২০০৬-এর পুনরাবৃত্তি? কেন লেবাননে ইসরাইলের স্থল আক্রমণ সহজ হবে না

২০০৬-এর জুলাইতে শুরু হওয়া মাসব্যাপী যুদ্ধে ইসরাইলি সৈন্যরা প্রচণ্ড লড়াইয়ে মগ্ন ছিল। হিজবুল্লাহ যোদ্ধারাও এক চিলতে জমি ছাড়তে নারাজ ছিল। তখনকার সংঘাতে কমপক্ষে ২০টি ট্যাংক ধ্বংস করে হিজবুল্লাহ এবং এতে ১২১ জন ইসরাইলি সৈন্য মারা যায়। যুদ্ধের ফলাফল মূল্যায়নের জন্য সরকার-নিযুক্ত উইনোগ্রাড কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, ‘ইসরাইল একটি দীর্ঘ যুদ্ধ শুরু করেছিল, যা তার সামরিক বিজয় ছাড়াই শেষ হয়েছিল’। ইসরাইলের – কোড-নাম অপারেশন চেঞ্জ অফ ডাইরেকশন –কে কমিশন ব্যর্থ বলে অভিহিত করে। তারা বলে, 'ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে হাইকমান্ড এবং স্থল বাহিনীর আচরণের কারণে। লেবাননের সামনে তারা একটি কার্যকর সামরিক প্রতিক্রিয়া প্রদান করতে পারেনি।'

প্রায় দুই দশক পর, মঙ্গলবার ইসরাইলি সামরিক বাহিনী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে দক্ষিণ লেবাননে 'সীমিত, স্থানীয়  লক্ষ্যনির্ভর স্থল অভিযান শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ইসরাইলের অভিযানের জন্য সৈন্য ও ট্যাঙ্কের প্রকৃতি এবং মাত্রার উপর ভিত্তি করে অনুমান করা যায় যে দেশটি লেবাননে আরও দীর্ঘ আক্রমণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে।  গাজায় যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে তার দক্ষিণ প্রতিবেশীকে চাপ দেয়ার জন্য ৮ অক্টোবর ইসরাইল রকেট ছুড়তে শুরু করেছে। হিজবুল্লাহর বোমা হামলার ফলে উত্তর ইসরাইলের প্রায় ৬০,০০০ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। লেবানিজ গোষ্ঠী বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে ইসরাইল যদি ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজায় বছরব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটায়, যার মধ্যে ইসরাইলে প্রায় ১১০০ জন নিহত হয়েছিল, তাহলে তারা যুদ্ধ বন্ধ করবে। গাজার যুদ্ধে ৪১৬০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

গত এক বছরে লেবাননে ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এক লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গত সপ্তাহে ইসরাইল  বিমান হামলা চালিয়ে  হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে। গত সপ্তাহে এক মিলিয়ন লেবানিজ তাদের বাড়িঘর ও এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন স্কুল, ক্যাম্প এবং রাস্তার ধারে কোনোমতে মাথা গুঁজে রয়েছেন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নির্ধারিত লক্ষ্যটি পরিচিত:   হিজবুল্লাহ যাতে আর ইসরাইলিদের হুমকির কারণ না হতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন যে, লেবাননে আরও একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে ইসরাইল যে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে তা অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে।

ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রধান স্টাফ হারজি হালেভি গত সপ্তাহে স্থল আক্রমণের আগে সাঁজোয়া ব্রিগেডকে ২০০৬ -এর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে বলেছেন। হালেভি সৈন্যদলকে বলেন, “আপনারা হিজবুল্লাহদের সাথে মুখোমুখি হলে দেখবেন যে একজন পেশাদার, অত্যন্ত দক্ষ এবং যুদ্ধ-অভিজ্ঞ বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার অর্থ কী। আপনাকে  তাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী এবং অনেক বেশি অভিজ্ঞ হতে হবে। ' সাঁজোয়া ব্রিগেডের পাশাপাশি, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী তার বায়ু সৈন্যদের ৯৮তম ডিভিশনকে একত্রিত করেছে, যারা গাজায় কয়েক মাস ধরে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আল জাজিরার ডিফেন্স এডিটর অ্যালেক্স গ্যাটোপোলোস বলেছেন যে অভিজাত ইউনিট পাঠানোর মাধ্যমে, ইসরাইল হিজবুল্লাহকে এই বার্তাটি পৌঁছে দিচ্ছে যে এটিকে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে তারা অটল। গ্যাটাপুলোস বলেন, ডিভিশনটিতে প্রায় ১২,০০০ থেকে ১৪,০০০ অভিজ্ঞ সৈন্য এবং কয়েক ডজন ট্যাঙ্ক ও অস্ত্র রয়েছে।' গ্যাটোপোলোস ইসরাইলি সেনাবাহিনী সম্পর্কে বলছেন, যখন আপনি মনে করেন যে আপনার প্রতিপক্ষ লড়াই করতে পারবে না, এর অর্থ আপনি তাদের অবমূল্যায়ন করছেন।'

গ্যাটোপোলোস বলছেন, '২০০৬ সালের তুলনায়, হিজবুল্লাহ দক্ষিণে মোতায়েন প্রায় ৫,০০০ সৈন্য থেকে কয়েক হাজার যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে। এর অভিজাত রাদওয়ান ফোর্সের যোদ্ধা, যারা "দক্ষিণে প্রশিক্ষণ দেয় এবং  গোটা ভূখণ্ডকে হাতের তালুর মতো চেনে  তাদের সংখ্যাও প্রায় ৩,০০০। হিজবুল্লাহর কাছে হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্রের অস্ত্রাগার রয়েছে বলে জানা যায়। ২০১৩ সাল থেকে বাশার আল-আসাদের শাসনের সমর্থনে হস্তক্ষেপ করার সময় এই গোষ্ঠীটি সিরিয়ায় যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছে। যদিও ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এখন হিজবুল্লাহর অতর্কিত আক্রমণগুলি প্রতিরোধ করার জন্য নজরদারি ড্রোনগুলির একটি শক্তিশালী বহরের উপর নির্ভর করতে পারে, ভূগর্ভস্থ যুদ্ধের টানেলগুলি এখনও লেবানিজ গ্রুপকে হোম টার্ফে সামরিক সুবিধা দিতে পারে।

প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিক এবং ওয়াশিংটন ডিসির আরব সেন্টারের সিনিয়র ফেলো নাবিল খুরি আল জাজিরাকে বলেছেন যে, সামরিকভাবে ইসরাইল হয়তো কিছু লোককে হত্যা করতে পারে। তবে তাদের লক্ষ্য তার চেয়ে অনেক বেশি । তারা গাজা, পশ্চিম তীর এবং এখন স্পষ্টভাবে লেবাননের জন্য একটি বিস্তৃত নকশা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। 'শেষ পর্যন্ত, হিজবুল্লাহর হুমকিকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী একটি "সীমিত" অপারেশন পরিচালনা করার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যদিও সেই লক্ষ্য পূরণ করতে তারা  বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরাইলের প্রথম অভিযানকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) দ্বারা সৃষ্ট হুমকিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে একটি সংক্ষিপ্ত মিশন হিসাবে উল্লেখ  করা হয়েছিল, যার ফল দক্ষিণ লেবাননে ১৮ বছরের দখলদারি। সাবরা এবং শাতিলার ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলের স্থল আগ্রাসন এবং ৩৫০০ জন লোকের গণহত্যাও শেষ পর্যন্ত লেবাননে একটি নতুন শক্তির উত্থানে অবদান রেখেছিল- হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহর একটি বৃহৎ অস্ত্রাগার রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে লেবাননের যেকোনো স্থান থেকে ইসরাইলি ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। বিশ্লেষকরা বলেছেন, নৈতিকভাবে এবং ভৌগোলিকভাবে - ইসরাইল তার রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলি সুরক্ষিত করতে কতদূর যেতে ইচ্ছুক তা এখনও স্পষ্ট নয়।
গ্যাটোপোলোস বলছেন, ইতিহাস বলছে এটি একটি খুব অগোছালো অপারেশন হতে চলেছে।

সূত্র : আলজাজিরা

mzamin

No comments

Powered by Blogger.