সন্তানকে খুঁজতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ বাবা দুর্বিষহ জীবন by ফাহিমা আক্তার সুমি
হামিদ আলী মানবজমিনকে বলেন, পেটের মধ্যে গুলিটা বিদ্ধ হলে হয়তো আমি আর বেঁচে ফিরতাম না। আমার সংসারে আমিই ছিলাম একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। সতেরো বছর বয়সী একমাত্র ছেলে অন্তরকে খুঁজতে গিয়ে আমার হাতে গুলি লাগে। সে আগে বেকার ছিল। আমি অসুস্থ থাকায় সংসার চলে না দেখে একটি পাখির দোকানে কাজ শুরু করেছে। আমি ঘুরে ঘুরে ফেরি করে হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতাম। এখানে চার হাজার টাকা দিয়ে টিনের চালের একটি রুম ভাড়া করে থাকি। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা থানায়। অভাবের কারণে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। পাঁচ বছর ধরে থাকি ঢাকায়। গ্রামে কোনো জায়গা-জমি নেই যে কিছু উপার্জন করে সংসারের খরচ চালাবো। আমার স্ত্রী বাসা বাড়িতে কাজ করেন। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী, চোখে কম দেখে। প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এই হাত আবার অপারেশন করে সোজা করতে হবে। হাতের রগ কাটায় বাঁকা হয়ে থাকে সবসময়। চিকিৎসক বলেছেন আরেকটি অপারেশন করা লাগবে। তবে কখনো সচল হবে কিনা সেটির নিশ্চয়তা নেই।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ২০শে জুলাই আমার ছেলে প্রতিদিনের মতো আন্দোলনে যায়। সেদিন বাইরের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ ছিল। চারদিকে বৃষ্টির মতো গুলি। হেলিকপ্টার থেকেও ছোড়া হচ্ছিল গুলি। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। নিজের জীবনের মায়া ভুলে সন্তানের খোঁজে বিকাল পাঁচটার দিকে বাইরে যাই। ঢাকা-চিটাগাং রোডে উঠতে না উঠতেই একটি গুলি এসে আমার হাতে লাগে। প্রথমে আমাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় মানুষ। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে একটি এক্সেরে করা হয়। রিপোর্টে দেখা যায় হাত ঠিক আছে। পরে সেখান থেকে চিকিৎসকরা অন্য হাসপাতালে যেতে বলেন। সেখানে হাতের একটি অপারেশন হয়। হাতের রগ কেটে ফেলতে হয়। গুলিটা হাতে লাগার পর পেট ঘেঁষে চলে যায়। পেটে খুব একটা ক্ষত না হলেও হাতের পরিস্থিতি খারাপ হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেদিন আমার সামনে কয়েকজন মারা গিয়েছে। ভেবেছিলাম তাকে বাসায় নিয়ে আসি না হলে কিনা কী হয়। রাজু নামে পাশের বাসার একজন মারা গেছে তাকে আমি ছেলেকে খুঁজতে যাওয়ার আগে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরে নিয়ে আসি।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনদী নতুন মহল্লার ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তার স্ত্রী রিনা বেগম চোখেমুখে হতাশা নিয়ে দরজার সামনে বসে আছেন। ঘরের ভেতরে বিছানায় শুয়ে হাতের ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন হামিদ। সেখানে দুই সন্তানকে নিয়ে টিনের চালের একটি রুমে ভাড়া থাকেন। হামিদ আলীর স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, ঘটনা শুনে গিয়ে দেখি তার হাতের অবস্থা খুবই খারাপ। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল জামা-কাপড়। এটি দেখে আমি ভেবেছিলাম সে আর বাঁচবে না। আমার স্বামীর জীবনটা ফিরে পেয়েছে। রাত হলে তার হাতের মধ্যে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা করে। মেডিসিন খেয়ে ব্যথা কমাতে হয়। দুইটা আঙ্গুল ছাড়া পুরো হাতটিই অচল। হাতটি সোজা করতে পারে না সবসময় বাঁকা হয়ে থাকে। যখন হাতের মধ্যে ব্যথা শুরু হয় তখন সহ্য করতে না পেরে বটি নিয়ে হাত কেটে ফেলতে যায়। ঘর থেকে দা-বটি লুকিয়ে রাখতে হয়েছে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটায় সেজন্য। বাসা-বাড়িতে মাঝে মাঝে কাজ করি। একমাত্র ছেলেকে একটি পাখির দোকানে কাজ দিয়েছি। আমি নিজে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। আমার একটা কার্ড করতে পারলে অনেক ভালো হতো। এখনো অনেক ওষুধ খেতে হয়। আরেকটি অপারেশন করতে হবে। আমার স্বামীর এক হাত তো অচল হয়ে কখনো ঠিক হবে কিনা জানি না। কীভাবে চলবে আমাদের সংসার।
No comments