‘ফেরত আসার পর শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইনি’ -‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে
মাকসুদা
আক্তার প্রিয়তী। বাংলাদেশী মেয়ে। বড় হয়েছেন ঢাকায়। পড়াশোনার জন্য পাড়ি
জমান আয়ারল্যান্ডে। পড়াশোনার সঙ্গে জড়ান মডেলিং-এ। নিজের চেষ্টা আর সাধনায়
অর্জন করেন মিস আয়ারল্যান্ড হওয়ার গৌরব। নিজের চেষ্টায়ই বিমান চালনা
শিখেছেন। ঘর সংসার পেতেছেন আয়ারল্যান্ডেই।
নানা উত্থান পতন আর ঝড় বয়ে গেছে। নিজের বেড়ে উঠা, প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, মডেলিং, ক্যারিয়ার, প্রতারণা সব মিলিয়ে টালমাটাল এক পথ। প্রিয়তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-‘প্রিয়তীর আয়না’। বইটিতে খোলামেলাভাবে নিজের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো মানবজমিন এর সৌজনে। আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব-
আট/দশ দিনের সকালের মতোই আমার সকাল ছিল। কোনো ধরনের ভিন্ন বার্তা দেয়নি সেই সকাল। কি হতে যাচ্ছে বা কি বদলাতে যাচ্ছে কোনোরকম আভাস পাইনি। প্রতিটা সকাল নাকি ভিন্ন সুন্দর। সব সকাল হয়তো মানুষের জীবনের সুন্দর হয় না কিন্তু ভিন্নতা হয়তো ঠিকই থাকে।
সম্পূর্ণ আউট অফ দা ব্লু, দেখলাম হঠাৎ করে বিবেক তার ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে তৈরি। বিবেক আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ আমাকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি, সে নিজ থেকে বলে যাচ্ছিল। তার কাছে মনে হয়েছে, আমি আমার জমি বিক্রি ঠিকই করেছি এবং তার বিশাল অংকের টাকা আমি পেয়েছি, সেই টাকা আমি ব্যাংকে রেখে দিয়েছি। আমি চাই না বিবেক ফ্লায়িং কোর্স করুক, তাই আমি বিবেককে টাকা দিয়ে সাহায্য করছি না। এই পুরো ব্যাপারটি ঢাকার জন্য বাবার সম্পত্তি বিক্রি একটি পরিকল্পনা অংশমাত্র। আমি ঠা-া মাথায় বিবেকের কোর্স করার টাকা প্রথমে দিতে রাজি হই কারণ সে যাতে আমাকে বাংলাদেশ যেতে দিতে রাজি হয়। আর আমি এত সব পরিকল্পনা করছি, যাতে আমি আমার পুরনো প্রেমিকের সাথে সুখের সংসার গোছাতে পারি ভবিষ্যতে, এইগুলো সব আমাদের সূক্ষ্ম পরিকল্পনা। আর তাই আমি ফেরত আসার পর শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইনি। এমনকি বাংলাদেশ যাওয়ার পর, আমার পুরনো প্রেমিকের সাথে দৈহিক সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। আমি তার ডাকেই বাংলাদেশে যাই বলে বিবেকের ধারণা।
আমি অনুভূতি শূন্য একজন মানুষ ছিলাম ওই মুহূর্তে। চোখের পলক পড়ছিল না, আমাকে স্পর্শ করতে পারছিল না, সবকিছু থমকে দাঁড়িয়েছিল। আমাকে বিবেক এই কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তার ব্যাগগুলো নিয়ে।
আমি সেদিন ছিলাম শব্দহীন একজন মানুষ। একবারের জন্যও আমি তাকে আটকাইনি। এটা ডাকও দেইনি, আর কোনদিনও দেইনি।
বিশ্বাস করুন, আমার ওই মুহূর্তে হচ্ছিল, আমি মনে হয় এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমার ওই মুহূর্তে আফসোস হয়নি, আজ এত বছর পরও বিন্দুমাত্র আফসোস হচ্ছে না। বিন্দুমাত্র কখনো মনে হয়নি আমার কোথাও কোনো ভুল হয়েছে।
ইতি হলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পর্ক।
পাইলট ট্রেইনিং ও সিঙ্গেল মাদারের যাত্রা শুরু: বিবেক তো ওই ধারণা নিয়েই চলে গেল যে, আমার কাছে অগাধ অর্থ এবং সেটাতে আমিসহ আমার সন্তানদের জীবন-যাত্রায় কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। তার জন্য সে এক পয়সা রেখে যাওয়া তো দূরের কথা, দেয়ার কথাও চিন্তা করেনি, এমন কি বাচ্চাদেরও না। অথচ এই বাচ্চাদের জন্মের কারণে আয়ারল্যান্ডে স্থায়ীভাবে থাকার গ্রিন কার্ড পেল। শকড হয়েছি, যখন সামনে এলো সে বাসার সব বিল কয়েক মাস জমিয়ে রেখেছে, যা করে রেখেছিল সব আমার নামে। লাইন বিচ্ছিন্ন করার নোটিশ আসে আমি বাংলাদেশে থাকতেই, চিঠিপত্র খুলে যা দেখলাম। ভাড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের খরচ রেখে গেল আমার কাঁধে। হিসাব-নিকাশ যোগ-বিয়োগ তেমন বেশি করতে হবে না, আমার হাতে যেই অর্থের পরিমাণ আছে, তা শুধুমাত্রই পুরো এয়ারলাইন পাইলট হতে যতটুকু ট্রেইনিং এবং যেগুলো লাইসেন্স নিতে হবে তার ফিস বাবদ ছিল। বাসা ভাড়া, বিল, খাবারের খরচ, বাচ্চাদের খরচ, বাচ্চাদের রাখার জন্য বেবি মাইন্ডারের খরচ সামলানোর জন্য খরচ অতিরিক্ত দুই বছরের জন্য নয়। এভাবে সময়ের সাথে জীবনের মোড় পাল্টাবে কে জানত? যদি জানতাম এমনভাবে রাস্তা পাল্টে যাবে তাহলে হয়তো বাবার সম্পত্তি বিক্রি করতাম না। আমার এবার জেদ ধরেছে। জেদটি হলো, বাবার রক্তে-ঘামে করা সম্পত্তি যেহেতু বিক্রি করেছি, যতদূর পারি কোর্স করে যাব। আর তার মধ্যে যোগাযোগ চালিয়ে যাব, যেকোনো ভাবে আমার জায়গাটি থেকে রায়নুল সাহেবের কাছ থেকে কোনো রকম টাকা আদায় করা যায় কিনা, আমি তো সহজে হাল ছাড়ছি না। আমারও তো কষ্টে উপার্জিত অর্থ ছিল, নিজের ঘামের কি কোনো মূল্য থাকবে না।
আমি যেহেতু ফ্লাইং কোর্স-এর মতো ব্যয়বহুল একটি কোর্স করছি, তাই আয়ারল্যান্ডে সিঙ্গেল মাদারদের ভাতা দেয় তার জন্য এপ্লাই করা আমি এলিজেব্যাল না।
আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি খরচ কিভাবে কমানো যায়। কিন্তু সিংহভাগই খরচ হলো, বাসা ভাড়া এবং বেবি সিস্টারের বেতন। আমার আজও সেই ক্ষুধার জ্বালার কথা মনে পড়লে পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। যখন আমি সারাদিন ক্লাস করতাম কিন্তু কোনো খাবার বা কফি কিনে খাওয়ার কথা এফোর্ড করতে পারতাম না। ব্যাচমেট যখন একসাথে লাঞ্চ করতে যেত, তখন আমি অন্য কোথাও চলে যেতাম। চা-কফির কথা বললে বলতাম, রাতে ঘুম আসবে না। ব্যাগে করে একটা কলা আর বোতল ভর্তি ট্যাপের পানি। বোতলের পানি কিনতেও তো এক ইউরো লাগবে, ওই টাকার হিসাবও আমাকে মিলাতে হয়েছিল। মাথায় তো খরচের বিয়োগগুলো যোগ হতো। আমার বাসা থেকে ফ্লাইং স্কুলের দূরত্ব ছিল এক ঘণ্টা ড্রাইভিংয়ের, পেট্রোল খরচও একটা বড় বিষয় ছিল। কাছাকাছি বাসা নিতে চেয়েছিলাম। পার্মানেন্ট কোনো চাকরি ছিল না বলে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায়নি। তাই যেখানে বাসা ছিল সেখানেই থেকে যেতে হলো।
বাসা ভাড়ার খরচ, বাচ্চাদের দুধ, ন্যাপি এবং মাইন্ডারের খরচের পর আমার চাল-ডাল কেনার খরচ। চাল-ডাল বলতে চাল-ডালই বুঝিয়েছি। কোন ধরনের মাংস বা তার সাথে কোন মসলা তেল কেনা তো সেই বিশাল ব্যাপার। যা বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নাই, কীভাবে সামলাচ্ছি এই জীবন যুদ্ধ।
আর অন্যদিকে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আমাকে নিয়ে শুরু হলো নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা, যাকে আমরা বলি স্ক্যান্ডাল। যেই কমিউনিটিতে আয়ারল্যান্ডে পা রাখা থেকে শুরু করে তখন অব্দি আমার আনাগোনা ছিল প্রচুর। নিজেকে তখন পর্যন্ত আইরিশ কালচারের সাথে জড়াইনি বিন্দুমাত্র। যেই মানুষগুলো আমাকে পছন্দ করত, সেই মানুষগুলোই আজ আমার পিছনে পিছনে আজেবাজে কথা বলা শুরু করল। আমার সাথে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করেই। আমাদের সমাজের একই তরফা বিচার, যা-ই ঘটুক না কেন, সব দোষ মেয়েদের।
অবশ্য তার জন্য সবটুকু দোষ আমি তাদের দেব না। বিবেক তার জন্য দায়ী। সে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিল আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। কারণ, আমার অন্য কারোর সাথে প্রেম ছিল। সবাই তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করা শুরু করল। সমাজ তো এমনিতেই পুরুষদের বিশ্বাস করে বেশি। তার মধ্যে বিবেক ছিল ঠা-া, ভদ্র মেজাজের একটি ছেলে, যে কারোর আগে পিছে নেই। আমার না, হঠাৎ করে ভিজা বিড়ালের কথা মনে পড়ল এই লেখা লিখতে লিখতে। কেনো বলুন তো? আচ্ছা যা বলছিলাম, আমি হলাম চঞ্চল, ক্যারিয়ার ফোকাসড, সাজুনি বেগম। সবাই সেভাবেই জানে বা চিনত আমাকে। সুতরাং ওই ভদ্র ছেলে এমন কিছু তার পার্টনারকে নিয়ে বললে কেউ অবিশ্বাস করবে না। চোখ বন্ধ করেই বিচার করবে আমাকে। হ্যাঁ ওই মেয়ে এই ধরনের প্রেমঘটিত ব্যাপার করতেই পারে। একবারও প্রশ্ন করে না নিজেকে, আচ্ছা ওই মেয়ে তো একাই থাকছে, কোথাও তো চলে যায়নি তার সন্তানদের ফেলে? বিবেক ওইগুলো করে যাচ্ছিল সব হিংসা নামক অনুভূতি থেকে। তার চোখে-মুখে হিংসা ছেঁয়ে গিয়েছিল। কেউ না দেখলেও আমি তা দেখেছি। যার কারণে সে বাচ্চাদের ব্যবহার করেছে অস্ত্র হিসেবে সেই অস্ত্র দিয়ে আমাকে ভাঙার চেষ্টা করত প্রতিদিন। বাচ্চাদের কোনো ভরণপোষণ দিত না, যাতে আমি আর্থিকভাবে সচ্ছল না হই। কোর্টের কথা তো বলবেন আপনারা এখন? অনেক দৌড়িয়েছি। লাভ হয়নি। কিছু বাঙালি ভুয়া কাগজ করে কোর্টকে দেখাত যে, তাদের কোনো অর্থ-উপার্জনের উৎস নেই। ছিঃ! নিজের সন্তানদের দিতে এত কষ্ট কোন বাবার হতে পারে? আচ্ছা ওরা কি জবাব দেয় নিজের বিবেককে? নাকি ওরা বিবেকহীন মানুষ।
একটা কথা মনে রাখবেন একজন মানুষ সবদিক থেকে কখনো শ্রেষ্ঠ হয় না, একজন মানুষ শ্রেষ্ঠ ভাই, শ্রেষ্ঠ সন্তান, শ্রেষ্ঠ বন্ধু, শ্রেষ্ঠ বাবা হতে পারে কিন্তু শ্রেষ্ঠ জীবন সঙ্গী বা স্বামী নাও হতে পারে বা শ্রেষ্ঠ বাবা নাও হতে পারে। এটি নারীদের বেলায়ও।
আমার যেই বিষয়টি বিষাদগ্রস্ত করেছে তা হলো, আয়ারল্যান্ডে যারা আমার খুব কাছের ছিল, বন্ধু ছিল তারা তখন এক তরফা আমাকে বিচার শুরু করল, অন্যদের কথা বাদ দিলাম। বেশিরভাগ মানুষ তো এইসব রসালো আলাপেই মজা পায়, দরকার হলে আরও মাসালা লাগায়। কিন্তু ওই কাছের মানুষগুলো কি একবারও জিজ্ঞেস করতে পারল না, একবার খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করতে পারল না, আসল ঘটনাটা কী?
আমি নিজ থেকে বলতে গিয়েছি, জানাতে চেয়েছি। দেখলাম, তারা আগে থেকেই অবিশ্বাসের দেয়াল উঁচু করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, আমি যাই বলি না কেন, মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে তাদের কাছে।
আস্তে আস্তে উপলব্দি করা শুরু করলাম যে, তারা আমাকে এড়িয়ে চলছে কারণ আমি খারাপ মেয়ে। আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছে, বৌদির স্বামীরা হুকুম দিয়েছেন আমার সাথে যেন না মেশে, কারণ আমি খারাপ মেয়ে। বাসায় গেলে আর আগের মতো এসে কথা বলে না, যে যার রুমে বসে থাকে ড্রয়িং রুমে আর আসে না আমার সাথে দেখা করতে, কারণ আমি খারাপ মেয়ে।
আচ্ছা আমাকে দয়া করে বলবেন, ‘খারাপ মেয়ের সংজ্ঞাটা কী? আর কি করলে খারাপ মেয়ের তকমাটি মুছে ফেলা যায়।’
তাদের ওই আচরণগুলো আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। সত্যি সত্যি নিজেকে নোংরা, বাজে, খারাপ মেয়ে মনে হচ্ছিল। আমাকে যে ওরা দিনকে দিন কোথায় ধাবিত করছিল আমার কোনো আন্দাজ ছিল না। আমার যুদ্ধগুলো আমার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ছিল। বেঁচে থাকার স্পৃহা হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। যেন পৃথিবীর বুকে আমি এক আবর্জনা এবং সেই আবর্জনা নিজেকেই পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। মনে মনে জোড়ালোভাবে অনেকগুলো কণ্ঠ এক হয়ে আসছে, সবাই যেন বলছে, ‘তোকে মরে যেতে হবে, তুই অর্থহীন, তুই নোংরা।’
একমাত্র আত্মহত্যাই যেন আমার বাঁচার পথ। এই আত্মহননই যেন আমাকে বাঁচাবে। ওই চিৎকার করে আসা অসহ্যকর শব্দগুলো। আর তো কোনো পথ নেই এই আওয়াজ বন্ধ করার, সব পথ তো বন্ধ। এই ঘোরে আমার কেটেছে অনেকগুলো দিন।
ঘরে আমার দুটো শিশু ঘুমাচ্ছে। তাদের রেখে আমি হাঁটা শুরু করি। বাসা থেকে ৩/৪ মিনিট হাঁটার দূরুত্বেই হলো সমুুদ্র। আমি যেহেতু জলকে ভয় পাই, এই জলেই শেষ হোক আমার শেষ নিঃশ্বাস। রাত তখন কয়টা বাজে ঠিক মনে পড়ছে না, ১০/১১টা হবে। নির্জন শীতের রাত। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি বীচ/সৈকতের দিকে। কনকনে ঠা-া পানি আমার পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। বরফের মতো ঠা-া সমুদ্রের পানি আমার কোনো স্নায়ু যেন জাগাতে পারছে না। আমি আবছা অন্ধকারেই সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে হেঁটে চলছি। সমুদ্রের ঢেউ যখন হাঁটু পর্যন্ত তখন এক বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কা এসে আমাকে ফেলে দিল। আমি যখন এই লেখাগুলো লিখছি আমার বুক ধর ফর করে কেঁপে উঠছে। আমার পায়ের নিচে মাটি হারিয়ে যখন নাক-মুখ পানি ঢুকছিল, তখন মনে হয় আমার মাথায় টনক নড়ে, মাথায় তখন একমাত্র চিন্তা আসলো আমার বাচ্চারা যদি ফ্ল্যাটে না খেয়ে মরে তখনও কেউ জানবে না। আহারে! শিশু বাচ্চাগুলো তো কড (শিশুদের বিছানা) থেকেও নামতে পারবে না। আমার সোনার বাচ্চাগুলো, আমি তো ওদের জন্যই যুদ্ধে নেমেছিলাম। যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি বলে, নিজের জীবন নিজেই নিতে চলছি? এত স্বার্থপর আমি? হতাশা আমার বোধ শক্তিকে এইভাবে খেয়ে ফেলল? গুটি কয়েক মানুষের জন্য আমি এত তাড়াতাড়ি পরাজয় মেনে নিলাম? যারা আমার জীবনের কেউ না।
ঢেউ আমাকে আছড়ে ফেলছে, আমি মৃত্যুকে দেখছি খুব কাছ থেকে, কেন দুই মিনিট আগেও এইভাবে দেখলাম না পৃথিবীকে, এভাবে ভাবিনি নিজের অস্তিত্বকে। আমি বুঝতে পারছি, আর কয়েকটি নিঃশ্বাসই হয়তো আছে আমার জীবনের খাতায় এই মুহূর্তে, তারপর সব শেষ। সব!!
একি! এ যেন ফেরেশতা পাঠিয়েছে সৃষ্টিকর্তা আমাকে বাঁচানোর জন্য। আমাকে টেনে ওপরে তুললেন একজন। আমি আবার নতুন জীবন পেলাম, যেই জীবন আমাকে জীবনের অর্থ শিখিয়েছে, বেঁচে থাকাটা যে সুখের, আশীর্বাদের তা উপলব্দি করিয়েছে। আমার জন্ম হলো নতুন প্রিয়তীর রূপে।
দেরিতে হলেও অনুধাবন করলাম, ওই মানুষগুলো জানে না, আমরা আজ কি খাচ্ছি, বাসায় আমার খাবার আছে কি, নাই। ওই মানুষগুলো আমার বাসা ভাড়া বিল দিবে না। ওই মানুষগুলো বলবে না, ‘প্রিয়তী তুমি চব্বিশ ঘণ্টা তোমার বাচ্চাদের দেখাশুনা করো, আমরা কিছুক্ষণ রাখি, তুমি একটু রেস্ট নাও। অথবা, ওই মানুষগুলো জীবনেও বলবে না যে, ‘প্রিয়তী, তোমার ব্যক্তি জীবনে যা ইচ্ছা তাই হয়েছে, তুমি তো আমাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করো নাই, তাহলে তোমাকে কেন আমরা বিচার করব? তুমি আমাদের কাছে যেমন ছিলে, তেমনই থাকবে।’ (চলবে...)
‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে নেয়া
নানা উত্থান পতন আর ঝড় বয়ে গেছে। নিজের বেড়ে উঠা, প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, মডেলিং, ক্যারিয়ার, প্রতারণা সব মিলিয়ে টালমাটাল এক পথ। প্রিয়তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-‘প্রিয়তীর আয়না’। বইটিতে খোলামেলাভাবে নিজের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো মানবজমিন এর সৌজনে। আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব-
আট/দশ দিনের সকালের মতোই আমার সকাল ছিল। কোনো ধরনের ভিন্ন বার্তা দেয়নি সেই সকাল। কি হতে যাচ্ছে বা কি বদলাতে যাচ্ছে কোনোরকম আভাস পাইনি। প্রতিটা সকাল নাকি ভিন্ন সুন্দর। সব সকাল হয়তো মানুষের জীবনের সুন্দর হয় না কিন্তু ভিন্নতা হয়তো ঠিকই থাকে।
সম্পূর্ণ আউট অফ দা ব্লু, দেখলাম হঠাৎ করে বিবেক তার ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে তৈরি। বিবেক আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ আমাকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি, সে নিজ থেকে বলে যাচ্ছিল। তার কাছে মনে হয়েছে, আমি আমার জমি বিক্রি ঠিকই করেছি এবং তার বিশাল অংকের টাকা আমি পেয়েছি, সেই টাকা আমি ব্যাংকে রেখে দিয়েছি। আমি চাই না বিবেক ফ্লায়িং কোর্স করুক, তাই আমি বিবেককে টাকা দিয়ে সাহায্য করছি না। এই পুরো ব্যাপারটি ঢাকার জন্য বাবার সম্পত্তি বিক্রি একটি পরিকল্পনা অংশমাত্র। আমি ঠা-া মাথায় বিবেকের কোর্স করার টাকা প্রথমে দিতে রাজি হই কারণ সে যাতে আমাকে বাংলাদেশ যেতে দিতে রাজি হয়। আর আমি এত সব পরিকল্পনা করছি, যাতে আমি আমার পুরনো প্রেমিকের সাথে সুখের সংসার গোছাতে পারি ভবিষ্যতে, এইগুলো সব আমাদের সূক্ষ্ম পরিকল্পনা। আর তাই আমি ফেরত আসার পর শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইনি। এমনকি বাংলাদেশ যাওয়ার পর, আমার পুরনো প্রেমিকের সাথে দৈহিক সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। আমি তার ডাকেই বাংলাদেশে যাই বলে বিবেকের ধারণা।
আমি অনুভূতি শূন্য একজন মানুষ ছিলাম ওই মুহূর্তে। চোখের পলক পড়ছিল না, আমাকে স্পর্শ করতে পারছিল না, সবকিছু থমকে দাঁড়িয়েছিল। আমাকে বিবেক এই কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তার ব্যাগগুলো নিয়ে।
আমি সেদিন ছিলাম শব্দহীন একজন মানুষ। একবারের জন্যও আমি তাকে আটকাইনি। এটা ডাকও দেইনি, আর কোনদিনও দেইনি।
বিশ্বাস করুন, আমার ওই মুহূর্তে হচ্ছিল, আমি মনে হয় এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমার ওই মুহূর্তে আফসোস হয়নি, আজ এত বছর পরও বিন্দুমাত্র আফসোস হচ্ছে না। বিন্দুমাত্র কখনো মনে হয়নি আমার কোথাও কোনো ভুল হয়েছে।
ইতি হলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পর্ক।
পাইলট ট্রেইনিং ও সিঙ্গেল মাদারের যাত্রা শুরু: বিবেক তো ওই ধারণা নিয়েই চলে গেল যে, আমার কাছে অগাধ অর্থ এবং সেটাতে আমিসহ আমার সন্তানদের জীবন-যাত্রায় কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। তার জন্য সে এক পয়সা রেখে যাওয়া তো দূরের কথা, দেয়ার কথাও চিন্তা করেনি, এমন কি বাচ্চাদেরও না। অথচ এই বাচ্চাদের জন্মের কারণে আয়ারল্যান্ডে স্থায়ীভাবে থাকার গ্রিন কার্ড পেল। শকড হয়েছি, যখন সামনে এলো সে বাসার সব বিল কয়েক মাস জমিয়ে রেখেছে, যা করে রেখেছিল সব আমার নামে। লাইন বিচ্ছিন্ন করার নোটিশ আসে আমি বাংলাদেশে থাকতেই, চিঠিপত্র খুলে যা দেখলাম। ভাড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের খরচ রেখে গেল আমার কাঁধে। হিসাব-নিকাশ যোগ-বিয়োগ তেমন বেশি করতে হবে না, আমার হাতে যেই অর্থের পরিমাণ আছে, তা শুধুমাত্রই পুরো এয়ারলাইন পাইলট হতে যতটুকু ট্রেইনিং এবং যেগুলো লাইসেন্স নিতে হবে তার ফিস বাবদ ছিল। বাসা ভাড়া, বিল, খাবারের খরচ, বাচ্চাদের খরচ, বাচ্চাদের রাখার জন্য বেবি মাইন্ডারের খরচ সামলানোর জন্য খরচ অতিরিক্ত দুই বছরের জন্য নয়। এভাবে সময়ের সাথে জীবনের মোড় পাল্টাবে কে জানত? যদি জানতাম এমনভাবে রাস্তা পাল্টে যাবে তাহলে হয়তো বাবার সম্পত্তি বিক্রি করতাম না। আমার এবার জেদ ধরেছে। জেদটি হলো, বাবার রক্তে-ঘামে করা সম্পত্তি যেহেতু বিক্রি করেছি, যতদূর পারি কোর্স করে যাব। আর তার মধ্যে যোগাযোগ চালিয়ে যাব, যেকোনো ভাবে আমার জায়গাটি থেকে রায়নুল সাহেবের কাছ থেকে কোনো রকম টাকা আদায় করা যায় কিনা, আমি তো সহজে হাল ছাড়ছি না। আমারও তো কষ্টে উপার্জিত অর্থ ছিল, নিজের ঘামের কি কোনো মূল্য থাকবে না।
আমি যেহেতু ফ্লাইং কোর্স-এর মতো ব্যয়বহুল একটি কোর্স করছি, তাই আয়ারল্যান্ডে সিঙ্গেল মাদারদের ভাতা দেয় তার জন্য এপ্লাই করা আমি এলিজেব্যাল না।
আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি খরচ কিভাবে কমানো যায়। কিন্তু সিংহভাগই খরচ হলো, বাসা ভাড়া এবং বেবি সিস্টারের বেতন। আমার আজও সেই ক্ষুধার জ্বালার কথা মনে পড়লে পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। যখন আমি সারাদিন ক্লাস করতাম কিন্তু কোনো খাবার বা কফি কিনে খাওয়ার কথা এফোর্ড করতে পারতাম না। ব্যাচমেট যখন একসাথে লাঞ্চ করতে যেত, তখন আমি অন্য কোথাও চলে যেতাম। চা-কফির কথা বললে বলতাম, রাতে ঘুম আসবে না। ব্যাগে করে একটা কলা আর বোতল ভর্তি ট্যাপের পানি। বোতলের পানি কিনতেও তো এক ইউরো লাগবে, ওই টাকার হিসাবও আমাকে মিলাতে হয়েছিল। মাথায় তো খরচের বিয়োগগুলো যোগ হতো। আমার বাসা থেকে ফ্লাইং স্কুলের দূরত্ব ছিল এক ঘণ্টা ড্রাইভিংয়ের, পেট্রোল খরচও একটা বড় বিষয় ছিল। কাছাকাছি বাসা নিতে চেয়েছিলাম। পার্মানেন্ট কোনো চাকরি ছিল না বলে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায়নি। তাই যেখানে বাসা ছিল সেখানেই থেকে যেতে হলো।
বাসা ভাড়ার খরচ, বাচ্চাদের দুধ, ন্যাপি এবং মাইন্ডারের খরচের পর আমার চাল-ডাল কেনার খরচ। চাল-ডাল বলতে চাল-ডালই বুঝিয়েছি। কোন ধরনের মাংস বা তার সাথে কোন মসলা তেল কেনা তো সেই বিশাল ব্যাপার। যা বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নাই, কীভাবে সামলাচ্ছি এই জীবন যুদ্ধ।
আর অন্যদিকে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আমাকে নিয়ে শুরু হলো নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা, যাকে আমরা বলি স্ক্যান্ডাল। যেই কমিউনিটিতে আয়ারল্যান্ডে পা রাখা থেকে শুরু করে তখন অব্দি আমার আনাগোনা ছিল প্রচুর। নিজেকে তখন পর্যন্ত আইরিশ কালচারের সাথে জড়াইনি বিন্দুমাত্র। যেই মানুষগুলো আমাকে পছন্দ করত, সেই মানুষগুলোই আজ আমার পিছনে পিছনে আজেবাজে কথা বলা শুরু করল। আমার সাথে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করেই। আমাদের সমাজের একই তরফা বিচার, যা-ই ঘটুক না কেন, সব দোষ মেয়েদের।
অবশ্য তার জন্য সবটুকু দোষ আমি তাদের দেব না। বিবেক তার জন্য দায়ী। সে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিল আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। কারণ, আমার অন্য কারোর সাথে প্রেম ছিল। সবাই তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করা শুরু করল। সমাজ তো এমনিতেই পুরুষদের বিশ্বাস করে বেশি। তার মধ্যে বিবেক ছিল ঠা-া, ভদ্র মেজাজের একটি ছেলে, যে কারোর আগে পিছে নেই। আমার না, হঠাৎ করে ভিজা বিড়ালের কথা মনে পড়ল এই লেখা লিখতে লিখতে। কেনো বলুন তো? আচ্ছা যা বলছিলাম, আমি হলাম চঞ্চল, ক্যারিয়ার ফোকাসড, সাজুনি বেগম। সবাই সেভাবেই জানে বা চিনত আমাকে। সুতরাং ওই ভদ্র ছেলে এমন কিছু তার পার্টনারকে নিয়ে বললে কেউ অবিশ্বাস করবে না। চোখ বন্ধ করেই বিচার করবে আমাকে। হ্যাঁ ওই মেয়ে এই ধরনের প্রেমঘটিত ব্যাপার করতেই পারে। একবারও প্রশ্ন করে না নিজেকে, আচ্ছা ওই মেয়ে তো একাই থাকছে, কোথাও তো চলে যায়নি তার সন্তানদের ফেলে? বিবেক ওইগুলো করে যাচ্ছিল সব হিংসা নামক অনুভূতি থেকে। তার চোখে-মুখে হিংসা ছেঁয়ে গিয়েছিল। কেউ না দেখলেও আমি তা দেখেছি। যার কারণে সে বাচ্চাদের ব্যবহার করেছে অস্ত্র হিসেবে সেই অস্ত্র দিয়ে আমাকে ভাঙার চেষ্টা করত প্রতিদিন। বাচ্চাদের কোনো ভরণপোষণ দিত না, যাতে আমি আর্থিকভাবে সচ্ছল না হই। কোর্টের কথা তো বলবেন আপনারা এখন? অনেক দৌড়িয়েছি। লাভ হয়নি। কিছু বাঙালি ভুয়া কাগজ করে কোর্টকে দেখাত যে, তাদের কোনো অর্থ-উপার্জনের উৎস নেই। ছিঃ! নিজের সন্তানদের দিতে এত কষ্ট কোন বাবার হতে পারে? আচ্ছা ওরা কি জবাব দেয় নিজের বিবেককে? নাকি ওরা বিবেকহীন মানুষ।
একটা কথা মনে রাখবেন একজন মানুষ সবদিক থেকে কখনো শ্রেষ্ঠ হয় না, একজন মানুষ শ্রেষ্ঠ ভাই, শ্রেষ্ঠ সন্তান, শ্রেষ্ঠ বন্ধু, শ্রেষ্ঠ বাবা হতে পারে কিন্তু শ্রেষ্ঠ জীবন সঙ্গী বা স্বামী নাও হতে পারে বা শ্রেষ্ঠ বাবা নাও হতে পারে। এটি নারীদের বেলায়ও।
আমার যেই বিষয়টি বিষাদগ্রস্ত করেছে তা হলো, আয়ারল্যান্ডে যারা আমার খুব কাছের ছিল, বন্ধু ছিল তারা তখন এক তরফা আমাকে বিচার শুরু করল, অন্যদের কথা বাদ দিলাম। বেশিরভাগ মানুষ তো এইসব রসালো আলাপেই মজা পায়, দরকার হলে আরও মাসালা লাগায়। কিন্তু ওই কাছের মানুষগুলো কি একবারও জিজ্ঞেস করতে পারল না, একবার খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করতে পারল না, আসল ঘটনাটা কী?
আমি নিজ থেকে বলতে গিয়েছি, জানাতে চেয়েছি। দেখলাম, তারা আগে থেকেই অবিশ্বাসের দেয়াল উঁচু করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, আমি যাই বলি না কেন, মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে তাদের কাছে।
আস্তে আস্তে উপলব্দি করা শুরু করলাম যে, তারা আমাকে এড়িয়ে চলছে কারণ আমি খারাপ মেয়ে। আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছে, বৌদির স্বামীরা হুকুম দিয়েছেন আমার সাথে যেন না মেশে, কারণ আমি খারাপ মেয়ে। বাসায় গেলে আর আগের মতো এসে কথা বলে না, যে যার রুমে বসে থাকে ড্রয়িং রুমে আর আসে না আমার সাথে দেখা করতে, কারণ আমি খারাপ মেয়ে।
আচ্ছা আমাকে দয়া করে বলবেন, ‘খারাপ মেয়ের সংজ্ঞাটা কী? আর কি করলে খারাপ মেয়ের তকমাটি মুছে ফেলা যায়।’
তাদের ওই আচরণগুলো আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। সত্যি সত্যি নিজেকে নোংরা, বাজে, খারাপ মেয়ে মনে হচ্ছিল। আমাকে যে ওরা দিনকে দিন কোথায় ধাবিত করছিল আমার কোনো আন্দাজ ছিল না। আমার যুদ্ধগুলো আমার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ছিল। বেঁচে থাকার স্পৃহা হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। যেন পৃথিবীর বুকে আমি এক আবর্জনা এবং সেই আবর্জনা নিজেকেই পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। মনে মনে জোড়ালোভাবে অনেকগুলো কণ্ঠ এক হয়ে আসছে, সবাই যেন বলছে, ‘তোকে মরে যেতে হবে, তুই অর্থহীন, তুই নোংরা।’
একমাত্র আত্মহত্যাই যেন আমার বাঁচার পথ। এই আত্মহননই যেন আমাকে বাঁচাবে। ওই চিৎকার করে আসা অসহ্যকর শব্দগুলো। আর তো কোনো পথ নেই এই আওয়াজ বন্ধ করার, সব পথ তো বন্ধ। এই ঘোরে আমার কেটেছে অনেকগুলো দিন।
ঘরে আমার দুটো শিশু ঘুমাচ্ছে। তাদের রেখে আমি হাঁটা শুরু করি। বাসা থেকে ৩/৪ মিনিট হাঁটার দূরুত্বেই হলো সমুুদ্র। আমি যেহেতু জলকে ভয় পাই, এই জলেই শেষ হোক আমার শেষ নিঃশ্বাস। রাত তখন কয়টা বাজে ঠিক মনে পড়ছে না, ১০/১১টা হবে। নির্জন শীতের রাত। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি বীচ/সৈকতের দিকে। কনকনে ঠা-া পানি আমার পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। বরফের মতো ঠা-া সমুদ্রের পানি আমার কোনো স্নায়ু যেন জাগাতে পারছে না। আমি আবছা অন্ধকারেই সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে হেঁটে চলছি। সমুদ্রের ঢেউ যখন হাঁটু পর্যন্ত তখন এক বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কা এসে আমাকে ফেলে দিল। আমি যখন এই লেখাগুলো লিখছি আমার বুক ধর ফর করে কেঁপে উঠছে। আমার পায়ের নিচে মাটি হারিয়ে যখন নাক-মুখ পানি ঢুকছিল, তখন মনে হয় আমার মাথায় টনক নড়ে, মাথায় তখন একমাত্র চিন্তা আসলো আমার বাচ্চারা যদি ফ্ল্যাটে না খেয়ে মরে তখনও কেউ জানবে না। আহারে! শিশু বাচ্চাগুলো তো কড (শিশুদের বিছানা) থেকেও নামতে পারবে না। আমার সোনার বাচ্চাগুলো, আমি তো ওদের জন্যই যুদ্ধে নেমেছিলাম। যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি বলে, নিজের জীবন নিজেই নিতে চলছি? এত স্বার্থপর আমি? হতাশা আমার বোধ শক্তিকে এইভাবে খেয়ে ফেলল? গুটি কয়েক মানুষের জন্য আমি এত তাড়াতাড়ি পরাজয় মেনে নিলাম? যারা আমার জীবনের কেউ না।
ঢেউ আমাকে আছড়ে ফেলছে, আমি মৃত্যুকে দেখছি খুব কাছ থেকে, কেন দুই মিনিট আগেও এইভাবে দেখলাম না পৃথিবীকে, এভাবে ভাবিনি নিজের অস্তিত্বকে। আমি বুঝতে পারছি, আর কয়েকটি নিঃশ্বাসই হয়তো আছে আমার জীবনের খাতায় এই মুহূর্তে, তারপর সব শেষ। সব!!
একি! এ যেন ফেরেশতা পাঠিয়েছে সৃষ্টিকর্তা আমাকে বাঁচানোর জন্য। আমাকে টেনে ওপরে তুললেন একজন। আমি আবার নতুন জীবন পেলাম, যেই জীবন আমাকে জীবনের অর্থ শিখিয়েছে, বেঁচে থাকাটা যে সুখের, আশীর্বাদের তা উপলব্দি করিয়েছে। আমার জন্ম হলো নতুন প্রিয়তীর রূপে।
দেরিতে হলেও অনুধাবন করলাম, ওই মানুষগুলো জানে না, আমরা আজ কি খাচ্ছি, বাসায় আমার খাবার আছে কি, নাই। ওই মানুষগুলো আমার বাসা ভাড়া বিল দিবে না। ওই মানুষগুলো বলবে না, ‘প্রিয়তী তুমি চব্বিশ ঘণ্টা তোমার বাচ্চাদের দেখাশুনা করো, আমরা কিছুক্ষণ রাখি, তুমি একটু রেস্ট নাও। অথবা, ওই মানুষগুলো জীবনেও বলবে না যে, ‘প্রিয়তী, তোমার ব্যক্তি জীবনে যা ইচ্ছা তাই হয়েছে, তুমি তো আমাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করো নাই, তাহলে তোমাকে কেন আমরা বিচার করব? তুমি আমাদের কাছে যেমন ছিলে, তেমনই থাকবে।’ (চলবে...)
‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে নেয়া
No comments