যৌথ বাহিনীর অভিযান: কী ঘটেছিল মোহাম্মদপুরে by সুদীপ অধিকারী

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জুম্মন ও মিরাজ নামে দুইজন নিহত হয়েছে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে আরও ৫ জনকে আটক করা হয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে চাঁদ উদ্যানের ৬ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়ির ছাদে এ ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা। এ সময় সন্ত্রাসীরা গুলি চালানো শুরু করে। আত্মরক্ষায় অভিযানে যাওয়া যৌথ বাহিনীর সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এরই জেরে দু’জনের মৃত্যু হয়। পরে আটক ৫ জন হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করলে তাদের থানা হেফাজতে নেয়া হয়। গতকাল সরজমিন মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। উৎসুক মানুষ ভিড় করছে লাশ উদ্ধার করা ওই ৯ নম্বর বাড়ির সামনে। টিনের ছাউনিঅলা আধাপাকা বাড়িটিতে বেশির ভাগই নিম্ন্নআয়ের মানুষের বসবাস। বাড়িটির মেইন গেটের উপরে ছোট্ট একতলা ভবন। সরু লোহার মই দিয়ে উপরে উঠে দেখা যায়- ওই ভবনের ছাদের উপর ছোট ছোট দু’টি রুমে বিভিন্ন পেশার কর্মজীবীরা মেস আকারে থাকেন। ওই রুমের টিনের চালার উপর থেকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জুম্মন ও মিরাজের লাশ উদ্ধার করা হয়। বাড়িটির দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা মো.  জুলহাস বলেন, বুধবার রাত ১২টার পর হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ পাই। সেনাবাহিনী-পুলিশের পক্ষ থেকে বার বার এলাকাবাসীর উদ্দেশ্যে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে- আপনারা কেউ বাসা থেকে বের হবেন না। আপনারা সকলে ঘরের মধ্যে থাকুন। কাউকে বাসায় ঢুকতে দিবেন না। আমি তখন ভাব বুঝতে গেটের সামনে বের হই। তখন আমাদের সামনের বাজারের রাস্তার দুইপাশে অবস্থান নিয়ে একদল সন্ত্রাসীকে ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এরই মধ্যে কোনো দিক না পেয়ে জুম্মন, মিরাজসহ বেশ কয়েকজন দৌড়ে আমাদের গলিতে ঢুকে পড়ে। তারা আমাদের পাশের ৬ নম্বর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানের ওপর দিয়ে দেওয়াল বেয়ে ভবনের উপরে উঠে যায়। বাকিরা বাড়ির টিনের ওপরে উঠতে পারলেও একজন নিচ থেকেই ধরা পড়ে। এ সময় যৌথ বাহিনীর সদস্যরাও তাদের ধাওয়া দিলে আমাদের ছাদের ওপরের রুমের টিনের ওপর উঠে জুম্মন-মিরাজেরা গুলি ও ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। দুইপক্ষের গোলাগুলির শব্দে তখন পুরো এলাকা প্রকম্পিত হচ্ছিল। আমিও দৌড় দিয়ে ঘরে ঢুকে যাই। গুলির শব্দ থেমে গেলে আবারো আমিসহ অনেকেই বাইরে বের হই। একপর্যায়ে সেনাসদস্যরা উপরে গিয়ে দুইজনের লাশ উদ্ধার করে। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় ৬ নম্বর বাড়ির ভাড়াটিয়া ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী মো. বিল্লাল তার ভ্যানে করে ওই লাশ দু’টো সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপতালে নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, নিহত মিরাজ ও জুম্মনের গ্রামের বাড়ি ভোলাতে হলেও বর্তমানে তারা  চাঁদ উদ্যান এলাকার ৮ নম্বর রোডে বসবাস করতেন। জুম্মনের বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। আর মিরাজ শাহ আলমের সন্তান। তারা তেমন কোনো পেশায় জড়িত ছিল না। সারা দিন ঘুরে বেড়াত। তারা মূলত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাথা ‘মাহী গ্রুপের’ লোক। তিনি বলেন, যে দু’জন মারা গেছে, তাদের নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। তবে আটক হওয়া ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই আমাদের মেসের ছেলে। একজন শুধু সন্ত্রাসী। তিনি বলেন, আটক হওয়াদের মধ্যে মেহেদী, মিরাজ, হোসেন ও মোমিন আমার মেসের ছেলে। এদের মধ্যে মেহেদী ও মোমেন স্থানীয় ঠিকাদার মান্নানের অধীনে রড কাটার কাজ করতো। হোসেন ইটভাঙার কাজ করে সঙ্গে তালার কাজ করে। আর মোমিন ভাঙ্গারির ব্যবসা করে। ঠিকাদার মান্নান বলেন, আটককৃতদের মধ্যে মেহেদী ও মিরাজ আমার এখানে রড কাটার নিয়মিত কাজ করতো। খাতা-পত্রে তাদের সব প্রমাণ রয়েছে। তারা কোনো ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। নারগিস, রেহেনা, বিল্লাল, জসিমসহ বেশ কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, ছিনতাইকারীদের দাপটে দিনের বেলায় রাস্তা দিয়ে চলতে পারি না। কাজ করে ফেরার পথে গলায় ধারালো অস্ত্র ধরে সব নিয়ে চলে যায়। জুম্মন ও মিরাজের লাশ বহন করে নিয়ে যাওয়া ভ্যানের চালক মো. বিল্লাল বলেন, বুধবার রাতে যখন গোলাগুলি শেষে দু’টি লাশ উদ্ধার করা হয় তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমার ভ্যান দেখে চালকের খোঁজ করছিল। আমি তখন এগিয়ে যাই। আমাকে তারা বলেন- এখন তো তেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, আপনি একটু লাশ দুটো সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দিয়ে আসেন। তখন তারাই আমার ভ্যানে লাশগুলো তুলে দেয়। আমি তাদের সঙ্গে লাশ নিয়ে হাসপাতালে দিয়ে আসি। তিনি বলেন, আমাদের গলির মাথায় একটি বহুতল ভবন আছে। বেশির ভাগ সময়ই এরা ওই ভবনের ছাদে আড্ডা দিতো।

এদিকে মোহাম্মদপুর থানার নথি থেকে জানা গেছে- যৌথ বাহিনীর গুলিতে নিহত জুম্মনের বিরুদ্ধে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৯ই আগস্ট ২০২৩, ৪ঠা জুলাই ২০২৩, ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২রা জানুয়ারি ২০২৩, ৩১শে মার্চ ২০২০, ৫ই মার্চ ২০২৩, ৬ই মার্চ ২০২৩ ও ১৭ই ডিসেম্বর ২০১৮ সালে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। অস্ত্র, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, হত্যাচেষ্টা, মারামারি, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে তার বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়েছে। নিহত মিরাজের বিরুদ্ধে ৭ই জানুয়ারি ২০২৩-এ মাদক, ১৫ই ডিসেম্বর ২০২০-এ মারামারি, ১৫ই মার্চ ২০২৪ ও ১৫ই জুন ২০২১ সালে হত্যা চেষ্টা, ছিনতাইসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজ উদ্দিন বলেন, চাঁদ উদ্যানের পাঁচ নম্বর রোডের এক বাড়ির চিলেকোঠায় ১০-১৫ জন সন্ত্রাসী থাকার খবর পেয়ে বুধবার রাত ১২টার দিকে সেখানে অভিযানে যায় যৌথ বাহিনী। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়। পরে  জুম্মন ও মিরাজ নামে দু’জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা দু’জনেই চাঁদ উদ্যান এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। আটককৃতদের বর্তমানে মোহাম্মদপুর থানা হাজতে রাখা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের আদালতে প্রেরণ করা হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপি’র মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জুয়েল রানা বলেন, কব্জি কাটা আনোয়ারকে গ্রেপ্তারের পর থেকে অপর একটি গ্রুপ মোহাম্মদপুরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। নিহতরা সেই গ্রুপেরই সদস্য। তিনি বলেন, বুধবার রাতে তাদের অবস্থানের খবর পেয়ে যখন চাঁদ উদ্যান এলাকায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টিম যায় তখন সন্ত্রাসীরা একটি বাড়ির ছাদ থেকে ইট-পাটকেল ও গুলি ছোড়া শুরু করে। আত্মরক্ষার্থে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা পাল্টা গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলেই ২ জনের মৃত্যু হয়। এ সময় বেশ কয়েকজন পালিয়ে গেছে। পরে ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল ও একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়।

অপরদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, চাঁদ উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে যৌথ বাহিনীর একটি দল অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় একটি গলির দুই পাশ যৌথ বাহিনীর সদস্যরা ঘেরাও করলে ‘সন্ত্রাসীরা’ একটি একতলা ভবনের ছাদ থেকে অতর্কিত গুলি করে। আভিযানিক দলটি আত্মরক্ষার্থে তৎক্ষণাৎ পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং ৫ সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করতে সক্ষম হয়। পরে ওই বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ছাদের উপর থেকে দু’জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। আর আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি এবং একটি চাপাতি। আইনগত ব্যবস্থা নিতে তাদের মোহাম্মদপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.