তারেকের স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন নুরুন নাহার by মরিয়ম চম্পা
দীর্ঘ
৮ বছর। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে চাপা কান্নায়। শূন্য হৃদয়ে
শুধু হাহাকার। ছেলে তারেক মাসুদ নেই। তারপরও অপেক্ষা তার মা নুরুন নাহারের।
সারাক্ষণ ছেলের স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন। তারেকের স্মৃতিবিজড়িত স্টুডিও,
বইপত্র, আর ঘরের নানা আসবাবপত্রের মাঝে পান ছেলের গন্ধ। কখনো কখনো হাউমাউ
করে কেঁদে উঠেন। কখনো নীরবে চোখের জল ফেলেন। এভাবেই পেরুচ্ছে দিন। তারেক
মাসুদের কথা জিজ্ঞেস করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুরুন নাহার বলেন, সৃষ্টিকর্তা
কেন আমাকে নিয়ে গেলো না? তারেককে কেন এতো জলদি নিয়ে গেলো?
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ। মাটির ময়নার প্রিকুয়েল কাগজের ফুল সিনেমার কাজ চলছিল তখন। তারেক মাসুদের মনিপুরিপাড়ার বাসায় মা নুরুন নাহার মাসুদ এখনো খুঁজে ফেরেন তার নারী ছেড়া ধন তারেক মাসুদকে।
তিনি বলেন, আমার হিরার টুকরো ছেলের মতো দেখিনা কাউকে। অনেক খুঁজি কিন্তু পাইনা। ওযে কি রত্ন ছিল সেটা আমি জানি। ওর হাটা-চলা, কথা-বার্তা কারো মাঝে খুঁজে পাইনা। ওকে হারিয়ে কোনোরকম বেঁচে আছি। তারেকের রেখে যাওয়া সব স্মৃতিতে বিশেষ করে ওর পাওয়া বিভিন্ন পুরষ্কার, বই ইত্যাদিতে ধুলো-ময়লা জমে গেছে। অথচ এগুলো সবই ছিল তার কষ্টার্জিত। এগুলোর অবহেলা দেখতে আমার খুব খারাপ লাগে। কষ্ট লাগে। বেঁচে থাকাবস্থায় যদি দেখে যেতাম এগুলো সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়েছে তাহলে আমি শান্তি পেতাম।
নুরুন নাহার বলেন, আমারতো বয়স কম হয়নি। ওর আগেই আমার যাওয়া উচিৎ ছিল। তারেক চলে যাওয়ার ৮ বছরের মধ্যে ৬ থেকে ৭ বছর আমার কোনো সেন্স ছিল না। মানুষ দেখেছে আমি ভালো আছি। কথা বলছি। কিন্তু গত দুই বছর ধরে আমার একটু একটু করে মনে হচ্ছে চারপাশে আমার তারেকের স্মৃতিগুলো নষ্ট হচ্ছে। কোথায় তার ব্যবহৃত পাপোশটা নষ্ট হচ্ছে। কোথায় তার হাতের ছোয়া জিনিসগুলো নষ্ট হচ্ছে। এগুলো নিয়েই আমার কষ্ট এখন। তারেকের নামে একটি জাদুঘর ও লাইব্রেরী তৈরি করা, তারেকের সমাধির সঠিক সংরক্ষণ এগুলোই আমার চাওয়া। দেশ বিদেশের মানুষ দেখতে এসে অযত্ন অবহেলা দেখে আফসোস করে।
তিনি বলেন, আমার ছেলে আমার বুকে থাকতো। ও কেনো এতো বড় হতে গেলো। ও এতো বড় এবং বিখ্যাত না হয়ে সাধারণ তারেক হয়ে বেঁচে থাকতো। তারেকের মৃত্যুর পাঁচদিন আগে ওর বাবা মারা যায়। তখন তারেক বলেছিল, আমার মায়ের কাছে কেউ যদি না থাকে আমি থাকবো। ঠিক তার পাঁচদিন পরে তারেক মারা যায়। মৃত্যুর আগে চারদিন আমার কাছে ছিল। তখন রমজান মাস। মিশুক মনির আমেরিকা থেকে আসার পর কাগজের ফুল সিনেমার বিষয়ে কথা বলতে ফোন দিলে ও চলে যায়। তার পরেই সব শেষ হয়ে যায়।
তারেক যেদিন চলে গেছে সেদিনই আমি চলে যেতে পারতাম। কিজন্য তারেক আমাকে রেখে গেছে সেটাও আমি বুঝি। তার কষ্টের স্মৃতিগুলো নিয়ে থাকতে এবং দেখার জন্য আমাকে তারেক রেখে গেছে। ও প্রায়ই বলতো, ‘আমি বেশি দিন থাকবো না। ক্যাথরিন তুমি আমার কাজগুলো সমাধান করো’।
ক্যাথরিন ছেলে নিষাদকে নিয়ে এখন আমেরিকায় আছে। গত বছর আগস্টে তারেকের মৃত্যুদিবসের আগে ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। এ বছর হয়তো তারেকের মৃত্যুবার্ষিকীতে ওরা দেশে আসবে। এখন নিষাদের বয়স ৯ বছর। গত এপ্রিলে তার জন্মদিন ছিল। জন্মদিনের সময় ওদের সঙ্গে শেষবার আমার কথা হয়েছে। ক্যাথরিন বললো, ‘আম্মা তুমি কেমন আছো। ভিডিও কল করলে নিষাদকে দেখতে পাবে’। নিষাদ বাংলা বোঝে কিন্তু বলেনা। নিষাদকে তার বাবার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারনা দিতে মা ক্যাথরিন একটি বই তৈরি করেছে। যেখানে ইংরেজিতে তারেকের জীবনের আদ্যপান্ত লিখে দিয়েছে মা ক্যাথরিন।
খুব সকালে উঠে নামাজ শেষে তারেকের জন্য দোয়া করি। ওর সকল ছবিগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। এইতো আমার সারাদিনের রুটিন। আমি মনে করি আমার তারেক মারা যায়নি। তারেক মাঝে মাঝে আমাকে দেখা দিয়ে বলতো, আম্মা ফোন ধরো। আম্মা বসো। ও বেঁচে থাকাবস্থায় সবসময় একথাটি বলতো, আম্মা আসো। বসো। কারণে অকারণে তারেক আমাকে ডাকতো। কোনো কারণ ছাড়াই ডাকতো। চিৎকার করে ডাকতো।
এতো স্মৃতি আমি কিভাবে ভুলবো। ও যে এভাবে হঠাৎ করে হারিয়ে যাবে এটা আমি কখনো ভাবিনি। ও সবসময় আমাকে নিয়ে চিন্তা করতো। সবাইকে বলতো আমার মা’কে দেখো। আমাকে ওর সাথে ঢাকায় থাকতে বলতো। এখনতো থাকছি। কিন্তু তখন থাকিনি। নিষাদের হাতে একটি তিল রয়েছে। ঠিক একই জায়গায় তারেকের হাতেও তিল ছিল।
তারেক যখন আমেরিকায় থাকতো তখন আমার সাথে প্রতি সপ্তাহে ভিডিও কথা এবং দেখা হতো। বলতো আম্মা তোমাকে দেখা যায়না। তোমার পাশে বড় একটি লাইট নাও। এমন একটি বটগাছ এভাবে চলে যাবে আমি মেনে নিতে পারছিনা। যতোদিন থাকবো ততোদিনই তারেকের কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকতে তার স্মৃতিগুলো আমি একজায়গায় একত্রে দেখতে চাই। তার স্মৃতিতে একটি জাদুঘর ও লাইব্রেরী হোক। বিশ্বরোড থেকে বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় একটি মসজিদ হোক। আমার এই দাবি। সে কোনো বাড়িঘর করেনি। মনিপুরিপাড়ার এই ভাড়াবাড়িতেই থাকতো সে। তার যাবতীয় কাজ করতো এখানেই। ৫ ভাই তিন বোনের মধ্যে তারেক ছিলো মেজো। বড় মেয়ে প্রয়াত আসমার পরেই তারেকের জন্ম।
তারেক মাসুদের ছোট ভাই সাঈদ মাসুদ বলেন, সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ হঠাৎ এরকম একটি দুর্ঘটনায় মারা যাবেন এটা এখনো আমরা মানতে পারছিনা। কোনো কোনো মানুষের জন্ম হয় একটি পুরো পরিবারকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারেক ভাই আমাদের পরিবারের জন্য তেমনই একজন মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমাদের পরিবারের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। ছোট বাচ্চাদের সাথে এবং পরিবারের বাবা-মা ও ভাই বোনদের সাথে তার আচরণ ছিল অন্যরকম। তার শূণ্যতা কখনো পূরণ হবার নয়।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ। মাটির ময়নার প্রিকুয়েল কাগজের ফুল সিনেমার কাজ চলছিল তখন। তারেক মাসুদের মনিপুরিপাড়ার বাসায় মা নুরুন নাহার মাসুদ এখনো খুঁজে ফেরেন তার নারী ছেড়া ধন তারেক মাসুদকে।
তিনি বলেন, আমার হিরার টুকরো ছেলের মতো দেখিনা কাউকে। অনেক খুঁজি কিন্তু পাইনা। ওযে কি রত্ন ছিল সেটা আমি জানি। ওর হাটা-চলা, কথা-বার্তা কারো মাঝে খুঁজে পাইনা। ওকে হারিয়ে কোনোরকম বেঁচে আছি। তারেকের রেখে যাওয়া সব স্মৃতিতে বিশেষ করে ওর পাওয়া বিভিন্ন পুরষ্কার, বই ইত্যাদিতে ধুলো-ময়লা জমে গেছে। অথচ এগুলো সবই ছিল তার কষ্টার্জিত। এগুলোর অবহেলা দেখতে আমার খুব খারাপ লাগে। কষ্ট লাগে। বেঁচে থাকাবস্থায় যদি দেখে যেতাম এগুলো সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়েছে তাহলে আমি শান্তি পেতাম।
নুরুন নাহার বলেন, আমারতো বয়স কম হয়নি। ওর আগেই আমার যাওয়া উচিৎ ছিল। তারেক চলে যাওয়ার ৮ বছরের মধ্যে ৬ থেকে ৭ বছর আমার কোনো সেন্স ছিল না। মানুষ দেখেছে আমি ভালো আছি। কথা বলছি। কিন্তু গত দুই বছর ধরে আমার একটু একটু করে মনে হচ্ছে চারপাশে আমার তারেকের স্মৃতিগুলো নষ্ট হচ্ছে। কোথায় তার ব্যবহৃত পাপোশটা নষ্ট হচ্ছে। কোথায় তার হাতের ছোয়া জিনিসগুলো নষ্ট হচ্ছে। এগুলো নিয়েই আমার কষ্ট এখন। তারেকের নামে একটি জাদুঘর ও লাইব্রেরী তৈরি করা, তারেকের সমাধির সঠিক সংরক্ষণ এগুলোই আমার চাওয়া। দেশ বিদেশের মানুষ দেখতে এসে অযত্ন অবহেলা দেখে আফসোস করে।
তিনি বলেন, আমার ছেলে আমার বুকে থাকতো। ও কেনো এতো বড় হতে গেলো। ও এতো বড় এবং বিখ্যাত না হয়ে সাধারণ তারেক হয়ে বেঁচে থাকতো। তারেকের মৃত্যুর পাঁচদিন আগে ওর বাবা মারা যায়। তখন তারেক বলেছিল, আমার মায়ের কাছে কেউ যদি না থাকে আমি থাকবো। ঠিক তার পাঁচদিন পরে তারেক মারা যায়। মৃত্যুর আগে চারদিন আমার কাছে ছিল। তখন রমজান মাস। মিশুক মনির আমেরিকা থেকে আসার পর কাগজের ফুল সিনেমার বিষয়ে কথা বলতে ফোন দিলে ও চলে যায়। তার পরেই সব শেষ হয়ে যায়।
তারেক যেদিন চলে গেছে সেদিনই আমি চলে যেতে পারতাম। কিজন্য তারেক আমাকে রেখে গেছে সেটাও আমি বুঝি। তার কষ্টের স্মৃতিগুলো নিয়ে থাকতে এবং দেখার জন্য আমাকে তারেক রেখে গেছে। ও প্রায়ই বলতো, ‘আমি বেশি দিন থাকবো না। ক্যাথরিন তুমি আমার কাজগুলো সমাধান করো’।
ক্যাথরিন ছেলে নিষাদকে নিয়ে এখন আমেরিকায় আছে। গত বছর আগস্টে তারেকের মৃত্যুদিবসের আগে ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। এ বছর হয়তো তারেকের মৃত্যুবার্ষিকীতে ওরা দেশে আসবে। এখন নিষাদের বয়স ৯ বছর। গত এপ্রিলে তার জন্মদিন ছিল। জন্মদিনের সময় ওদের সঙ্গে শেষবার আমার কথা হয়েছে। ক্যাথরিন বললো, ‘আম্মা তুমি কেমন আছো। ভিডিও কল করলে নিষাদকে দেখতে পাবে’। নিষাদ বাংলা বোঝে কিন্তু বলেনা। নিষাদকে তার বাবার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারনা দিতে মা ক্যাথরিন একটি বই তৈরি করেছে। যেখানে ইংরেজিতে তারেকের জীবনের আদ্যপান্ত লিখে দিয়েছে মা ক্যাথরিন।
খুব সকালে উঠে নামাজ শেষে তারেকের জন্য দোয়া করি। ওর সকল ছবিগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। এইতো আমার সারাদিনের রুটিন। আমি মনে করি আমার তারেক মারা যায়নি। তারেক মাঝে মাঝে আমাকে দেখা দিয়ে বলতো, আম্মা ফোন ধরো। আম্মা বসো। ও বেঁচে থাকাবস্থায় সবসময় একথাটি বলতো, আম্মা আসো। বসো। কারণে অকারণে তারেক আমাকে ডাকতো। কোনো কারণ ছাড়াই ডাকতো। চিৎকার করে ডাকতো।
এতো স্মৃতি আমি কিভাবে ভুলবো। ও যে এভাবে হঠাৎ করে হারিয়ে যাবে এটা আমি কখনো ভাবিনি। ও সবসময় আমাকে নিয়ে চিন্তা করতো। সবাইকে বলতো আমার মা’কে দেখো। আমাকে ওর সাথে ঢাকায় থাকতে বলতো। এখনতো থাকছি। কিন্তু তখন থাকিনি। নিষাদের হাতে একটি তিল রয়েছে। ঠিক একই জায়গায় তারেকের হাতেও তিল ছিল।
তারেক যখন আমেরিকায় থাকতো তখন আমার সাথে প্রতি সপ্তাহে ভিডিও কথা এবং দেখা হতো। বলতো আম্মা তোমাকে দেখা যায়না। তোমার পাশে বড় একটি লাইট নাও। এমন একটি বটগাছ এভাবে চলে যাবে আমি মেনে নিতে পারছিনা। যতোদিন থাকবো ততোদিনই তারেকের কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকতে তার স্মৃতিগুলো আমি একজায়গায় একত্রে দেখতে চাই। তার স্মৃতিতে একটি জাদুঘর ও লাইব্রেরী হোক। বিশ্বরোড থেকে বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় একটি মসজিদ হোক। আমার এই দাবি। সে কোনো বাড়িঘর করেনি। মনিপুরিপাড়ার এই ভাড়াবাড়িতেই থাকতো সে। তার যাবতীয় কাজ করতো এখানেই। ৫ ভাই তিন বোনের মধ্যে তারেক ছিলো মেজো। বড় মেয়ে প্রয়াত আসমার পরেই তারেকের জন্ম।
তারেক মাসুদের ছোট ভাই সাঈদ মাসুদ বলেন, সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ হঠাৎ এরকম একটি দুর্ঘটনায় মারা যাবেন এটা এখনো আমরা মানতে পারছিনা। কোনো কোনো মানুষের জন্ম হয় একটি পুরো পরিবারকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারেক ভাই আমাদের পরিবারের জন্য তেমনই একজন মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমাদের পরিবারের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। ছোট বাচ্চাদের সাথে এবং পরিবারের বাবা-মা ও ভাই বোনদের সাথে তার আচরণ ছিল অন্যরকম। তার শূণ্যতা কখনো পূরণ হবার নয়।
No comments