প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ আকবর আলি খান ভারতে সরকার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের স্বার্থ
তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার ও জনগণ অভিন্ন। বাস্তব জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক সরকার সংখ্যাগুরুর সরকার। জর্জ বার্নার্ডশ ঠাট্টা করে লিখেছেন, ‘A government that robs Peter to pay Paul can always depend on the support of Peter.’ (যে সরকার পিটারের টাকা লুট করে পলকে দেয়, সে পিটারের সমর্থনের ওপর সব সময়ই নির্ভর করে)। যে তথ্য বার্নার্ডশ উহ্য রেখেছেন তা হলো বেচারা পিটারদের জন্য এমন অবস্থা সৃষ্টি করা হয় যে তাদের সরকারকে সমর্থন করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রে পল হলেন সমতলবাসী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। আর পিটার হলো বাঁধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি অঞ্চলের প্রান্তজনেরা। পল আর পিটারদের স্বার্থ ভিন্ন। পলদের স্বার্থ রক্ষা করে সরকার। তাই সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে লাভ-লোকসান দেখাটা যথেষ্ট নয়। পল ও পিটার উভয়ের স্বার্থই দেখতে হবে। ভারত সরকারের স্বার্থের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের স্বার্থও এ নিবন্ধে পরীক্ষা করা হবে।
ভারত সরকারের বক্তব্য হলো, টিপাইমুখ বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। যদিও দীর্ঘদিন ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্ষাকালে জল জমিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছে, তবু টিপাইমুখের মুখ্য লক্ষ্য জলবিদ্যুত্, বন্যা নিয়ন্ত্রণ নয়। এর কারণ হলো জলবিদ্যুতের আর্থিক মুনাফা বন্যা নিয়ন্ত্রণের ফিরতির বা লাভের চেয়ে অনেক বেশি।
ভারতে দ্রুত জলবিদ্যুত্ উত্পাদন বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জরুরি। ২০০৪ সালে ভারতে মাথাপিছু বিদ্যুত্ ব্যবহূত হয় ৪৫৭ কিলোওয়াট-ঘণ্টা, চীনে মাথাপিছু ১৫৮৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুত্ ব্যবহূত হয়। চীনে মাথাপিছু বিদ্যুত্ ব্যবহার ভারতের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। কাজেই ভারতকে শিল্পায়নে চীনের কাছাকাছি যেতে হলে বিদ্যুত্ উত্পাদন নাটকীয় হারে বাড়াতে হবে। নিম্ন পর্যায়ে বিদ্যুত্ ব্যবহার সত্ত্বেও ২০০৬-০৭ সালে ভারতে মোট বিদ্যুত্ সরবরাহে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ ঘাটতি ছিল। এই অবস্থায় ১৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রকল্প ভারতের জন্য বিধাতার আশীর্বাদ।
টিপাইমুখ প্রকল্পে প্রতি মেগাওয়াটে বিদ্যুতের বিনিয়োগ ব্যয় হবে ৪ দশমিক ৬৫ কোটি রুপি। অথচ চেন্নাইয়ে একটি ১০০০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রে মেগাওয়াট-প্রতি খরচ হচ্ছে ছয় কোটি রুপি। অন্যদিকে জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রে জ্বালানি খরচ শূন্য এবং পরিচালনা ও মেরামত ব্যয় খুবই নগণ্য। একটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে যে ত্রিপুরা রাজ্যে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের বার্ষিক খরচ হয় তিন কোটি টাকা আর আয় হয় ২১ কোটি টাকা। এই হারে টিপাইমুখের আয় হলে টিপাইমুখ থেকে বছরে কমপক্ষে দুই হাজার ৭০০ কোটি ভারতীয় রুপি আয় হবে। উপরন্তু ভারতের বিদ্যুতের সিংহভাগ আসে কয়লা থেকে। এতে পরিবেশদূষণের সমস্যা রয়েছে। জলবিদ্যুতে এ সমস্যা নেই। পৃথিবীর যেকোনো দেশে এ ধরনের প্রকল্প সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করবে। স্বভাবতই এ ধরনের আকর্ষণীয় প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের আপত্তি অথবা ভারতের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আপত্তি ভারত সরকার শুনবে না। আসলে ঘটেছেও তা-ই।
এ প্রকল্পের বিপক্ষে উপদ্রুত উত্তর-পূর্ব ভারতে বিশেষ করে মণিপুর রাজ্যে প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। এই আপত্তির কারণ চারটি। প্রথমত, প্রস্তাবিত বাঁধটি নিরাপদ নয়। দ্বিতীয়ত, প্রকল্প অঞ্চলে আদিবাসীদের চিরাচরিত জীবনযাত্রার জন্য এটি একটি বড় হুমকি। তৃতীয়ত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এ ধরনের প্রকল্প ইতিমধ্যে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। চতুর্থত, প্রস্তাবিত বাঁধ পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
টিপাইমুখ ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে একটি অতি স্পর্শকাতর এলাকা। এখানে সতত চলছে মহাদেশীয় ভূতাত্ত্বিক প্লেটের সংঘাত এবং ভূমির অধোগমন (বা নিচের দিকে বসে যাওয়া)। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তারাও এ সমস্যা স্বীকার করেন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের প্রণীত পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন দলিলে এ প্রক্রিয়াকে নিম্নরূপে বর্ণনা করা হয়েছে: Subduction process between Indian Plate and Shan-Teanagserim Block along Indo-Burma Mobile Belt has made this area tectonically very active. In addition, continent-continent collision of (1) NE Projection of India shield with Himalayan Thrust Front and (2) Eastern Mishimi Block and thrust implicated Indo-Burmese Block have added to this subduction process (P XII). (ভারত-ব্রহ্ম পরিপ্লব বলয়ের সমান্তরালে ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক প্লেট এবং শান-টেনাসেরিম ব্লকের মধ্যে অবস্থিত অঞ্চলে অধোগমন প্রক্রিয়া ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত সক্রিয় রেখেছে। উপরন্তু মহাদেশ প্লেটের সঙ্গে মহাদেশ প্লেটের মধ্যে ১. হিমালয়ের ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখ ভাগসহ ভারতীয় ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব অভিক্ষেপ ২. পূর্ব মিশিমি ব্লক এবং ভারত-ব্রহ্ম ব্লকের ঘাত-প্রতিঘাত অধোগমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে)।
এই ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেশি। উদ্যোক্তাদের হিসাবে এখানে রিখটার স্কেলে ৭-এর বড় ভূমিকম্প ১৬টি হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হচ্ছে অত্যন্ত বড়, রিখটার স্কেলে এদের পরিমাপ ৮ দশমিক ৫-এর বেশি এবং এ দুটি ভূমিকম্প বিশ্বের সর্ববৃহত্ ভূমিকম্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত (পৃষ্ঠা-১১২)। উদ্যোক্তারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে টিপাইমুখে ভূমিকম্পের অভিঘাত ভারতের অতি বিতর্কিত তেহরি বাঁধ এলাকা থেকে বেশি। তেহরি বাঁধে সর্বোচ্চ গড় ত্বরণ (Peak Mean Acceleration) অনুমান করা হয়েছে ০.২২ম। টিপাইমুখ বাঁধে এই মাত্রা ০.২৩ম থেকে ০.৩৫ম অনুমান করা হয়েছে। এই হিসাবও কম হতে পারে এ বিবেচনায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ করার কথা বলা হয়েছে। ভারত সরকারের বক্তব্য হলো যে ভূমিকম্পের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে ভয়ের কারণ নেই। কিন্তু নিরাপদ বাঁধের ডিজাইন সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে তেহরি বাঁধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গড় ত্বরণ (PMA) ০.৭০ম বলে অনেকে মত প্রকাশ করছেন। সে ক্ষেত্রে টিপাইমুখের প্রস্তাবিত ডিজাইন নিরাপত্তার জন্য অনেক কম। তাই এ প্রস্তাবিত বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের শেষ নেই। বাঁধের প্রস্তাবিত উচ্চতার ফলে এ উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, ৬৭টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার আদিবাসী এ বাঁধের ফলে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৬৭টি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের মধ্যে ১৬টি সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে। এখানে বাস করে নাগাদের জেলিয়ানগ্রং (Zelian grong) উপজাতির লোকেরা। এদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিলেও এদের চিরাচরিত জীবনযাত্রা ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। বরাক নদীর স্থানীয় নাম আহু। এ নদী ও টিপাইমুখ অঞ্চলে রয়েছে তাদের অনেক পবিত্র স্থান। বাঁধের জলে তলিয়ে যাবে আহু জলপ্রপাত, যাকে ঘিরে শত শতাব্দী ধরে আদিবাসীদের রূপকথা ও ধর্ম বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, হারিয়ে যাবে আহু জলপ্রপাতের ওপর পাঁচটি হ্রদ, যেখানে তাদের জাতীয় বীর যদুনংয়ের মায়াবি তরবারি লুকিয়ে আছে। এখানকার আদিবাসীরা ক্ষতিপূরণ চায় না, বিদ্যুত্ চায় না; চায় তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে। তাদের দাবি, বরাকে প্রবাহের ওপর সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা হোক।
তৃতীয়ত, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ইতিমধ্যে দুটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র ব্যর্থ হয়েছে অথচ এ প্রকল্প দুটি স্থানীয় আদিবাসীদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। একটি হলো ত্রিপুরায় গোমতী নদীতে ডুম্বুর বাঁধ। ৩০ মিটার উঁচু এই বাঁধ ১০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ১৯৭৬ সালে চালু করা হয়। এতে ৪৬ দশমিক ৩৪ বর্গকিলোমিটার ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। সরকারি হিসাবে জমির মালিকানার রেকর্ড অনুসারে দুই হাজার ৫৫৮টি পরিবার বা প্রায় ১৫ হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা হবে আট থেকে ১০ হাজার আর মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা হবে ৬০ থেকে ৭০ হাজার আদিবাসী। বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ পরিবার জমির দলিল না থাকায় কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। তাই সরকারি হিসাবে এরা অন্তর্ভুক্ত নয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বাধ্য হয়ে বনাঞ্চলে জুম চাষ করে ও গাছ কাটার ব্যবসায় লিপ্ত হয়। এতে গোমতী অববাহিকায় পরিবেশগত বিপর্যয় শুরু হয়। গাছ কেটে ফেলায় পাহাড়গুলোর আচ্ছাদন উঠে যায়। ফলে অনেক বেশি পলি আসতে থাকে। পলি জমে ৩০ বছরের মধ্যে গোমতীর ওপর বাঁধ অকার্যকর হয়ে গেছে। বাঁধ তৈরির সময় অনুমান করা হয়েছিল বছরে শূন্য দশমিক ৩৬২ মিলিমিটার পলি বাঁধে জমবে। প্রকৃতপক্ষে বছরে ৯ দশমিক ৯৪ মিলিমিটার পলি জমে। যে পরিমাণ পলি জমবে বলে অনুমান করা হয়েছিল তার চেয়ে ২৭ গুণ বেশি হারে পলি জমেছে। কোনো মতে ব্যয়বহুল ড্রেজিং করে চালু রাখার চেষ্টা চললেও প্রকল্পটি প্রকৃতপক্ষে অকার্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দাবি উঠেছে, এ বাঁধ খুলে দেওয়ার জন্য এবং আদিবাসীদের তাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরা এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য এত বড় খেসারত কোনো দেশ এখন পর্যন্ত দেয়নি।
দ্বিতীয় ব্যর্থ প্রকল্প মণিপুরে অবস্থিত। এটি ইথাই বাঁধ বা লোকটাক প্রকল্প নামে পরিচিত। ১১৫ কোটি রুপি ব্যয়ে ১৯৮৩ সালে ১০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এ জলবিদ্যুত্ প্রকল্প চালু করা হয়। ইতিমধ্যে পলি জমে বিদ্যুত্ কেন্দ্রের জলাধারের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। জলাধারের পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। কচুরিপানা ও বিভিন্ন আগাছার প্রসার জলকে দূষিত করেছে ও প্রবাহ বিঘ্নিত করেছে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি এমফিল থিসিসের হিসাব অনুসারে লোকটাক প্রকল্প এলাকায় গত দুই দশকে পরিবারগুলোর আয় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। বাঁধ এলাকায় পরিবেশসংকটের ফলে প্রতিদিন উদ্বাস্তুর পরিমাণ বাড়ছে। জলাধারে মাছের পরিমাণ কমে গেছে। মণিপুরবাসীর দাবি, তাই লোকটাক প্রকল্প বন্ধ করা হোক। মণিপুরে জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র ব্যর্থতার ফলে নতুন জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। কোনো নির্বাচিত সরকার মণিপুর রাজ্যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দেয়নি। রাষ্ট্রপতির শাসনকালে মণিপুরে যখন কোনো নির্বাচিত সরকার ছিল না, তখন এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।
চতুর্থত, বাঁধ ও জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মণিপুরে নাগা মহিলা ইউনিয়নের সম্পাদিকা আরাম পামে (Aram Pamei) এক খোলাচিঠিতে সুন্দরভাবে লিখেছেন, “Manipur also falls in one of the genetic hot spots of the world where rare bio-diversity resources are found. The project will submerge the exotic and rare flora and fauna and rich gene pools” (‘মণিপুর রাজ্য জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে পৃথিবীর সর্বাধিক সম্ভাবনাময় অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে দুর্লভ জীববৈচিত্র্যের সম্পদ রয়েছে। প্রকল্পে তলিয়ে যাবে বিচিত্র, অচেনা ও দুর্লভ উদ্ভিদকুল ও প্রাণিকুল ও সমৃদ্ধ জিনের সম্পদভাণ্ডার।’) ইতিমধ্যে লোকটাক প্রকল্পে পাঁচ প্রজাতির মাছ লুপ্ত হয়ে গেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় জনগণের বিরোধিতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক কারণে টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়। স্থানীয় জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভারত সরকার ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রথমত, কেন্দ্রটি নির্মাণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের মালিকানাধীন North Eastern Electric Power Company (NEEPCO) থেকে মণিপুর সরকারের মালিকানাধীন National Hydro Electric Power Company-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের মুনাফার একটি বড় হিস্সা মণিপুর পাবে। দ্বিতীয়ত, জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাতে প্রতিটি পরিবারকে ১০০ ইউনিট বিদ্যুত্ ১০ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে দেওয়া হবে। বিদ্যুত্ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান উত্পাদিত বিদ্যুতের আয়ের মোট এক শতাংশ ও রাজ্য সরকার সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করবে। তৃতীয়ত, জলবিদ্যুত্ প্রকল্পগুলোর পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়ন করে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
ভারত সরকারের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে সরকার ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে মতানৈক্য নিরসন সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হওয়ার ফলে সংক্ষুব্ধ মণিপুরের বাসিন্দারা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কোনো দাগ কাটতে পারেনি। তবু তারা হরতাল, মিছিল, সভা ও আবেদন-নিবেদন করে তাদের বক্তব্য পেশ করে চলছে। আধুনিক ভারতের স্থপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বাঁধকে আধুনিক ভারতের মন্দির বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর বক্তব্য অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা সঠিক। তবে তিনি লক্ষ করেননি যে এ মন্দিরের সোপনগুলো সংখ্যালঘু আদিবাসীদের শোনিতে রঞ্জিত ও অশ্রুতে সিক্ত। প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধ শুধু ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। টিপাইমুখে বৃহত্ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশেও প্রান্তজনের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
আগামীকাল: টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশের স্বার্থ
আকবর আলি খান: গবেষক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অর্থ, বন ও পরিবেশ ও মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব। এ ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
ভারত সরকারের বক্তব্য হলো, টিপাইমুখ বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। যদিও দীর্ঘদিন ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্ষাকালে জল জমিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছে, তবু টিপাইমুখের মুখ্য লক্ষ্য জলবিদ্যুত্, বন্যা নিয়ন্ত্রণ নয়। এর কারণ হলো জলবিদ্যুতের আর্থিক মুনাফা বন্যা নিয়ন্ত্রণের ফিরতির বা লাভের চেয়ে অনেক বেশি।
ভারতে দ্রুত জলবিদ্যুত্ উত্পাদন বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জরুরি। ২০০৪ সালে ভারতে মাথাপিছু বিদ্যুত্ ব্যবহূত হয় ৪৫৭ কিলোওয়াট-ঘণ্টা, চীনে মাথাপিছু ১৫৮৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুত্ ব্যবহূত হয়। চীনে মাথাপিছু বিদ্যুত্ ব্যবহার ভারতের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। কাজেই ভারতকে শিল্পায়নে চীনের কাছাকাছি যেতে হলে বিদ্যুত্ উত্পাদন নাটকীয় হারে বাড়াতে হবে। নিম্ন পর্যায়ে বিদ্যুত্ ব্যবহার সত্ত্বেও ২০০৬-০৭ সালে ভারতে মোট বিদ্যুত্ সরবরাহে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ ঘাটতি ছিল। এই অবস্থায় ১৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রকল্প ভারতের জন্য বিধাতার আশীর্বাদ।
টিপাইমুখ প্রকল্পে প্রতি মেগাওয়াটে বিদ্যুতের বিনিয়োগ ব্যয় হবে ৪ দশমিক ৬৫ কোটি রুপি। অথচ চেন্নাইয়ে একটি ১০০০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রে মেগাওয়াট-প্রতি খরচ হচ্ছে ছয় কোটি রুপি। অন্যদিকে জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রে জ্বালানি খরচ শূন্য এবং পরিচালনা ও মেরামত ব্যয় খুবই নগণ্য। একটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে যে ত্রিপুরা রাজ্যে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের বার্ষিক খরচ হয় তিন কোটি টাকা আর আয় হয় ২১ কোটি টাকা। এই হারে টিপাইমুখের আয় হলে টিপাইমুখ থেকে বছরে কমপক্ষে দুই হাজার ৭০০ কোটি ভারতীয় রুপি আয় হবে। উপরন্তু ভারতের বিদ্যুতের সিংহভাগ আসে কয়লা থেকে। এতে পরিবেশদূষণের সমস্যা রয়েছে। জলবিদ্যুতে এ সমস্যা নেই। পৃথিবীর যেকোনো দেশে এ ধরনের প্রকল্প সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করবে। স্বভাবতই এ ধরনের আকর্ষণীয় প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের আপত্তি অথবা ভারতের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আপত্তি ভারত সরকার শুনবে না। আসলে ঘটেছেও তা-ই।
এ প্রকল্পের বিপক্ষে উপদ্রুত উত্তর-পূর্ব ভারতে বিশেষ করে মণিপুর রাজ্যে প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। এই আপত্তির কারণ চারটি। প্রথমত, প্রস্তাবিত বাঁধটি নিরাপদ নয়। দ্বিতীয়ত, প্রকল্প অঞ্চলে আদিবাসীদের চিরাচরিত জীবনযাত্রার জন্য এটি একটি বড় হুমকি। তৃতীয়ত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এ ধরনের প্রকল্প ইতিমধ্যে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। চতুর্থত, প্রস্তাবিত বাঁধ পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
টিপাইমুখ ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে একটি অতি স্পর্শকাতর এলাকা। এখানে সতত চলছে মহাদেশীয় ভূতাত্ত্বিক প্লেটের সংঘাত এবং ভূমির অধোগমন (বা নিচের দিকে বসে যাওয়া)। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তারাও এ সমস্যা স্বীকার করেন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের প্রণীত পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন দলিলে এ প্রক্রিয়াকে নিম্নরূপে বর্ণনা করা হয়েছে: Subduction process between Indian Plate and Shan-Teanagserim Block along Indo-Burma Mobile Belt has made this area tectonically very active. In addition, continent-continent collision of (1) NE Projection of India shield with Himalayan Thrust Front and (2) Eastern Mishimi Block and thrust implicated Indo-Burmese Block have added to this subduction process (P XII). (ভারত-ব্রহ্ম পরিপ্লব বলয়ের সমান্তরালে ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক প্লেট এবং শান-টেনাসেরিম ব্লকের মধ্যে অবস্থিত অঞ্চলে অধোগমন প্রক্রিয়া ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত সক্রিয় রেখেছে। উপরন্তু মহাদেশ প্লেটের সঙ্গে মহাদেশ প্লেটের মধ্যে ১. হিমালয়ের ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখ ভাগসহ ভারতীয় ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব অভিক্ষেপ ২. পূর্ব মিশিমি ব্লক এবং ভারত-ব্রহ্ম ব্লকের ঘাত-প্রতিঘাত অধোগমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে)।
এই ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেশি। উদ্যোক্তাদের হিসাবে এখানে রিখটার স্কেলে ৭-এর বড় ভূমিকম্প ১৬টি হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হচ্ছে অত্যন্ত বড়, রিখটার স্কেলে এদের পরিমাপ ৮ দশমিক ৫-এর বেশি এবং এ দুটি ভূমিকম্প বিশ্বের সর্ববৃহত্ ভূমিকম্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত (পৃষ্ঠা-১১২)। উদ্যোক্তারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে টিপাইমুখে ভূমিকম্পের অভিঘাত ভারতের অতি বিতর্কিত তেহরি বাঁধ এলাকা থেকে বেশি। তেহরি বাঁধে সর্বোচ্চ গড় ত্বরণ (Peak Mean Acceleration) অনুমান করা হয়েছে ০.২২ম। টিপাইমুখ বাঁধে এই মাত্রা ০.২৩ম থেকে ০.৩৫ম অনুমান করা হয়েছে। এই হিসাবও কম হতে পারে এ বিবেচনায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ করার কথা বলা হয়েছে। ভারত সরকারের বক্তব্য হলো যে ভূমিকম্পের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে ভয়ের কারণ নেই। কিন্তু নিরাপদ বাঁধের ডিজাইন সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে তেহরি বাঁধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গড় ত্বরণ (PMA) ০.৭০ম বলে অনেকে মত প্রকাশ করছেন। সে ক্ষেত্রে টিপাইমুখের প্রস্তাবিত ডিজাইন নিরাপত্তার জন্য অনেক কম। তাই এ প্রস্তাবিত বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের শেষ নেই। বাঁধের প্রস্তাবিত উচ্চতার ফলে এ উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, ৬৭টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার আদিবাসী এ বাঁধের ফলে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৬৭টি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের মধ্যে ১৬টি সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে। এখানে বাস করে নাগাদের জেলিয়ানগ্রং (Zelian grong) উপজাতির লোকেরা। এদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিলেও এদের চিরাচরিত জীবনযাত্রা ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। বরাক নদীর স্থানীয় নাম আহু। এ নদী ও টিপাইমুখ অঞ্চলে রয়েছে তাদের অনেক পবিত্র স্থান। বাঁধের জলে তলিয়ে যাবে আহু জলপ্রপাত, যাকে ঘিরে শত শতাব্দী ধরে আদিবাসীদের রূপকথা ও ধর্ম বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, হারিয়ে যাবে আহু জলপ্রপাতের ওপর পাঁচটি হ্রদ, যেখানে তাদের জাতীয় বীর যদুনংয়ের মায়াবি তরবারি লুকিয়ে আছে। এখানকার আদিবাসীরা ক্ষতিপূরণ চায় না, বিদ্যুত্ চায় না; চায় তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে। তাদের দাবি, বরাকে প্রবাহের ওপর সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা হোক।
তৃতীয়ত, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ইতিমধ্যে দুটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র ব্যর্থ হয়েছে অথচ এ প্রকল্প দুটি স্থানীয় আদিবাসীদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। একটি হলো ত্রিপুরায় গোমতী নদীতে ডুম্বুর বাঁধ। ৩০ মিটার উঁচু এই বাঁধ ১০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ১৯৭৬ সালে চালু করা হয়। এতে ৪৬ দশমিক ৩৪ বর্গকিলোমিটার ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। সরকারি হিসাবে জমির মালিকানার রেকর্ড অনুসারে দুই হাজার ৫৫৮টি পরিবার বা প্রায় ১৫ হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা হবে আট থেকে ১০ হাজার আর মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা হবে ৬০ থেকে ৭০ হাজার আদিবাসী। বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ পরিবার জমির দলিল না থাকায় কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। তাই সরকারি হিসাবে এরা অন্তর্ভুক্ত নয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বাধ্য হয়ে বনাঞ্চলে জুম চাষ করে ও গাছ কাটার ব্যবসায় লিপ্ত হয়। এতে গোমতী অববাহিকায় পরিবেশগত বিপর্যয় শুরু হয়। গাছ কেটে ফেলায় পাহাড়গুলোর আচ্ছাদন উঠে যায়। ফলে অনেক বেশি পলি আসতে থাকে। পলি জমে ৩০ বছরের মধ্যে গোমতীর ওপর বাঁধ অকার্যকর হয়ে গেছে। বাঁধ তৈরির সময় অনুমান করা হয়েছিল বছরে শূন্য দশমিক ৩৬২ মিলিমিটার পলি বাঁধে জমবে। প্রকৃতপক্ষে বছরে ৯ দশমিক ৯৪ মিলিমিটার পলি জমে। যে পরিমাণ পলি জমবে বলে অনুমান করা হয়েছিল তার চেয়ে ২৭ গুণ বেশি হারে পলি জমেছে। কোনো মতে ব্যয়বহুল ড্রেজিং করে চালু রাখার চেষ্টা চললেও প্রকল্পটি প্রকৃতপক্ষে অকার্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দাবি উঠেছে, এ বাঁধ খুলে দেওয়ার জন্য এবং আদিবাসীদের তাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরা এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য এত বড় খেসারত কোনো দেশ এখন পর্যন্ত দেয়নি।
দ্বিতীয় ব্যর্থ প্রকল্প মণিপুরে অবস্থিত। এটি ইথাই বাঁধ বা লোকটাক প্রকল্প নামে পরিচিত। ১১৫ কোটি রুপি ব্যয়ে ১৯৮৩ সালে ১০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এ জলবিদ্যুত্ প্রকল্প চালু করা হয়। ইতিমধ্যে পলি জমে বিদ্যুত্ কেন্দ্রের জলাধারের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। জলাধারের পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। কচুরিপানা ও বিভিন্ন আগাছার প্রসার জলকে দূষিত করেছে ও প্রবাহ বিঘ্নিত করেছে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি এমফিল থিসিসের হিসাব অনুসারে লোকটাক প্রকল্প এলাকায় গত দুই দশকে পরিবারগুলোর আয় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। বাঁধ এলাকায় পরিবেশসংকটের ফলে প্রতিদিন উদ্বাস্তুর পরিমাণ বাড়ছে। জলাধারে মাছের পরিমাণ কমে গেছে। মণিপুরবাসীর দাবি, তাই লোকটাক প্রকল্প বন্ধ করা হোক। মণিপুরে জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র ব্যর্থতার ফলে নতুন জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। কোনো নির্বাচিত সরকার মণিপুর রাজ্যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দেয়নি। রাষ্ট্রপতির শাসনকালে মণিপুরে যখন কোনো নির্বাচিত সরকার ছিল না, তখন এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।
চতুর্থত, বাঁধ ও জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মণিপুরে নাগা মহিলা ইউনিয়নের সম্পাদিকা আরাম পামে (Aram Pamei) এক খোলাচিঠিতে সুন্দরভাবে লিখেছেন, “Manipur also falls in one of the genetic hot spots of the world where rare bio-diversity resources are found. The project will submerge the exotic and rare flora and fauna and rich gene pools” (‘মণিপুর রাজ্য জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে পৃথিবীর সর্বাধিক সম্ভাবনাময় অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে দুর্লভ জীববৈচিত্র্যের সম্পদ রয়েছে। প্রকল্পে তলিয়ে যাবে বিচিত্র, অচেনা ও দুর্লভ উদ্ভিদকুল ও প্রাণিকুল ও সমৃদ্ধ জিনের সম্পদভাণ্ডার।’) ইতিমধ্যে লোকটাক প্রকল্পে পাঁচ প্রজাতির মাছ লুপ্ত হয়ে গেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় জনগণের বিরোধিতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক কারণে টিপাইমুখ জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়। স্থানীয় জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভারত সরকার ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রথমত, কেন্দ্রটি নির্মাণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের মালিকানাধীন North Eastern Electric Power Company (NEEPCO) থেকে মণিপুর সরকারের মালিকানাধীন National Hydro Electric Power Company-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে জলবিদ্যুত্ কেন্দ্রের মুনাফার একটি বড় হিস্সা মণিপুর পাবে। দ্বিতীয়ত, জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাতে প্রতিটি পরিবারকে ১০০ ইউনিট বিদ্যুত্ ১০ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে দেওয়া হবে। বিদ্যুত্ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান উত্পাদিত বিদ্যুতের আয়ের মোট এক শতাংশ ও রাজ্য সরকার সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করবে। তৃতীয়ত, জলবিদ্যুত্ প্রকল্পগুলোর পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়ন করে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
ভারত সরকারের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে সরকার ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে মতানৈক্য নিরসন সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হওয়ার ফলে সংক্ষুব্ধ মণিপুরের বাসিন্দারা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কোনো দাগ কাটতে পারেনি। তবু তারা হরতাল, মিছিল, সভা ও আবেদন-নিবেদন করে তাদের বক্তব্য পেশ করে চলছে। আধুনিক ভারতের স্থপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বাঁধকে আধুনিক ভারতের মন্দির বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর বক্তব্য অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা সঠিক। তবে তিনি লক্ষ করেননি যে এ মন্দিরের সোপনগুলো সংখ্যালঘু আদিবাসীদের শোনিতে রঞ্জিত ও অশ্রুতে সিক্ত। প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধ শুধু ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। টিপাইমুখে বৃহত্ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশেও প্রান্তজনের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
আগামীকাল: টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশের স্বার্থ
আকবর আলি খান: গবেষক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। অর্থ, বন ও পরিবেশ ও মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব। এ ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
No comments