সন্ত্রাসীদের হাতে ভারী অস্ত্র নানা আলোচনা by শুভ্র দেব
একে
২২ রাইফেল। অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রের মধ্যে একটি। তৈরি হয় চীন-রাশিয়ায়।
বিক্রি হয় ছয় থেকে সাত লাখ টাকায়। একসঙ্গে ত্রিশটি গুলি করা যায় একে-২২
রাইফেল দিয়ে। বড় ধরনের হামলায় এই অস্ত্রটি ব্যবহার করে জঙ্গিগোষ্ঠী। ২০১৬
সালে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় জঙ্গিরা এই অস্ত্র ব্যবহার
করেছিল। ইদানিং এই ভারী অস্ত্র মিলছে সন্ত্রাসীদের হাতে। মিয়ানমার ও ভারতীয়
সীমান্ত দিয়ে এই মরনাস্ত্র ঢুকছে দেশে।
সরবরাহ করছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদাররা। গত মাসে এ ধরনের দুটি অস্ত্র উদ্ধারের পর গোয়েন্দারা বেশ চিন্তিত। বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তারা মাঠে নেমেছেন। গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছেন অত্যাধুনিক এই অস্ত্র কারা সরবরাহ করছে, কেনইবা করছে। এর নেপথ্য কারা রয়েছেন। সীমান্তবর্তী এলাকায় বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। এছাড়া তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম ও গতিবিধির ওপর নজরদারি করা হচ্ছে।
জুলাই মাসে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার একটি টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকার খিলগাঁর সিপাহীবাগ এলাকার ফাইভ স্টার নিবাসের সামনে থেকে মোহাম্মদ ফয়সাল নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে। তার দেয়া তথ্যমতে ফাইভ স্টার নিবাসের আট তলায় অভিযান চালিয়ে জিয়াউল আবেদীন জুয়েল ও জাহেদ আল আবেদীন রুবেলকে গ্রেপ্তার করে। এসময় তাদের হেফাজত থেকে একে-২২ রাইফেল, চারটি বিদেশী পিস্তল ও ১টি রিভলবার উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা টিম জানতে পারে তারা খিলগাঁও এলাকার পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের অনুসারি। মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এক শীর্ষ নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্য তাদের এসব অস্ত্র জিসান সরবরাহ করেছে। যুবলীগের ওই নেতার সঙ্গে জিসানের দীর্ঘদিন ধরে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি নিয়ে ঝামেলা চলছিল। তাই বাধা সরাতে ওই নেতাকে হত্যার চক একেছিল জিসান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ গত ৩০ জুন ওয়ারীর ওয়ান্ডারল্যান্ডের সামনে থেকে একটি একে ২২ রাইফেল উদ্ধার করে। এ ঘটনায় বাবুল ও সাদেক নামের দুজনকে উদ্ধার করে সিটিটিসির এই টিম জানতে পারে তারা ওই রাইফেলের বাহক। শ্যামপুর এলাকা থেকেও সম্প্রতি গুলিসহ ছয়টি বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। ৩ মার্চ রাতে ঢাকার যাত্রাবাড়ির ধোলাইখাল এলাকা থেকে ১২ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাদের দেয়া তথ্য মতে রামপুরার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে হরকাতুল জিহাদের দুই সদস্য হাফিজ ওরফে খালিদ ওরফে ইব্রাহিম গাজী ও মামুনুর রশিদ ওরফে বাচ্চু মোল্যাকে গ্রেপ্তার করে। এসময় তাদের কাছে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১টি একে ২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে হুজির ওই সদস্যরা জানিয়েছে, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি আসামি উজ্বলের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কয়েকজন সদস্য মিলে ডাকাতি করছে। ডাকাতির লুন্ঠিত মালামাল থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ তারা সংগঠনের কাজে ব্যয় করে।
অস্ত্র নিয়ে কাজ করেন এমন গোয়েন্দারা বলছেন, সন্ত্রাসীদের হাতে একে ২২ রাইফেল রয়েছে বিষয়টিকে ছোট করে দেখার উপায় নাই। কারণ সন্ত্রাসীরা কোনো মিশনের টার্গেট নিয়েই এসব অস্ত্র মজুদ করে। ছোটখাটো অনেক অস্ত্র সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করে। বিভিন্ন মহলের কাছে এমন বিপুল পরিমান অস্ত্র রয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত ও বিশেষ অভিযানে এসব অস্ত্র ধরা পড়ে। কিন্তু একে-২২ রাইফেল থাকাটা চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। খিলগাঁও ও ওয়ারীর ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্য থেকে জানা গেছে দেশের বাইরে থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য কলকাঠি নাড়া হচ্ছে। তাই পেশি শক্তি জানান দেয়ার জন্য এসব অস্ত্র মজুদ রাখছে সন্ত্রাসীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এধরনের বিদেশী দামী অস্ত্র ছোটখাটো সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করে না। তারা এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহারও জানেনা আবার সরবরাহ করার সাহসও করে না। সম্প্রতি দুটি বিদেশী অস্ত্র উদ্ধারের পর পর্যালোচনা করে জানতে পেরেছি দেশের বাইরে থেকে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য কোনো সন্ত্রাসী মহল এমনটা করছে। তারা ধর্মীয় বড় উৎসব বা বিশেষ কোন দিনকে ঘিরে এমন পরিকল্পনা করে। যখন দেশে টাকার প্রবাহ বেশি থাকে বা আধিপত্যের বিস্তার, পেশি শক্তি প্রদর্শন ও টার্গেট কিলিং মিশনে এ ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করে।
গোয়েন্দা তথ্যমতে, বেশ কিছুদিন ধরে দেশের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলার মত বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনাও ঘটেনি। তাই এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে ইন্টারপোলের রেডএলার্টভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। এসব সন্ত্রাসীদের অনেকেই এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছে। কেউ কেউ কারাগারে বসে কলকাঠি নাড়ছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, টার্গেট কিলিং সবকিছু তারা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করছে। এসব সন্ত্রাসীরা আবার এলাকা ভিত্তিক রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে। এছাড়া পেশাদার স্মাগলার, মাদক ব্যবসায়ী, অবৈধ পণ্যের ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার জন্য অস্ত্র রাখে। অনেক সময় এসব অস্ত্র ভাড়ায় নিয়ে যায় পেশাদার সন্ত্রাসীরা। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে পেশি শক্তির ব্যবহার বেড়ে যায়। তখন বাজারে অস্ত্রের চাহিদা থাকে। এ সুযোগে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সবধরনের অস্ত্র আনে। পুলিশের কড়াকড়ি থাকলে অস্ত্রের দামও বেড়ে যায়। ভারত, মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে এসব অস্ত্র আনা হয়। তাই অস্ত্র ব্যবসায়ী ও সীমান্তে কড়া নজরদারি রাখতে হবে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করেন এমন গোয়েন্দারা সূত্র জানিয়েছেন, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবনের দুর্গমপাহাড়ি এলাকা থেকে প্রায়ই অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র আটক করা হয়। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এম কে-১১, এইচ কে-৩৩, জি-৩, একে-৪৭, একে-২২, এম-১৬ রাইফেল, নাইন এমএম পিস্তল। মানের দিক দিয়ে এসব অস্ত্র যেমন অত্যাধুনিক তেমনি ব্যয়বহুল। পাহাড়িদের হাত ঘুরে এসব অস্ত্র পৌঁছে যায় সন্ত্রাসীদের হাতে। এসব অস্ত্র যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে তাই এই তিন জেলায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এই তিন জেলার কিছু স্থানকে অস্ত্র আসার রুট হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে-বান্দরবানের থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকা, রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার চোট হরিণা, বড় হরিণা, বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক, জুরাছড়ির আন্দারমানিক, ফকিরাছড়ি, বিলাইছড়ি, খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার নারাইছড়ি, পানছড়ির দুদকছড়ি, কেদারাছড়া, মাটিরাঙা উপজেলার আচালং, রামগড় উপজেলার বাগানবাজার, বড়বিল, রামগড় বাজার ইত্যাদি।
অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, দেশের পেক্ষাপটে এধরনের ভারী অস্ত্র উদ্ধার মোটেই সুখকর খবর নয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অজান্তে এরকম আরও কত ভারী অস্ত্র আছে সেটি এখন ভাবার বিষয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও হয়তো বিষয়টি চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে তারা এই বিষয়টি কিভাবে মোকাবেলা করবে। এছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের সাম্প্রতিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে আমরা দেখতে পারছি এখানে সামাজিক শৃঙ্খলা, পরস্পর যোগাযোগ ও সম্প্রিতি নষ্ট করে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। এটাকে আমরা জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসবাদ যেভাবেই আখ্যায়িত করি না কেন এসবের একটা সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় দায়িত্বরত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশ্লেষক। কারণ তাদের চোখ ফাঁকি দিয়েই এসব অস্ত্র দেশে আনা হয়। এছাড়া কিছু অসাধু কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে অস্ত্রের চালান আনতে সহযোগীতা করেন।
সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ বলেন, সন্ত্রাসীদের হাতে ভারী অস্ত্র থাকা মানে ভয়ঙ্কর বিষয়। কারণ তারা এটা ভাল কাজে ব্যবহার করবে না। হয় মানুষকে ভয় দেখিয়ে ফায়দা নিবে না হয় মেরে ফেলবে। আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো সুরক্ষিত না থাকার কারণে দেশে অস্ত্র সহজেই প্রবেশ করে। বলা হয় মাত্র ১০ শতাংশ অস্ত্রের চালান আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। বাকি অস্ত্রগুলো কোন না কোন ভাবে দেশে ঢুকে। তিনি বলেন, অস্ত্র আসবে, অস্ত্রের ব্যবহার হবে। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সেটি হচ্ছে মুল বিষয়।
সরবরাহ করছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদাররা। গত মাসে এ ধরনের দুটি অস্ত্র উদ্ধারের পর গোয়েন্দারা বেশ চিন্তিত। বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তারা মাঠে নেমেছেন। গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছেন অত্যাধুনিক এই অস্ত্র কারা সরবরাহ করছে, কেনইবা করছে। এর নেপথ্য কারা রয়েছেন। সীমান্তবর্তী এলাকায় বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। এছাড়া তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম ও গতিবিধির ওপর নজরদারি করা হচ্ছে।
জুলাই মাসে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার একটি টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকার খিলগাঁর সিপাহীবাগ এলাকার ফাইভ স্টার নিবাসের সামনে থেকে মোহাম্মদ ফয়সাল নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে। তার দেয়া তথ্যমতে ফাইভ স্টার নিবাসের আট তলায় অভিযান চালিয়ে জিয়াউল আবেদীন জুয়েল ও জাহেদ আল আবেদীন রুবেলকে গ্রেপ্তার করে। এসময় তাদের হেফাজত থেকে একে-২২ রাইফেল, চারটি বিদেশী পিস্তল ও ১টি রিভলবার উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা টিম জানতে পারে তারা খিলগাঁও এলাকার পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের অনুসারি। মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এক শীর্ষ নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্য তাদের এসব অস্ত্র জিসান সরবরাহ করেছে। যুবলীগের ওই নেতার সঙ্গে জিসানের দীর্ঘদিন ধরে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি নিয়ে ঝামেলা চলছিল। তাই বাধা সরাতে ওই নেতাকে হত্যার চক একেছিল জিসান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ গত ৩০ জুন ওয়ারীর ওয়ান্ডারল্যান্ডের সামনে থেকে একটি একে ২২ রাইফেল উদ্ধার করে। এ ঘটনায় বাবুল ও সাদেক নামের দুজনকে উদ্ধার করে সিটিটিসির এই টিম জানতে পারে তারা ওই রাইফেলের বাহক। শ্যামপুর এলাকা থেকেও সম্প্রতি গুলিসহ ছয়টি বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। ৩ মার্চ রাতে ঢাকার যাত্রাবাড়ির ধোলাইখাল এলাকা থেকে ১২ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাদের দেয়া তথ্য মতে রামপুরার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে হরকাতুল জিহাদের দুই সদস্য হাফিজ ওরফে খালিদ ওরফে ইব্রাহিম গাজী ও মামুনুর রশিদ ওরফে বাচ্চু মোল্যাকে গ্রেপ্তার করে। এসময় তাদের কাছে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১টি একে ২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে হুজির ওই সদস্যরা জানিয়েছে, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি আসামি উজ্বলের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কয়েকজন সদস্য মিলে ডাকাতি করছে। ডাকাতির লুন্ঠিত মালামাল থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ তারা সংগঠনের কাজে ব্যয় করে।
অস্ত্র নিয়ে কাজ করেন এমন গোয়েন্দারা বলছেন, সন্ত্রাসীদের হাতে একে ২২ রাইফেল রয়েছে বিষয়টিকে ছোট করে দেখার উপায় নাই। কারণ সন্ত্রাসীরা কোনো মিশনের টার্গেট নিয়েই এসব অস্ত্র মজুদ করে। ছোটখাটো অনেক অস্ত্র সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করে। বিভিন্ন মহলের কাছে এমন বিপুল পরিমান অস্ত্র রয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত ও বিশেষ অভিযানে এসব অস্ত্র ধরা পড়ে। কিন্তু একে-২২ রাইফেল থাকাটা চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। খিলগাঁও ও ওয়ারীর ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্য থেকে জানা গেছে দেশের বাইরে থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য কলকাঠি নাড়া হচ্ছে। তাই পেশি শক্তি জানান দেয়ার জন্য এসব অস্ত্র মজুদ রাখছে সন্ত্রাসীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এধরনের বিদেশী দামী অস্ত্র ছোটখাটো সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করে না। তারা এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহারও জানেনা আবার সরবরাহ করার সাহসও করে না। সম্প্রতি দুটি বিদেশী অস্ত্র উদ্ধারের পর পর্যালোচনা করে জানতে পেরেছি দেশের বাইরে থেকে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য কোনো সন্ত্রাসী মহল এমনটা করছে। তারা ধর্মীয় বড় উৎসব বা বিশেষ কোন দিনকে ঘিরে এমন পরিকল্পনা করে। যখন দেশে টাকার প্রবাহ বেশি থাকে বা আধিপত্যের বিস্তার, পেশি শক্তি প্রদর্শন ও টার্গেট কিলিং মিশনে এ ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করে।
গোয়েন্দা তথ্যমতে, বেশ কিছুদিন ধরে দেশের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলার মত বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনাও ঘটেনি। তাই এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে ইন্টারপোলের রেডএলার্টভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। এসব সন্ত্রাসীদের অনেকেই এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছে। কেউ কেউ কারাগারে বসে কলকাঠি নাড়ছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, টার্গেট কিলিং সবকিছু তারা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করছে। এসব সন্ত্রাসীরা আবার এলাকা ভিত্তিক রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে। এছাড়া পেশাদার স্মাগলার, মাদক ব্যবসায়ী, অবৈধ পণ্যের ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার জন্য অস্ত্র রাখে। অনেক সময় এসব অস্ত্র ভাড়ায় নিয়ে যায় পেশাদার সন্ত্রাসীরা। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে পেশি শক্তির ব্যবহার বেড়ে যায়। তখন বাজারে অস্ত্রের চাহিদা থাকে। এ সুযোগে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সবধরনের অস্ত্র আনে। পুলিশের কড়াকড়ি থাকলে অস্ত্রের দামও বেড়ে যায়। ভারত, মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে এসব অস্ত্র আনা হয়। তাই অস্ত্র ব্যবসায়ী ও সীমান্তে কড়া নজরদারি রাখতে হবে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করেন এমন গোয়েন্দারা সূত্র জানিয়েছেন, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবনের দুর্গমপাহাড়ি এলাকা থেকে প্রায়ই অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র আটক করা হয়। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এম কে-১১, এইচ কে-৩৩, জি-৩, একে-৪৭, একে-২২, এম-১৬ রাইফেল, নাইন এমএম পিস্তল। মানের দিক দিয়ে এসব অস্ত্র যেমন অত্যাধুনিক তেমনি ব্যয়বহুল। পাহাড়িদের হাত ঘুরে এসব অস্ত্র পৌঁছে যায় সন্ত্রাসীদের হাতে। এসব অস্ত্র যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে তাই এই তিন জেলায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এই তিন জেলার কিছু স্থানকে অস্ত্র আসার রুট হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে-বান্দরবানের থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকা, রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার চোট হরিণা, বড় হরিণা, বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক, জুরাছড়ির আন্দারমানিক, ফকিরাছড়ি, বিলাইছড়ি, খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার নারাইছড়ি, পানছড়ির দুদকছড়ি, কেদারাছড়া, মাটিরাঙা উপজেলার আচালং, রামগড় উপজেলার বাগানবাজার, বড়বিল, রামগড় বাজার ইত্যাদি।
অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, দেশের পেক্ষাপটে এধরনের ভারী অস্ত্র উদ্ধার মোটেই সুখকর খবর নয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অজান্তে এরকম আরও কত ভারী অস্ত্র আছে সেটি এখন ভাবার বিষয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও হয়তো বিষয়টি চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে তারা এই বিষয়টি কিভাবে মোকাবেলা করবে। এছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের সাম্প্রতিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে আমরা দেখতে পারছি এখানে সামাজিক শৃঙ্খলা, পরস্পর যোগাযোগ ও সম্প্রিতি নষ্ট করে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। এটাকে আমরা জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসবাদ যেভাবেই আখ্যায়িত করি না কেন এসবের একটা সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় দায়িত্বরত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশ্লেষক। কারণ তাদের চোখ ফাঁকি দিয়েই এসব অস্ত্র দেশে আনা হয়। এছাড়া কিছু অসাধু কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে অস্ত্রের চালান আনতে সহযোগীতা করেন।
সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ বলেন, সন্ত্রাসীদের হাতে ভারী অস্ত্র থাকা মানে ভয়ঙ্কর বিষয়। কারণ তারা এটা ভাল কাজে ব্যবহার করবে না। হয় মানুষকে ভয় দেখিয়ে ফায়দা নিবে না হয় মেরে ফেলবে। আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো সুরক্ষিত না থাকার কারণে দেশে অস্ত্র সহজেই প্রবেশ করে। বলা হয় মাত্র ১০ শতাংশ অস্ত্রের চালান আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। বাকি অস্ত্রগুলো কোন না কোন ভাবে দেশে ঢুকে। তিনি বলেন, অস্ত্র আসবে, অস্ত্রের ব্যবহার হবে। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সেটি হচ্ছে মুল বিষয়।
No comments