কিছু আইনগত প্রশ্ন -রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম by আকবর আলি খান
ব্রিটিশ শাসনামলে একটি কৌতুক প্রচলিত ছিল, পদমর্যাদাক্রমের সনদে (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) সাহেবদের চেয়ে মেমসাহেবদের আগ্রহ বেশি এবং মেমসাহেবদের চেয়ে ধোপাদের আগ্রহ বেশি। সরকারি আচার-অনুষ্ঠানে সাহেবদের ঠিকমতো না বসালে তাঁরা ঠিকই মনঃক্ষুণ্ন হতেন, কিন্তু মুখে কিছু বলতেন না। মেমসাহেবেরা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতেন। কারণ পতির পদমর্যাদায় তাঁদের মর্যাদা। ধোপাদের পদমর্যাদার সংকট অবশ্য সারা দেশে দেখা যায়নি, দেখা গিয়েছে শৈল শহর সিমলায়। গ্রীষ্মের সময়ে বড়লাট বাহাদুর তাঁর পর্ষদবর্গ ও সেনাপতিদের নিয়ে সিমলায় অবস্থান করতেন। সিমলায় কাপড় ধোয়ার ঘাট ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। অথচ তখনকার দিনে সব বড় সাহেবের নিজস্ব ধোপা থাকত। ঘাটের অভাবে কে আগে কাপড় ধোবে, কে পরে কাপড় পরিষ্কার করবে তা নিয়ে ধোপাদের পদমর্যাদার প্রশ্ন ওঠে। এই প্রশ্নের নিরসন করতে গিয়ে আরও প্রশ্ন ওঠে, কোন কোন ধোপা পাহাড়ের উপরের ঘাট ব্যবহার করবে আর কোন ধোপা পাহাড়ের নিচের ঘাটে কাজ করবে। এ নিয়ে গভর্নর জেনারেলের ধোপা আর প্রধান ব্রিটিশ সেনাপতির ধোপার মধ্যে ঝগড়া নিরসন করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।
ব্রিটিশ শাসনামলে তিনটি কারণে পদমর্যাদাক্রম বা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারি মহলে বাইবেলে পরিণত হয়। প্রথমত, ভারতে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে বর্ণবাদব্যবস্থা, যেখানে শূদ্রদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের সামাজিক মেলামেশা নিষিদ্ধ। প্রচ্ছন্ন ব্রিটিশ বর্ণবাদ ভারতের সনাতন বর্ণবাদকে আত্মস্থ করে। দ্বিতীয়ত, মোগল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় শানশওকতের সঙ্গে আমির-ওমরাদের পদমর্যাদাক্রম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। তৃতীয়ত, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই পদমর্যাদার টোপ ফেলে দেশীয় রাজ্যের শাসকদের মধ্যে আনুগত্যের প্রতিযোগিতার সূচনা করে। এসবের ফলে পদমর্যাদা-সংবলিত লাল বই বা নীল বই ব্রিটিশ ভারতের শাসনব্যবস্থায় অপরিহার্য ছিল।
৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে মিজানুর রহমান খানের ‘রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম নিয়ে বিতর্ক’ প্রবন্ধটি পড়ে আমার মনে হলো যে আমরা ব্রিটিশ শাসনামলে ফিরে গেছি। ব্রিটিশ শাসনামলেও পদমর্যাদাক্রম নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। বিতর্ক ছিল প্রধানত সামরিক বনাম অসামরিক মানমর্যাদা নিয়ে এবং সব কর্মকর্তার সঙ্গে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের পদমর্যাদাক্রম নিয়ে। এই ব্যবস্থায় ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, তাঁরা যত ধনী হোন না কেন, তাঁদের কোনো পদমর্যাদা ছিল না। তাঁদের বলা হতো, বক্সওয়ালা বা বাক্সওয়ালা। সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসামরিক কর্মকর্তাদের পদমর্যাদার খিটিমিটি লেগেই থাকত। অসামরিক কর্মকর্তারা মনে করতেন, অর্ধশিক্ষিত ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা যাঁরা এ দেশে স্বল্পকাল থাকতেন এবং এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে যাঁদের কোনো ধারণা ছিল না, শিক্ষাদীক্ষার মাপকাঠিতে তাঁদের স্থান নিচে আর তাই তাঁদের পদমর্যাদা নিচু হওয়া উচিত। এর ফলে সামরিক কর্মকর্তারাও প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে পদমর্যাদা নিয়ে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে কোনো বড় দ্বন্দ্ব দেখা দেয়নি। আর একটি কারণ ছিল আইসিএস বা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ দুই বিভাগেই কাজ করতেন। তাই তাঁরা বিচার বিভাগের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতেন। মিজানুর রহমান খান পদমর্যাদাক্রম নিয়ে যে বিতর্কের কথা লিখেছেন সেই বিতর্ক মূলত বিচার বিভাগের সঙ্গে অসামরিক নির্বাহী ও সামরিক বিভাগের মর্যাদা নিয়ে। ব্রিটিশ আমলের লড়াই থেকে এটি ভিন্ন।
মিজানুর রহমান খানের সুলিখিত ও বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধটি আমি পড়েছি। তিনি একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তিনি এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন—‘আকবর আলি খান তাকে শুধুই দাওয়াত দেওয়ার বিষয় হিসেবে দেখেছেন। বলেছেন, এর উদ্দেশ্য ও কোথায় কী কাজে ব্যবহার হবে তার কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু তা সঠিক নয়। বিধিতেই বলা আছে, রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষসহ সব ধরনের সরকারি উদ্দেশ্যে প্রিসিডেন্সের ব্যবহার হবে।’
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের যে সূত্রটি টেনে মিজানুর রহমান খান বলতে চাইছেন যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স শুধু আনুষ্ঠানিকতার বিষয় নয়, সেই সূত্রটি হলো ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের এক নম্বর পাদটীকা। এই পাদটীকায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি সব রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ এবং সরকারের সকল উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহূত হবে।’ আমার প্রশ্ন হলো, ‘সরকারের সকল উদ্দেশ্যে’ বাক্যাংশের অর্থ কী? ওই বাক্যাংশ ১৯৮৮ সালে যোগ করা হয়। আমি মনে করি, বাক্যাংশটির প্রেষিত বা content বিবেচনায় নিতে হবে। এই বাক্যাংশ ‘রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ’-এর পরে যোগ করা হয়েছে। সুতরাং এই ক্ষেত্রে ‘সরকারের সকল উদ্দেশ্য’ বাক্যাংশটি রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষের মধ্যে সীমিত। যদি দাবি করা হয় যে এটি অনুষ্ঠানের বাইরে সব সরকারি কাজে ব্যবহূত হবে, তবে তার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বলি—ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, কোনো আইনগত ভিত্তিও নেই। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র একই অবস্থা। যদিও এর কোনো আইনগত বা সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, তবু পৃথিবীর অনেক দেশে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স রয়েছে। কিন্তু সেখানে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া থাকে, এর কোনো আইনগত মর্যাদা নেই। ভারতের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে তাই বলা হয়েছে, এই মানক্রম শুধু রাষ্ট্রীয় এবং আনুষ্ঠানিক উপলক্ষে ব্যবহূত হবে এবং সরকারের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপে এর কোনো প্রয়োগ হবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ডার অব প্রিসিডেন্সে স্পষ্ট বলা আছে, এটি আনুষ্ঠানিক প্রোটোকল বা রাষ্ট্রাচারের জন্য ব্যবহূত হয়, এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে যে সমমর্যাদা সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে, তাও কোনোভাবে বিঘ্নিত হবে না। আমরা যদি এই যুক্তি ধরে নিই, বাংলাদেশের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সব রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহূত হবে এবং শুধু রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষে ব্যবহূত হবে না, তাহলে পরিপত্রটি সম্পূর্ণ বেআইনি। কার স্থান কোথায় হবে এটি আইনগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সব উদ্দেশ্যের জন্য ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স জারি করতে পারেন কি না? সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে এ ক্ষমতা দেয়নি। কোনো আইনও রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেয়নি। অথচ, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সৃষ্টি করে দেশের মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যদি ধরে নিই, সরকারের সব কাজে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স প্রযোজ্য—সাধারণ নাগরিক ও ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে উল্লিখিত ব্যক্তিদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ যদি দাবি করে, সরকারের সব উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য এটি একটি আইনসম্মত মানক্রম, তাহলে একে অবিলম্বে বেআইনি ঘোষণা করা উচিত। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের দাবি রাষ্ট্রপক্ষ করেনি। এ ধরনের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সাধারণ নাগরিকের মানমর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বাংলাদেশে কী হবে জানি না, তবে পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে সরকারি অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো কাজে সরকারের সব উদ্দেশ্যে এই ওয়ারেন্টের ব্যবহার গ্রহণযোগ্য হবে না।
মিজানুর রহমান খানের মতো যেসব আইনজ্ঞ এটি রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষের জন্য আইনের ভিত্তি ছাড়া একটি নির্বাহী আদেশ গণ্য না করে এটিকে আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ও সরকারের সব উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য হিসেবে বৈধতা দিতে চান তাঁদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিয়ে একটু চিন্তা করতে অনুরোধ করি:
১. বর্তমান ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। আদালতের নির্দেশে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করা হলে, এটি আইনগত মর্যাদা পাবে। ওয়ারেন্টের অন্তর্গত ও ওয়ারেন্ট-বহির্ভূত নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য রচিত হবে এবং এই বৈষম্যকেই আইনগতভাবে বৈধ করা হবে। কাজেই, সরকারের সব উদ্দেশ্যে ব্যবহূত এই বাক্যাংশসহ ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স আদালতের মাধ্যমে সংশোধিত হওয়া হবে দুর্ভাগ্যজনক। আর আদালত যদি বাক্যাংশটি বেআইনি ঘোষণা করেন, তাহলে এই ওয়ারেন্ট শুধু অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
২. আদালত কর্তৃক ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স গৃহীত হলে আইনগতভাবে বিচার বিভাগের জন্য তা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। আদালত কর্তৃক স্বীকৃত মানক্রমে প্রধানমন্ত্রীর নিচে প্রধান বিচারপতির অবস্থান। আমার ব্যাখ্যা হলো—এটি শুধু অনুষ্ঠানের জন্য করা হয়েছে এবং ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারের সব কাজের জন্য প্রযোজ্য নয়। যদি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারের সব কাজে ব্যবহারযোগ্য বলে স্বীকৃত হয় এবং আদালত যদি স্বীকার করে নেন, প্রধান বিচারপতির মানক্রম প্রধানমন্ত্রীর নিচে, তাহলে তর্কশাস্ত্রের সূত্র অনুসারে প্রধান বিচারপতি সরকারের সব কাজে প্রধানমন্ত্রীর অধীন হয়ে যান। এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না হয়, সে জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্ডার অব প্রিসিডেন্সে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এর কোনো আইনি মর্যাদা নেই এবং এই মানক্রম রাষ্ট্রে প্রধান তিনটি অঙ্গের ক্ষমতা কোনোরূপ বিঘ্নিত করবে না।
৩. আইনের ভিত্তিতে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অধস্তন বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আদেশ দেওয়া হয়, প্রধানমন্ত্রীর নিচে যেসব মানকর্মচারী-কর্মকর্তা রয়েছেন, তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে, তাহলে কোন যুক্তিতে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা এই দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করবেন?
৪. ধরা যাক, আদালত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সম্পর্কে এমন এক আদেশ দিলেন যা সরকারের মনঃপূত হলো না, সরকার যদি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তুলে দেয়, তাহলে আদালত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারকে জারি করতে বাধ্য করতে পারেন কি না? অর্থাত্, ধরা যাক যেসব পদ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, সেসব পদ অর্থাত্ এর নিচে যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন, তাঁদের বাদ দিলে বর্তমান সংকটের নিরসন হবে কি? বিষয়টিতে আদালতের এখতিয়ার কতটুকু তা চিন্তা করার প্রয়োজন আছে।
৫. আদালত কর্তৃক সংশোধিত ও অনুমোদিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সঠিকভাবে প্রতিপালিত না হলে তার বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক সরকারি অনুষ্ঠানে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের জ্যেষ্ঠতা অনুসারে দাওয়াত দেওয়া হয় না। বরং কনিষ্ঠ কর্মকর্তা যাঁরা অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের দাওয়াত দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দাওয়াত না দেওয়াতে মামলা করতে পারবেন কি? জনাব মিজানুর রহমান খানের মতে, দাওয়াত দেওয়া ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের একমাত্র উদ্দেশ্য না হলেও অন্যতম উদ্দেশ্য।
৬. ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স না মানা হলে কী শাস্তি দেওয়া হবে? বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আচার-বিধিমালা অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যাঁরা স্থায়ী সরকারি কর্মচারী, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? এটি আদালত অবমাননার আইনের মাধ্যমে কি করা সম্ভব? বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
আর একটি আইনগত প্রশ্ন উঠেছে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের ভিত্তি কী হবে? আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সাংবিধানিক পদগুলো অন্য সব পদের ঊর্ধ্বে থাকবে। পৃথিবীর সব দেশে কিন্তু এ ধরনের রীতি অনুসৃত হয় না। সাংবিধানিক পদের অধিকারী সবাই নির্বাচিত নন, অনেক দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপরে স্থান দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানক্রমে প্রধান বিচারপতির অবস্থান নিম্নরূপ—
১। মার্কিন প্রেসিডেন্ট
২। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট
৩। গভর্নর (নিজ রাজ্য)
৪। মেয়র
৫। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের স্পিকার
৬। রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি
এ তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান বিচারপতির অবস্থান ওয়াশিংটন ডিসির মেয়রের নিচে। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়েছে বলে শুনিনি। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে অনেক সময় বিশেষ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মানক্রম ১৪ নম্বরে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্টদের বিধবা স্ত্রীদের অবস্থান ১২ নম্বরে। রাষ্ট্রপতির বিধবা স্ত্রী কি সাংবিধানিক পদ? এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একটি ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। ২০০১ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের (যদিও তখন তাঁদের কেউই সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না) তদানীন্তন মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টাদের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়। যেভাবে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সকে আইনের নিগড়ে বন্দী করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে সমস্যার সমাধান না হয়ে সমস্যাটি আরও জটিল হতে পারে।
পদমর্যাদাক্রমের লড়াই শুধু প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন শ্রেণী ও বিচার বিভাগে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মধ্যে লড়াই নয়, এখানে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের ক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে কেউ কারও ঊর্ধ্বে নয়। প্রত্যেকটি বিভাগেরই নিজস্ব কিছু দায়িত্ব রয়েছে এবং সেসব ব্যাপারে অন্য বিভাগের হস্তক্ষেপ দেখা গেলে সংঘাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বিষয়টি নির্বাহী বিভাগের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। এখানে বিচার বিভাগের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠা করা কতটুকু কল্যাণকর ও যুক্তিযুক্ত হবে, সেটা ভেবে দেখা দরকার। এ ছাড়া জবাবদিহিতার প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাহী বিভাগকে প্রত্যক্ষভাবে জনগণের কাছে দায়ী থাকতে হয়। প্রতি পাঁচ বছর পর তাদের জনগণের কাছ থেকে ভোটের মাধ্যমে মর্যাদা অর্জন করতে হয়। কাজেই নির্বাহীকে নিয়ন্ত্রণ করাই শুধু নয়, নির্বাহী বিভাগকে কাজ করারও সুযোগ দিতে হবে।
অবশ্য আমি এ কথা অস্বীকার করি না, বিচারপতিদের অসন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। আমি প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে বিষয়গুলো পরিষ্কার করব।
[দ্বিতীয় কিস্তি আগামীকাল]
আকবর আলি খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
ব্রিটিশ শাসনামলে তিনটি কারণে পদমর্যাদাক্রম বা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারি মহলে বাইবেলে পরিণত হয়। প্রথমত, ভারতে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে বর্ণবাদব্যবস্থা, যেখানে শূদ্রদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের সামাজিক মেলামেশা নিষিদ্ধ। প্রচ্ছন্ন ব্রিটিশ বর্ণবাদ ভারতের সনাতন বর্ণবাদকে আত্মস্থ করে। দ্বিতীয়ত, মোগল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় শানশওকতের সঙ্গে আমির-ওমরাদের পদমর্যাদাক্রম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। তৃতীয়ত, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই পদমর্যাদার টোপ ফেলে দেশীয় রাজ্যের শাসকদের মধ্যে আনুগত্যের প্রতিযোগিতার সূচনা করে। এসবের ফলে পদমর্যাদা-সংবলিত লাল বই বা নীল বই ব্রিটিশ ভারতের শাসনব্যবস্থায় অপরিহার্য ছিল।
৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে মিজানুর রহমান খানের ‘রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম নিয়ে বিতর্ক’ প্রবন্ধটি পড়ে আমার মনে হলো যে আমরা ব্রিটিশ শাসনামলে ফিরে গেছি। ব্রিটিশ শাসনামলেও পদমর্যাদাক্রম নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। বিতর্ক ছিল প্রধানত সামরিক বনাম অসামরিক মানমর্যাদা নিয়ে এবং সব কর্মকর্তার সঙ্গে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের পদমর্যাদাক্রম নিয়ে। এই ব্যবস্থায় ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, তাঁরা যত ধনী হোন না কেন, তাঁদের কোনো পদমর্যাদা ছিল না। তাঁদের বলা হতো, বক্সওয়ালা বা বাক্সওয়ালা। সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসামরিক কর্মকর্তাদের পদমর্যাদার খিটিমিটি লেগেই থাকত। অসামরিক কর্মকর্তারা মনে করতেন, অর্ধশিক্ষিত ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা যাঁরা এ দেশে স্বল্পকাল থাকতেন এবং এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে যাঁদের কোনো ধারণা ছিল না, শিক্ষাদীক্ষার মাপকাঠিতে তাঁদের স্থান নিচে আর তাই তাঁদের পদমর্যাদা নিচু হওয়া উচিত। এর ফলে সামরিক কর্মকর্তারাও প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে পদমর্যাদা নিয়ে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে কোনো বড় দ্বন্দ্ব দেখা দেয়নি। আর একটি কারণ ছিল আইসিএস বা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ দুই বিভাগেই কাজ করতেন। তাই তাঁরা বিচার বিভাগের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতেন। মিজানুর রহমান খান পদমর্যাদাক্রম নিয়ে যে বিতর্কের কথা লিখেছেন সেই বিতর্ক মূলত বিচার বিভাগের সঙ্গে অসামরিক নির্বাহী ও সামরিক বিভাগের মর্যাদা নিয়ে। ব্রিটিশ আমলের লড়াই থেকে এটি ভিন্ন।
মিজানুর রহমান খানের সুলিখিত ও বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধটি আমি পড়েছি। তিনি একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তিনি এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন—‘আকবর আলি খান তাকে শুধুই দাওয়াত দেওয়ার বিষয় হিসেবে দেখেছেন। বলেছেন, এর উদ্দেশ্য ও কোথায় কী কাজে ব্যবহার হবে তার কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু তা সঠিক নয়। বিধিতেই বলা আছে, রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষসহ সব ধরনের সরকারি উদ্দেশ্যে প্রিসিডেন্সের ব্যবহার হবে।’
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের যে সূত্রটি টেনে মিজানুর রহমান খান বলতে চাইছেন যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স শুধু আনুষ্ঠানিকতার বিষয় নয়, সেই সূত্রটি হলো ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের এক নম্বর পাদটীকা। এই পাদটীকায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি সব রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ এবং সরকারের সকল উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহূত হবে।’ আমার প্রশ্ন হলো, ‘সরকারের সকল উদ্দেশ্যে’ বাক্যাংশের অর্থ কী? ওই বাক্যাংশ ১৯৮৮ সালে যোগ করা হয়। আমি মনে করি, বাক্যাংশটির প্রেষিত বা content বিবেচনায় নিতে হবে। এই বাক্যাংশ ‘রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ’-এর পরে যোগ করা হয়েছে। সুতরাং এই ক্ষেত্রে ‘সরকারের সকল উদ্দেশ্য’ বাক্যাংশটি রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষের মধ্যে সীমিত। যদি দাবি করা হয় যে এটি অনুষ্ঠানের বাইরে সব সরকারি কাজে ব্যবহূত হবে, তবে তার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বলি—ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, কোনো আইনগত ভিত্তিও নেই। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র একই অবস্থা। যদিও এর কোনো আইনগত বা সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, তবু পৃথিবীর অনেক দেশে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স রয়েছে। কিন্তু সেখানে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া থাকে, এর কোনো আইনগত মর্যাদা নেই। ভারতের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে তাই বলা হয়েছে, এই মানক্রম শুধু রাষ্ট্রীয় এবং আনুষ্ঠানিক উপলক্ষে ব্যবহূত হবে এবং সরকারের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপে এর কোনো প্রয়োগ হবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ডার অব প্রিসিডেন্সে স্পষ্ট বলা আছে, এটি আনুষ্ঠানিক প্রোটোকল বা রাষ্ট্রাচারের জন্য ব্যবহূত হয়, এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে যে সমমর্যাদা সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে, তাও কোনোভাবে বিঘ্নিত হবে না। আমরা যদি এই যুক্তি ধরে নিই, বাংলাদেশের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সব রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহূত হবে এবং শুধু রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষে ব্যবহূত হবে না, তাহলে পরিপত্রটি সম্পূর্ণ বেআইনি। কার স্থান কোথায় হবে এটি আইনগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সব উদ্দেশ্যের জন্য ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স জারি করতে পারেন কি না? সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে এ ক্ষমতা দেয়নি। কোনো আইনও রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেয়নি। অথচ, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সৃষ্টি করে দেশের মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যদি ধরে নিই, সরকারের সব কাজে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স প্রযোজ্য—সাধারণ নাগরিক ও ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে উল্লিখিত ব্যক্তিদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ যদি দাবি করে, সরকারের সব উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য এটি একটি আইনসম্মত মানক্রম, তাহলে একে অবিলম্বে বেআইনি ঘোষণা করা উচিত। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের দাবি রাষ্ট্রপক্ষ করেনি। এ ধরনের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সাধারণ নাগরিকের মানমর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বাংলাদেশে কী হবে জানি না, তবে পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে সরকারি অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো কাজে সরকারের সব উদ্দেশ্যে এই ওয়ারেন্টের ব্যবহার গ্রহণযোগ্য হবে না।
মিজানুর রহমান খানের মতো যেসব আইনজ্ঞ এটি রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষের জন্য আইনের ভিত্তি ছাড়া একটি নির্বাহী আদেশ গণ্য না করে এটিকে আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ও সরকারের সব উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য হিসেবে বৈধতা দিতে চান তাঁদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিয়ে একটু চিন্তা করতে অনুরোধ করি:
১. বর্তমান ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। আদালতের নির্দেশে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করা হলে, এটি আইনগত মর্যাদা পাবে। ওয়ারেন্টের অন্তর্গত ও ওয়ারেন্ট-বহির্ভূত নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য রচিত হবে এবং এই বৈষম্যকেই আইনগতভাবে বৈধ করা হবে। কাজেই, সরকারের সব উদ্দেশ্যে ব্যবহূত এই বাক্যাংশসহ ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স আদালতের মাধ্যমে সংশোধিত হওয়া হবে দুর্ভাগ্যজনক। আর আদালত যদি বাক্যাংশটি বেআইনি ঘোষণা করেন, তাহলে এই ওয়ারেন্ট শুধু অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
২. আদালত কর্তৃক ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স গৃহীত হলে আইনগতভাবে বিচার বিভাগের জন্য তা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। আদালত কর্তৃক স্বীকৃত মানক্রমে প্রধানমন্ত্রীর নিচে প্রধান বিচারপতির অবস্থান। আমার ব্যাখ্যা হলো—এটি শুধু অনুষ্ঠানের জন্য করা হয়েছে এবং ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারের সব কাজের জন্য প্রযোজ্য নয়। যদি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারের সব কাজে ব্যবহারযোগ্য বলে স্বীকৃত হয় এবং আদালত যদি স্বীকার করে নেন, প্রধান বিচারপতির মানক্রম প্রধানমন্ত্রীর নিচে, তাহলে তর্কশাস্ত্রের সূত্র অনুসারে প্রধান বিচারপতি সরকারের সব কাজে প্রধানমন্ত্রীর অধীন হয়ে যান। এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না হয়, সে জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্ডার অব প্রিসিডেন্সে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এর কোনো আইনি মর্যাদা নেই এবং এই মানক্রম রাষ্ট্রে প্রধান তিনটি অঙ্গের ক্ষমতা কোনোরূপ বিঘ্নিত করবে না।
৩. আইনের ভিত্তিতে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অধস্তন বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আদেশ দেওয়া হয়, প্রধানমন্ত্রীর নিচে যেসব মানকর্মচারী-কর্মকর্তা রয়েছেন, তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে, তাহলে কোন যুক্তিতে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা এই দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করবেন?
৪. ধরা যাক, আদালত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সম্পর্কে এমন এক আদেশ দিলেন যা সরকারের মনঃপূত হলো না, সরকার যদি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তুলে দেয়, তাহলে আদালত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারকে জারি করতে বাধ্য করতে পারেন কি না? অর্থাত্, ধরা যাক যেসব পদ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, সেসব পদ অর্থাত্ এর নিচে যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন, তাঁদের বাদ দিলে বর্তমান সংকটের নিরসন হবে কি? বিষয়টিতে আদালতের এখতিয়ার কতটুকু তা চিন্তা করার প্রয়োজন আছে।
৫. আদালত কর্তৃক সংশোধিত ও অনুমোদিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সঠিকভাবে প্রতিপালিত না হলে তার বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক সরকারি অনুষ্ঠানে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের জ্যেষ্ঠতা অনুসারে দাওয়াত দেওয়া হয় না। বরং কনিষ্ঠ কর্মকর্তা যাঁরা অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের দাওয়াত দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দাওয়াত না দেওয়াতে মামলা করতে পারবেন কি? জনাব মিজানুর রহমান খানের মতে, দাওয়াত দেওয়া ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের একমাত্র উদ্দেশ্য না হলেও অন্যতম উদ্দেশ্য।
৬. ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স না মানা হলে কী শাস্তি দেওয়া হবে? বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আচার-বিধিমালা অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যাঁরা স্থায়ী সরকারি কর্মচারী, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? এটি আদালত অবমাননার আইনের মাধ্যমে কি করা সম্ভব? বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
আর একটি আইনগত প্রশ্ন উঠেছে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের ভিত্তি কী হবে? আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সাংবিধানিক পদগুলো অন্য সব পদের ঊর্ধ্বে থাকবে। পৃথিবীর সব দেশে কিন্তু এ ধরনের রীতি অনুসৃত হয় না। সাংবিধানিক পদের অধিকারী সবাই নির্বাচিত নন, অনেক দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপরে স্থান দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানক্রমে প্রধান বিচারপতির অবস্থান নিম্নরূপ—
১। মার্কিন প্রেসিডেন্ট
২। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট
৩। গভর্নর (নিজ রাজ্য)
৪। মেয়র
৫। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের স্পিকার
৬। রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি
এ তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান বিচারপতির অবস্থান ওয়াশিংটন ডিসির মেয়রের নিচে। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়েছে বলে শুনিনি। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে অনেক সময় বিশেষ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মানক্রম ১৪ নম্বরে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্টদের বিধবা স্ত্রীদের অবস্থান ১২ নম্বরে। রাষ্ট্রপতির বিধবা স্ত্রী কি সাংবিধানিক পদ? এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একটি ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। ২০০১ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের (যদিও তখন তাঁদের কেউই সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না) তদানীন্তন মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টাদের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়। যেভাবে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সকে আইনের নিগড়ে বন্দী করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে সমস্যার সমাধান না হয়ে সমস্যাটি আরও জটিল হতে পারে।
পদমর্যাদাক্রমের লড়াই শুধু প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন শ্রেণী ও বিচার বিভাগে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মধ্যে লড়াই নয়, এখানে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের ক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে কেউ কারও ঊর্ধ্বে নয়। প্রত্যেকটি বিভাগেরই নিজস্ব কিছু দায়িত্ব রয়েছে এবং সেসব ব্যাপারে অন্য বিভাগের হস্তক্ষেপ দেখা গেলে সংঘাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বিষয়টি নির্বাহী বিভাগের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। এখানে বিচার বিভাগের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠা করা কতটুকু কল্যাণকর ও যুক্তিযুক্ত হবে, সেটা ভেবে দেখা দরকার। এ ছাড়া জবাবদিহিতার প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাহী বিভাগকে প্রত্যক্ষভাবে জনগণের কাছে দায়ী থাকতে হয়। প্রতি পাঁচ বছর পর তাদের জনগণের কাছ থেকে ভোটের মাধ্যমে মর্যাদা অর্জন করতে হয়। কাজেই নির্বাহীকে নিয়ন্ত্রণ করাই শুধু নয়, নির্বাহী বিভাগকে কাজ করারও সুযোগ দিতে হবে।
অবশ্য আমি এ কথা অস্বীকার করি না, বিচারপতিদের অসন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। আমি প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে বিষয়গুলো পরিষ্কার করব।
[দ্বিতীয় কিস্তি আগামীকাল]
আকবর আলি খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments