রহস্যে আবৃত সহাস্য জেনারেল এরশাদ
রাজনীতির
রহস্য পুরুষ এরশাদ। সারা জীবনই রহস্যময় থেকেছেন। কর্মজীবনে, প্রেমে,
বিবাহে, পরকীয়ায়, কবিতায় রহস্যময় থেকেছেন। রাজনীতিতেও রহস্যময় ছিলেন
আগাগোড়া। সেনা জীবনেও রহস্যময় থেকেছেন। মৃত্যুতে কিংবা মৃত্যুলগ্নে রহস্যময়
কম থাকেননি।
শুধু বাংলাদেশে নয়। সারা বিশ্বের স্বৈরশাসকদের জীবনী বিশ্লেষণ করলেও জেনারেল এরশাদ হবেন এক অপার বিস্ময়। কারণ তিনি প্রথা ভেঙেছেন।
সামরিক স্বৈরশাসকদের একটি অভিন্ন পরিণতির গল্প রয়েছে। আর সেই গল্পটি হলো স্বৈরশাসন দীর্ঘায়িত হতে পারে। কিন্তু স্বৈরশাসকের অপমানজনক প্রস্থান ঘটবে। এটা অনেকটাই নিয়তি নির্দিষ্ট। তারা যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিনই তাদের নাম মানুষ জানে, জপ করে। তার গুণগানে মুখর থাকে। স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম এবং জনসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের চক্ষুশূল থাকে। পতনের পরে তারা হারিয়ে যায়।
এরশাদের পতনের পর লেখা হতো পতিত স্বৈরশাসক। নিশ্চয় যথার্থ বিশেষণ। কিন্তু এরশাদ এমন একজন স্বৈরশাসক, যিনি সেই প্রথাগত ধ্যান-ধারণাকে অনেকটাই বদলে দিয়ে গেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন মানুষ বিচিত্র রূপে বেঁচে থাকতে পারে। জেনারেল এরশাদ শুধু ক্ষমতাই ভোগ করেন নি, তার ভোগের তালিকা দীর্ঘ। তিনি পরকীয়ায় মজেছেন। ক্ষমতায় থাকতে তার নৈতিক স্খলন কোনো অজানা বিষয় ছিল না। মরিয়মদের গল্প বিদেশি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ফেয়ার ফ্যাক্স তদন্ত রিপোর্টের কথা বহুকাল পশ্চিমা সমাজে আগ্রহের বিষয় হয়েছিল। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত কিংবা তাকে ছেঁটে ফেলার ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বলাবলি আছে, তিনি একজন পাকিস্তানপন্থি। তিনি রিপ্যাটরিয়েটদের তোষণ করে গেছেন। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল, একাত্তরে পাকিস্তানে বাঙালিদের বিচারে যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল তার চেয়ারম্যান ছিলেন। যদিও সেটা প্রমাণ করা যায়নি। অপ্রমাণিত থেকে গেছে। কিন্তু এই তথ্য খেয়েছে। বাংলাদেশ রাজনীতির দুই প্রধান ধারার উল্লেখযোগ্য নেতারা বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে যখন তারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দুই নেত্রী যৌথভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছেন। তাদের সেই আন্দোলন বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এরশাদের রহস্যময় কৌশল কাজ দিয়েছে। কখনো বলা হয়েছে যে তার অধীনে নির্বাচনে গেলে সেটা বেইমানি বলে গণ্য হবে। কিন্তু আবার তার অধীনেই নির্বাচনে গিয়ে সেটাকে ?‘গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার’ একটা বিরাট সাফল্য হিসেবে দাবি করা হয়েছে।
জেনারেল এরশাদ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কি বিচিত্র ও হেয়ালিভরা কৌশলে সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব, তিনি তার একটা ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত বা মডেল রেখে গেছেন। তার বিরুদ্ধে রাজনীতিকরা সরব হয়েছেন। সর্বতোভাবে বিরোধিতা করেছেন। আবার তার সঙ্গে যোগাযোগও রেখেছেন। তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কখনো ক্ষমতায় থাকতে করেছেন। আবার কখনো ক্ষমতার বাইরে এসে করেছেন। এভাবে তিনিই আমৃত্যু ছিলেন এক রহস্যময় কিংমেকার। সবাই তাকে নিন্দে, সবাই তাকে পিন্দে।
জেনারেল এরশাদ দীর্ঘ সময় দুর্নীতির দায়ে কারাগারে থেকেছেন। কিন্তু কারাগারে থেকেও তিনি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি। বরং স্বৈরশাসকের জীবনী তাকে সফল রাজনীতিকে পরিণত করেছে। সুতরাং রাজনীতিবিদ হতে হলে তাকে সবসময় রাজনীতির ময়দান থেকে আসতে হবে, সেটা সবসময় যে তা নয়, তিনিই সেটা দেখিয়েছেন। কি করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বঙ্গভবনে, সেখান থেকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েও ৫টি আসনে জয়লাভ করা সম্ভব, তার নজির এই কীর্তিমান ‘অঙপুরের ছাওয়াল’।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি বহু রহস্যময় প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন। মরিয়মদের সংখ্যা এক দুই নয়। রহস্য জাল কম বিস্তার করেননি জিনাত মোশাররফকে নিয়ে। বান্ধবীকে নিয়ে সংসদে একত্রে বসতে পারা, তাও ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পরে, সেটা আরেক মহা রহস্য জাল। তিনি কোথায় রহস্য জাল বিস্তার করেননি, তার তালিকা করলে সেটাই বরং হ্রস্ব হবে। তিনি মসজিদে গিয়ে তার পরদিন স্বপ্নের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছেন। তার স্ত্রীকে কেউ গর্ভবতী রূপে দেখেনি। কিন্তু সফল সন্তান প্রসবের খবর হজম করতে হয়েছে।
সাধারণ মানুষ না দেখলেও বিশ্বাস না করার কোনো উপায় ছিল না। এমন একজন মানুষ, যিনি তার সন্তান নিয়েও রহস্য করেছেন এবং সেই রহস্যময় সন্তানরা সমাজে তার পরিচয়ে বেড়ে উঠেছে। অথচ তিনি তার সন্তানদের বাবা নন-এ নিয়ে এমনই অবস্থা যে, ডিএনএ টেস্ট ব্যতীত কেউ তার সন্তান দাবিদারদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার ঝুঁকি নেবেন না।
বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের সমাজ রক্ষণশীল। ধর্মভীরু। নীতি-নৈতিকতায় আমজনতা সংবেদনশীল। কিন্তু সে কথা পাঁচটি বা একাধিক আসনে ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পরে ক্রমাগতভাবে নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড কি প্রমাণ করে? মানুষ যে তাকে খুব খারাপ হিসেবে দেখেনি, সেটা অপ্রিয়, অনেকেই মানতে চাইবেন না। কিন্তু সত্যকে কীভাবে অস্বীকার করা যাবে?
জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে তার কি ভূমিকা ছিল, সেটা অজানাই থেকে গেল। মঞ্জুর হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়ার শুনানি, এবং মামলা মুলতবি হওয়া এবং জেনারেল এরশাদের জাতীয় রাজনীতিতে তার ডিগবাজি, সবগুলোর তারিখ পরম্পরা মেলালে দেখা যাবে সেখানেও রহস্যের গন্ধ। সেই গন্ধ বাতাসে মিলিয়ে যায়নি।
প্রতিটি নির্বাচন তাকে রহস্য করার সুযোগ দিয়েছে। সবাই তার সঙ্গে রহস্য করেছেন। তাকে রহস্যে আবৃত করে থাকতেও সুযোগ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি রহস্য কম করেননি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তার বাসা থেকে রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধান ঘটেছিল। তাকে সিএমএইচে খুঁজে পাওয়া যায় আচমকা। এ নিয়ে অনেক গল্প। অনেক গুজবের ডালপালা বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু তিনি সক্ষম হয়েছেন নিজেকে রহস্যের ঘেরাটোপে বন্দি রাখতেই।
তিনি স্বাধীনভাবে নির্বাচনে যাবেন, ঘোষণা দিয়েছেন, সব ঠিকঠাক। কিন্তু তিনি উধাও হয়ে গেছেন। ঘনিষ্ঠদের তিনি সব সময় বলতেন, তিনি এককভাবে একটা নির্বাচন করতে চান। নানাভাবে চেষ্টাও করেছেন। তিনি একা দলকে নির্বাচনে নেবেন। দলের নেতাকর্মীদের তিনি বলেছেন যে তিনি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিলে নিজেই সরকার গঠন করতে সক্ষম। সেই সংকল্প তিনি ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার সুযোগ ছিল কিনা, সেটা তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। কেউ বলবেন তাকে প্রমাণ করতে দেয়া হয়নি। কিংবা তার হয়তো সে সামর্থ্য আদৌ ছিল না। এখানেও রহস্য থেকে গেল। বিএনপির সঙ্গে তিনি যেতে চেয়েছেন, যেতে চাননি। এটাও রহস্যেঘেরা।
বিএনপির সঙ্গে একবার মোর্চা করার একটা সুযোগ পেলে ষোলো কলা পূর্ণ হতো তার। সামরিক বাহিনীর সাদামাটা কর্মকর্তা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন।
জেনারেল জিয়াউর রহমান দ্বারা সেনাপ্রধান নির্বাচিত হয়ে তারই রেখে যাওয়া রাজনীতি দ্বারা বা তার বৃত্তে কখনও আক্রমণকারী, কখনও আক্রান্ত হন। বিএনপির জমানায় তিনি জেলে যান।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব থেকে স্পর্শকাতর বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদেরকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করা। এরশাদ এটা খালেদা জিয়ার বেশি করেছেন বা কম করেননি বলে অনেকে দাবি করতে পারেন।
এটা খুবই পরিষ্কার ফ্রিডম পার্টিকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেছেন তিনিই। বিশেষ করে তিনিই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হত্যাকারী সৈয়দ ফারুক রহমানকে নির্বাচনে টেনে এনে চূড়ান্ত রাজনৈতিক পুনর্বাসন প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু সেই তিনিই গত এক দশকের বেশির ভাগ সময় মন্ত্রীর পদমর্যাদায় জীবনযাপনে তার অসুবিধা হয়নি। সুযোগ বুঝে রহস্যময় পুরুষটি শুধু ভোল পাল্টে নিয়েছেন।
তিনিই ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। মনে করা হয়ে থাকে তিনি যদি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা না করতেন, তাহলে বাংলাদেশের অসামপ্রদায়িক রাজনীতি আরো অনেক বেশি এগিয়ে থাকতে পারতো। কিন্তু সেটা হয়নি।
জেনারেল এরশাদ যেসব পরিবর্তন করেছেন তার অনেকগুলোই কিন্তু স্থায়ী ছাপ লেগে গিয়েছে। পরবর্তীকালে তা রাজনীতি থেকে উঠে যেতে পারেনি। তার বড় প্রমাণ উপজেলা ব্যবস্থা। তার বড় প্রমাণ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ধরে রাখা। পররাষ্ট্রনীতিতেও তিনি চীনকে অন্তর্ভুক্ত করতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। ইতিহাস প্রমাণ করছে যে বাংলাদেশের রাজনীতি সেখানেই থমকে গিয়েছে।
কবি হিসেবে ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কবি ছিলেন না। নিজেকে তৈরি করেছেন। রাজকবিও হয়েছেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংসদে বিরোধী দল, জাতীয় পার্টি, স্ত্রী এবং ভাইকে নিয়ে নানা রহস্যময় ছলাকলা করে গেছেন। নিজের মন্ত্রীর পদমর্যাদা নিরঙ্কুশ রেখেছেন সুকৌশলে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির ইতিহাস লেখা যাবে না। রাজনীতিকরা তাকে টেনে নামিয়ে ছিলেন। সেই রাজনীতিকরা তাকে নিয়ে টানাটানি করেছে। সত্যি এরশাদের সবটাই বড় রহস্যময়। এরশাদ যেন, ‘বাই দ্য মিস্ট্রি, ফর দ্য মিস্ট্রি।’ তার হাত রক্তাক্ত। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে সদালাপী, সহাস্যই ছিলেন।
শুধু বাংলাদেশে নয়। সারা বিশ্বের স্বৈরশাসকদের জীবনী বিশ্লেষণ করলেও জেনারেল এরশাদ হবেন এক অপার বিস্ময়। কারণ তিনি প্রথা ভেঙেছেন।
সামরিক স্বৈরশাসকদের একটি অভিন্ন পরিণতির গল্প রয়েছে। আর সেই গল্পটি হলো স্বৈরশাসন দীর্ঘায়িত হতে পারে। কিন্তু স্বৈরশাসকের অপমানজনক প্রস্থান ঘটবে। এটা অনেকটাই নিয়তি নির্দিষ্ট। তারা যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিনই তাদের নাম মানুষ জানে, জপ করে। তার গুণগানে মুখর থাকে। স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম এবং জনসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের চক্ষুশূল থাকে। পতনের পরে তারা হারিয়ে যায়।
এরশাদের পতনের পর লেখা হতো পতিত স্বৈরশাসক। নিশ্চয় যথার্থ বিশেষণ। কিন্তু এরশাদ এমন একজন স্বৈরশাসক, যিনি সেই প্রথাগত ধ্যান-ধারণাকে অনেকটাই বদলে দিয়ে গেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন মানুষ বিচিত্র রূপে বেঁচে থাকতে পারে। জেনারেল এরশাদ শুধু ক্ষমতাই ভোগ করেন নি, তার ভোগের তালিকা দীর্ঘ। তিনি পরকীয়ায় মজেছেন। ক্ষমতায় থাকতে তার নৈতিক স্খলন কোনো অজানা বিষয় ছিল না। মরিয়মদের গল্প বিদেশি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ফেয়ার ফ্যাক্স তদন্ত রিপোর্টের কথা বহুকাল পশ্চিমা সমাজে আগ্রহের বিষয় হয়েছিল। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত কিংবা তাকে ছেঁটে ফেলার ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বলাবলি আছে, তিনি একজন পাকিস্তানপন্থি। তিনি রিপ্যাটরিয়েটদের তোষণ করে গেছেন। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল, একাত্তরে পাকিস্তানে বাঙালিদের বিচারে যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল তার চেয়ারম্যান ছিলেন। যদিও সেটা প্রমাণ করা যায়নি। অপ্রমাণিত থেকে গেছে। কিন্তু এই তথ্য খেয়েছে। বাংলাদেশ রাজনীতির দুই প্রধান ধারার উল্লেখযোগ্য নেতারা বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে যখন তারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দুই নেত্রী যৌথভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছেন। তাদের সেই আন্দোলন বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এরশাদের রহস্যময় কৌশল কাজ দিয়েছে। কখনো বলা হয়েছে যে তার অধীনে নির্বাচনে গেলে সেটা বেইমানি বলে গণ্য হবে। কিন্তু আবার তার অধীনেই নির্বাচনে গিয়ে সেটাকে ?‘গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার’ একটা বিরাট সাফল্য হিসেবে দাবি করা হয়েছে।
জেনারেল এরশাদ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কি বিচিত্র ও হেয়ালিভরা কৌশলে সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব, তিনি তার একটা ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত বা মডেল রেখে গেছেন। তার বিরুদ্ধে রাজনীতিকরা সরব হয়েছেন। সর্বতোভাবে বিরোধিতা করেছেন। আবার তার সঙ্গে যোগাযোগও রেখেছেন। তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কখনো ক্ষমতায় থাকতে করেছেন। আবার কখনো ক্ষমতার বাইরে এসে করেছেন। এভাবে তিনিই আমৃত্যু ছিলেন এক রহস্যময় কিংমেকার। সবাই তাকে নিন্দে, সবাই তাকে পিন্দে।
জেনারেল এরশাদ দীর্ঘ সময় দুর্নীতির দায়ে কারাগারে থেকেছেন। কিন্তু কারাগারে থেকেও তিনি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি। বরং স্বৈরশাসকের জীবনী তাকে সফল রাজনীতিকে পরিণত করেছে। সুতরাং রাজনীতিবিদ হতে হলে তাকে সবসময় রাজনীতির ময়দান থেকে আসতে হবে, সেটা সবসময় যে তা নয়, তিনিই সেটা দেখিয়েছেন। কি করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বঙ্গভবনে, সেখান থেকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েও ৫টি আসনে জয়লাভ করা সম্ভব, তার নজির এই কীর্তিমান ‘অঙপুরের ছাওয়াল’।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি বহু রহস্যময় প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন। মরিয়মদের সংখ্যা এক দুই নয়। রহস্য জাল কম বিস্তার করেননি জিনাত মোশাররফকে নিয়ে। বান্ধবীকে নিয়ে সংসদে একত্রে বসতে পারা, তাও ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পরে, সেটা আরেক মহা রহস্য জাল। তিনি কোথায় রহস্য জাল বিস্তার করেননি, তার তালিকা করলে সেটাই বরং হ্রস্ব হবে। তিনি মসজিদে গিয়ে তার পরদিন স্বপ্নের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছেন। তার স্ত্রীকে কেউ গর্ভবতী রূপে দেখেনি। কিন্তু সফল সন্তান প্রসবের খবর হজম করতে হয়েছে।
সাধারণ মানুষ না দেখলেও বিশ্বাস না করার কোনো উপায় ছিল না। এমন একজন মানুষ, যিনি তার সন্তান নিয়েও রহস্য করেছেন এবং সেই রহস্যময় সন্তানরা সমাজে তার পরিচয়ে বেড়ে উঠেছে। অথচ তিনি তার সন্তানদের বাবা নন-এ নিয়ে এমনই অবস্থা যে, ডিএনএ টেস্ট ব্যতীত কেউ তার সন্তান দাবিদারদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার ঝুঁকি নেবেন না।
বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের সমাজ রক্ষণশীল। ধর্মভীরু। নীতি-নৈতিকতায় আমজনতা সংবেদনশীল। কিন্তু সে কথা পাঁচটি বা একাধিক আসনে ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পরে ক্রমাগতভাবে নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড কি প্রমাণ করে? মানুষ যে তাকে খুব খারাপ হিসেবে দেখেনি, সেটা অপ্রিয়, অনেকেই মানতে চাইবেন না। কিন্তু সত্যকে কীভাবে অস্বীকার করা যাবে?
জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে তার কি ভূমিকা ছিল, সেটা অজানাই থেকে গেল। মঞ্জুর হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়ার শুনানি, এবং মামলা মুলতবি হওয়া এবং জেনারেল এরশাদের জাতীয় রাজনীতিতে তার ডিগবাজি, সবগুলোর তারিখ পরম্পরা মেলালে দেখা যাবে সেখানেও রহস্যের গন্ধ। সেই গন্ধ বাতাসে মিলিয়ে যায়নি।
প্রতিটি নির্বাচন তাকে রহস্য করার সুযোগ দিয়েছে। সবাই তার সঙ্গে রহস্য করেছেন। তাকে রহস্যে আবৃত করে থাকতেও সুযোগ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি রহস্য কম করেননি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তার বাসা থেকে রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধান ঘটেছিল। তাকে সিএমএইচে খুঁজে পাওয়া যায় আচমকা। এ নিয়ে অনেক গল্প। অনেক গুজবের ডালপালা বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু তিনি সক্ষম হয়েছেন নিজেকে রহস্যের ঘেরাটোপে বন্দি রাখতেই।
তিনি স্বাধীনভাবে নির্বাচনে যাবেন, ঘোষণা দিয়েছেন, সব ঠিকঠাক। কিন্তু তিনি উধাও হয়ে গেছেন। ঘনিষ্ঠদের তিনি সব সময় বলতেন, তিনি এককভাবে একটা নির্বাচন করতে চান। নানাভাবে চেষ্টাও করেছেন। তিনি একা দলকে নির্বাচনে নেবেন। দলের নেতাকর্মীদের তিনি বলেছেন যে তিনি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিলে নিজেই সরকার গঠন করতে সক্ষম। সেই সংকল্প তিনি ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার সুযোগ ছিল কিনা, সেটা তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। কেউ বলবেন তাকে প্রমাণ করতে দেয়া হয়নি। কিংবা তার হয়তো সে সামর্থ্য আদৌ ছিল না। এখানেও রহস্য থেকে গেল। বিএনপির সঙ্গে তিনি যেতে চেয়েছেন, যেতে চাননি। এটাও রহস্যেঘেরা।
বিএনপির সঙ্গে একবার মোর্চা করার একটা সুযোগ পেলে ষোলো কলা পূর্ণ হতো তার। সামরিক বাহিনীর সাদামাটা কর্মকর্তা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন।
জেনারেল জিয়াউর রহমান দ্বারা সেনাপ্রধান নির্বাচিত হয়ে তারই রেখে যাওয়া রাজনীতি দ্বারা বা তার বৃত্তে কখনও আক্রমণকারী, কখনও আক্রান্ত হন। বিএনপির জমানায় তিনি জেলে যান।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব থেকে স্পর্শকাতর বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদেরকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করা। এরশাদ এটা খালেদা জিয়ার বেশি করেছেন বা কম করেননি বলে অনেকে দাবি করতে পারেন।
এটা খুবই পরিষ্কার ফ্রিডম পার্টিকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেছেন তিনিই। বিশেষ করে তিনিই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হত্যাকারী সৈয়দ ফারুক রহমানকে নির্বাচনে টেনে এনে চূড়ান্ত রাজনৈতিক পুনর্বাসন প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু সেই তিনিই গত এক দশকের বেশির ভাগ সময় মন্ত্রীর পদমর্যাদায় জীবনযাপনে তার অসুবিধা হয়নি। সুযোগ বুঝে রহস্যময় পুরুষটি শুধু ভোল পাল্টে নিয়েছেন।
তিনিই ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। মনে করা হয়ে থাকে তিনি যদি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা না করতেন, তাহলে বাংলাদেশের অসামপ্রদায়িক রাজনীতি আরো অনেক বেশি এগিয়ে থাকতে পারতো। কিন্তু সেটা হয়নি।
জেনারেল এরশাদ যেসব পরিবর্তন করেছেন তার অনেকগুলোই কিন্তু স্থায়ী ছাপ লেগে গিয়েছে। পরবর্তীকালে তা রাজনীতি থেকে উঠে যেতে পারেনি। তার বড় প্রমাণ উপজেলা ব্যবস্থা। তার বড় প্রমাণ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ধরে রাখা। পররাষ্ট্রনীতিতেও তিনি চীনকে অন্তর্ভুক্ত করতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। ইতিহাস প্রমাণ করছে যে বাংলাদেশের রাজনীতি সেখানেই থমকে গিয়েছে।
কবি হিসেবে ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কবি ছিলেন না। নিজেকে তৈরি করেছেন। রাজকবিও হয়েছেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংসদে বিরোধী দল, জাতীয় পার্টি, স্ত্রী এবং ভাইকে নিয়ে নানা রহস্যময় ছলাকলা করে গেছেন। নিজের মন্ত্রীর পদমর্যাদা নিরঙ্কুশ রেখেছেন সুকৌশলে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির ইতিহাস লেখা যাবে না। রাজনীতিকরা তাকে টেনে নামিয়ে ছিলেন। সেই রাজনীতিকরা তাকে নিয়ে টানাটানি করেছে। সত্যি এরশাদের সবটাই বড় রহস্যময়। এরশাদ যেন, ‘বাই দ্য মিস্ট্রি, ফর দ্য মিস্ট্রি।’ তার হাত রক্তাক্ত। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে সদালাপী, সহাস্যই ছিলেন।
No comments