয়েছেন কেউ কেউ। কেউ কিছু বললে বলা হতো সবই ‘ষড়যন্ত্র’। সুকুমার রায় থাকলে বলতেন, ‘দ্রুম-দ্রাম দ্রিদিম-দ্রিদিম, কানে লাগে খটকা/ ফুল ফোটে তাই বল, আমি ভাবি পটকা’। আমাদের মনে রাগ-ক্ষোভ কিংবা ষড় বা অষ্টযন্ত্র যা-ই থাকুক, ছাত্রলীগের রামদার কোপানিগুলোকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ম্যানুয়াল হাতিয়ারই ভাবতে হবে।
মনে হয়, দুই প্রধান নেত্রী এই সশস্ত্র তরুণদেরই তাঁদের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির খুঁটি মনে করেন। অথচ জরুরি অবস্থার সময় তাঁরা যখন বন্দী ছিলেন, তখন এদের কাউকেই নিজ নিজ নেত্রীর জন্য সামান্য ত্যাগ স্বীকার করতে দেখা যায়নি। তখন যারা গর্তে লুকিয়েছিল, আজ তারা পিলপিল করে বেরিয়ে এসে পরস্পরকে কাটছে, বুক ফুটো করে দিচ্ছে—কেবলই অর্থ আর ক্ষমতার লোভে। অন্যদিকে গ্রাম-শহরের যে নিরীহ তরুণদের ভোট আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করেছিল, মনে হচ্ছে তারা পরিত্যক্ত। সেই দরিদ্র ও শ্রমজীবী তরুণ, সেসব শহুরে শিক্ষিত জীবনসংগ্রামী তরুণ, সুন্দর-সমৃদ্ধ দেশ চাওয়া সেসব লাখ লাখ তরুণের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য নেই, ক্ষমতার দুধ-মধু খেয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী তরুণেরা আর তাদের নেতা ও গডফাদাররা।
আমাদের সময়ের নায়ক-নায়িকা
আজকের তরুণের স্বপ্ন নেই, দুঃস্বপ্ন আছে। রাজনীতি তাকে ক্ষমতার বশ করেছে। আর বাজার তাকে করেছে টাকার কাঙাল। বিনোদন-সংস্কৃতি তথা মুঠোফোন-টেলিভিশন-ইন্টারনেট তাকে টানছে চটকদার জীবনে। চারদিকে ভোগ আর বিত্তের হাতছানি। সবার ভাগ্যে কল্পনার মেওয়া জোটে না, কিন্তু অনেকেই ভাবে সেও একদিন ফ্যাশনের মডেলের মতো, নাটকের নায়ক-নায়িকার মতো, বিজ্ঞাপনে দামি গাড়ি হাঁকানো হিরোর মতো জীবন পাবে। এত সব ভোগের টোপে তার চিন্তা অসাড়। হিংসা আর প্রতিষ্ঠার ইঁদুর-দৌড়ে সে থতমত। তার মাথা নেই চিন্তা করার, হাত নেই ধরার, পা নেই চলার, চোখ নেই দেখার। কিংবা আছে, কিন্তু সেগুলো যা দেখার তা দেখে না, যা শোনার তা শোনে না, যা বলার তা বলে না। তার প্রতিটি অঙ্গেই পণ্যের বাহার। যতই সে পণ্যে ভরে দেহ ততই তার মন শূন্য হয় যায়। নিজের গুণে নয়, পণ্যের গুণে সে বড় হতে চায়। এর সঙ্গে সেই তরুণের কী ফারাক, যে নিজের যোগ্যতায় নয়, দলীয় দম্ভে বেপরোয়া হয়ে যায়? ভোগের মরিয়া বাসনা আর ক্ষমতার জন্য নিষ্ঠুরতা কি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ নয়? এই ভোগবাসনা পুরুষালি এই সন্ত্রাসও ব্যাটাগিরি। এ দুইয়ের সাঁড়াশি চাপে সামাজিক নিরাপত্তা এবং বিশেষ করে নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা বিপন্ন।
অনেক কাল আগে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে’। সত্যিই যেন বিজ্ঞাপনের ভিড়ে আর পণ্যের লোগোয় ঢাকা পড়া আজকের তরুণ-তরুণীর স্বাভাবিক মুখ আর দেখা যায় না। এবং এরাই আমাদের সময়ের নায়ক-নায়িকা। অথচ দেশে বা প্রবাসে যে কয়েক কোটি তরুণ শ্রম দিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখছে, উৎপাদন করছে, সন্ত্রাসের বাহাদুরি বা বাসনাবিলাসের সুযোগ যাদের কম, তারা উপেক্ষিত। যে লুঙ্গি পরা যুবকটি ঢাকার পাসপোর্ট অফিসে লাইন দিয়ে বা দালাল বা এজেন্টদের মাধ্যমে শ্রম বিক্রি করতে বিদেশ যাচ্ছে, অথবা যে ১৫-২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরা পোশাক কারখানায় দিন-রাত খেটে যাচ্ছে, এদের শ্রম আর বঞ্চনার দামেই কিন্তু আমাদের বিত্তবানদের ছেলেমেয়েদের শানশওকত আর আমোদ-উল্লাস চলতে পারছে। প্রবাসী শ্রমিক আর গার্মেন্ট শ্রমিকদের শ্রমে অর্জিত ডলার দিয়েই বিদেশি মোবাইল কোম্পানির মুনাফা শোধ হচ্ছে, দামি বিদেশি পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। অথচ জাতীয় সংস্কৃতিতে, মিডিয়া আর বিজ্ঞাপনের বানানো রূপকথায়, কিংবা সরকারি নীতিতে ওইসব উৎপাদক তারুণ্যের কথা কম। তারা হিরো নয়, জমজমাট রাজনীতি আর রং-রসে ভরপুর ভোগমেলায় পার্শ্বচরিত্র মাত্র।
রোম প্রতিষ্ঠা করেছিল তরুণ দুই ভাই। এক তরুণ কৃষ্ণ আর এক তরুণী রাধা হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসার ধন। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি চিরকালের জন্য তারুণ্যের আদলেই আঁকা হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের সময় তরুণকে হত্যা করে, সন্ত্রাসী বানায়; তার মনকে মোহগ্রস্ত করে অমানবিক প্রতিষ্ঠার কাঙাল বানায়। তারুণ্য আজ বাজারের খোরাক, রাজনীতির বলি।
‘হারিয়েযাও’, ‘মেতে ওঠো’
তরুণদের ছুটি দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের দায় থেকে, সমাজ পাল্টানোর কর্তব্য থেকে। বিজ্ঞাপনের ভাষা তাদের বলছে ‘হারিয়েযেতে’, লোকালয়থেকে দূরে ফূর্তিতে মেতে উঠতে। তাদের অনেকে তা-ই করছে। তারা হারিয়েযাচ্ছে পণ্যের ঢলে, ফূর্তির আহ্লাদে থাকতে চাইছে সমাজের জীবন থেকে দূরে। তাদের আর কোনো দায়নেই। এই অবকাশে জাতির ভাগ্য ঠিক করে দেবে মুষ্টিমেয় বিশেষজ্ঞ আর হাতে গোনা কয়েকজন নেতা। ওদিকে যারা খেটে খাওয়ার, তারা খাটতেই থাকবে। বাকিরা অফুরান অবসরে প্রেম করবে, নতুন পোশাক পরবে, ভিডিও গেম বা পুল খেলবে—জিমে গিয়ে ফিগার বানাবে, লাবণ্য বাড়াতে রূপটান লাগাবে। সুন্দর লাগবে দেখতে। তার মনমর্জি গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে টেলিভিশন আর বিজ্ঞাপন। এভাবে স্বপ্নহীন করে দিয়ে এদের শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। সেই শূন্য হাতে নতুন মডেলের মুঠোফোন বা বন্দুক-রামদা-চাপাতি যা-ই তুলে দেওয়া হোক, তারা শান্তি পাবে না, লাগামে বাঁধা অবস্থায় চড়কির মতো ঘুরবে। অথচ একসময় জাতীয় পতাকা আর আশার মশাল তরুণদের হাতেই ধরা ছিল।
এখন অস্ত্র দিয়ে যেমন রাজনীতি চিনতে হচ্ছে, তেমনি মেকি ও আত্মকেন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষা দিয়েও চেনা যাচ্ছে আমাদের সময়ের নায়ক-নায়িকাদের।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
তাহলে নৌকা, ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লা বা লাঙ্গল মার্কার কী হবে? এগুলো দেখেই তো আগে দল চেনা যেত; ব্যালট পেপারে তো আর রামদা-কাটা রাইফেল-ক্ষুরের ছবি থাকে না? কে না জানে বিজ্ঞাপন আর বাস্তবের মধ্যে মেঘ আর মাটির তফাৎ। একটা কৌতুক মনে পড়ে। মৃত্যুর পর এক লোকের পাপ আর পুণ্য পরিমাপে দেখা গেল দুটোই কাঁটায় কাঁটায় সমান। ঈশ্বর ভাবলেন, এ তো মহামুসিবত। একে কোথায় ফেলা যায় স্বর্গে না নরকে? একটা বুদ্ধি বের হলো। প্রহরীদের সঙ্গে লোকটাকে দিয়ে বলে দিলেন, তোমার ব্যক্তিস্বাধীনতা আমি সম্মান করি, তাই চোখে দেখে নিজেই ঠিক করো কোথায় থাকবে। প্রহরীরা প্রথমে তাকে এক অনিন্দ্যসুন্দর উদ্যানে নিয়ে গেল। দুনিয়ার যত নায়ক-নায়িকা, খ্যাতিমান-ধনবান সবাই সেখানে শুয়ে-বসে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আনন্দের ফোয়ারা ছুটছে। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো আরেকটি জায়গায়। সেখানে দুনিয়ার গরিব-দুঃখী, নির্যাতিত ও দুস্থ লোকেরা নানান কাজ-কারবার করে খেটে খাচ্ছে। আর দেখার দরকার হলো না। লোকটি সাফ জানিয়ে দিল, সে প্রথম জায়গাটিতেই থাকতে চায়। ঈশ্বর মুচকি হাসলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রহরীরা তাকে সাঁড়াশিতে আটকে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে ফেলল। হতভম্ব লোকটি চিৎকার করে, আরে! আমি তো এটা চাইনি!!! প্রহরী হেসে উত্তর দেয়, আরে গর্দভ, ওটা তো ছিল বিজ্ঞাপন! দিনবদলের প্রতিশ্রুতিও ছিল তেমন বিজ্ঞাপন। আর বাস্তব তো প্রতিদিন সশস্ত্র চেহারায় দেখা দিচ্ছে। সন্ত্রাসের তোড়ে জনজীবনের আর কোনো সমস্যার দিকে তাকানোরও সময় মিলছে না।
শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ‘ছিল একটা বেড়াল হয়ে গেল রুমাল’। এভাবেই ছাত্রদলের সোনার ছেলেদের আমরা সোনালি সন্ত্রাস চালাতে দেখেছি। আঙুল ফুলে কলাগাছ আর বিদ্যুতের খুঁটি পুঁতে মহারাজও হয়েছেন কেউ কেউ। কেউ কিছু বললে বলা হতো সবই ‘ষড়যন্ত্র’। সুকুমার রায় থাকলে বলতেন, ‘দ্রুম-দ্রাম দ্রিদিম-দ্রিদিম, কানে লাগে খটকা/ ফুল ফোটে তাই বল, আমি ভাবি পটকা’। আমাদের মনে রাগ-ক্ষোভ কিংবা ষড় বা অষ্টযন্ত্র যা-ই থাকুক, ছাত্রলীগের রামদার কোপানিগুলোকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ম্যানুয়াল হাতিয়ারই ভাবতে হবে।
মনে হয়, দুই প্রধান নেত্রী এই সশস্ত্র তরুণদেরই তাঁদের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির খুঁটি মনে করেন। অথচ জরুরি অবস্থার সময় তাঁরা যখন বন্দী ছিলেন, তখন এদের কাউকেই নিজ নিজ নেত্রীর জন্য সামান্য ত্যাগ স্বীকার করতে দেখা যায়নি। তখন যারা গর্তে লুকিয়েছিল, আজ তারা পিলপিল করে বেরিয়ে এসে পরস্পরকে কাটছে, বুক ফুটো করে দিচ্ছে—কেবলই অর্থ আর ক্ষমতার লোভে। অন্যদিকে গ্রাম-শহরের যে নিরীহ তরুণদের ভোট আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করেছিল, মনে হচ্ছে তারা পরিত্যক্ত। সেই দরিদ্র ও শ্রমজীবী তরুণ, সেসব শহুরে শিক্ষিত জীবনসংগ্রামী তরুণ, সুন্দর-সমৃদ্ধ দেশ চাওয়া সেসব লাখ লাখ তরুণের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য নেই, ক্ষমতার দুধ-মধু খেয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী তরুণেরা আর তাদের নেতা ও গডফাদাররা।
আমাদের সময়ের নায়ক-নায়িকা
আজকের তরুণের স্বপ্ন নেই, দুঃস্বপ্ন আছে। রাজনীতি তাকে ক্ষমতার বশ করেছে। আর বাজার তাকে করেছে টাকার কাঙাল। বিনোদন-সংস্কৃতি তথা মুঠোফোন-টেলিভিশন-ইন্টারনেট তাকে টানছে চটকদার জীবনে। চারদিকে ভোগ আর বিত্তের হাতছানি। সবার ভাগ্যে কল্পনার মেওয়া জোটে না, কিন্তু অনেকেই ভাবে সেও একদিন ফ্যাশনের মডেলের মতো, নাটকের নায়ক-নায়িকার মতো, বিজ্ঞাপনে দামি গাড়ি হাঁকানো হিরোর মতো জীবন পাবে। এত সব ভোগের টোপে তার চিন্তা অসাড়। হিংসা আর প্রতিষ্ঠার ইঁদুর-দৌড়ে সে থতমত। তার মাথা নেই চিন্তা করার, হাত নেই ধরার, পা নেই চলার, চোখ নেই দেখার। কিংবা আছে, কিন্তু সেগুলো যা দেখার তা দেখে না, যা শোনার তা শোনে না, যা বলার তা বলে না। তার প্রতিটি অঙ্গেই পণ্যের বাহার। যতই সে পণ্যে ভরে দেহ ততই তার মন শূন্য হয় যায়। নিজের গুণে নয়, পণ্যের গুণে সে বড় হতে চায়। এর সঙ্গে সেই তরুণের কী ফারাক, যে নিজের যোগ্যতায় নয়, দলীয় দম্ভে বেপরোয়া হয়ে যায়? ভোগের মরিয়া বাসনা আর ক্ষমতার জন্য নিষ্ঠুরতা কি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ নয়? এই ভোগবাসনা পুরুষালি এই সন্ত্রাসও ব্যাটাগিরি। এ দুইয়ের সাঁড়াশি চাপে সামাজিক নিরাপত্তা এবং বিশেষ করে নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা বিপন্ন।
অনেক কাল আগে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে’। সত্যিই যেন বিজ্ঞাপনের ভিড়ে আর পণ্যের লোগোয় ঢাকা পড়া আজকের তরুণ-তরুণীর স্বাভাবিক মুখ আর দেখা যায় না। এবং এরাই আমাদের সময়ের নায়ক-নায়িকা। অথচ দেশে বা প্রবাসে যে কয়েক কোটি তরুণ শ্রম দিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখছে, উৎপাদন করছে, সন্ত্রাসের বাহাদুরি বা বাসনাবিলাসের সুযোগ যাদের কম, তারা উপেক্ষিত। যে লুঙ্গি পরা যুবকটি ঢাকার পাসপোর্ট অফিসে লাইন দিয়ে বা দালাল বা এজেন্টদের মাধ্যমে শ্রম বিক্রি করতে বিদেশ যাচ্ছে, অথবা যে ১৫-২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরা পোশাক কারখানায় দিন-রাত খেটে যাচ্ছে, এদের শ্রম আর বঞ্চনার দামেই কিন্তু আমাদের বিত্তবানদের ছেলেমেয়েদের শানশওকত আর আমোদ-উল্লাস চলতে পারছে। প্রবাসী শ্রমিক আর গার্মেন্ট শ্রমিকদের শ্রমে অর্জিত ডলার দিয়েই বিদেশি মোবাইল কোম্পানির মুনাফা শোধ হচ্ছে, দামি বিদেশি পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। অথচ জাতীয় সংস্কৃতিতে, মিডিয়া আর বিজ্ঞাপনের বানানো রূপকথায়, কিংবা সরকারি নীতিতে ওইসব উৎপাদক তারুণ্যের কথা কম। তারা হিরো নয়, জমজমাট রাজনীতি আর রং-রসে ভরপুর ভোগমেলায় পার্শ্বচরিত্র মাত্র।
রোম প্রতিষ্ঠা করেছিল তরুণ দুই ভাই। এক তরুণ কৃষ্ণ আর এক তরুণী রাধা হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসার ধন। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি চিরকালের জন্য তারুণ্যের আদলেই আঁকা হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের সময় তরুণকে হত্যা করে, সন্ত্রাসী বানায়; তার মনকে মোহগ্রস্ত করে অমানবিক প্রতিষ্ঠার কাঙাল বানায়। তারুণ্য আজ বাজারের খোরাক, রাজনীতির বলি।
‘হারিয়েযাও’, ‘মেতে ওঠো’
তরুণদের ছুটি দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের দায় থেকে, সমাজ পাল্টানোর কর্তব্য থেকে। বিজ্ঞাপনের ভাষা তাদের বলছে ‘হারিয়েযেতে’, লোকালয়থেকে দূরে ফূর্তিতে মেতে উঠতে। তাদের অনেকে তা-ই করছে। তারা হারিয়েযাচ্ছে পণ্যের ঢলে, ফূর্তির আহ্লাদে থাকতে চাইছে সমাজের জীবন থেকে দূরে। তাদের আর কোনো দায়নেই। এই অবকাশে জাতির ভাগ্য ঠিক করে দেবে মুষ্টিমেয় বিশেষজ্ঞ আর হাতে গোনা কয়েকজন নেতা। ওদিকে যারা খেটে খাওয়ার, তারা খাটতেই থাকবে। বাকিরা অফুরান অবসরে প্রেম করবে, নতুন পোশাক পরবে, ভিডিও গেম বা পুল খেলবে—জিমে গিয়ে ফিগার বানাবে, লাবণ্য বাড়াতে রূপটান লাগাবে। সুন্দর লাগবে দেখতে। তার মনমর্জি গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে টেলিভিশন আর বিজ্ঞাপন। এভাবে স্বপ্নহীন করে দিয়ে এদের শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। সেই শূন্য হাতে নতুন মডেলের মুঠোফোন বা বন্দুক-রামদা-চাপাতি যা-ই তুলে দেওয়া হোক, তারা শান্তি পাবে না, লাগামে বাঁধা অবস্থায় চড়কির মতো ঘুরবে। অথচ একসময় জাতীয় পতাকা আর আশার মশাল তরুণদের হাতেই ধরা ছিল।
এখন অস্ত্র দিয়ে যেমন রাজনীতি চিনতে হচ্ছে, তেমনি মেকি ও আত্মকেন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষা দিয়েও চেনা যাচ্ছে আমাদের সময়ের নায়ক-নায়িকাদের।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments