চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম রফতানি শূন্যের কোঠায়
বাংলাদেশসহ
ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের ব্যাপক চাহিদা
রয়েছে। কিন্তু রফতানি প্রক্রিয়ায় জটিলতা, জেলা কৃষি বিভাগের গাফিলতি ও
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই জেলার আমের রফতানি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে
বলে কৃষকদের অভিযোগ। ফলে গত কয়েক বছর ধরে এখানকার আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা
ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। আম রফতানির দৃশ্যমান ত্রুটিগুলো সমাধান
করলে এই অঞ্চলের আমকেন্দ্রিক অর্থনীতি সচল হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আম চাষিদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ‘কনট্রাক্ট ফার্মিং’এ (আম চাষিদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এক ধরনের চুক্তি) তারা আম উৎপাদন করেন। যে প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আইনি কোনও ভিত্তি নেই। এ প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ীরা নিজেদের সুবিধামতো চাষিদের সঙ্গে চুক্তি করেন। এখানে কৃষকদের কিছু করার থাকে না। কৃষি বিভাগও এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এছাড়া আম রফতানি সংশ্লিষ্ট কৃষি ও উদ্ভিদ সংঘ নিরোধ বিভাগের (কোয়ারেন্টাইন বিভাগ) উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনাও এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। বিষয়গুলো তদারকিতে সরকারি কোনও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসছে না। ফলে অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে বিদেশে আমের বাজার সৃষ্টির প্রক্রিয়া।
চাষিরা আরও অভিযোগ করেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কোনও বছরই আম রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় না। এ মৌসুমে কী পরিমাণ আম রফতানি করা হবে তা আম চাষি, রফতানিকারক, স্থানীয় কৃষি বিভাগ, আম গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় প্রশাসনের কেউই জানেন না। ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ পদ্ধতি রফতানির ক্ষেত্রে ভালো হলেও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। প্রতিবছর আম সংগ্রহ করার পরপরই সংযোগ চাষির সঙ্গে চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয় না। কোনও কোনও সময় রফতানি শুরুর কয়েক মাস আগে তাড়াহুড়া করে সাদা কাগজে নামমাত্র চুক্তি সম্পাদন করা হয়। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটিও উল্লেখ থাকে না। কোন জাতের আম, কখন নেওয়া হবে, কত টাকা কেজি হিসেবে নেবেন এবং কত টন আম নেবেন সেই বিষয়ে কিছু উল্লেখ থাকে না। যদিও সাদা কাগজে চুক্তির কোনও বৈধতা বা আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে চাষিরা তাদের নিজেদের খেয়ালখুশিমতো আম উৎপাদন করে থাকেন। বিগত কয়েক বছর এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোনও লাভ হয়নি।
চাষিরা জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অথবা নারায়ণগঞ্জের শ্যামপুরে আমের কোয়ারেন্টাইন পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। দেখা যায়, চাষি প্রথমে আমবাগান থেকে আম সংগ্রহ করেন এবং প্যাকিং করে রফতানির জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে আসেন। পরে সেখান থেকে রফতানিকারকরা আম বাছাই করে ক্রয় করে থাকেন এবং পুনরায় প্যাকিং করে নারায়ণগঞ্জের শ্যামপুরে যান। সেখানে পুনরায় খোলা হয় এবং কোয়ারেন্টাইন পরীক্ষা সম্পন্ন করে নির্ধারিত কার্টনে প্যাকিং করা হয়। এতে দেখা যায়, পরিবহনের সময় ঘর্ষণজনিত কারণে আমের গায়ে দাগ পড়ে এবং ৫০-৬০ ভাগ আম বাদ পড়ে যায়। ফলে বিগত বছরগুলোতে এক হাজার কেজি আম চাষির কাছ থেকে ক্রয় করলে পাঁচ-ছয়শ’ কেজি কোয়ারেন্টাইন পরীক্ষার সময় বাতিল হয়ে যায়। এ কারণে রফতানিকারকের চাহিদানুযায়ী এবং এয়ারস্পেস বুকিং মোতাবেক আম পাঠাতে পারেন না কৃষকরা। ফলে পরবর্তী সময়ে আম রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। এ করণে বিদেশে আম রফতানির যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ও নতুন বাজার তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
আমের কোয়ারেন্টাইন পরীক্ষার বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমের কোয়ারেন্টাইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো: যেমন—আমে কোনও রোগ বা পোকার আক্রমণ নেই, ব্যবহৃত কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ নেই যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, ঢাকায় বসে পরীক্ষণ ত্রুটিপূর্ণ বা সম্ভব নয়। বিশেষ করে মাছি ও পোকা আমের খোসার নিচে হুল ফুটিয়ে ডিম প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং পরে স্থানটি বন্ধ হয়ে যায়; যা আম পাকার পর কাটা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া যায় না। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের শ্যামপুরে বসে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ফলে রফতানি করা আমে নন-কমপ্লায়েন্স আসাটা স্বাভাবিক।’
জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথমবারের মতো ২০১৫ সালে শুরু হয় আম রফতানি প্রক্রিয়া। সেবার পরীক্ষামূলক বিদেশের বাজারে পাঠানো হয় দুই মেট্রিক টন। পরের বছর ২০১৬ সালে রফতানি করা হয় প্রায় ১০৪ মেট্রিক টন। ২০১৭ সালে তা আরও কমে যায়। ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ৩৩ মেট্রিক টনে। আর এ মৌসুমে কী পরিমাণ আম রফতানি হবে, তা আম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কেউ জানেন না।
সরেজমিনে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের একটি আমবাগানে কথা হয় কয়েকজন আম চাষির সঙ্গে। তাদের একজন শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে পাঁচ মেট্রিক টন আম বিদেশে রফতানি করেছি। তবে পরের বছর থেকে কৃষি বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও ব্যক্তি ইচ্ছার কারণে আম বিদেশে পাঠাতে পারিনি। উল্টো বাদ পড়েছি কন্ট্রাক্ট ফার্মিং থেকে।’ শহীদুলের মতো বিদেশে রফতানির লক্ষ্যে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় বিশেষ পরিচর্যায় আম উৎপাদন শুরু করেন আহসান হাবিব, জেনারুল ইসলাম ও কাইয়ুম আলীর মতো প্রায় ৫০ জন চাষি। কিন্তু স্থানীয় কৃষি বিভাগের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতায় তা ভেস্তে গেছে। এতে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েন এসব চাষি।
আম চাষি কাইয়ুম আলী অভিযোগ করেন, ‘আম রফতানিতে প্রয়োজন হয় স্থানীয় কৃষি বিভাগের সনদ বা প্রত্যয়নপত্র। এই সনদের কাছে জিম্মি রফতানিকারকরা। তারা কৃষি বিভাগের স্বার্থ রক্ষায় সিন্ডিকেট করে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে’ চাষিদের কাছ থেকে আম না কিনে, বাইরের খোলা বাজার থেকে নন-ব্যাগিং আম কিনে রফতানি করে। এতে সহায়তা করে কৃষি বিভাগ। অথচ এই আম রফতানিযোগ্য ছিল না। এতে আমরা যারা বিদেশে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন করেছিলাম, তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছি।
আরেক আম চাষি আহসান হাবিব বলেন, ‘কৃষি বিভাগের দুর্নীতি ও অদূরদর্শিতায় আম রফতানি না হলে, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সারাদেশের আম চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ অবস্থায় আমের নায্যমূল্য প্রাপ্তিতে আম রফতানিতে আমরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
চাষি রবিউল আওয়াল বলেন, ‘২০১৭ সালে বিদেশে রফতানির ২০ মেট্রিক টন আম উৎপাদন করি। কিন্তু মাত্র চার মেট্রিক টন বিদেশে রফতানি করতে পারি। ২০১৮ সালে একইভাবে ৩০ মেট্রিক টন আম উৎপাদন করে পাঠাই মাত্র দুই মেট্রিক টন। অথচ প্রতি মেট্রিক টন আম উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। বাকি আম স্থানীয় খোলা বাজারে বিক্রি করতে হয়েছে এবং বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হুদা জানান, আম রফতানিতে একাধিক পক্ষ থাকায় এবং তাদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষা করায় রফতানিটা সহজ হচ্ছে না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক চাহিদা ও নিয়মকানুনের দিকে লক্ষ রেখে উৎপাদনকারী ও রফতানিকারকদের বোঝাপড়া ভালো না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত আম রফতানি হচ্ছে না। তবে কৃষি বিভাগের এ বিষয়ে প্রচেষ্টার কোনও ঘাটতি নেই। আমরা আশা করছি, রফতানি বাড়বে এবং এটা বাড়াতে হবে।’ কৃষি বিভাগের অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনও কিছু প্রথম চালু হলে, সেটা অতটা গোছানো থাকে না। এর কারণে অনিয়ম হয়ে থাকলেও থাকতে পারে। আমি এ সময় এখানে ছিলাম না। তবে অনিয়মটা ধরা পড়ার পর আমরা শক্ত অবস্থান নিয়েছি।’
আম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আম রফতানি প্রক্রিয়ায় কোনও আম বিশেষজ্ঞ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা নেই; যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আম রফতানির পরিকল্পনা থেকে শুরু করে চাষি নির্বাচন, বাগান নির্বাচন, বাগান ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন পদ্ধতি, সংগ্রহ, প্যাকিংসহ সব ধাপে গবেষকদের সংশ্লিষ্টতা বা মতামত দরকার আছে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এ প্রক্রিয়ায় গবেষকদের কোনও সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়নি। বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলে আম রফতানির ক্ষেত্রে বিগত বছরের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তারা বলছেন,
আম রফতানি কোনও জটিল বিষয় নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো একসঙ্গে পরিকল্পনা করে রফতানি করলে সহজেই এক-দুই ভাগ আম রফতানি করা সম্ভব; যার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে।
আম চাষিদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ‘কনট্রাক্ট ফার্মিং’এ (আম চাষিদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এক ধরনের চুক্তি) তারা আম উৎপাদন করেন। যে প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আইনি কোনও ভিত্তি নেই। এ প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ীরা নিজেদের সুবিধামতো চাষিদের সঙ্গে চুক্তি করেন। এখানে কৃষকদের কিছু করার থাকে না। কৃষি বিভাগও এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এছাড়া আম রফতানি সংশ্লিষ্ট কৃষি ও উদ্ভিদ সংঘ নিরোধ বিভাগের (কোয়ারেন্টাইন বিভাগ) উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনাও এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। বিষয়গুলো তদারকিতে সরকারি কোনও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসছে না। ফলে অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে বিদেশে আমের বাজার সৃষ্টির প্রক্রিয়া।
চাষিরা আরও অভিযোগ করেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কোনও বছরই আম রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় না। এ মৌসুমে কী পরিমাণ আম রফতানি করা হবে তা আম চাষি, রফতানিকারক, স্থানীয় কৃষি বিভাগ, আম গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় প্রশাসনের কেউই জানেন না। ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ পদ্ধতি রফতানির ক্ষেত্রে ভালো হলেও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। প্রতিবছর আম সংগ্রহ করার পরপরই সংযোগ চাষির সঙ্গে চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয় না। কোনও কোনও সময় রফতানি শুরুর কয়েক মাস আগে তাড়াহুড়া করে সাদা কাগজে নামমাত্র চুক্তি সম্পাদন করা হয়। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটিও উল্লেখ থাকে না। কোন জাতের আম, কখন নেওয়া হবে, কত টাকা কেজি হিসেবে নেবেন এবং কত টন আম নেবেন সেই বিষয়ে কিছু উল্লেখ থাকে না। যদিও সাদা কাগজে চুক্তির কোনও বৈধতা বা আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে চাষিরা তাদের নিজেদের খেয়ালখুশিমতো আম উৎপাদন করে থাকেন। বিগত কয়েক বছর এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোনও লাভ হয়নি।
চাষিরা জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অথবা নারায়ণগঞ্জের শ্যামপুরে আমের কোয়ারেন্টাইন পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। দেখা যায়, চাষি প্রথমে আমবাগান থেকে আম সংগ্রহ করেন এবং প্যাকিং করে রফতানির জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে আসেন। পরে সেখান থেকে রফতানিকারকরা আম বাছাই করে ক্রয় করে থাকেন এবং পুনরায় প্যাকিং করে নারায়ণগঞ্জের শ্যামপুরে যান। সেখানে পুনরায় খোলা হয় এবং কোয়ারেন্টাইন পরীক্ষা সম্পন্ন করে নির্ধারিত কার্টনে প্যাকিং করা হয়। এতে দেখা যায়, পরিবহনের সময় ঘর্ষণজনিত কারণে আমের গায়ে দাগ পড়ে এবং ৫০-৬০ ভাগ আম বাদ পড়ে যায়। ফলে বিগত বছরগুলোতে এক হাজার কেজি আম চাষির কাছ থেকে ক্রয় করলে পাঁচ-ছয়শ’ কেজি কোয়ারেন্টাইন পরীক্ষার সময় বাতিল হয়ে যায়। এ কারণে রফতানিকারকের চাহিদানুযায়ী এবং এয়ারস্পেস বুকিং মোতাবেক আম পাঠাতে পারেন না কৃষকরা। ফলে পরবর্তী সময়ে আম রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। এ করণে বিদেশে আম রফতানির যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ও নতুন বাজার তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
আমের কোয়ারেন্টাইন পরীক্ষার বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমের কোয়ারেন্টাইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো: যেমন—আমে কোনও রোগ বা পোকার আক্রমণ নেই, ব্যবহৃত কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ নেই যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, ঢাকায় বসে পরীক্ষণ ত্রুটিপূর্ণ বা সম্ভব নয়। বিশেষ করে মাছি ও পোকা আমের খোসার নিচে হুল ফুটিয়ে ডিম প্রবেশ করিয়ে দেয় এবং পরে স্থানটি বন্ধ হয়ে যায়; যা আম পাকার পর কাটা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া যায় না। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের শ্যামপুরে বসে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ফলে রফতানি করা আমে নন-কমপ্লায়েন্স আসাটা স্বাভাবিক।’
জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথমবারের মতো ২০১৫ সালে শুরু হয় আম রফতানি প্রক্রিয়া। সেবার পরীক্ষামূলক বিদেশের বাজারে পাঠানো হয় দুই মেট্রিক টন। পরের বছর ২০১৬ সালে রফতানি করা হয় প্রায় ১০৪ মেট্রিক টন। ২০১৭ সালে তা আরও কমে যায়। ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ৩৩ মেট্রিক টনে। আর এ মৌসুমে কী পরিমাণ আম রফতানি হবে, তা আম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কেউ জানেন না।
সরেজমিনে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের একটি আমবাগানে কথা হয় কয়েকজন আম চাষির সঙ্গে। তাদের একজন শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে পাঁচ মেট্রিক টন আম বিদেশে রফতানি করেছি। তবে পরের বছর থেকে কৃষি বিভাগের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও ব্যক্তি ইচ্ছার কারণে আম বিদেশে পাঠাতে পারিনি। উল্টো বাদ পড়েছি কন্ট্রাক্ট ফার্মিং থেকে।’ শহীদুলের মতো বিদেশে রফতানির লক্ষ্যে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় বিশেষ পরিচর্যায় আম উৎপাদন শুরু করেন আহসান হাবিব, জেনারুল ইসলাম ও কাইয়ুম আলীর মতো প্রায় ৫০ জন চাষি। কিন্তু স্থানীয় কৃষি বিভাগের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতায় তা ভেস্তে গেছে। এতে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েন এসব চাষি।
আম চাষি কাইয়ুম আলী অভিযোগ করেন, ‘আম রফতানিতে প্রয়োজন হয় স্থানীয় কৃষি বিভাগের সনদ বা প্রত্যয়নপত্র। এই সনদের কাছে জিম্মি রফতানিকারকরা। তারা কৃষি বিভাগের স্বার্থ রক্ষায় সিন্ডিকেট করে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে’ চাষিদের কাছ থেকে আম না কিনে, বাইরের খোলা বাজার থেকে নন-ব্যাগিং আম কিনে রফতানি করে। এতে সহায়তা করে কৃষি বিভাগ। অথচ এই আম রফতানিযোগ্য ছিল না। এতে আমরা যারা বিদেশে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন করেছিলাম, তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছি।
আরেক আম চাষি আহসান হাবিব বলেন, ‘কৃষি বিভাগের দুর্নীতি ও অদূরদর্শিতায় আম রফতানি না হলে, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সারাদেশের আম চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ অবস্থায় আমের নায্যমূল্য প্রাপ্তিতে আম রফতানিতে আমরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
চাষি রবিউল আওয়াল বলেন, ‘২০১৭ সালে বিদেশে রফতানির ২০ মেট্রিক টন আম উৎপাদন করি। কিন্তু মাত্র চার মেট্রিক টন বিদেশে রফতানি করতে পারি। ২০১৮ সালে একইভাবে ৩০ মেট্রিক টন আম উৎপাদন করে পাঠাই মাত্র দুই মেট্রিক টন। অথচ প্রতি মেট্রিক টন আম উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। বাকি আম স্থানীয় খোলা বাজারে বিক্রি করতে হয়েছে এবং বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হুদা জানান, আম রফতানিতে একাধিক পক্ষ থাকায় এবং তাদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষা করায় রফতানিটা সহজ হচ্ছে না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক চাহিদা ও নিয়মকানুনের দিকে লক্ষ রেখে উৎপাদনকারী ও রফতানিকারকদের বোঝাপড়া ভালো না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত আম রফতানি হচ্ছে না। তবে কৃষি বিভাগের এ বিষয়ে প্রচেষ্টার কোনও ঘাটতি নেই। আমরা আশা করছি, রফতানি বাড়বে এবং এটা বাড়াতে হবে।’ কৃষি বিভাগের অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনও কিছু প্রথম চালু হলে, সেটা অতটা গোছানো থাকে না। এর কারণে অনিয়ম হয়ে থাকলেও থাকতে পারে। আমি এ সময় এখানে ছিলাম না। তবে অনিয়মটা ধরা পড়ার পর আমরা শক্ত অবস্থান নিয়েছি।’
আম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আম রফতানি প্রক্রিয়ায় কোনও আম বিশেষজ্ঞ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা নেই; যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আম রফতানির পরিকল্পনা থেকে শুরু করে চাষি নির্বাচন, বাগান নির্বাচন, বাগান ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন পদ্ধতি, সংগ্রহ, প্যাকিংসহ সব ধাপে গবেষকদের সংশ্লিষ্টতা বা মতামত দরকার আছে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এ প্রক্রিয়ায় গবেষকদের কোনও সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়নি। বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলে আম রফতানির ক্ষেত্রে বিগত বছরের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তারা বলছেন,
আম রফতানি কোনও জটিল বিষয় নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো একসঙ্গে পরিকল্পনা করে রফতানি করলে সহজেই এক-দুই ভাগ আম রফতানি করা সম্ভব; যার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি বাগানে ঝুলছে আম |
No comments