মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় by সুদীপ অধিকারী
ডিএনসিসি’র ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে গেলে ইশতিয়াক আহমেদ, এমদাদ হোসেন, রুবেল মিয়া, মো. জুয়েল, হাসান তালুকদারসহ বেশ কয়েকজন জানান, ওয়ার্ডটির সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান শুধু মোহাম্মদপুরে নয় শ্যামলী-আদাবর এলাকাতেও তার ব্যাপক দাপট। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন ছাত্রলীগ-যুবলীগের সদস্যদের ব্যবহার করে বিপুল সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন এই পাগলা মিজান। ১৯৭৩ সালে জীবিকার তাগিদে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় এসে হোটেল বয়ের কাজ নেন। অপরাধ জগতে তার হাতেখড়ি ম্যানহোলের ঢাকনা চুরির মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর খামারবাড়ি খেজুর বাগান এলাকায় ছিনতাই করতে গেলে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়া মসজিদের পাশের পুকুরে নেমে পড়েন মিজান। যাতে পুলিশ কাছে আসতে না পারে সেজন্য কাপড় ছাড়াই উপরে উঠে আসেন। তার এ ধরনের কাজের জন্য পুলিশ তাকে ‘পাগলা’ আখ্যা দেয়। তখন থেকেই এলাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে ‘পাগলা মিজান’ হিসাবে। ’৮০ ও ’৯০ দশকে এই পাগলা মিজান সংসদ ভবন এলাকা থেকে শুরু করে মোহাম্মদপুর স্যার সৈয়দ রোড, ইকবাল রোড এলাকা ও মিরপুর রোড এলাকার মেইন রোডের বিদ্যুতের খুঁটি থেকে বিদ্যুৎ মিস্ত্রি দিয়ে তামার তার চুরি করাতো। এভাবে একের পর এক সরকারি স্থাপনায় চুরি করতো মিজান বাহিনীর সদস্যরা। তখন মোহাম্মদপুরে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত বাড়ি দখলেরও অভিযোগ ওঠে মিজান বাহিনীর বিরুদ্ধে। একের পর এক চুরি-ছিনতাই ও দখলের মাধ্যমে মোহাম্মদপুর এলাকায় অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন মিজান। ফ্রিডম পার্টির মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ির পর ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন পাগলা মিজান। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নিজের পাগলা নাম পাল্টে হয়ে যান হাবিবুর রহমান মিজান। তৎকালীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতার আশীর্বাদে ’৯২ সালে কাউন্সিলর বনে যান মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজান। ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকেন মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকা। ১৯৯৪ সালে বনে যান ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মিজান হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া। বাড়ি দখল, জমি দখল, খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অনেক অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠতে থাকে তার বিরুদ্ধে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, নিজ দলেরই কেউ তার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করে না। এক সময়ের জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার এই নিয়ন্ত্রক মিজান মাদকের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজধানীর নামি-দামি বড় বড় হোটেলে মিটিং করতেন, আড্ডা দিতেন। আর ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দৈনিক ৩০ হাজার টাকা নিতেন। ওই টাকা তোলার কাজে নিয়োজিত ছিল- মর্তুজা, জিলানীসহ বেশ কয়েকজন। এ ছাড়াও টোল মার্কেটের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল মিজানের। মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. শাহেদ বলেন, পাগলা মিজান আমাদের ক্যাম্পের বিদ্যুতের সংযোগের লাইন দু’টি ভাগে ভাগ করে একটি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দিতেন। আরেকটি ক্যাম্পের বাজারে সংযোগ দেয়া হয়। প্রায় ২৫০টি দোকান থেকে বিদ্যুতের জন্য আলাদাভাবে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আদায় করতো মিজানোর লোক। ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ভারতে পালানোর সময় ১১ই অক্টোবর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ফজলুর রহমানের (মৃত) বাসা থেকে হাবিবুর রহমান মিজানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিন ও নগদ দুই লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। তখন তাকে ঢাকায় নিয়ে এসে প্রথমে লালমাটিয়ায় তার কাউন্সিলর কার্যালয়ে এবং পরে মোহাম্মদপুরে আওরঙ্গজেব রোডে তার বাসায় অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। তখন তার বাসা থেকে ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক ও এক কোটি টাকার এফডিআর উদ্ধার করা হয়। তৎকালীন র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম অভিযান পরিচালনা শেষে বলেছিলেন, মিজানের আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় দুটো বাড়ি ও গাড়ি রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ থেকেই তিনি এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও চাঁদাবাজি ও জমি দখলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।’ তবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবলে অল্প সময়ের মধ্যেই কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন পাগলা মিজান। বাইরে বের হয়ে আবারো বীরদর্পে নিজের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেন মিজান। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও মোহাম্মদপুর এলাকায় আওয়ামী লীগের হয়ে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন তিনি। নিজের বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে অস্ত্র হাতে ধাপিয়ে বেড়ান আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর। এতসব কাণ্ডে একাধিক মামলার আসামি হয়েও এখনো অধরা পাগলা মিজান। ছাত্রহত্যা মামলার আসামি হয়েও মিজান বর্তমানে নিজেকে বিএনপি’র সমর্থক দাবি করে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে গোপনে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ করেছে তার এলাকার বাসিন্দারা।
মিজানের যত সম্পত্তি: মো. নিজামউদ্দিন নামে মোহাম্মদপুরের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় যুবলীগ-ছাত্রলীগের সদস্য ও নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর দিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন সাবেক এই কাউন্সিলর। মাদকের এই গডফাদার মোহাম্মদপুর এলাকায় ভূমিদস্যু হিসেবেই বেশ পরিচিত। জমি দখলকে কেন্দ্র করে গত বছর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান সংলগ্ন তুরাগ নদের ওপারে একটি রিয়েল এস্টেটের ছয় কর্মীকে গুলি এবং আরও ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে মিজান বাহিনীর সদস্যরা। আবাসনের ওই জমি দখলকে কেন্দ্র করে তখন জুয়েল নামের এক যুবককে হত্যা করে লাশ তুরাগে ফেলে দেয়ারও অভিযোগ ওঠে মিজানের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া মিজান শ্যামলী মাঠের পশ্চিম পাশের জমির একাংশ দখল করে বানিয়েছেন মার্কেট। সেখানে তিন শতাধিক ঘর তুলে ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় থেকে একটু এগিয়ে বছিলা রোডে ঢুকলেই চোখে পড়বে হাবিবুর রহমান মিজানের নিজের নামে ‘হাবিব মার্কেট’। এরপর লাউতলা ভেতরের রোডে ঢুকলেই এক বিশাল প্লট (খালি জমি) রয়েছে মিজানের। চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকাতেও তৎকালীন হাউজিং চেয়ারম্যান প্রয়াত আক্কাস হাজীর কাছ থেকে বেশ কিছু প্লট বাগিয়ে নিয়েছিলেন এই মিজান। লালমাটিয়া এলাকায় স্বপনপুরী হাউজিংয়ে রয়েছে তার আরও দু’টি বহুতল বাড়ি। লালমাটিয়া বি-ব্লকে একটি ছয় তলা বাড়ি (২৪/এ)। এরই পাশে ২৪/এ এর সি/ডি নম্বরে লালমাটিয়ায় আরও একটি ৭ তলা ভবন রয়েছে তার। মোহাম্মাদপুরের আওরঙ্গজেব সড়কে আছে আরেকটি ফ্ল্যাট, যেখানে তিনি নিজে বসবাস করেন। এ ছাড়াও রাজধানীর পল্টন এলাকার একটি পাঁচতলা ভবনের মালিক হাবিবুর রহমান মিজান। সেখানেও ১০টি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে এই পাগলা মিজান মিশুক অ্যান্ড কোম্পানির মালিক। এ ছাড়া তিনি ঢাকার হজ কাফেলা অ্যান্ড ট্র্যাভেলসের মালিক বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদপুরের স্থায়ী বাসিন্দারা। নিজের নামে ছাড়াও দেশে-বিদেশে নামে- বেনামে টাকার পাহাড় গড়েছেন ক্যাসিনো কাণ্ডের অন্যতম হোতা মোহাম্মদপুরের সাবেক এই কাউন্সিলর। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মিজানের আলিশান দু’টি বাড়ি ও দামি গাড়ি রয়েছে। যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে অনেক আগেই জনসম্মুখে এসেছে। তার ভাইদের নামেও রয়েছে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ। সরকারি টেন্ডার ছাড়াই বিভিন্ন দপ্তরের কাজ বাগিয়ে নিয়ে মিজান তার ভাইদের দিতেন। পাঁচ ভায়ের মধ্যে মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান ১৯৯৫ সালে দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে নিহত হন। বর্তমানে ঠিকাদার হেলাল, দুলাল ও শাজাহান নামে তার আরও তিনটি ভাই রয়েছে। মিজানের ভাই শাজাহান লালমাটিয়া ওয়াসার অফিস নিয়ন্ত্রণ করতো। একই সঙ্গে আবাসিক গ্যাসলাইন নিয়ন্ত্রণ করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। মিজানের আরেক ভাই হেলাল আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঢাকা-১৩ আসনের সদ্য সাবেক এমপি’র আমলে বিনা টেন্ডারে ৫ থেকে ৬শ’ কোটি টাকার এলজিআরডি ও সিটি করপোরেশনের কাজ করছে। যার ভাগ এলাকাটির আওয়ামী লীগের সব বড় নেতার পকেটে ঢুকতো নিয়মিত।
পাগলা মিজানের শক্তি: হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের এত ক্ষমতার উৎস বর্তমান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও এলাকাটির সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য। এ ছাড়াও এলাকাটিতে তার মাই ম্যান হিসেবে খ্যাত আদাবর থানা যুবলীগের আহ্বায়ক আরিফুর রহমান তুহিন। এই তুহিনের মাধ্যমেই আদাবর এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাখেন মিজান। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর এলাকায় রয়েছে সাবেক কাউন্সিলর রাজিব, আলা বক্সের ভাই ইয়াসিন বক্স, সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুদ রানা শাহীন, মজিবর প্রমুখ। যারা সকলেই মোহাম্মদপুর এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা এবং পাগলা মিজানের সহকারী বলে সকলের কাছে পরিচিত। ছাত্র আন্দোলনের সময় এদের সকলকেই অস্ত্র হাতে রাস্তায় নামায় মিজান। এদের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের সময় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাতে চালাতে গত ১৯শে জুলাই মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ্ রোডে শটগানে বুলেট আটকে যায় সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুদ রানা শাহীনের। সেদিন একটি পিস্তলও হারিয়ে ফেলেন শাহীন। তিনিও এই পাগলা মিজানের খাস লোক হিসেবে পরিচিত।
এসব বিষয়ে জানতে মিজানের বসবাস করা মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব সড়কের বাসা, লালমাটিয়ার বাড়ি, মার্কেটে একাধিকবার গেলেও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৫ই আগস্ট পট পরিবর্তনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরও বন্ধ রয়েছে।
এবিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান বলেন, আমরা জুলাই বিপ্লবের বিরুদ্ধে জড়িত আসামিদের ধরতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিযান পরিচালনা করছি। একই সঙ্গে সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এসব পাগলা মিজানের মতো অপরাধীরা আত্মগোপনে থাকায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। আশা করছি তারাও আইনের জালে ধরা পড়বে।
No comments