গুলিতে বাবার মৃত্যু, জিদনীর সামনে অনিশ্চিত জীবন by ফাহিমা আক্তার সুমি
জাকিরের স্ত্রী ছালমা বেগম মানবজমিনকে বলেন, আমার একমাত্র মেয়ে জিদনী। সে সবেমাত্র সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চালাকালীন সময়ে গত ১৯শে জুলাই গুলিবিদ্ধ হয় ওর বাবা। সে ঘটনার দিন সকালে রায়েরবাগ বোনকে দেখতে তার বাসায় যায়। কামরাঙ্গীরচরে একটি কাপড়ের কারখানায় দর্জির কাজ শুরু করেছিল। শুক্রবার ঘটনাটি ঘটার আগে সোমবার বাড়িতে এসেছিল। ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় থাকে। আগে মানুষের কাছে কাজ শিখে নিজে কাজ করতো। তারা আগে থেকেই খুব অভাবী ছিল। বাবা মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল তৃতীয়। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি। এখন নিজের কাজ করতে হয়। ওর বাবার একার আয়ে আমাদের সংসার চলতো। সারা জীবনের জন্য বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলো আমার মেয়েটি।
তিনি বলেন, স্বামী না থাকলে একজন নারীর জীবন কঠিন হয়ে যায়। বাবাহারা সন্তানের কতো কষ্ট, কতো আহাজারি সেটি শুধু সেই সন্তানই জানে। সে থাকলে তার কাছে আমাদের মা-মেয়ের সব আবদার থাকতো। এখন আমাদের আর কেউ নেই। প্রতি মাসে সে কাজ করে দশ হাজার টাকার মতো পাঠাতো সেটি দিয়ে মোটামুটি সংসার চলতো। মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসতো। আমারও বাবা নেই, মা নেই। ছোটবেলায় মারা গেছেন। এখন আমি কোথায় যাবো? ছোটবেলা থেকে কষ্ট করছি, ভেবেছিলাম বিয়ের পর কষ্ট দূর হবে, হয়েছিল কিন্তু টিকেনি বেশিদিন। ওর বাবা থাকলে আমাদের জীবনে কোনো চিন্তা ছিল না।
ছালমা বেগম বলেন, ঘটনার দিন যখন আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যায় তখন আমাকে ফোনে জানায় পাশে থাকা শিক্ষার্থীরা। সেদিন সকালে তার সঙ্গে আমার মোবাইলে কথা হয়। তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলাম। ওইটাই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। সে সময় পুরো কারফিউ চলছিল দেশে। শুক্রবার গুলিবিদ্ধ হয় আর আমি তার কাছে যেতে পারি মঙ্গলবার। গিয়ে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে কথা বলছে। আমার ও মেয়ের জন্য হয়তো বেঁচেছিল ততক্ষণ। ঘটনার দিন তিনটা বাজে গুলি লেগেছিল আর পরের দিন চারটা বাজে অপারেশন হয় তার। হাসপাতালের বেডে শুয়ে মেয়েটাকে দেখামাত্রই বুকে টেনে নিয়েছিল। মেয়েকে দেখেই ওর বাবা বলেছিল, ‘আম্মু তুমি ভালো আছো?’ বরিশাল থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে পদে পদে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, অনেক ঝুঁকি ছিল। পাঁচটা দিন একটুও ঘুম ছিল না আমার স্বামীর চোখে, ক্ষত স্থানের যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। পেটের নিচের দিকে গুলি লাগে। পরে ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার রাতে মারা যায়। গ্রামে নিয়ে তার লাশ দাফন করা হয়। সে কখনো তার মেয়েটির সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলতো না। তার লেখাপড়ার জন্য কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দিতো না। মেয়ে যত বড় হবে তত তার বাবার অভাব বুঝবে। যখন সবার বাবাকে দেখবে তখন তার মুখটা কালো হয়ে যাবে। ওর বাবার মৃত্যুর পরে অনেক নীরব হয়ে গেছে, কম কথা বলে। বাবার প্রাণ ছিল সে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বাড়িতে শুধু ভিটে আছে- কোনো জমি নেই। একটা ঘর তৈরি শুরু করেছিল সেটিও শেষ হয়নি পুরোপুরি। যে মারা গেছে তাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। এখন মেয়েটাকে নিয়ে আমার যত চিন্তা। আমার মেয়েটাকে অনেক পড়াশোনা করাতে চাই, পড়াশোনা শেষে তার একটা ভালো চাকরি হবে একদিন। আমি মা আমার সবটা দিয়ে বড় করতে চাই, ভবিষ্যতে সেই আমাকে দেখে রাখবে। আমার একটা কাজের ব্যবস্থা হলে মেয়েটিকে ভালোভাবে মানুষ করতে পারতাম। সবেমাত্র সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে; এখন যদি শিখাতে না পারি তাহলে ভালো কিছু করতে পারবে না। আমি ছোটবেলা থেকে যত কষ্ট করে বড় হয়েছি আমি চাই না আমার সন্তান কষ্ট করুক।
No comments