অসামান্য বালিশ ও ক্যাসিনো কেস by কাজী জেসিন
কাজী জেসিন |
পুরোটাই
লুটপাটের টাকায় জুয়াখেলা। ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো চলে আসছে বছর বছর ধরে।
সাধারণ মানুষ কেউ কিছুই জানে না। কিন্তু, কিছু মানুষ না জানলে তো ক্যাসিনো
ক্লাবগুলো তার গ্রাহক পেতো না, কোটি কোটি টাকা আয় হতো না, মজুদ হতো না ভরি
ভরি সোনা। ক্যাসিনো থেকে সর্বস্ব হারিয়ে কেঁদে বের হয়ে যাওয়া মানুষের চোখের
জল আশেপাশের মানুষ দেখেছে। তবু রাষ্ট্রের নজরে আসেনি। রাষ্ট্রতো অন্ধ না।
রাষ্ট্রের চোখ আছে।
যে রাষ্ট্র ডিজিটাল তার তো চোখ, নাক, কান আরও সুতীক্ষ্ণ। যখন তখন সে রাষ্ট্র নামের কারিগর যার-তার ফোনে আড়ি পাততে পারে, যখন খুশি যে কারো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়তে পারে। ডিজিটাল রাষ্ট্র বলে কথা। কিন্তু এই রাষ্ট্র গত দশ-বারো বছরে কোথায় কিভাবে ক্যাসিনো চলেছে তা দেখতে পায়নি। তাহলে এখন দেখতে পেলো যে! কী অদ্ভুত!
সাধারণ মানুষ বিগত বছরগুলোতে দেখে এসেছে কিভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার বাণিজ্য নিজেদের আয়ত্তে নিতে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কখনও কখনও হানাহানি, মারামারি এমন কি খুন পর্যন্ত করেছে। যুবলীগ, ছাত্রলীগের টেন্ডার নিয়ে একের পর এক সংঘর্ষ, হত্যা বাংলাদেশের মানুষের সামনে একটা অতি পরিচিত চিত্র। সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠন সংবিধান লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতির মহাউল্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশানস কনভেনশান এগেইন্সট করাপশান (টঘঈঅঈ) এর অনুসমর্থনকারী দেশ। দূর্নীতি নির্মূলের জন্য ’ফৌজদারী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রতিকার ছাড়া ও দুর্নীতির ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এই কনভেনশানে। শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ও জনগনের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতিতে বার বার উল্লেখ করেছে দুর্নীতি নির্মূলের কথা, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এক অস্বাভাবিক দুর্নীতির খেলা, যেখানে সরকারি কাজের টেন্ডারে বালিশের মূল্য ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার নয় শত সাতান্ন টাকা, তিরিশটি বিছানার চাদর আনতে ট্রাক ভাড়া তিরিশ হাজার টাকা। কী অসামান্য বালিশ! কী অসামান্য চাদর! শুধু বালিশের মূল্যই নয়, আমরা দেখেছি সড়ক নির্মাণেও অনান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ব্যয় কয়েকগুণ। উন্নত দেশগুলোতে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয় হচ্ছে ৩১ কোটি টাকা। বাংলাদেশে ঢাকা-পায়রা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭৩ কিলোমিটার রেলপথের ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৩ কোটি টাকা। চট্রগ্রামের দোহাজারি থেকে বান্দরবনের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় ১৩৯ কোটি টাকারও বেশি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে গড় ব্যয় ১২ কোটি টাকা। চীনে সিঙ্গেল রেলপথ নির্মাণে গড় কিলোমিটার ব্যয় ১২ কোটি ৫০ লাখ ও ২০০ কিলোমিটার গতিবেগের রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয়৭৫ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের গবেষণাপত্রের তথ্যমতে, উন্নয়নশীল দেশে সড়ক নির্মাণের খরচ বাড়ার কারণের মধ্যে রয়েছে বাজার থেকে সড়কের দূরত্ব, দরপত্রের প্রতিযোগিতা না হওয়া, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, সংঘাত ও উচ্চমাত্রার দুর্নীতি। দুর্নীতির মহোৎসব বাংলাদেশে নতুন কিছু না। বর্তমান সরকার দুর্নীতি রোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মূলত উলটা, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়েছে।
যে দেশে ৪৭.১% মানুষ দারিদ্রসীমা এবং ২৪.৬% মানুষ চরম দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে, যে দেশে এখনও মানুষ খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগে সেই দেশে সরকারদলের একজন মাঝারি সারির নেতার ঘরে পাওয়া যায় প্রায় দুই কোটি টাকা, পৌনে দুইশত কোটি টাকার এফডিআর। তিনি শুধু ক্ষমতা দেখিয়ে টেন্ডার সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েই অর্থ উপার্জন করেন নি, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় চালিয়ে এসেছেন ক্যাসিনো বাণিজ্য। এর আগে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে যুবলীগের আরেক নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে আটক করা হয়। নানান তালবাহানার পর অবশেষে গত রোববার ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গ্রেফতার করেছে বলে বলা হচ্ছে ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত সদ্য বহিষ্কৃত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও সহসভাপতি আরমানকে। প্রশাসন কি হঠাৎ করেই ক্যাসিনো আবিষ্কার করেছে? নিশ্চয়ই তা নয়। বছরের পর বছর ধরে যেখানে ক্লাবগুলোতে চলছে ক্যাসিনো, যেখানে মানুষ খেলতে যাচ্ছে, বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছে, যেখানে এই দৃশ্য আশপাশের সাধারণ মানুষ সকলেই দেখছে, প্রশাসনের চোখে পড়েনি একথা একেবারেই ভিত্তিহীন। ক্যাসিনো খেলতে যে সরঞ্জাম লাগে তা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। কাস্টমস এর নাকের ডগা দিয়ে এই সব অবৈধ খেলার সরঞ্জাম কি করে দেশে ঢুকলো এর জবাব কে দেবে? আজ বা্ংলাদেশ যে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছে সেখান থেকে দেশকে, দেশের মানুষকে উদ্ধার করতে হলে এর মূলে যেতে হবে।
বিভিন্ন সময় সরকারদলের ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নানাবিধ ফৌজদারী অপরাধে জড়ালে ও সরকার শুধু ক্ষোভ প্রকাশ আর বিব্রতই বোধ করেছে। দু্’একটা ঘটনা ছাড়া মানুষ চাঁদাবাজ, টেন্ডারসন্ত্রাস, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিচার হতে দেখেনি। দরপত্র ছিনিয়ে নিয়ে ঠিকাদারকে মারধরের ঘটনায় সাধারণ মানুষ হয়ত হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয় কিন্তু আর অবাক হয় না। ছাত্রলীগ, যুবলীগের টেন্ডারসন্ত্রাস থেকে রক্ষা পায়নি এমন কি সাধারণ মানুষও। মনে পড়ে রাব্বির কথা। ২০১৩সালের ১৯ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার, নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি নিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই গ্রপের গোলাগুলিতে পাশের গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের ১০ বছরের শিশু রাব্বি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এমনকি নিজদলের নেতাকর্মীদের হীন স্বার্থে খুনের ঘটনা বারবার জাতীয় দৈনিকগুলোর খবর হয়েছে। আইনের শাসন জারি থাকলে, প্রশাসন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে, বলাবাহুল্য সরকারি দলের কোনো নেতাকর্মী, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গায়ে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজের তকমা লাগতো না।
কিন্তু প্রশাসনকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হলে সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। বর্তমান সরকার পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, সাধারণ মানুষকে তাদের সাংবিধানিক ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতায় আছে। কোনো দল যখন মানুষের ভোটের উপর আস্থা রাখতে না পারে, তখন ক্ষমতায় আসার জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় প্রশাসনের অনৈতিক, অসাংবিধানিক সহযোগিতা, পেশীশক্তি এবং জাল ভোটের উপর। জালভোটের মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকার সাধরণত: আটকে যায় অনাকাঙ্খিত সব নির্ভরতার জালে। তখন সেই সরকার জনগনকে তুষ্ট না করে তুষ্ট করতে বাধ্য হয় নানারকম পেশীশক্তিকে। আইনের শাসনহীনতার এক অশুভ দুষ্টজালে আটকে যায় সরকার। বাংলাদেশ সরকার এমন উদাহরণ থেকে ব্যতিক্রম নয়। সুষ্টু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগনের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই রুল অব ল প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না তবু একটি নির্বাচিত সরকারই নিয়মতান্ত্রিক শাসনের প্রথম শর্ত। সুতরাং দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে, জনগনের কাছেই সরকারকে ফিরতেই হবে। জনগনের ভোটে নির্বাচিত একটি শক্তিমান স্বনির্ভর সরকারই পারবে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করতে।
একের পর এক দুর্নীতির কালিমা সরকারকে এমনভাবে কালিমাময় করেছে, প্রশাসন যখন ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো অভিযান চালাচ্ছে তখন, সারাদেশে গুঞ্জন চলছে কেন হঠাৎ এই অভিযান। প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজ শাসক দলের ভিতরেই অভিযান চালাবে এটা যেন অবিশ্বাস্য, অথচ অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, এটাই জনমানুষের সবসময় কাম্য। সরকার সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ থাকবে, একটি শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করবে এটাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ। অথচ সোশ্যাল নেটওর্য়াক খুললেই দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নানান জল্পনা-কল্পনা। এই নিয়ে বিবিসি রিপোর্ট করেছে,’শেখ হাসিনা কেন হঠাৎ ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ সজাগ হলেন। উল্লেখ্য ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ শব্দযুগলকে এই রিপোর্টে কোড করা হয়েছে অর্থাৎ এই অভিযানকে বিবিসি হয়তো এখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান বলতে নারাজ। কারণ কী হতে পারে এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিবিসি আমাদের জানাচ্ছে এই অভিযানের পেছনে দল এবং সরকারকে রক্ষার কোন চেষ্টা থাকতে পারে। ‘অপরাধে জড়িতদের সতর্ক করা হয়েছিলো ’উল্লেখ করে বিবিসি জানাচ্ছে, ”শেখ হাসিনা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে পরিস্থিতি যাচাই করে অভিযান চালানোসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছেন।’’
অর্থাৎ সরকার একরকম বাধ্য হয়ে একটানা তৃতীয় মেয়াদে এসে কতিপয় দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাও আবার ব্যাবস্থা গ্রহনের আগে অপরাধীদের সর্তক করা হয়েছিলো। সরকার যে এই অভিযানেও কতোটা ইতস্তত তা অনুমান করা যায় ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত সম্রাটকে গ্রেফতারে টালবাহানা দেখে। শুধুমাত্র এই ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান নয়, সরকারকে তার ভাবমূতি উজ্জ্বল করতে চাইলে রাষ্ট্রের বিভিন্নস্তরে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, অপকর্ম রোধ করতে হবে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে ফিরে গিয়ে মানুষকে তার হারিয়ে যাওয়া ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। জনমানুষের অধিকার সমুন্নত রাখার মধ্য দিয়েই শুধুমাত্র একটি সরকার জনপ্রিয় থাকতে পারে। কোনো চাপের মুখে নয় সরকার সংবিধান মেনে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করুক, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুক, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করুক, এটাই সাধারণ মানুষের কাম্য। ক্লাবে ক্যাসিনো চলেছে, বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে যেন কোন ক্যাসিনো না চলে, তা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন যখন এতদিন পর দেখতে পেলো অসাংবিধানিকভাবে চলে আসা এই ক্যাসিনো বাণিজ্য, তখন এই চোখ খোলা থাকুক, সকল অপরাধই রাষ্ট্রের চোখে ধরা পড়ুক। কারণ, অন্ধ হলেই বন্ধ হবে না প্রলয়।
>>>লেখক: সাংবাাদিক, উপস্থাপক
যে রাষ্ট্র ডিজিটাল তার তো চোখ, নাক, কান আরও সুতীক্ষ্ণ। যখন তখন সে রাষ্ট্র নামের কারিগর যার-তার ফোনে আড়ি পাততে পারে, যখন খুশি যে কারো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়তে পারে। ডিজিটাল রাষ্ট্র বলে কথা। কিন্তু এই রাষ্ট্র গত দশ-বারো বছরে কোথায় কিভাবে ক্যাসিনো চলেছে তা দেখতে পায়নি। তাহলে এখন দেখতে পেলো যে! কী অদ্ভুত!
সাধারণ মানুষ বিগত বছরগুলোতে দেখে এসেছে কিভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার বাণিজ্য নিজেদের আয়ত্তে নিতে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কখনও কখনও হানাহানি, মারামারি এমন কি খুন পর্যন্ত করেছে। যুবলীগ, ছাত্রলীগের টেন্ডার নিয়ে একের পর এক সংঘর্ষ, হত্যা বাংলাদেশের মানুষের সামনে একটা অতি পরিচিত চিত্র। সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠন সংবিধান লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতির মহাউল্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশানস কনভেনশান এগেইন্সট করাপশান (টঘঈঅঈ) এর অনুসমর্থনকারী দেশ। দূর্নীতি নির্মূলের জন্য ’ফৌজদারী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রতিকার ছাড়া ও দুর্নীতির ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এই কনভেনশানে। শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ও জনগনের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতিতে বার বার উল্লেখ করেছে দুর্নীতি নির্মূলের কথা, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এক অস্বাভাবিক দুর্নীতির খেলা, যেখানে সরকারি কাজের টেন্ডারে বালিশের মূল্য ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার নয় শত সাতান্ন টাকা, তিরিশটি বিছানার চাদর আনতে ট্রাক ভাড়া তিরিশ হাজার টাকা। কী অসামান্য বালিশ! কী অসামান্য চাদর! শুধু বালিশের মূল্যই নয়, আমরা দেখেছি সড়ক নির্মাণেও অনান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ব্যয় কয়েকগুণ। উন্নত দেশগুলোতে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয় হচ্ছে ৩১ কোটি টাকা। বাংলাদেশে ঢাকা-পায়রা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭৩ কিলোমিটার রেলপথের ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৩ কোটি টাকা। চট্রগ্রামের দোহাজারি থেকে বান্দরবনের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় ১৩৯ কোটি টাকারও বেশি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে গড় ব্যয় ১২ কোটি টাকা। চীনে সিঙ্গেল রেলপথ নির্মাণে গড় কিলোমিটার ব্যয় ১২ কোটি ৫০ লাখ ও ২০০ কিলোমিটার গতিবেগের রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয়৭৫ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের গবেষণাপত্রের তথ্যমতে, উন্নয়নশীল দেশে সড়ক নির্মাণের খরচ বাড়ার কারণের মধ্যে রয়েছে বাজার থেকে সড়কের দূরত্ব, দরপত্রের প্রতিযোগিতা না হওয়া, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, সংঘাত ও উচ্চমাত্রার দুর্নীতি। দুর্নীতির মহোৎসব বাংলাদেশে নতুন কিছু না। বর্তমান সরকার দুর্নীতি রোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মূলত উলটা, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়েছে।
যে দেশে ৪৭.১% মানুষ দারিদ্রসীমা এবং ২৪.৬% মানুষ চরম দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে, যে দেশে এখনও মানুষ খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগে সেই দেশে সরকারদলের একজন মাঝারি সারির নেতার ঘরে পাওয়া যায় প্রায় দুই কোটি টাকা, পৌনে দুইশত কোটি টাকার এফডিআর। তিনি শুধু ক্ষমতা দেখিয়ে টেন্ডার সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েই অর্থ উপার্জন করেন নি, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় চালিয়ে এসেছেন ক্যাসিনো বাণিজ্য। এর আগে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে যুবলীগের আরেক নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে আটক করা হয়। নানান তালবাহানার পর অবশেষে গত রোববার ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গ্রেফতার করেছে বলে বলা হচ্ছে ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত সদ্য বহিষ্কৃত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও সহসভাপতি আরমানকে। প্রশাসন কি হঠাৎ করেই ক্যাসিনো আবিষ্কার করেছে? নিশ্চয়ই তা নয়। বছরের পর বছর ধরে যেখানে ক্লাবগুলোতে চলছে ক্যাসিনো, যেখানে মানুষ খেলতে যাচ্ছে, বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছে, যেখানে এই দৃশ্য আশপাশের সাধারণ মানুষ সকলেই দেখছে, প্রশাসনের চোখে পড়েনি একথা একেবারেই ভিত্তিহীন। ক্যাসিনো খেলতে যে সরঞ্জাম লাগে তা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। কাস্টমস এর নাকের ডগা দিয়ে এই সব অবৈধ খেলার সরঞ্জাম কি করে দেশে ঢুকলো এর জবাব কে দেবে? আজ বা্ংলাদেশ যে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছে সেখান থেকে দেশকে, দেশের মানুষকে উদ্ধার করতে হলে এর মূলে যেতে হবে।
বিভিন্ন সময় সরকারদলের ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নানাবিধ ফৌজদারী অপরাধে জড়ালে ও সরকার শুধু ক্ষোভ প্রকাশ আর বিব্রতই বোধ করেছে। দু্’একটা ঘটনা ছাড়া মানুষ চাঁদাবাজ, টেন্ডারসন্ত্রাস, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিচার হতে দেখেনি। দরপত্র ছিনিয়ে নিয়ে ঠিকাদারকে মারধরের ঘটনায় সাধারণ মানুষ হয়ত হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয় কিন্তু আর অবাক হয় না। ছাত্রলীগ, যুবলীগের টেন্ডারসন্ত্রাস থেকে রক্ষা পায়নি এমন কি সাধারণ মানুষও। মনে পড়ে রাব্বির কথা। ২০১৩সালের ১৯ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার, নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি নিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই গ্রপের গোলাগুলিতে পাশের গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের ১০ বছরের শিশু রাব্বি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এমনকি নিজদলের নেতাকর্মীদের হীন স্বার্থে খুনের ঘটনা বারবার জাতীয় দৈনিকগুলোর খবর হয়েছে। আইনের শাসন জারি থাকলে, প্রশাসন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে, বলাবাহুল্য সরকারি দলের কোনো নেতাকর্মী, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গায়ে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজের তকমা লাগতো না।
কিন্তু প্রশাসনকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হলে সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। বর্তমান সরকার পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, সাধারণ মানুষকে তাদের সাংবিধানিক ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতায় আছে। কোনো দল যখন মানুষের ভোটের উপর আস্থা রাখতে না পারে, তখন ক্ষমতায় আসার জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় প্রশাসনের অনৈতিক, অসাংবিধানিক সহযোগিতা, পেশীশক্তি এবং জাল ভোটের উপর। জালভোটের মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকার সাধরণত: আটকে যায় অনাকাঙ্খিত সব নির্ভরতার জালে। তখন সেই সরকার জনগনকে তুষ্ট না করে তুষ্ট করতে বাধ্য হয় নানারকম পেশীশক্তিকে। আইনের শাসনহীনতার এক অশুভ দুষ্টজালে আটকে যায় সরকার। বাংলাদেশ সরকার এমন উদাহরণ থেকে ব্যতিক্রম নয়। সুষ্টু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগনের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই রুল অব ল প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না তবু একটি নির্বাচিত সরকারই নিয়মতান্ত্রিক শাসনের প্রথম শর্ত। সুতরাং দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে, জনগনের কাছেই সরকারকে ফিরতেই হবে। জনগনের ভোটে নির্বাচিত একটি শক্তিমান স্বনির্ভর সরকারই পারবে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করতে।
একের পর এক দুর্নীতির কালিমা সরকারকে এমনভাবে কালিমাময় করেছে, প্রশাসন যখন ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো অভিযান চালাচ্ছে তখন, সারাদেশে গুঞ্জন চলছে কেন হঠাৎ এই অভিযান। প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজ শাসক দলের ভিতরেই অভিযান চালাবে এটা যেন অবিশ্বাস্য, অথচ অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, এটাই জনমানুষের সবসময় কাম্য। সরকার সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ থাকবে, একটি শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করবে এটাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ। অথচ সোশ্যাল নেটওর্য়াক খুললেই দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নানান জল্পনা-কল্পনা। এই নিয়ে বিবিসি রিপোর্ট করেছে,’শেখ হাসিনা কেন হঠাৎ ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ সজাগ হলেন। উল্লেখ্য ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ শব্দযুগলকে এই রিপোর্টে কোড করা হয়েছে অর্থাৎ এই অভিযানকে বিবিসি হয়তো এখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান বলতে নারাজ। কারণ কী হতে পারে এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিবিসি আমাদের জানাচ্ছে এই অভিযানের পেছনে দল এবং সরকারকে রক্ষার কোন চেষ্টা থাকতে পারে। ‘অপরাধে জড়িতদের সতর্ক করা হয়েছিলো ’উল্লেখ করে বিবিসি জানাচ্ছে, ”শেখ হাসিনা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে পরিস্থিতি যাচাই করে অভিযান চালানোসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছেন।’’
অর্থাৎ সরকার একরকম বাধ্য হয়ে একটানা তৃতীয় মেয়াদে এসে কতিপয় দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাও আবার ব্যাবস্থা গ্রহনের আগে অপরাধীদের সর্তক করা হয়েছিলো। সরকার যে এই অভিযানেও কতোটা ইতস্তত তা অনুমান করা যায় ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত সম্রাটকে গ্রেফতারে টালবাহানা দেখে। শুধুমাত্র এই ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান নয়, সরকারকে তার ভাবমূতি উজ্জ্বল করতে চাইলে রাষ্ট্রের বিভিন্নস্তরে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, অপকর্ম রোধ করতে হবে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে ফিরে গিয়ে মানুষকে তার হারিয়ে যাওয়া ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। জনমানুষের অধিকার সমুন্নত রাখার মধ্য দিয়েই শুধুমাত্র একটি সরকার জনপ্রিয় থাকতে পারে। কোনো চাপের মুখে নয় সরকার সংবিধান মেনে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করুক, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুক, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করুক, এটাই সাধারণ মানুষের কাম্য। ক্লাবে ক্যাসিনো চলেছে, বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে যেন কোন ক্যাসিনো না চলে, তা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন যখন এতদিন পর দেখতে পেলো অসাংবিধানিকভাবে চলে আসা এই ক্যাসিনো বাণিজ্য, তখন এই চোখ খোলা থাকুক, সকল অপরাধই রাষ্ট্রের চোখে ধরা পড়ুক। কারণ, অন্ধ হলেই বন্ধ হবে না প্রলয়।
>>>লেখক: সাংবাাদিক, উপস্থাপক
No comments