‘শুধু প্রেমই নয় একসঙ্গে থাকছিও’ -‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে
মাকসুদা
আক্তার প্রিয়তী। বাংলাদেশী মেয়ে। বড় হয়েছেন ঢাকায়। পড়াশোনার জন্য পাড়ি
জমান আয়ারল্যান্ডে। পড়াশোনার সঙ্গে জড়ান মডেলিং-এ। নিজের চেষ্টা আর সাধনায়
অর্জন করেন মিস আয়ারল্যান্ড হওয়ার গৌরব। নিজের চেষ্টায়ই বিমান চালনা
শিখেছেন। ঘর সংসার পেতেছেন আয়ারল্যান্ডেই।
নানা উত্থান পতন আর ঝড় বয়ে গেছে। নিজের বেড়ে উঠা, প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, মডেলিং, ক্যারিয়ার, প্রতারণা সব মিলিয়ে টালমাটাল এক পথ। প্রিয়তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-‘প্রিয়তীর আয়না’। বইটিতে খোলামেলাভাবে নিজের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো মানবজমিন এর সৌজন্যে। আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব-
প্রথম যেদিন ওর সঙ্গে বাসায় উঠি সেদিনের স্মৃতিটা আমার আবছা আবছা মনে আছে। আমি আমার ল্যাগেজ নিয়ে একটা নির্দিষ্ট স্টপেজে এসে দাঁড়াই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় বিবেকের জন্য। ও চলে আসে। তারপর দু’জন মিলে একসঙ্গে নতুন বাসার দিকে রওনা দেই। বাসা বলা যাবে না, রুম বলাই ভালো।
দু’জন মিলে রুমটা গোছগাছ করি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু’জন টুকটাক গল্প করি। একটা অদ্ভুত অনুভূতি পুরো শরীরে বয়ে যায়। আমার কেমন যেন লাগে। একটা পুরুষের সঙ্গে এভাবে এক রুমে থাকব! আমার বারবার মনে হয়, আজ থেকে বুঝি আমাদের নতুন সংসার শুরু হলো। যে সংসারে আমরা দু’জনই রাজা। এখন আমাকে দেখার একজন মানুষ হলো।
আমার কেমন কেমন যেন লাগে। ওইদিন বাইরে যেতে যেতে আমাদের অলিখিত একটু চুক্তি হয়। আমাদের এই নতুন সংসারে যা কিছু করার বা কেনার সেটা শেয়ার করে কিনব বা করব। বিবেক রাজি। আমরা সেই রাত থেকেই শুরু করি। যখন দু’জন সে রাতে বাইরে খেতে যাই তখনই শেয়ারে বিল দিই। তারপর এটা নিয়ে হাসাহাসি করি দু’জন। তবে কি আমাদের যৌথ জীবন শুরু হলো। আমরা কি এক পথে হাঁটা শুরু করলাম দু’জন? কি জানি, এতে সুন্দর জোছনা রাতে ওইসব ভাবনা মাথায় আসে না। আয়ারল্যান্ডেও ফিনিক দেওয়া জোছনা ফোটে। যে জোছনা আমাদের জানালা ভেদ করে রুমে এসে ঠাঁয় নেয়। আমরা দু’জন জোসনায় মাখামাখি করতে করতে যৌথ জীবনের প্রথম রাত পাড়ি দেই।
এভাবে চলছিল আমাদের জীবন। ভালো অন্যরকম অনুভূতির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। শরীর-মন জাগছে। চাইছে। কিছু কিছু রাত অসম্ভব ভালোলাগা তৈরি করে ভোরের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সে রাতে আর ঘুম হয় না। কী অদ্ভুত আবেশে পার করি প্রতিটি মুহূর্ত।
হঠাৎ একদিন আমি উপলব্ধি করি এই যে আমরা একসঙ্গে থাকছি, এটা কি ঠিক হচ্ছে। মা শুনলে কি কষ্ট পাবেন না? কেমন লাগবে তাঁর? কষ্ট পাবেন? এসব করার জন্যই কি আমাকে শত শত মাইল দূরে পাঠিয়েছেন? আমি কি তবে অন্য পথে হাঁটছি?
ততদিনে মানে দু’তিন মাসের মধ্যেই বাঙালি পাড়ায় খবর রটে যায়, আমর প্রেম করছি। শুধু প্রেমই না, একসঙ্গেও থাকছি।
এ ধরনের সমালোচনার বড় কারণ হলো, আমার চেয়ে বিবেক বাঙালিদের সঙ্গে বেশি মিশতো। যার ফলে, অনেকেই সন্দেহ করা শুরু করেন। মানে তারা আসলে ধোঁয়া খুঁজতে থাকেন। সেই ধোঁয়া থেকে আগুন ধরাতে একবিন্দু সময় নেন না এই দেশের বাঙালি সকল। সেই আগুনে পা দিয়ে আমরা জানিয়ে দেই ‘হ্যাঁ আমরা একসঙ্গেই আছি এবং সাথে জানিয়ে দেই আমরা বিয়ে করেই থাকছি একসাথে।’ আগে-পিছে এত যোগ-বিয়োগ করার মতো বয়স আমাদের হয়নি। শুধু জানি, এত আড় চোখ আর এত সমালোচনা আমি নিতে পারব না, যেহেতু এই কমিউনিটিতে আমাদের আনাগোনা।
এক সন্ধ্যায় আমি মায়ের কাছে ফোন দেই। অবশ্য মা’র সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হতো। আমার তখন আর্থিক স্বচ্ছলতা চলে এসেছে। মায়ের কাছ থেকে টাকা নেয়া বন্ধ করেছি অনেক দিন হয়েছে।
মা’কে জানিয়ে দেই, আমি বিবেক নামে এক ছেলেকে পছন্দ করি এবং তাকে বিয়ে করেছি হঠাৎ করেই। কারণ তার সাথে মেলামেশা নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে বদনাম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। শুনে বোধ হয় চমকে যান মা। কিন্তু তেমন কিছু বলেন না। খুশি হন কিনা কে জানে। তবে অখুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, মা’র চাওয়া ছিল আমি যেন বিয়ে করি। এই বিয়ের জন্য মা কম চেষ্টা করেন নি।
আমার মা বিচক্ষণ ও আধুনিক মনার মানুষ ছিলেন, কয়েক মিনিটের মাথায় স্বাভাবিক হয়ে বিবেকের সব খোঁজ-খবর নিলেন। আমাকে বিবেক তার পরিবার নিয়ে যতখানি তথ্য দিয়েছিল, আমি তাই দিয়েছি। অনেক তথ্যের মধ্যে যে কিছু মিথ্যারও মিশ্রণ ছিল, তা জেনেছি অনেক পরে। আমি ওইসব দোষ-গুণ, সত্য-মিথ্যাতে এখন যাবো না।
মা আমাকে বলেছিলেন, একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। এ দেশে বিয়ে করলে তাঁকে আবার আয়ারল্যান্ড নিয়ে যেতে হতো। তার চাকরির ব্যবস্থা করতে হতো। এখন আর সেই সমস্যা নেই। ভালোই করেছিস মা।
এবার বিবেকের পালা। ওকে আমি অনুরোধ করি বাড়িতে জানাতে। না হলে পরে ওর পরিবারের মানুষ শুনলে কষ্ট পাবেন। তার চেয়ে সন্তানের কাছ থেকে শুনলে আনন্দিত হতে পারেন। বিবেক আমার এই বুদ্ধিটা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে। সেদিন সন্ধ্যাতেই ওর বাড়িতে ফোন করে। সরাসরি জানিয়ে দেয়, আমরা বিয়ে করেছি।
এই কথাটা পাশে বসে থেকে শুনতে বেশ ভালো লাগে। অন্যরকম একটা অনুভূতি খেলে যায় নিজের মধ্যে। বুঝতে পারি বিবেকের পরিবারও বিষয়টি সাধরে গ্রহণ করেছে। আমার বিশ্বাস ছিল উনারা মেনে নিবেন। কারণ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি এবং আমাদের পরিবারের অবস্থা, বিবেকদের পরিবার থেকে দ্বিগুণ ভালো। আমি অহঙ্কার করে বলছি না, আমি শুধুই তখনকার বাস্তবতা এবং পরিস্থিতি জানাচ্ছি মাত্র।
মা খুশি, যে আমার সঙ্গী সেও খুশি, তার পরিবারের লোকজনও খুশি। আর কি লাগে? সুখেই আছি বলা যায়। কিন্তু এরই মধ্যে আমাকে বাড়ি থেকে চাপ দিয়ে বলা হয়, বিয়ে করেছ ভালো করেছ এখন তো সবাইকে জানাতে হবে। সামাজিকতা বজায় রাখতে হবে। বিবাহ সংবর্ধনার একটা অনুষ্ঠান করতে হবে। তোমরা প্রস্তুতি নাও।
আমি বিষয়টি বিবেককে জানাই। ও রাজি হয়। মা’র সঙ্গে কথা বলে জানিয়ে দেই আমরা আগামী বছর দু’জন দেশে আসবো। তার আগে পরিকল্পনা করবো। তুমিও প্রস্তুতি নাও মা।
আমরা দু’জনই প্রায় এক বছর সময় পাই। বিবেক রাজি বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। কিন্তু ওর পরিবার রাজি নয়। তাদের কথা, কি দরকার শুধু শুধু টাকা খরচ করার? এমন একটা ভাব নিয়ে বসে আছেন তাঁরা। কিন্তু আমার চাওয়ার কারণ, আমার মা। সঙ্গে আমাদের সামাজিক স্ট্যাটাস। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন। তাছাড়া আমি মায়ের বড় মেয়ে। স্বাভাবিকভাবেই ঘটা করে আয়োজনের একটা তাগিদ আছে। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। এই ফাঁকে ওকে বোঝাই।
তুমি বাসায় বলে কয়ে রাজি করাও।
আমি জানি বিবেকের আর্থিক অবস্থা। বরাবরই আমার চেয়ে কম বেতনের চাকরি করতো। যা আয় করতো সেটার অল্প কিছু খরচ করতো আয়ারল্যান্ডে, বাকিটা পাঠিয়ে দিত বাড়িতে। পুরো পরিবার চলতো এই ছেলেটির পাঠানো টাকার ওপর। বাবা কোনো কাজ করতেন না। বোন ছিল দুটো। তাদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে পরিবারের সবার খরচ দিত ছেলেটি। আমি জোর করে কিছু বলতেও পারতাম না। তারই তো বাবা-মা ও বোন। আমি কি বলব? একসঙ্গে থাকা মানেই তো একটা ছেলের যাবতীয় বিষয়ে তদারকি করা না!
মাঝখানে ছোট একটা ঝামেলা বাধে। যেটা আমি অনেক পরে টের পাই। শুরুতে আমাকে বিবেক বলেছিল ওদের পরিবারের ঢাকা বাড়ি, গাড়ি বেশ সম্পত্তি আছে। এমনকি পারিবারিক সামাজিক মর্যাদাও আমাদের সমান। কিন্তু যখন বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি তখনই বুঝি পুরো ব্যাপারটাই ফাঁকা। ফাঁকা কলসি যেমন বাজে বেশি। মায়ের কাছে মিথ্যা বলেছি এবং সামনের সুন্দর দিনগুলোর কথা ভেবে আপ্লুত হয়েছি।
এখানেই শেষ নয়, আমার কাছে খুব বিনয়ী হয়ে বলে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য যে টাকা লাগবে সেটা নেই। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি তো মা’কে বলেছি বিবেকদের এটা আছে, ওটা আছে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যথেষ্ট স্বচ্ছল। এখন বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য যদি টাকা-পয়সাই না থাকে তাহলে বিষয়টা লজ্জার। বাধ্য হয়ে আমি আয়ারল্যান্ডের ব্যাংক থেকে আমার নামে একটা বড় অঙ্কের ঋণ উঠিয়ে বিবেকের হাতে দেই। পই পই করে বলে দেই এই টাকা কোথায় কীভাবে খরচ করবে। আমাকে বিবেক কথা দিয়েছিল, আমাকে দেয়া কথা অনুযায়ী সে কাজ করবে। আমার পরিবারের কাছে কোনোভাবেই ছোট করবে না।
কিন্তু বিবেক দেশে গিয়ে আর কথা রাখেনি। বিয়ের আয়োজনের পুরো টাকাটাই ওর বাবার হাতে তুলে দেয়। এবং তার বাবা টাকা বাঁচানোর জন্য যতখানি সস্তায় বিয়ের অনুষ্ঠান করা যায় সেই দিকেই হাঁটলেন অর্থাৎ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন।
শুরুতেই এমন ধাক্কা খেয়ে আমি চুপসে যাই। হতভম্ব হয়ে যাই। মা আস্তে আস্তে বুঝতে পারেন, কিন্তু মেয়ে বিয়ে করে ফেলেছে তাই চুপ করে যান। আমাদের ওরা জানিয়ে দেয় আমার বেশি অতিথি ওরা খাওয়াতে পারবে না। আমি আরো আশ্চর্য হলাম। বিবেককে জিজ্ঞেস কলাম, এসব কি হচ্ছে? বিবেক আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ওর বাবা যা করছে তার ওপর সে একটা কথাও বলতে পারবে না। আমি স্তব্ধ!
আমরা আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিবাহোত্তর সংবর্ধনা, যেটাকে আমরা রিসেপসন বলি সেই অনুষ্ঠানগুলো শেষ করলাম। আমার আর বিবেকের মাঝে কোনো রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়নি।
আমার জীবনের অনেক বড় একটা সিগন্যাল যে সৃষ্টিকর্তা এই বিয়ে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিয়েছিলেন, তা আমি বা আমরা ধরতে পারিনি। সম্পর্কের শুরুতেই এত বড় প্রতারণা, মিথ্যের আশ্রয় বা ব্যবহার আমার বোঝার দরকার ছিল। পরিবার তো জানতো আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাই চুপ ছিল, কিন্তু আমি? আমি কেন সরে আসিনি? কারণ সমাজের চোখে ছোট ও হাসির পাত্র হবো বলে। মাত্রই ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে আসলাম, কীভাবে দাঁড়বো সম্পর্ক বিচ্ছেদ হলে সেই চক্ষু লজ্জায়। আমার কি সেই বয়স হয়েছিল এই কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার? আর সাহস তো আমার একদমই নেই। চিটার এবং মিথ্যুক আমি নিজেও, কারণ মায়ের কাছে অনেক সত্য লুকিয়েছি একসাথে থাকার জন্য। মায়ের চিন্তা লাঘব করার জন্য আমি ভুল পন্থা অবলম্বন করেছি। কিন্তু পাঠক, আজকের আমার এই অভিজ্ঞতা কীভাবে অর্জন করতাম যদি ভুল না করতাম? ভুল থেকেই তো আমরা শিখি, শক্ত হই।
আমরা চলে আসি বাংলাদেশ থেকে। ওই মিথ্যা জালেই, মিথ্যার আড়ালেই শুরু করি নতুন করে দেখা বিবেকের সাথে জীবন। ওই সময় ভেবেই নেই আমাকে এইগুলো মেনেই বিবেকের সাথে থাকতে হবে। তাকে ছেড়ে দেয়ার স্পর্ধা আমার তৈরি হয়নি। কারণটা তখন না জানলেও এখন জানি। সাহসী ছিলাম না।
ফেরত আসার পর এভাবেই তার সাথে কেটে যায় তিন বছর। আমি আর এই তিন বছরের ভিতরে না ঢুকে আপনাদের নিয়ে যেতে চাই সেই সময়ে, যেই সময় থেকে শুরু হতে থাকে আমার জীবনের নাটকীয় মোড়। সেই টার্ন ওভার।
নানা উত্থান পতন আর ঝড় বয়ে গেছে। নিজের বেড়ে উঠা, প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, মডেলিং, ক্যারিয়ার, প্রতারণা সব মিলিয়ে টালমাটাল এক পথ। প্রিয়তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-‘প্রিয়তীর আয়না’। বইটিতে খোলামেলাভাবে নিজের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো মানবজমিন এর সৌজন্যে। আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব-
প্রথম যেদিন ওর সঙ্গে বাসায় উঠি সেদিনের স্মৃতিটা আমার আবছা আবছা মনে আছে। আমি আমার ল্যাগেজ নিয়ে একটা নির্দিষ্ট স্টপেজে এসে দাঁড়াই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় বিবেকের জন্য। ও চলে আসে। তারপর দু’জন মিলে একসঙ্গে নতুন বাসার দিকে রওনা দেই। বাসা বলা যাবে না, রুম বলাই ভালো।
দু’জন মিলে রুমটা গোছগাছ করি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু’জন টুকটাক গল্প করি। একটা অদ্ভুত অনুভূতি পুরো শরীরে বয়ে যায়। আমার কেমন যেন লাগে। একটা পুরুষের সঙ্গে এভাবে এক রুমে থাকব! আমার বারবার মনে হয়, আজ থেকে বুঝি আমাদের নতুন সংসার শুরু হলো। যে সংসারে আমরা দু’জনই রাজা। এখন আমাকে দেখার একজন মানুষ হলো।
আমার কেমন কেমন যেন লাগে। ওইদিন বাইরে যেতে যেতে আমাদের অলিখিত একটু চুক্তি হয়। আমাদের এই নতুন সংসারে যা কিছু করার বা কেনার সেটা শেয়ার করে কিনব বা করব। বিবেক রাজি। আমরা সেই রাত থেকেই শুরু করি। যখন দু’জন সে রাতে বাইরে খেতে যাই তখনই শেয়ারে বিল দিই। তারপর এটা নিয়ে হাসাহাসি করি দু’জন। তবে কি আমাদের যৌথ জীবন শুরু হলো। আমরা কি এক পথে হাঁটা শুরু করলাম দু’জন? কি জানি, এতে সুন্দর জোছনা রাতে ওইসব ভাবনা মাথায় আসে না। আয়ারল্যান্ডেও ফিনিক দেওয়া জোছনা ফোটে। যে জোছনা আমাদের জানালা ভেদ করে রুমে এসে ঠাঁয় নেয়। আমরা দু’জন জোসনায় মাখামাখি করতে করতে যৌথ জীবনের প্রথম রাত পাড়ি দেই।
এভাবে চলছিল আমাদের জীবন। ভালো অন্যরকম অনুভূতির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। শরীর-মন জাগছে। চাইছে। কিছু কিছু রাত অসম্ভব ভালোলাগা তৈরি করে ভোরের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সে রাতে আর ঘুম হয় না। কী অদ্ভুত আবেশে পার করি প্রতিটি মুহূর্ত।
হঠাৎ একদিন আমি উপলব্ধি করি এই যে আমরা একসঙ্গে থাকছি, এটা কি ঠিক হচ্ছে। মা শুনলে কি কষ্ট পাবেন না? কেমন লাগবে তাঁর? কষ্ট পাবেন? এসব করার জন্যই কি আমাকে শত শত মাইল দূরে পাঠিয়েছেন? আমি কি তবে অন্য পথে হাঁটছি?
ততদিনে মানে দু’তিন মাসের মধ্যেই বাঙালি পাড়ায় খবর রটে যায়, আমর প্রেম করছি। শুধু প্রেমই না, একসঙ্গেও থাকছি।
এ ধরনের সমালোচনার বড় কারণ হলো, আমার চেয়ে বিবেক বাঙালিদের সঙ্গে বেশি মিশতো। যার ফলে, অনেকেই সন্দেহ করা শুরু করেন। মানে তারা আসলে ধোঁয়া খুঁজতে থাকেন। সেই ধোঁয়া থেকে আগুন ধরাতে একবিন্দু সময় নেন না এই দেশের বাঙালি সকল। সেই আগুনে পা দিয়ে আমরা জানিয়ে দেই ‘হ্যাঁ আমরা একসঙ্গেই আছি এবং সাথে জানিয়ে দেই আমরা বিয়ে করেই থাকছি একসাথে।’ আগে-পিছে এত যোগ-বিয়োগ করার মতো বয়স আমাদের হয়নি। শুধু জানি, এত আড় চোখ আর এত সমালোচনা আমি নিতে পারব না, যেহেতু এই কমিউনিটিতে আমাদের আনাগোনা।
এক সন্ধ্যায় আমি মায়ের কাছে ফোন দেই। অবশ্য মা’র সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হতো। আমার তখন আর্থিক স্বচ্ছলতা চলে এসেছে। মায়ের কাছ থেকে টাকা নেয়া বন্ধ করেছি অনেক দিন হয়েছে।
মা’কে জানিয়ে দেই, আমি বিবেক নামে এক ছেলেকে পছন্দ করি এবং তাকে বিয়ে করেছি হঠাৎ করেই। কারণ তার সাথে মেলামেশা নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে বদনাম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। শুনে বোধ হয় চমকে যান মা। কিন্তু তেমন কিছু বলেন না। খুশি হন কিনা কে জানে। তবে অখুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, মা’র চাওয়া ছিল আমি যেন বিয়ে করি। এই বিয়ের জন্য মা কম চেষ্টা করেন নি।
আমার মা বিচক্ষণ ও আধুনিক মনার মানুষ ছিলেন, কয়েক মিনিটের মাথায় স্বাভাবিক হয়ে বিবেকের সব খোঁজ-খবর নিলেন। আমাকে বিবেক তার পরিবার নিয়ে যতখানি তথ্য দিয়েছিল, আমি তাই দিয়েছি। অনেক তথ্যের মধ্যে যে কিছু মিথ্যারও মিশ্রণ ছিল, তা জেনেছি অনেক পরে। আমি ওইসব দোষ-গুণ, সত্য-মিথ্যাতে এখন যাবো না।
মা আমাকে বলেছিলেন, একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। এ দেশে বিয়ে করলে তাঁকে আবার আয়ারল্যান্ড নিয়ে যেতে হতো। তার চাকরির ব্যবস্থা করতে হতো। এখন আর সেই সমস্যা নেই। ভালোই করেছিস মা।
এবার বিবেকের পালা। ওকে আমি অনুরোধ করি বাড়িতে জানাতে। না হলে পরে ওর পরিবারের মানুষ শুনলে কষ্ট পাবেন। তার চেয়ে সন্তানের কাছ থেকে শুনলে আনন্দিত হতে পারেন। বিবেক আমার এই বুদ্ধিটা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে। সেদিন সন্ধ্যাতেই ওর বাড়িতে ফোন করে। সরাসরি জানিয়ে দেয়, আমরা বিয়ে করেছি।
এই কথাটা পাশে বসে থেকে শুনতে বেশ ভালো লাগে। অন্যরকম একটা অনুভূতি খেলে যায় নিজের মধ্যে। বুঝতে পারি বিবেকের পরিবারও বিষয়টি সাধরে গ্রহণ করেছে। আমার বিশ্বাস ছিল উনারা মেনে নিবেন। কারণ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি এবং আমাদের পরিবারের অবস্থা, বিবেকদের পরিবার থেকে দ্বিগুণ ভালো। আমি অহঙ্কার করে বলছি না, আমি শুধুই তখনকার বাস্তবতা এবং পরিস্থিতি জানাচ্ছি মাত্র।
মা খুশি, যে আমার সঙ্গী সেও খুশি, তার পরিবারের লোকজনও খুশি। আর কি লাগে? সুখেই আছি বলা যায়। কিন্তু এরই মধ্যে আমাকে বাড়ি থেকে চাপ দিয়ে বলা হয়, বিয়ে করেছ ভালো করেছ এখন তো সবাইকে জানাতে হবে। সামাজিকতা বজায় রাখতে হবে। বিবাহ সংবর্ধনার একটা অনুষ্ঠান করতে হবে। তোমরা প্রস্তুতি নাও।
আমি বিষয়টি বিবেককে জানাই। ও রাজি হয়। মা’র সঙ্গে কথা বলে জানিয়ে দেই আমরা আগামী বছর দু’জন দেশে আসবো। তার আগে পরিকল্পনা করবো। তুমিও প্রস্তুতি নাও মা।
আমরা দু’জনই প্রায় এক বছর সময় পাই। বিবেক রাজি বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। কিন্তু ওর পরিবার রাজি নয়। তাদের কথা, কি দরকার শুধু শুধু টাকা খরচ করার? এমন একটা ভাব নিয়ে বসে আছেন তাঁরা। কিন্তু আমার চাওয়ার কারণ, আমার মা। সঙ্গে আমাদের সামাজিক স্ট্যাটাস। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন। তাছাড়া আমি মায়ের বড় মেয়ে। স্বাভাবিকভাবেই ঘটা করে আয়োজনের একটা তাগিদ আছে। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। এই ফাঁকে ওকে বোঝাই।
তুমি বাসায় বলে কয়ে রাজি করাও।
আমি জানি বিবেকের আর্থিক অবস্থা। বরাবরই আমার চেয়ে কম বেতনের চাকরি করতো। যা আয় করতো সেটার অল্প কিছু খরচ করতো আয়ারল্যান্ডে, বাকিটা পাঠিয়ে দিত বাড়িতে। পুরো পরিবার চলতো এই ছেলেটির পাঠানো টাকার ওপর। বাবা কোনো কাজ করতেন না। বোন ছিল দুটো। তাদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে পরিবারের সবার খরচ দিত ছেলেটি। আমি জোর করে কিছু বলতেও পারতাম না। তারই তো বাবা-মা ও বোন। আমি কি বলব? একসঙ্গে থাকা মানেই তো একটা ছেলের যাবতীয় বিষয়ে তদারকি করা না!
মাঝখানে ছোট একটা ঝামেলা বাধে। যেটা আমি অনেক পরে টের পাই। শুরুতে আমাকে বিবেক বলেছিল ওদের পরিবারের ঢাকা বাড়ি, গাড়ি বেশ সম্পত্তি আছে। এমনকি পারিবারিক সামাজিক মর্যাদাও আমাদের সমান। কিন্তু যখন বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি তখনই বুঝি পুরো ব্যাপারটাই ফাঁকা। ফাঁকা কলসি যেমন বাজে বেশি। মায়ের কাছে মিথ্যা বলেছি এবং সামনের সুন্দর দিনগুলোর কথা ভেবে আপ্লুত হয়েছি।
এখানেই শেষ নয়, আমার কাছে খুব বিনয়ী হয়ে বলে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য যে টাকা লাগবে সেটা নেই। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি তো মা’কে বলেছি বিবেকদের এটা আছে, ওটা আছে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যথেষ্ট স্বচ্ছল। এখন বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য যদি টাকা-পয়সাই না থাকে তাহলে বিষয়টা লজ্জার। বাধ্য হয়ে আমি আয়ারল্যান্ডের ব্যাংক থেকে আমার নামে একটা বড় অঙ্কের ঋণ উঠিয়ে বিবেকের হাতে দেই। পই পই করে বলে দেই এই টাকা কোথায় কীভাবে খরচ করবে। আমাকে বিবেক কথা দিয়েছিল, আমাকে দেয়া কথা অনুযায়ী সে কাজ করবে। আমার পরিবারের কাছে কোনোভাবেই ছোট করবে না।
কিন্তু বিবেক দেশে গিয়ে আর কথা রাখেনি। বিয়ের আয়োজনের পুরো টাকাটাই ওর বাবার হাতে তুলে দেয়। এবং তার বাবা টাকা বাঁচানোর জন্য যতখানি সস্তায় বিয়ের অনুষ্ঠান করা যায় সেই দিকেই হাঁটলেন অর্থাৎ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন।
শুরুতেই এমন ধাক্কা খেয়ে আমি চুপসে যাই। হতভম্ব হয়ে যাই। মা আস্তে আস্তে বুঝতে পারেন, কিন্তু মেয়ে বিয়ে করে ফেলেছে তাই চুপ করে যান। আমাদের ওরা জানিয়ে দেয় আমার বেশি অতিথি ওরা খাওয়াতে পারবে না। আমি আরো আশ্চর্য হলাম। বিবেককে জিজ্ঞেস কলাম, এসব কি হচ্ছে? বিবেক আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ওর বাবা যা করছে তার ওপর সে একটা কথাও বলতে পারবে না। আমি স্তব্ধ!
আমরা আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিবাহোত্তর সংবর্ধনা, যেটাকে আমরা রিসেপসন বলি সেই অনুষ্ঠানগুলো শেষ করলাম। আমার আর বিবেকের মাঝে কোনো রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়নি।
আমার জীবনের অনেক বড় একটা সিগন্যাল যে সৃষ্টিকর্তা এই বিয়ে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিয়েছিলেন, তা আমি বা আমরা ধরতে পারিনি। সম্পর্কের শুরুতেই এত বড় প্রতারণা, মিথ্যের আশ্রয় বা ব্যবহার আমার বোঝার দরকার ছিল। পরিবার তো জানতো আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাই চুপ ছিল, কিন্তু আমি? আমি কেন সরে আসিনি? কারণ সমাজের চোখে ছোট ও হাসির পাত্র হবো বলে। মাত্রই ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে আসলাম, কীভাবে দাঁড়বো সম্পর্ক বিচ্ছেদ হলে সেই চক্ষু লজ্জায়। আমার কি সেই বয়স হয়েছিল এই কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার? আর সাহস তো আমার একদমই নেই। চিটার এবং মিথ্যুক আমি নিজেও, কারণ মায়ের কাছে অনেক সত্য লুকিয়েছি একসাথে থাকার জন্য। মায়ের চিন্তা লাঘব করার জন্য আমি ভুল পন্থা অবলম্বন করেছি। কিন্তু পাঠক, আজকের আমার এই অভিজ্ঞতা কীভাবে অর্জন করতাম যদি ভুল না করতাম? ভুল থেকেই তো আমরা শিখি, শক্ত হই।
আমরা চলে আসি বাংলাদেশ থেকে। ওই মিথ্যা জালেই, মিথ্যার আড়ালেই শুরু করি নতুন করে দেখা বিবেকের সাথে জীবন। ওই সময় ভেবেই নেই আমাকে এইগুলো মেনেই বিবেকের সাথে থাকতে হবে। তাকে ছেড়ে দেয়ার স্পর্ধা আমার তৈরি হয়নি। কারণটা তখন না জানলেও এখন জানি। সাহসী ছিলাম না।
ফেরত আসার পর এভাবেই তার সাথে কেটে যায় তিন বছর। আমি আর এই তিন বছরের ভিতরে না ঢুকে আপনাদের নিয়ে যেতে চাই সেই সময়ে, যেই সময় থেকে শুরু হতে থাকে আমার জীবনের নাটকীয় মোড়। সেই টার্ন ওভার।
‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে নেয়া
No comments