সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন: বাধা কোথায় -আমার ভাষা আমার একুশ by সৌরভ সিকদা
একসময় স্লোগান উঠেছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে আমরা শুধু রাষ্ট্রভাষা বাংলাই পাইনি, বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য পৃথিবী নামের গ্রহে ‘বাংলাদেশ’ নামে মানচিত্রও পেয়েছি আমরা। এরপর পার হয়েছে প্রায় চার দশক। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে—‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ (১ম ভাগ, অনুচ্ছেদ-৩)। এ দেশের ৯৫ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা। তার পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। রাষ্ট্রীয় আইন করেও সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর প্রথম ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সরকারি আদেশে বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে।...এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেওয়া যেতে পারে না। এ আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধাসরকারি অফিসসমূহে কেবল বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এ বিষয়ে কোনো অন্যথা হলে ওই বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’ এরপর তিন যুগ চলে গেল, এখনো সরকারি কাজে শতভাগ বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। যদিও বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া সর্বত্র বাংলায় চিঠিপত্র ও নোট আদান-প্রদান চলছে। এ প্রসঙ্গে আরও একটি সরকারি আদেশের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। ১৯৭৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদের যে সভা অনুষ্ঠিত হয় বাংলা ব্যাপকতর ব্যবহারের উদ্দেশে, সেই সভায় সর্বস্তরে বাংলা প্রয়োগের সিদ্ধান্তটি ইংরেজিতে লেখা হয়। কাজেই এ থেকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আন্তরিকতার স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়।
সরকারি কাজকর্মে বাংলা ভাষার ব্যবহার আশানুরূপ হলেও পরিভাষাগত কিছু সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নামকরণ এখনো ইংরেজিতে—ডিআইটি যদি রাজউক, রেডিও যদি বেতার হতে পারে, তবে টিসিবি, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন, ঢাকা সিটি করপোরেশন, বিপিসি, এগুলো কেন বাংলায় করা যায় না? আসলে মানসিকতার সমস্যা। সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগ নিলে অবশ্যই সম্ভব।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, ‘সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের সিদ্ধান্ত দীর্ঘকাল আগে নেওয়া হয়েছে এবং অনেক স্তরে বাংলা এখন ব্যবহূত হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে একমাত্র বাংলাই প্রয়োগ হবে, এটা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অন্য স্তরেও বাংলা ব্যবহূত হচ্ছে। তবে যেসব ক্ষেত্রে জনসাধারণের সম্পৃক্তি খুব ঘনিষ্ঠ যেমন চিকিত্সা ব্যবস্থাপত্র, আইন, দোকানপাটের নামফলক, ব্যাংকের কাগজ প্রভৃতি, সেখানে বাংলা হওয়া জরুরি। সরকারি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে বাংলা প্রচলন হচ্ছে, পরিভাষার সমস্যা এখন নেই বললেই চলে। তবে বাংলার প্রচলন আরও ভালো করার ক্ষেত্রে আন্তরিক সদিচ্ছা থাকা দরকার সবার। এটি থাকলে যা কিছু ঘাটতি রয়েছে, তা সহজেই পূর্ণ হবে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যাম বেতার-টিভি যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারত, তা করছে না। আশা করব, তারা এ বিষয়ে মনোযোগী হবে।’
এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ ইংরেজি জানে না। অথচ কোনো চিকিত্সক বাংলায় ব্যবস্থাপত্র লিখেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এমনকি ইংরেজিতে সব ওষুধের নাম। এমন একটা অতি প্রয়োজনীয় এবং সাধারণ মানুষ-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ কবে হবে? বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন—‘স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলা প্রচলনে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। ছাত্ররা ভেবেছিল বাংলা শিখলে চাকরির রুদ্ধদ্বার খুলবে। নিম্নপদস্থ ব্যক্তিরা ভেবেছিলেন যুক্তাক্ষরগুলোকে বশ করতে পারলে উন্নতি হবে; পাওয়া যাবে সামাজিক অর্থনৈতিক স্বীকৃতি। তাই বাংলা শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল চতুর্দিকে। কিন্তু পঁচাত্তরের পর স্রোত বিপরীতমুখী হয়ে ওঠে—উগ্র হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীলতা—বাংলাদেশ বেতার, চালনা বন্দর, পৌরসভা, রাষ্ট্রপতি প্রভৃতি রেডিও বাংলাদেশ, পোর্ট অব চালনা, মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন, প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠতে থাকে। বাংলার মর্যাদা হ্রাস পায়, তার অর্থমূল্য ক্রমেই কমতে থাকে। এবং উত্সাহীরাও পুনরায় ইংরেজিমুখী হয়ে ওঠেন। এই অকারণ ইংরেজি উত্সাহীরা ক্রমেই বাড়ছে, তাদের ইংরেজির মান বাড়ছে না।’
১৮৭২ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন—‘লেখাপড়ার কথা দূরে থাক, এখন নব্য সমপ্রদায়ের মধ্যে কোনো কাজই বাংলায় হয় না...ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। ইংরেজি এক রাজভাষা তাহাতে অর্থ উপার্জনের ভাষা।’ বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার দেড় শ বছর পর আজ ইংরেজ রাজা নেই কিন্তু ঔপনিবেশিক দাসত্ববোধের দায় রয়ে গেছে। আর তথ্যপ্রযুক্তি-বহুজাতিক বাণিজ্য কোম্পানির লোভনীয় চাকরিতে অধিক উপার্জনের আকাঙ্ক্ষায় একালেও অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তি ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। শুদ্ধ করে মায়ের ভাষা জানার চেয়ে বিশ্বায়নের বিশ্বগ্রাসী ইংরেজি ভাষার উচ্চারণভঙ্গি আয়ত্ত করার প্রতি আগ্রহ বেশি। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেতে উঠেছে তড়িত্ গণমাধ্যমগুলো। তাই জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা তো পায়নি বরং পত্রিকার পাতায় আফসোসের বিজ্ঞাপন পড়ি, ‘ইংরেজিটা আরেকটু ভালো জানলে বেশি উপার্জন করতে পারতাম।’ দেশের রাষ্ট্রভাষা এবং জাতীয় ভাষা বাংলা, অথচ সেই দেশের রাস্তা বা সড়ক দিয়ে আপনি হাঁটতে পারবেন না। আপনাকে রোড অথবা এভিনিউ দিয়ে যেতে হবে। সড়কের পাশে আপনি কোনো ‘দোকান’ পাবেন না, ‘শপ’ বা ‘শপিং সেন্টার’ পাবেন অনেক। দোকানপাট, অফিস-আদালতের নামফলকে রোমান হরফের বাড়াবাড়ি দেখে ভুল হতে পারে, এটা লন্ডন বা নিউইয়র্কের কোনো স্ট্রিট, বাংলাদেশের সড়ক নয়। এ দেশের ৯৮ ভাগ মানুষ বাংলা বলে ও বোঝে, অথচ তারা দেশে উত্পাদিত এমন অনেক পণ্য ব্যবহার করে সেগুলোর অধিকাংশের নামকরণ ইংরেজিতে, শুধু আলুভর্তা আর ডালভাত ছাড়া আর সবই ইংরেজিতে খাই। অথচ এসব পণ্য উত্পাদিত হয় বাংলাদেশেই। শুধু কি খাবার? আপনি চুল-দাড়ি কাটাতে গেলে নরসুন্দর খুঁজে পাবেন না, হেয়ার ড্রেসার অথবা সেলুনে যেতে হবে। জায়গা কিনবেন, মডেল টাউন কিংবা রিভারভিউ খুঁজতে হবে। পড়তে যাবেন, ৯০ ভাগ বেসরকারি বিদ্যালয়ের নামকরণ ইংরেজিতে, ৯৫ ভাগ কলেজের নাম ইংরেজিতে, আর প্রায় ১০০ ভাগ ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইংরেজিতে এবং বিশুদ্ধ রোমান হরফে লেখা। আমাদের প্রিয় দুঃখিনী বর্ণমালার কোনো চিহ্নই সেখানে নেই। এমনকি আমাদের পেশার ক্ষেত্রে থেকেও বাংলা বিতাড়িত—অ্যাডভোকেট, মার্কেটিং ম্যানেজার, ট্রাফিক, টিচার, ওয়েটার, নাইটগার্ড, কোস্টগার্ড, বাসড্রাইভার, স্ক্রিপ্ট রাইটার—সবই ইংরেজি। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এবং তাদের অনুষ্ঠানের নামকরণের দিকে তাকাই—টক শো, মিউজিক শো, মেগাসিরিয়াল, নিউজ আপডেট, হেলথ লাইন কি ইংরেজি ছাড়া? এই হচ্ছে স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের অবস্থা।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সরকারি কাজকর্মে বাংলা ভাষার ব্যবহার আশানুরূপ হলেও পরিভাষাগত কিছু সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নামকরণ এখনো ইংরেজিতে—ডিআইটি যদি রাজউক, রেডিও যদি বেতার হতে পারে, তবে টিসিবি, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন, ঢাকা সিটি করপোরেশন, বিপিসি, এগুলো কেন বাংলায় করা যায় না? আসলে মানসিকতার সমস্যা। সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগ নিলে অবশ্যই সম্ভব।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, ‘সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের সিদ্ধান্ত দীর্ঘকাল আগে নেওয়া হয়েছে এবং অনেক স্তরে বাংলা এখন ব্যবহূত হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে একমাত্র বাংলাই প্রয়োগ হবে, এটা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অন্য স্তরেও বাংলা ব্যবহূত হচ্ছে। তবে যেসব ক্ষেত্রে জনসাধারণের সম্পৃক্তি খুব ঘনিষ্ঠ যেমন চিকিত্সা ব্যবস্থাপত্র, আইন, দোকানপাটের নামফলক, ব্যাংকের কাগজ প্রভৃতি, সেখানে বাংলা হওয়া জরুরি। সরকারি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে বাংলা প্রচলন হচ্ছে, পরিভাষার সমস্যা এখন নেই বললেই চলে। তবে বাংলার প্রচলন আরও ভালো করার ক্ষেত্রে আন্তরিক সদিচ্ছা থাকা দরকার সবার। এটি থাকলে যা কিছু ঘাটতি রয়েছে, তা সহজেই পূর্ণ হবে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যাম বেতার-টিভি যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারত, তা করছে না। আশা করব, তারা এ বিষয়ে মনোযোগী হবে।’
এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ ইংরেজি জানে না। অথচ কোনো চিকিত্সক বাংলায় ব্যবস্থাপত্র লিখেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এমনকি ইংরেজিতে সব ওষুধের নাম। এমন একটা অতি প্রয়োজনীয় এবং সাধারণ মানুষ-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ কবে হবে? বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন—‘স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলা প্রচলনে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। ছাত্ররা ভেবেছিল বাংলা শিখলে চাকরির রুদ্ধদ্বার খুলবে। নিম্নপদস্থ ব্যক্তিরা ভেবেছিলেন যুক্তাক্ষরগুলোকে বশ করতে পারলে উন্নতি হবে; পাওয়া যাবে সামাজিক অর্থনৈতিক স্বীকৃতি। তাই বাংলা শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল চতুর্দিকে। কিন্তু পঁচাত্তরের পর স্রোত বিপরীতমুখী হয়ে ওঠে—উগ্র হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীলতা—বাংলাদেশ বেতার, চালনা বন্দর, পৌরসভা, রাষ্ট্রপতি প্রভৃতি রেডিও বাংলাদেশ, পোর্ট অব চালনা, মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন, প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠতে থাকে। বাংলার মর্যাদা হ্রাস পায়, তার অর্থমূল্য ক্রমেই কমতে থাকে। এবং উত্সাহীরাও পুনরায় ইংরেজিমুখী হয়ে ওঠেন। এই অকারণ ইংরেজি উত্সাহীরা ক্রমেই বাড়ছে, তাদের ইংরেজির মান বাড়ছে না।’
১৮৭২ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন—‘লেখাপড়ার কথা দূরে থাক, এখন নব্য সমপ্রদায়ের মধ্যে কোনো কাজই বাংলায় হয় না...ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। ইংরেজি এক রাজভাষা তাহাতে অর্থ উপার্জনের ভাষা।’ বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার দেড় শ বছর পর আজ ইংরেজ রাজা নেই কিন্তু ঔপনিবেশিক দাসত্ববোধের দায় রয়ে গেছে। আর তথ্যপ্রযুক্তি-বহুজাতিক বাণিজ্য কোম্পানির লোভনীয় চাকরিতে অধিক উপার্জনের আকাঙ্ক্ষায় একালেও অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তি ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। শুদ্ধ করে মায়ের ভাষা জানার চেয়ে বিশ্বায়নের বিশ্বগ্রাসী ইংরেজি ভাষার উচ্চারণভঙ্গি আয়ত্ত করার প্রতি আগ্রহ বেশি। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেতে উঠেছে তড়িত্ গণমাধ্যমগুলো। তাই জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা তো পায়নি বরং পত্রিকার পাতায় আফসোসের বিজ্ঞাপন পড়ি, ‘ইংরেজিটা আরেকটু ভালো জানলে বেশি উপার্জন করতে পারতাম।’ দেশের রাষ্ট্রভাষা এবং জাতীয় ভাষা বাংলা, অথচ সেই দেশের রাস্তা বা সড়ক দিয়ে আপনি হাঁটতে পারবেন না। আপনাকে রোড অথবা এভিনিউ দিয়ে যেতে হবে। সড়কের পাশে আপনি কোনো ‘দোকান’ পাবেন না, ‘শপ’ বা ‘শপিং সেন্টার’ পাবেন অনেক। দোকানপাট, অফিস-আদালতের নামফলকে রোমান হরফের বাড়াবাড়ি দেখে ভুল হতে পারে, এটা লন্ডন বা নিউইয়র্কের কোনো স্ট্রিট, বাংলাদেশের সড়ক নয়। এ দেশের ৯৮ ভাগ মানুষ বাংলা বলে ও বোঝে, অথচ তারা দেশে উত্পাদিত এমন অনেক পণ্য ব্যবহার করে সেগুলোর অধিকাংশের নামকরণ ইংরেজিতে, শুধু আলুভর্তা আর ডালভাত ছাড়া আর সবই ইংরেজিতে খাই। অথচ এসব পণ্য উত্পাদিত হয় বাংলাদেশেই। শুধু কি খাবার? আপনি চুল-দাড়ি কাটাতে গেলে নরসুন্দর খুঁজে পাবেন না, হেয়ার ড্রেসার অথবা সেলুনে যেতে হবে। জায়গা কিনবেন, মডেল টাউন কিংবা রিভারভিউ খুঁজতে হবে। পড়তে যাবেন, ৯০ ভাগ বেসরকারি বিদ্যালয়ের নামকরণ ইংরেজিতে, ৯৫ ভাগ কলেজের নাম ইংরেজিতে, আর প্রায় ১০০ ভাগ ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইংরেজিতে এবং বিশুদ্ধ রোমান হরফে লেখা। আমাদের প্রিয় দুঃখিনী বর্ণমালার কোনো চিহ্নই সেখানে নেই। এমনকি আমাদের পেশার ক্ষেত্রে থেকেও বাংলা বিতাড়িত—অ্যাডভোকেট, মার্কেটিং ম্যানেজার, ট্রাফিক, টিচার, ওয়েটার, নাইটগার্ড, কোস্টগার্ড, বাসড্রাইভার, স্ক্রিপ্ট রাইটার—সবই ইংরেজি। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এবং তাদের অনুষ্ঠানের নামকরণের দিকে তাকাই—টক শো, মিউজিক শো, মেগাসিরিয়াল, নিউজ আপডেট, হেলথ লাইন কি ইংরেজি ছাড়া? এই হচ্ছে স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের অবস্থা।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments