খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে -শেয়ারবাজার by হানিফ মাহমুদ
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ কিছুদিন পরপরই মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে সূচক বৃদ্ধির ঘটনা উদ্যাপন করছে। সাংবাদিক ডেকে তারা ভাবটা এমন করে যে বাজার তার নিজস্ব গতি-প্রকৃতিতেই চাহিদা ও জোগানের অবাধ, স্বচ্ছন্দ আদান-প্রদানের দ্বারা মূল্য নির্ধারণ করছে। আর সূচকে তারই প্রতিফলন ঘটছে।
কিন্তু এই ‘ফিল গুড’ প্রচার অনেকের মানসপটে যতটা বিশুদ্ধ চিত্র তৈরি করছে, বাস্তব পরিস্থিতিটা ঠিক তার উল্টো। ডিএসইর সূচকটি বর্তমানে প্রায় অব্যবহারযোগ্য। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্য ও বাজারের একাধিক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা প্রকাশ্যে না বললেও একাধিকবার স্বীকার করেছেন এটি অতিমূল্যায়িত। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থাও স্বীকার করেছে এটিতে বিকৃতি আছে। তবে এটি সংশোধনের ব্যাপারে কারোরই কোনো তত্পরতা নেই।
উচ্চ সূচকের এই মোড়কের আড়ালে শেয়ারবাজারের একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ফায়দা লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে দেশের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের কর্মীরাও স্বার্থান্বেষী জুয়াড়িদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, এতে পেশাদারি হয়ে পড়ছে প্রশ্নবিদ্ধ।
কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো: বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ‘বুল কার্টেল’ বর্তমানে অতি মাত্রায় সক্রিয়। যাঁরা শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তা থেকে ফায়দা লুটতে চান, তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে বুল কার্টেল হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমানে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্রোকারেজ হাউসের মালিক ও প্রতিনিধি এবং বেশ কিছু বড় ব্যবসায়ী এই কার্টেলের সদস্য। এ ধরনের গ্রুপ বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বেশ কয়েকটি সক্রিয় রয়েছে, যাদের সংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ১০টি হবে। তারা কী ভাবছে লেনদেন শুরু আগে, তার ওপরই নির্ভর করে সেদিন বাজারে শেয়ারের গতি-প্রকৃতি? তারা লেনদেন শুরুর পর বিভিন্নভাবে গুজব ছড়ায় এবং তা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করে। তাদেরই অর্থায়নে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গুজবের ওয়েবসাইট। এসব ওয়েবসাইটে বাজারে বিভিন্ন শেয়ারের দামের গুজব, লভ্যাংশের গুজব, বড় বড় লেনদেনের তথ্য দেওয়া হচ্ছে। আবার আগামী এক সপ্তাহে কোনটার দামে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটবে, তারও উল্লেখ থাকে এসব সাইটে। সরকারের নানা মহল এসব ‘বুল কার্টেল’-এর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকলেও বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ রয়েছে।
ডিএসইর বিকৃত সূচক: আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সূচক হিসাবের দাবি করলেও দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসই সচেতনভাবে ভুল সূচক পরিমাপ করে আসছে। এতে বাজারে প্রকৃত পরিস্থিতির চেয়ে অনেক উচ্চ অবস্থা বিরাজ করছে এবং বিনিয়োগকারীদের ভুল সংকেত দিচ্ছে। কারণ, বাজারের তেজি অবস্থায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্রুত মুনাফা লাভের আশায় বাজারে ঢুকছে। শুধু তা-ই নয়, এই উচ্চসূচকের মোড়কে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ ঘটছে বহু বিনিয়োগকারীর। কারণ, সূচক ভালো থাকলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকার স্বস্তিবোধ করে।
সর্বশেষ ভুলটি করা হয়েছে গ্রামীণফোনের শেয়ারের লেনদেন শুরু হওয়ার দিন। ওই দিন বাজারের প্রবৃদ্ধিকে বড় করে দেখানোর জন্য আন্তর্জাতিক সূত্রই যে শুধু অনুসরণ করা হয়নি তা নয়, একই সঙ্গে প্রারম্ভিক মূল্য ৭০ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা ধরে সূচক পরিমাপ করা হয়েছে। এতে বাজারে সূচক কয়েক শ পয়েন্ট বেশি বেড়ে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের ভুল সংকেত দিয়েছে। পরে ভুলটি ধরা পড়লেও ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ এটি সংশোধন করেনি।
তবে এ নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। গত ২২ ডিসেম্বর ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনস (আইএসকো) নির্ধারিত পদ্ধতি বা সূত্র অনুসারে সূচক হিসাবের ক্ষেত্রে যেকোনো নতুন শেয়ার বাজারে এলে প্রথম দিনেই তার মূল্যের ওঠানামাকে বিবেচনা না করে দ্বিতীয় দিনের বাজার প্রারম্ভিক দামকে সূচকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিমাপ করতে হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালে সূচক পরিমাপের ক্ষেত্রে আইএসকো সূত্র অনুসরণের ঘোষণা দিলেও ডিএসই এই বিধি মেনে সূচক পরিমাপ করে না। বরং নতুন শেয়ারের বাজারে লেনদেন শুরুর প্রারম্ভিক দামকে বিবেচনা করে সূচক পরিমাপ করে আসছে। আর এ কারণেই গ্রামীণফোনের লেনদেন যেদিন শুরু হয়, সেদিন ডিএসইর সাধারণ সূচক ৭০৩ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ অতীতের এই ভুল সংশোধন করতে রাজি নয়। তবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আগামী দিনে এ ধরনের ভুল আর করা হবে না। গত ২৩ ডিসেম্বর ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত এক পত্রে এ বিষয়টি এসইসিকে জানিয়ে কমিশনের কাছ থেকে সূচক সংশোধনের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সঠিকভাবেই সূচক পরিমাপ করে আসছে। আর তাই গ্রামীণফোন বাজারে প্রথম দিন লেনদেন হওয়ার পর সিএসইর সূচকে তা প্রতিফলিত হয়নি। বরং নিয়মমাফিক দ্বিতীয় দিন থেকে গ্রামীণফোনের বাজারমূল্য সূচক পরিমাপে বিবেচনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার সূচকের পরিমাপে মিউচুয়াল ফান্ডের দর ওঠানামার হিসাব অন্তর্ভুক্ত করা না হলেও বাংলাদেশে তা হয়ে আসছে। এতে করেও বিনিয়োগকারীদের কাছে একটা ভুল সংকেত যাচ্ছে। কারণ, সূচক হলো শেয়ারের মূল্যের পরিবর্তনের পরিমাপক। শেয়ারের মূল্যসূচক বাজারে শেয়ারের মূল্যের গতিকে প্রতিফলন করে।
এসইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ: দেশের প্রধান শেয়ারবাজারের এই সূচক বিকৃতির বিষয়ে অবহিত থাকার পরও এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রথমে তারা বলছে, বিষয়টি তারা অবগত ছিল না। পরে বলেছে, বিষয়টি নিয়ে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এ রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাদের প্রায়ই চলে। সাম্প্রতিক সময়ে দুটি বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে বহু বিনিয়োগকারীকে ভুল সংকেত ও সর্বস্বান্ত করেছে। প্রথমটি হচ্ছে বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সব শেয়ারকে ১০ টাকায় পরিণত করা। শেয়ারবাজারের একটি চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এসইসির পরামর্শক কমিটি এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের সুপারিশ করে। কিন্তু বাস্তবে এর আগেই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
এসইসির এ ধরনের কর্মকাণ্ডের উদাহরণ অসংখ্য দেওয়া যাবে। মিউচুয়াল ফান্ড-সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি। কিন্তু তিন মাস আগেই হাইকোর্ট রায় দেওয়ার পরপরই এসইসি আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের মাঝামাঝি এসইসি মিউচুয়াল ফান্ড-সংক্রান্ত বিধিমালার ৬৬ বিধি সংশোধন করে জানায় যেকোনো ধরনের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড রাইট বা বোনাস দিয়ে মূল তহবিলের আকার বাড়াতে পারবে না। একই সঙ্গে সংস্থাটি মিউচুয়াল ফান্ডের প্রাক-আইপিও প্লেসমেন্ট অপর কোনো ফান্ডের ইউনিটের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ সময় মাত্র সাত কর্মদিবসেই মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সম্মিলিতভাবে ৩৫০ কোটি টাকার বাজার মূলধন হারায়। পরে এ নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত তিনজন বিনিয়োগকারী এসইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। গত ১১ নভেম্বর হাইকোর্ট মামলার রায় দিলে তা বিনিয়োগকারীদের পক্ষে যায়। কিন্তু এসইসির পক্ষ থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা হয় ওই দিনই। এতে মিউচুয়াল ফান্ডের দাম আবার কমতে শুরু করে। অনেক বিনিয়োগকারী বিপুল পরিমাণ মূলধন হারিয়ে রাস্তায় নামেন।
কিন্তু বিগত তিন মাসে এ ব্যাপারে এসইসির কোনো মাথাব্যথ্যা ছিল না। গত ২৭ জানুয়ারি ২০০ কোটি তহবিলের একটি মিউচুয়াল ফান্ডের লেনদেন শুরুর আগেই হঠাত্ করে কেন এসইসি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করার সিদ্ধান্ত নিল, সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ডিএসইর বেশ কিছু পরিচালক বেনামে এই মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার প্রাইভেট প্লেসমেন্ট থেকে সংগ্রহ করেছিলেন—এমন তথ্য বাজারে প্রায় সবারই জানা। ধারণা করা হয়, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না হলে এই মিউচুয়াল ফান্ডের দামের ওপর বড় প্রভাব পড়বে, সে বিবেচনায়ই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসইসি। বাস্তবেও দেখা গেছে এসইসির সিদ্ধান্তের কারণে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের মিউচুয়াল ফান্ডটির দাম প্রায় তিন গুণ বাড়ে।
এসইসির নৈতিকতার অধঃপতন এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ উঠেছে, ঢাকায় চলমান দক্ষিণ এশীয় গেমসে পৃষ্ঠপোষকতা জোগাড়ের কাজে নিজেরাই মাঠে নেমে পড়েছিল সংস্থাটি। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এসইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফোন করে ও দেখা করে ১৫ কোটি টাকার ‘স্পনসর তহবিল’ জোগাড় করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের খেলাধুলার বিকাশে বেসরকারি খাতগুলো এক দশক ধরেই এগিয়ে এসেছে। কিন্তু নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে এই কাজে কেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা জড়িয়ে পড়বে?
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশ্লেষণ: বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মতো দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংকটকালীন সহন-ক্ষমতা পরীক্ষা বা স্ট্রেস টেস্টিং সম্পন্ন করেছে। ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর পাঠানো সাময়িক ও অনিরীক্ষিত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে সম্ভাব্য অভিঘাতগুলো বিবেচনায় নিয়ে ঋণ ঝুঁকি, বাজার ঝুঁকি ও তারল্য ঝুঁকি নিয়ে স্পর্শকাতরতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তাদের বিশ্লেষণে, যদি বর্তমান মূল্য থেকে ৫০ শতাংশ শেয়ারের দরপতন হয়, তবে ব্যাংকগুলোর ক্ষতি হবে এক হাজার ৭২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষতি হবে ২০৩ কোটি ছয় লাখ টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ১৩৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এক হাজার ৩৭১ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর ক্ষতি হবে ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
কিন্তু এই ‘ফিল গুড’ প্রচার অনেকের মানসপটে যতটা বিশুদ্ধ চিত্র তৈরি করছে, বাস্তব পরিস্থিতিটা ঠিক তার উল্টো। ডিএসইর সূচকটি বর্তমানে প্রায় অব্যবহারযোগ্য। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্য ও বাজারের একাধিক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা প্রকাশ্যে না বললেও একাধিকবার স্বীকার করেছেন এটি অতিমূল্যায়িত। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থাও স্বীকার করেছে এটিতে বিকৃতি আছে। তবে এটি সংশোধনের ব্যাপারে কারোরই কোনো তত্পরতা নেই।
উচ্চ সূচকের এই মোড়কের আড়ালে শেয়ারবাজারের একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ফায়দা লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে দেশের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের কর্মীরাও স্বার্থান্বেষী জুয়াড়িদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, এতে পেশাদারি হয়ে পড়ছে প্রশ্নবিদ্ধ।
কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো: বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ‘বুল কার্টেল’ বর্তমানে অতি মাত্রায় সক্রিয়। যাঁরা শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তা থেকে ফায়দা লুটতে চান, তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে বুল কার্টেল হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমানে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্রোকারেজ হাউসের মালিক ও প্রতিনিধি এবং বেশ কিছু বড় ব্যবসায়ী এই কার্টেলের সদস্য। এ ধরনের গ্রুপ বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বেশ কয়েকটি সক্রিয় রয়েছে, যাদের সংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ১০টি হবে। তারা কী ভাবছে লেনদেন শুরু আগে, তার ওপরই নির্ভর করে সেদিন বাজারে শেয়ারের গতি-প্রকৃতি? তারা লেনদেন শুরুর পর বিভিন্নভাবে গুজব ছড়ায় এবং তা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করে। তাদেরই অর্থায়নে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গুজবের ওয়েবসাইট। এসব ওয়েবসাইটে বাজারে বিভিন্ন শেয়ারের দামের গুজব, লভ্যাংশের গুজব, বড় বড় লেনদেনের তথ্য দেওয়া হচ্ছে। আবার আগামী এক সপ্তাহে কোনটার দামে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটবে, তারও উল্লেখ থাকে এসব সাইটে। সরকারের নানা মহল এসব ‘বুল কার্টেল’-এর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকলেও বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ রয়েছে।
ডিএসইর বিকৃত সূচক: আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সূচক হিসাবের দাবি করলেও দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসই সচেতনভাবে ভুল সূচক পরিমাপ করে আসছে। এতে বাজারে প্রকৃত পরিস্থিতির চেয়ে অনেক উচ্চ অবস্থা বিরাজ করছে এবং বিনিয়োগকারীদের ভুল সংকেত দিচ্ছে। কারণ, বাজারের তেজি অবস্থায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্রুত মুনাফা লাভের আশায় বাজারে ঢুকছে। শুধু তা-ই নয়, এই উচ্চসূচকের মোড়কে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ ঘটছে বহু বিনিয়োগকারীর। কারণ, সূচক ভালো থাকলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকার স্বস্তিবোধ করে।
সর্বশেষ ভুলটি করা হয়েছে গ্রামীণফোনের শেয়ারের লেনদেন শুরু হওয়ার দিন। ওই দিন বাজারের প্রবৃদ্ধিকে বড় করে দেখানোর জন্য আন্তর্জাতিক সূত্রই যে শুধু অনুসরণ করা হয়নি তা নয়, একই সঙ্গে প্রারম্ভিক মূল্য ৭০ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা ধরে সূচক পরিমাপ করা হয়েছে। এতে বাজারে সূচক কয়েক শ পয়েন্ট বেশি বেড়ে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের ভুল সংকেত দিয়েছে। পরে ভুলটি ধরা পড়লেও ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ এটি সংশোধন করেনি।
তবে এ নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। গত ২২ ডিসেম্বর ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনস (আইএসকো) নির্ধারিত পদ্ধতি বা সূত্র অনুসারে সূচক হিসাবের ক্ষেত্রে যেকোনো নতুন শেয়ার বাজারে এলে প্রথম দিনেই তার মূল্যের ওঠানামাকে বিবেচনা না করে দ্বিতীয় দিনের বাজার প্রারম্ভিক দামকে সূচকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিমাপ করতে হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালে সূচক পরিমাপের ক্ষেত্রে আইএসকো সূত্র অনুসরণের ঘোষণা দিলেও ডিএসই এই বিধি মেনে সূচক পরিমাপ করে না। বরং নতুন শেয়ারের বাজারে লেনদেন শুরুর প্রারম্ভিক দামকে বিবেচনা করে সূচক পরিমাপ করে আসছে। আর এ কারণেই গ্রামীণফোনের লেনদেন যেদিন শুরু হয়, সেদিন ডিএসইর সাধারণ সূচক ৭০৩ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ অতীতের এই ভুল সংশোধন করতে রাজি নয়। তবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আগামী দিনে এ ধরনের ভুল আর করা হবে না। গত ২৩ ডিসেম্বর ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত এক পত্রে এ বিষয়টি এসইসিকে জানিয়ে কমিশনের কাছ থেকে সূচক সংশোধনের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সঠিকভাবেই সূচক পরিমাপ করে আসছে। আর তাই গ্রামীণফোন বাজারে প্রথম দিন লেনদেন হওয়ার পর সিএসইর সূচকে তা প্রতিফলিত হয়নি। বরং নিয়মমাফিক দ্বিতীয় দিন থেকে গ্রামীণফোনের বাজারমূল্য সূচক পরিমাপে বিবেচনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার সূচকের পরিমাপে মিউচুয়াল ফান্ডের দর ওঠানামার হিসাব অন্তর্ভুক্ত করা না হলেও বাংলাদেশে তা হয়ে আসছে। এতে করেও বিনিয়োগকারীদের কাছে একটা ভুল সংকেত যাচ্ছে। কারণ, সূচক হলো শেয়ারের মূল্যের পরিবর্তনের পরিমাপক। শেয়ারের মূল্যসূচক বাজারে শেয়ারের মূল্যের গতিকে প্রতিফলন করে।
এসইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ: দেশের প্রধান শেয়ারবাজারের এই সূচক বিকৃতির বিষয়ে অবহিত থাকার পরও এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রথমে তারা বলছে, বিষয়টি তারা অবগত ছিল না। পরে বলেছে, বিষয়টি নিয়ে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এ রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাদের প্রায়ই চলে। সাম্প্রতিক সময়ে দুটি বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে বহু বিনিয়োগকারীকে ভুল সংকেত ও সর্বস্বান্ত করেছে। প্রথমটি হচ্ছে বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সব শেয়ারকে ১০ টাকায় পরিণত করা। শেয়ারবাজারের একটি চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এসইসির পরামর্শক কমিটি এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের সুপারিশ করে। কিন্তু বাস্তবে এর আগেই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
এসইসির এ ধরনের কর্মকাণ্ডের উদাহরণ অসংখ্য দেওয়া যাবে। মিউচুয়াল ফান্ড-সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি। কিন্তু তিন মাস আগেই হাইকোর্ট রায় দেওয়ার পরপরই এসইসি আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের মাঝামাঝি এসইসি মিউচুয়াল ফান্ড-সংক্রান্ত বিধিমালার ৬৬ বিধি সংশোধন করে জানায় যেকোনো ধরনের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড রাইট বা বোনাস দিয়ে মূল তহবিলের আকার বাড়াতে পারবে না। একই সঙ্গে সংস্থাটি মিউচুয়াল ফান্ডের প্রাক-আইপিও প্লেসমেন্ট অপর কোনো ফান্ডের ইউনিটের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ সময় মাত্র সাত কর্মদিবসেই মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সম্মিলিতভাবে ৩৫০ কোটি টাকার বাজার মূলধন হারায়। পরে এ নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত তিনজন বিনিয়োগকারী এসইসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। গত ১১ নভেম্বর হাইকোর্ট মামলার রায় দিলে তা বিনিয়োগকারীদের পক্ষে যায়। কিন্তু এসইসির পক্ষ থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা হয় ওই দিনই। এতে মিউচুয়াল ফান্ডের দাম আবার কমতে শুরু করে। অনেক বিনিয়োগকারী বিপুল পরিমাণ মূলধন হারিয়ে রাস্তায় নামেন।
কিন্তু বিগত তিন মাসে এ ব্যাপারে এসইসির কোনো মাথাব্যথ্যা ছিল না। গত ২৭ জানুয়ারি ২০০ কোটি তহবিলের একটি মিউচুয়াল ফান্ডের লেনদেন শুরুর আগেই হঠাত্ করে কেন এসইসি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করার সিদ্ধান্ত নিল, সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ডিএসইর বেশ কিছু পরিচালক বেনামে এই মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার প্রাইভেট প্লেসমেন্ট থেকে সংগ্রহ করেছিলেন—এমন তথ্য বাজারে প্রায় সবারই জানা। ধারণা করা হয়, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না হলে এই মিউচুয়াল ফান্ডের দামের ওপর বড় প্রভাব পড়বে, সে বিবেচনায়ই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসইসি। বাস্তবেও দেখা গেছে এসইসির সিদ্ধান্তের কারণে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের মিউচুয়াল ফান্ডটির দাম প্রায় তিন গুণ বাড়ে।
এসইসির নৈতিকতার অধঃপতন এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ উঠেছে, ঢাকায় চলমান দক্ষিণ এশীয় গেমসে পৃষ্ঠপোষকতা জোগাড়ের কাজে নিজেরাই মাঠে নেমে পড়েছিল সংস্থাটি। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এসইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফোন করে ও দেখা করে ১৫ কোটি টাকার ‘স্পনসর তহবিল’ জোগাড় করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের খেলাধুলার বিকাশে বেসরকারি খাতগুলো এক দশক ধরেই এগিয়ে এসেছে। কিন্তু নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে এই কাজে কেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা জড়িয়ে পড়বে?
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশ্লেষণ: বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মতো দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংকটকালীন সহন-ক্ষমতা পরীক্ষা বা স্ট্রেস টেস্টিং সম্পন্ন করেছে। ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর পাঠানো সাময়িক ও অনিরীক্ষিত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে সম্ভাব্য অভিঘাতগুলো বিবেচনায় নিয়ে ঋণ ঝুঁকি, বাজার ঝুঁকি ও তারল্য ঝুঁকি নিয়ে স্পর্শকাতরতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তাদের বিশ্লেষণে, যদি বর্তমান মূল্য থেকে ৫০ শতাংশ শেয়ারের দরপতন হয়, তবে ব্যাংকগুলোর ক্ষতি হবে এক হাজার ৭২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষতি হবে ২০৩ কোটি ছয় লাখ টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ১৩৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এক হাজার ৩৭১ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর ক্ষতি হবে ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
হানিফ মাহমুদ: সাংবাদিক।
No comments