সরকারের ১০০ দিন উদ্যম উদ্যোগহীন -সিপিডি’র মূল্যায়ন
সরকারের
প্রথম ১০০ দিন উদ্যোগ, উদ্যম, উৎসাহ ও উচ্ছ্বাসহীন ছিল বলে মূল্যায়ন করেছে
সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। নতুন সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে গত ২৩ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার এক
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ
মন্তব্য করেন ড. দেবপ্রিয় বলেন, আশা ছিল ১০০ দিনে বড় ধরনের উত্থানের
প্রতিফলন দেখতে পাব। কিন্তু তা না হয়ে শুধু ধারাবাহিক উদ্যোগ দেখা গেছে। যা
মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে সরকারের কিছু ভালোর মধ্যে বিদেশি কর্মজীবীদের
বিষয়ে জরিপ চালিয়ে করের আওতায় আনার উদ্যোগ, মানি লন্ডারিং বিধিমালা জারি
করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপনকে করের আওতায় আনা। এছাড়া ভ্যাট আইন
বাস্তবায়ন হবে কিনা জানি না। তবে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক মনে হচ্ছে।
দেবপ্রিয় বলেন, সরকার যখন নতুনভাবে আসে, তখন গত সময়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে নতুন ধরনের উদ্যোগ নেয়।
সেই উদ্যোগটা তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। আমরা মনে করি সামপ্রতিক সময়ে যত নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনী (একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে) ইশতেহার সব থেকে সুচিন্তিত, সুলিখিত ও সুগঠিত।
নির্বাচনী ইশতেহার সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শাসক দলের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বাস্তবায়নের মধ্যে পার্থক্য আছে। শাসক দল বলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে তা দেখছি না। আমরা দেখছি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে, অন্যান্য সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে সেই দুর্নীতি প্রকটভাবে রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাব করা ৮.১৩ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিকে ঈর্ষণীয় বলছে সিপিডি। সিপিডির মতে, এই হিসাব বাস্তবসম্মত নয়। অর্থনীতির সূচকগুলোর সঙ্গে এর মিল নেই। জিডিপির হিসাব আরো গভীরে গিয়ে করা উচিত। তা না হলে নীতি নির্ধারণে সমস্যা হবে।
রাজধানীর সিরডাপ অডিটরিয়ামে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনা: বর্তমান সরকারের প্রথম একশো দিন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উপস্থিত ছিলেন। সিপিডির পর্যালোচনা উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি গণনার পদ্ধতির সমালোচনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখছি প্রবৃদ্ধি-নির্ভর অর্থনৈতিক আলোচনা। কেমন একটা প্রবৃদ্ধি আচ্ছন্নতা বা আকৃষ্টতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। অথচ অর্থনৈতিক তত্ত্বের সামপ্রতিককালের চিন্তা দেখলে দেখা যাবে, সকলেই বলবে প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যথেষ্ট নয়। এটা অর্থনীতি শাস্ত্রের দ্বৈতজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
জিডিপির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিপিডি বলেছে, উৎপাদন খাত নির্ভর প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিবিএসের হিসাব, চামড়া খাতে প্রথম প্রান্তিকে সাড়ে ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশ। কিন্তু চলতি মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ১২.৭ শতাংশ। আবার গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১২ শতাংশ। কিন্তু গতবার একই সময়ে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। সিপিডির মতে, বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের মানে হলো, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, সামপ্রতিককালে অর্থনৈতিক যে প্রবৃদ্ধি দেখি তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উঁচু, প্রশংসনীয় এবং অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। তবে যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে তাতে ব্যক্তিখাতের বাড়তি কোনো ভূমিকা আমরা দেখিনি। এই উন্নয়নের জন্য যে ধরনের কর আহরণ দরকার তা আমরা দেখলাম না। ব্যক্তিখাতে যে ধরনের ঋণপ্রবাহ বাড়ার কথা তা আমরা দেখলাম না। পুঁজিপণ্যের আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকখাতে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে ধরনের চাঞ্চল্য থাকে তা-ও দেখলাম না। প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে ধরনের চলক থাকে, সে চলকগুলোর প্রতিফল কিন্তু আমাদের কাছে ধরা পড়ছে না। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এমন কী প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনীর রূপান্তর ঘটল যে শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতা এমন বৈপ্লবিকভাবে বেড়ে গেল! এটা আমাদের এখন ভালো করে চিন্তা করে দেখতে হবে বলে মনে করেন সিপিডির এই ফেলো। তিনি বলেন, আমরা চাই প্রবৃদ্ধির অনুমিতি সঠিক হোক। সেটা থেকে যে ধরনের তাৎপর্য আসে সেটা যেন বাংলাদেশের নীতিকে সঠিকভাবে আগামী দিনে পরিচালিত করে। কোনো ধরনের অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে নীতিকে যেন বিভ্রান্ত না করে। এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা। এছাড়া এখন থেকে শুরু করে বাজেট প্রকাশ পর্যন্ত সরকারকে বাস্তবমুখী কিছু পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দেবপ্রিয় বলেন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হলো পরিবর্তন, দিন বদল। কিন্তু তা আটকে রাখছে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে থাকা সুবিধাভোগীরা। আওয়ামী লীগের দেয়া নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই নিতে হবে। তা না হলে এই ইশতেহার কাল্পনিক দলিল হিসেবে ইতিহাস বিচার করবে। তিনি বলেন, সরকারের গত ১০০ দিন আমরা একটি উৎসাহহীন, উদ্যোগহীন, উচ্ছ্বাসহীন এবং একই সঙ্গে উদ্যমহীন হিসেবে দেখেছি। অথচ আমরা আশা করে ছিলাম এটি একটি বড় ধরনের ১০০ দিনের উত্থানের ওপর দিয়ে প্রতিফলিত হবে। সেটা আমরা লক্ষ্য করিনি।
আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি গতানুগতিক ধারাবাহিকতা। নতুনভাবে সে রকম কিছু আমরা লক্ষ্য করিনি। বরং যে ধরনের উদ্যোগ আমরা দেখেছি, সে ধরনের উদ্যোগ মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছে। মিশ্র ইঙ্গিত কী দিচ্ছে? আমরা লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন কর ছাড় দেয়া হচ্ছে। আমরা দেখেছি সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এগুলোর ফলে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হবে- এটা আমরা মনে করি না। মনে হয় যেন কোথাও সরকারকে একটি প্রতীত গোষ্ঠী করায়ত্ব করে নীতিনির্ধারণ করছে।
দেবপ্রিয় বলেন, উন্নয়নের যে ধারণা তার সঙ্গে নীতি প্রণয়নের ধারণার অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের যে ধরনের ভূমিকা সেটা আমরা দেখতে পারছি না। বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্য যে ধরনের কাঠামোগত সংস্কারের দরকার ছিল, সেগুলোর কিছু হয়নি। এই ১০০ দিনে আমরা আশা করেছিলাম অসঙ্গতিগুলো দূর করা যাবে। আমরা সে ধরনের সচেতনতাও দেখিনি, সে ধরনের পদক্ষেপও দেখিনি।
খেলাপি ঋণ নিয়ে প্রতিবেদনে সিপিডি বলছে, খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া সুবিধার ফলে ঋণ খেলাপিরা ও দুর্বল ব্যাংক উৎসাহিত হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারল্য সংকট দেখা দেবে।
এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। আমরা অতীতে দেখেছি, বড় বড় উদ্যোক্তাদের অর্থ জোগানের ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থার একটা ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এখন আমরা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি ঋণ খেলাপি এটা একটা সমস্যা তা সবাই স্বীকার করছে। সরকারও স্বীকার করছে, যার ফলে আমরা দেখছি নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কীভাবে এটা (খেলাপি ঋণ) কমানো যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো সত্যিকার অর্থে ঋণ খেলাপি না কমিয়ে, সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে এটা কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যার ফলে আমরা গুড প্রাকটিস থেকে ব্যাড প্রাকটিসে চলে যাচ্ছি। সুবিধা দেয়ার ফলে ঋণ খেলাপিরা উৎসাহিত হবে। সেইসঙ্গে দূর্বল ব্যাংকও উৎসাহিত হবে। তার ফলে তারল্যের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।
তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য যখন ব্যাংকের কাছে অর্থ চাওয়া হবে, তখন ব্যাংক যদি অর্থ দিতে না পারে তাহলে আমাদের বিনিয়োগ এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে। ফাহমিদা বলেন, আমরা মনে করি খেলাপি ঋণের বিষয়ে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার ফলে আমরা উল্টো দিকে যাচ্ছি। এর ফলে ব্যাংকের প্রকৃত যে স্বাস্থ্য তা পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। এটা ভাসা ভাসা একটা সমাধান। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা একটি ব্যাংক কমিশনের কথা বলেছিলাম। আমরা সেটার জন্য কাজ করছি। সরকারের কাছে আমরা বার বার ব্যাংকিং কমিশনের কথা বলেছি। কিন্তু তারা এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখন আমরা শুধু ব্যাংকিং কমিশন নয়, নাগরিকদের নিয়েও কমিশনের চিন্তাভাবনা করছি।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেসব দেশে বৈষম্য কম, সেসব দেশে তুলনামূলকভাবে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা সহজ হয়। তাই বৈষম্য কমানোর দিকে নজর না দিলে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে পারে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান সরকারের ১০০ দিনে ব্যাংক খাতের কোনো উন্নয়ন আমরা দেখছি না। সরকারের পক্ষ থেকে ভালো ঋণ গ্রহীতাদের ছাড় দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কারা ভালো ঋণ গ্রহীতা সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা আসেনি। এটা নির্দিষ্ট করা উচিত।
পুঁজিবাজার নিয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শেয়ারবাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িত দুষ্টচক্রকে থামাতে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অনিয়মের বিরুদ্ধে যে ধরনের অর্থদণ্ড দেয়া হয় তাতে কারসাজি চক্র অনিয়ম করতে আরো উৎসাহিত হয়। কারণ আর্থিক দণ্ড তার জন্য খুব বেশি সমস্যার না। সুতরাং সুশাসনের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে পুঁজিবাজারকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি। তিনি বলন, সুশাসনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছাড় দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। বর্তমান সরকারের গত ১০০ দিনে শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়নে সুশাসন দেখা যায়নি। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক। তিনি বলেন, যে কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আনা হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে যে রিপোর্টি জমা দেয়া হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে অভিযোগ করা হচ্ছে। এমনকি বিএসইসির চেয়ারম্যানও রিপোর্টগুলো নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন।
দেবপ্রিয় বলেন, সরকার যখন নতুনভাবে আসে, তখন গত সময়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে নতুন ধরনের উদ্যোগ নেয়।
সেই উদ্যোগটা তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। আমরা মনে করি সামপ্রতিক সময়ে যত নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনী (একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে) ইশতেহার সব থেকে সুচিন্তিত, সুলিখিত ও সুগঠিত।
নির্বাচনী ইশতেহার সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শাসক দলের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বাস্তবায়নের মধ্যে পার্থক্য আছে। শাসক দল বলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে তা দেখছি না। আমরা দেখছি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে, অন্যান্য সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে সেই দুর্নীতি প্রকটভাবে রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাব করা ৮.১৩ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিকে ঈর্ষণীয় বলছে সিপিডি। সিপিডির মতে, এই হিসাব বাস্তবসম্মত নয়। অর্থনীতির সূচকগুলোর সঙ্গে এর মিল নেই। জিডিপির হিসাব আরো গভীরে গিয়ে করা উচিত। তা না হলে নীতি নির্ধারণে সমস্যা হবে।
রাজধানীর সিরডাপ অডিটরিয়ামে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনা: বর্তমান সরকারের প্রথম একশো দিন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উপস্থিত ছিলেন। সিপিডির পর্যালোচনা উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি গণনার পদ্ধতির সমালোচনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখছি প্রবৃদ্ধি-নির্ভর অর্থনৈতিক আলোচনা। কেমন একটা প্রবৃদ্ধি আচ্ছন্নতা বা আকৃষ্টতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। অথচ অর্থনৈতিক তত্ত্বের সামপ্রতিককালের চিন্তা দেখলে দেখা যাবে, সকলেই বলবে প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যথেষ্ট নয়। এটা অর্থনীতি শাস্ত্রের দ্বৈতজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
জিডিপির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিপিডি বলেছে, উৎপাদন খাত নির্ভর প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিবিএসের হিসাব, চামড়া খাতে প্রথম প্রান্তিকে সাড়ে ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশ। কিন্তু চলতি মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ১২.৭ শতাংশ। আবার গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১২ শতাংশ। কিন্তু গতবার একই সময়ে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। সিপিডির মতে, বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের মানে হলো, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, সামপ্রতিককালে অর্থনৈতিক যে প্রবৃদ্ধি দেখি তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উঁচু, প্রশংসনীয় এবং অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। তবে যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে তাতে ব্যক্তিখাতের বাড়তি কোনো ভূমিকা আমরা দেখিনি। এই উন্নয়নের জন্য যে ধরনের কর আহরণ দরকার তা আমরা দেখলাম না। ব্যক্তিখাতে যে ধরনের ঋণপ্রবাহ বাড়ার কথা তা আমরা দেখলাম না। পুঁজিপণ্যের আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকখাতে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে ধরনের চাঞ্চল্য থাকে তা-ও দেখলাম না। প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে ধরনের চলক থাকে, সে চলকগুলোর প্রতিফল কিন্তু আমাদের কাছে ধরা পড়ছে না। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এমন কী প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনীর রূপান্তর ঘটল যে শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতা এমন বৈপ্লবিকভাবে বেড়ে গেল! এটা আমাদের এখন ভালো করে চিন্তা করে দেখতে হবে বলে মনে করেন সিপিডির এই ফেলো। তিনি বলেন, আমরা চাই প্রবৃদ্ধির অনুমিতি সঠিক হোক। সেটা থেকে যে ধরনের তাৎপর্য আসে সেটা যেন বাংলাদেশের নীতিকে সঠিকভাবে আগামী দিনে পরিচালিত করে। কোনো ধরনের অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে নীতিকে যেন বিভ্রান্ত না করে। এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা। এছাড়া এখন থেকে শুরু করে বাজেট প্রকাশ পর্যন্ত সরকারকে বাস্তবমুখী কিছু পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দেবপ্রিয় বলেন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হলো পরিবর্তন, দিন বদল। কিন্তু তা আটকে রাখছে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে থাকা সুবিধাভোগীরা। আওয়ামী লীগের দেয়া নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই নিতে হবে। তা না হলে এই ইশতেহার কাল্পনিক দলিল হিসেবে ইতিহাস বিচার করবে। তিনি বলেন, সরকারের গত ১০০ দিন আমরা একটি উৎসাহহীন, উদ্যোগহীন, উচ্ছ্বাসহীন এবং একই সঙ্গে উদ্যমহীন হিসেবে দেখেছি। অথচ আমরা আশা করে ছিলাম এটি একটি বড় ধরনের ১০০ দিনের উত্থানের ওপর দিয়ে প্রতিফলিত হবে। সেটা আমরা লক্ষ্য করিনি।
আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি গতানুগতিক ধারাবাহিকতা। নতুনভাবে সে রকম কিছু আমরা লক্ষ্য করিনি। বরং যে ধরনের উদ্যোগ আমরা দেখেছি, সে ধরনের উদ্যোগ মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছে। মিশ্র ইঙ্গিত কী দিচ্ছে? আমরা লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন কর ছাড় দেয়া হচ্ছে। আমরা দেখেছি সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এগুলোর ফলে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হবে- এটা আমরা মনে করি না। মনে হয় যেন কোথাও সরকারকে একটি প্রতীত গোষ্ঠী করায়ত্ব করে নীতিনির্ধারণ করছে।
দেবপ্রিয় বলেন, উন্নয়নের যে ধারণা তার সঙ্গে নীতি প্রণয়নের ধারণার অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের যে ধরনের ভূমিকা সেটা আমরা দেখতে পারছি না। বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্য যে ধরনের কাঠামোগত সংস্কারের দরকার ছিল, সেগুলোর কিছু হয়নি। এই ১০০ দিনে আমরা আশা করেছিলাম অসঙ্গতিগুলো দূর করা যাবে। আমরা সে ধরনের সচেতনতাও দেখিনি, সে ধরনের পদক্ষেপও দেখিনি।
খেলাপি ঋণ নিয়ে প্রতিবেদনে সিপিডি বলছে, খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া সুবিধার ফলে ঋণ খেলাপিরা ও দুর্বল ব্যাংক উৎসাহিত হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারল্য সংকট দেখা দেবে।
এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। আমরা অতীতে দেখেছি, বড় বড় উদ্যোক্তাদের অর্থ জোগানের ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থার একটা ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এখন আমরা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি ঋণ খেলাপি এটা একটা সমস্যা তা সবাই স্বীকার করছে। সরকারও স্বীকার করছে, যার ফলে আমরা দেখছি নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কীভাবে এটা (খেলাপি ঋণ) কমানো যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো সত্যিকার অর্থে ঋণ খেলাপি না কমিয়ে, সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে এটা কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যার ফলে আমরা গুড প্রাকটিস থেকে ব্যাড প্রাকটিসে চলে যাচ্ছি। সুবিধা দেয়ার ফলে ঋণ খেলাপিরা উৎসাহিত হবে। সেইসঙ্গে দূর্বল ব্যাংকও উৎসাহিত হবে। তার ফলে তারল্যের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।
তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য যখন ব্যাংকের কাছে অর্থ চাওয়া হবে, তখন ব্যাংক যদি অর্থ দিতে না পারে তাহলে আমাদের বিনিয়োগ এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে। ফাহমিদা বলেন, আমরা মনে করি খেলাপি ঋণের বিষয়ে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার ফলে আমরা উল্টো দিকে যাচ্ছি। এর ফলে ব্যাংকের প্রকৃত যে স্বাস্থ্য তা পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। এটা ভাসা ভাসা একটা সমাধান। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা একটি ব্যাংক কমিশনের কথা বলেছিলাম। আমরা সেটার জন্য কাজ করছি। সরকারের কাছে আমরা বার বার ব্যাংকিং কমিশনের কথা বলেছি। কিন্তু তারা এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখন আমরা শুধু ব্যাংকিং কমিশন নয়, নাগরিকদের নিয়েও কমিশনের চিন্তাভাবনা করছি।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেসব দেশে বৈষম্য কম, সেসব দেশে তুলনামূলকভাবে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা সহজ হয়। তাই বৈষম্য কমানোর দিকে নজর না দিলে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে পারে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান সরকারের ১০০ দিনে ব্যাংক খাতের কোনো উন্নয়ন আমরা দেখছি না। সরকারের পক্ষ থেকে ভালো ঋণ গ্রহীতাদের ছাড় দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কারা ভালো ঋণ গ্রহীতা সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা আসেনি। এটা নির্দিষ্ট করা উচিত।
পুঁজিবাজার নিয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শেয়ারবাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িত দুষ্টচক্রকে থামাতে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অনিয়মের বিরুদ্ধে যে ধরনের অর্থদণ্ড দেয়া হয় তাতে কারসাজি চক্র অনিয়ম করতে আরো উৎসাহিত হয়। কারণ আর্থিক দণ্ড তার জন্য খুব বেশি সমস্যার না। সুতরাং সুশাসনের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে পুঁজিবাজারকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি। তিনি বলন, সুশাসনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছাড় দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। বর্তমান সরকারের গত ১০০ দিনে শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়নে সুশাসন দেখা যায়নি। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক। তিনি বলেন, যে কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আনা হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে যে রিপোর্টি জমা দেয়া হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে অভিযোগ করা হচ্ছে। এমনকি বিএসইসির চেয়ারম্যানও রিপোর্টগুলো নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন।
No comments