বিজেপির নির্বাচনি কৌশলে পরাস্ত ভারতের বিরোধীরা by আশীষ বিশ্বাস
এখন
পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কঠোর সমালোচকদের অন্যতম
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি এক সমাবেশে তিনি
অভিযোগ করেন, সাত ধাপের নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে ক্ষমতাসীন ভারতীয়
জনতা পার্টিকে (বিজেপি) সুবিধা দিতে। তৃতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগে
পর্যন্ত তার মতো অন্য বিরোধী দলগুলোর কারো মাথাতেই প্রচন্ড গরমের দিনের
দীর্ঘ এই তফসিল নিয়ে প্রশ্ন জাগেনি। আর এরইমধ্যে ৫৪৩ লোকসভা আসনের মধ্যে
৩০২টির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। বাকি আসনগুলোর জন্যও বিজেপি যে রাজনৈতিক
উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে বিরোধী দলগুলোর জন্যও খুব বেশি বিকল্প হাতে নেই।
ভারতের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে উত্তেজনাকর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তফসিলের মাঝামাঝি সময়ে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ক্ষমতাসীন বিজেপি তাদের বিরোধী দলগুলোকে কৌশল দিয়ে পরাস্ত করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিশাল বিজয় পেলেও ওই নির্বাচন থেকে ভিন্ন কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।
২০১৪ সালে তরুণ, মধ্যবিত্ত এবং অন্যান্য শ্রেণীপেশার সাধারণ মানুষের কাছে ভোট প্রার্থনা করেছিল দলটি। ভারত আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বিবেচ্য হতে শুরু করার মধ্য দিয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের রাজনৈতিক কৃতিত্বকে ছিনিয়ে নিয়েছে। গত পাঁচ বছরের সমস্যা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারত বিশ্বের এগারোতম অর্থনীতি থেকে ষষ্ঠ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।
তা সত্ত্বেও এবছর প্রার্থী নির্বাচন করতে গিয়ে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ জুটিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অর্থনীতির গতি নিম্নমুখী। প্রতিশ্রুত সংখ্যক চাকরির ব্যবস্থা করা যায়নি। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টিও থেকে গেছে অমীমাংসিত। হতাশ কৃষকরা বিক্ষোভ করছে। বেকার তরুণরা অশান্ত হয়ে উঠছে। শিল্প উৎপাদনের গতিও সীমিত। নোটের অবমূল্যায়ন বা নতুন জিএসটি নীতিও প্রত্যাশা মতো কাজ করছে না। তবে রেল, সড়ক, নদী এবং আকাশ অবকাঠামো উন্নয়নে আকর্ষণীয় কাজ হয়েছে। পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলেও সবার জন্য টয়লেট, গ্রামে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, দরিদ্রদের জন্য রান্নার গ্যাস সরবরাহ বা সামাজিকভাবে অবহেলিতদের জন্য ব্যাংক হিসাব খোলার মতো বিভিন্ন প্রকল্প আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নানাবিধ সুবিধা এনে দিয়েছে। জাতীয় কংগ্রেস থেকে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন বিরোধী দল এ ধরনের অর্জন চালু রাখার কথা বলেছে। এসব দলের নেতারা দাবি করেছেন, কয়েকটি রাজ্যে এই প্রকল্প সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়নি।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে পুনঃচিত্রায়িত করার ক্ষেত্রে বিজেপির রেকর্ড মিশ্র। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং ভুটানের একতরফা সমর্থনের মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতায় পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা ভারতের বড় ধরনের সাফল্য। কয়েক দিন আগে পর্যন্ত শ্রীনগর ও কাশ্মির উপত্যকার পরিস্থিতি উদ্বেগের কারণ ছিল। পাকিস্তান পাথর নিক্ষেপকারীদের সমর্থন দিচ্ছিলো আর উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো নিয়মিত বিরতিতে হামলা অব্যাহত রেখেছিল। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আত্মঘাতী বোমা হামলায় আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ সদস্য নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে।
তবে চাপের মুখে নুয়ে না পড়ার জন্য বিজেপির নীতি নির্ধারকরা অবশ্যই কৃতিত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। আক্রান্ত হলে পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে পারে এমন ব্ল্যাকমেইলিংয়ে তারা ভেঙে পড়েনি। এর পরিবর্তে পাকিস্তানকে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। দিল্লি এবং কলকাতাভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানের উত্তেজনা ঠেকানোর জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো প্রতিশোধ হলো ভারতের নতুন বিশ্লেষণ। এমনকি কারগিল অভিযানের সময়েও নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রমের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি ভারত।
মজার ব্যাপার হলো ওই সময়েও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী। ওই সময়ে বাজপেয়ী পাকিস্তান সমর্থিত সশস্ত্র গ্রুপকে নিস্ক্রিয় করতে পারলেও তারপরের নির্বাচনে জিতে আসতে পারেননি।
গত পাঁচ বছরে ভারত দুইবার আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করেছে। উরি এবং পুলওয়ামায় হামলার জেরে দুইবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে ভারত। প্রথমটি ছিল স্থল হামলা আর পরেরটি ছিল বিমান হামলা। এসব হামলায় কতজন নিহত হয়েছিল বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কেমন তা এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
প্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তান এ অভিযানের সফলতাকে অস্বীকার করেছে। আইএনসি ও টিএমসিসহ ভারতের বিরোধী দলগুলো পাকিস্তানের অবস্থানের পক্ষ নিয়ে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরেছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এ সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে ভারতের হামলার পর ৪১ দিন পর্যন্ত সাংবাদিক ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদেরকে হামলাস্থল পরিদর্শন করতে দেয়নি পাকিস্তানিরা।
কার্গিল যুদ্ধের দিনগুলোর পর থেকে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে, তা কি ভারতকে তার পারমাণবিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অনুপ্রাণিত করেছে? বিশ্লেষকরা বলেছেন, দিল্লির খুব বেশি কিছু করার ছিল না। এটি শুধু কাশ্মিরে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাস মোকাবিলার প্রশ্ন নয়। যখন মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার শুরু করেছে তখন কী ঘটতে যাচ্ছে সেটাও একটা প্রশ্ন। নতুন করে ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে কাবুল ও দিল্লি উদ্বিগ্ন। কাশ্মিরে যারা সীমিত আকারে হামলা ও উত্তেজনার সঙ্গে জড়িত তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনে চড়া মূল্য আদায় করে নিতে ভারত প্রস্তুত আছে এবং চ্যালেঞ্জ নিতে চায়-এ বার্তাটি যতটা সম্ভব স্পষ্ট করে পৌঁছে দিতে হবে।
এ বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য যে, গত পাঁচ বছরে ইসরায়েলের সঙ্গে অনেকবারই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ভারতের বিশদ আলোচনা হয়েছে। এক বিশ্লেষক বলেন, ‘প্রথমে স্থলভাগে চালানো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং পরবর্তীতে পুলওয়ামা হামলায় ভারতের পক্ষ থেকে যে জবাব দেওয়া হয়েছে তা মধ্যপ্রাচ্য ও অন্য জায়গায় ইসরায়েলের বিশেষায়িত সামরিক হামলারই পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয়েছে।’ ধারণাটি একইরকমের। তাহলো-সন্ত্রাসের মদতদাতাদেরকে এ কথা বোঝানো যে নিজস্ব ভূখণ্ড থেকে অভিযান পরিচালনাকারী অনিষ্টকর নন স্টেট অ্যাক্টরদেরকে দায়ী করে তারা সাজা থেকে বাঁচতে পারে না।
এ ধরনের হামলা চালিয়ে ‘কাশ্মির সমস্যা’র সমাধান করা যাবে কিনা সে বিতর্ক কেউ তুলছে না। তবে সত্যিকার অর্থে নির্বাচন যখন চলছে, তখন সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কাশ্মির উপত্যকায় পাথর ছোড়া কিংবা পাকিস্তান থেকে উস্কানিমূলক তৎপরতা চালাতে দেখা যায়নি বললেই চলে।
মমতা বন্দোপাধ্যায় ও অন্য নেতৃত্বের সমন্বয়ে গঠিত বিরোধী জোট অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজেপির ব্যর্থতাকে তুলে ধরে আক্রমণ করে যাচ্ছে বলে এ নিবন্ধে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের কিছু অংশে গো হত্যার মতো ইস্যুতে ডানপন্থী উগ্র হিন্দুদের প্রকোপ নিয়েও আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছে তারা। তবে একান্তে তারা যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা প্রকাশ করেছে, তাতে মনে হচ্ছে দীর্ঘ প্রচারণার মধ্যে মোদি তার পালে নতুন হাওয়া পেয়েছেন। আগের চেয়ে অনেক বেশি স্থির ও দৃঢ়চিত্ত নিয়ে হাজির হচ্ছেন তিনি। এমনকি যখন পশ্চিমবঙ্গে সমাবেশ করছেন তখনও। তিনি যেখানে যাচ্ছেন সব জায়গাতেই বিপুল মানুষের সমাগম হচ্ছে, যা তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৯ সালের নির্বাচনের সমস্যাগুলোর কথা বুঝতে পেরে মোদি তাকে ভালোভাবে প্রস্তুত করেছেন। যে ২০টি রাজ্যে তিনি প্রচারণা চালাচ্ছেন সেগুলোর প্রত্যেকটির সুনির্দিষ্ট সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন তিনি। বেশিরভাগ জাতীয় নেতাদের মতো নিজেকে সাধারণীকরণ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বিরোধী দলগুলোর কাজকে সহজ করে দেননি তিনি। উড়িষ্যা কিংবা ত্রিপুরা, তামিল নাড়ু কিংবা পশ্চিমবঙ্গ সব জায়গাতেই মোদি বিরোধীদের স্থানীয় দুর্নীতির মূল জায়গাকে সামনে এনেছেন।
কলকাতাভিত্তিক বিশ্লেষক চারুব্রত রায় বলেন, ‘আগে থেকে নিখুঁতভাবে সাজানো এ ধরনের নিবিড় কৌশলের মধ্য দিয়ে মোদি অনেক বিরোধী দলীয় নেতাকেই তাদের নিজ নিজ ঠেকিয়ে দিতে পারেন। মমতাকেই দেখুন না। তিনি গোটা ভারতে প্রচারণা চালানোর কথা বলেছিলেন। অথচ, পশ্চিম বঙ্গেই কঠোর লড়াই চালাচ্ছেন তিনি। রাহুল গান্ধীকে বাদ দিলে জাতীয় পর্যায়ের কোনও বিরোধী দলীয় নেতা নেই। আর ভাবমূর্তি, রাজনৈতিক প্রভাব ও অন্যান্য দিক দিয়ে মোদির চেয়ে পিছিয়ে আছেন রাহুল। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির চেয়ে এবং উড়িষ্যায় বিজেডি’র চেয়ে এখনও বেশি আসন পেতে পারে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে অন্য রাজ্যগুলোতে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে মোদি অনেক বেশি ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন যা উপেক্ষা করার নয়।’
নির্বাচন হিসেবে এখনও এটি অনেক কঠিন এক প্রতিযোগিতা। তবে এখনকার জন্য সুযোগ সুবিধাগুলো মোদির পক্ষেই রয়েছে।
ভারতের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে উত্তেজনাকর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তফসিলের মাঝামাঝি সময়ে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ক্ষমতাসীন বিজেপি তাদের বিরোধী দলগুলোকে কৌশল দিয়ে পরাস্ত করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিশাল বিজয় পেলেও ওই নির্বাচন থেকে ভিন্ন কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।
২০১৪ সালে তরুণ, মধ্যবিত্ত এবং অন্যান্য শ্রেণীপেশার সাধারণ মানুষের কাছে ভোট প্রার্থনা করেছিল দলটি। ভারত আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বিবেচ্য হতে শুরু করার মধ্য দিয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের রাজনৈতিক কৃতিত্বকে ছিনিয়ে নিয়েছে। গত পাঁচ বছরের সমস্যা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারত বিশ্বের এগারোতম অর্থনীতি থেকে ষষ্ঠ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।
তা সত্ত্বেও এবছর প্রার্থী নির্বাচন করতে গিয়ে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ জুটিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অর্থনীতির গতি নিম্নমুখী। প্রতিশ্রুত সংখ্যক চাকরির ব্যবস্থা করা যায়নি। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টিও থেকে গেছে অমীমাংসিত। হতাশ কৃষকরা বিক্ষোভ করছে। বেকার তরুণরা অশান্ত হয়ে উঠছে। শিল্প উৎপাদনের গতিও সীমিত। নোটের অবমূল্যায়ন বা নতুন জিএসটি নীতিও প্রত্যাশা মতো কাজ করছে না। তবে রেল, সড়ক, নদী এবং আকাশ অবকাঠামো উন্নয়নে আকর্ষণীয় কাজ হয়েছে। পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলেও সবার জন্য টয়লেট, গ্রামে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, দরিদ্রদের জন্য রান্নার গ্যাস সরবরাহ বা সামাজিকভাবে অবহেলিতদের জন্য ব্যাংক হিসাব খোলার মতো বিভিন্ন প্রকল্প আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নানাবিধ সুবিধা এনে দিয়েছে। জাতীয় কংগ্রেস থেকে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন বিরোধী দল এ ধরনের অর্জন চালু রাখার কথা বলেছে। এসব দলের নেতারা দাবি করেছেন, কয়েকটি রাজ্যে এই প্রকল্প সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়নি।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে পুনঃচিত্রায়িত করার ক্ষেত্রে বিজেপির রেকর্ড মিশ্র। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং ভুটানের একতরফা সমর্থনের মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতায় পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা ভারতের বড় ধরনের সাফল্য। কয়েক দিন আগে পর্যন্ত শ্রীনগর ও কাশ্মির উপত্যকার পরিস্থিতি উদ্বেগের কারণ ছিল। পাকিস্তান পাথর নিক্ষেপকারীদের সমর্থন দিচ্ছিলো আর উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো নিয়মিত বিরতিতে হামলা অব্যাহত রেখেছিল। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আত্মঘাতী বোমা হামলায় আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ সদস্য নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে।
তবে চাপের মুখে নুয়ে না পড়ার জন্য বিজেপির নীতি নির্ধারকরা অবশ্যই কৃতিত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। আক্রান্ত হলে পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে পারে এমন ব্ল্যাকমেইলিংয়ে তারা ভেঙে পড়েনি। এর পরিবর্তে পাকিস্তানকে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। দিল্লি এবং কলকাতাভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানের উত্তেজনা ঠেকানোর জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো প্রতিশোধ হলো ভারতের নতুন বিশ্লেষণ। এমনকি কারগিল অভিযানের সময়েও নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রমের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি ভারত।
মজার ব্যাপার হলো ওই সময়েও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী। ওই সময়ে বাজপেয়ী পাকিস্তান সমর্থিত সশস্ত্র গ্রুপকে নিস্ক্রিয় করতে পারলেও তারপরের নির্বাচনে জিতে আসতে পারেননি।
গত পাঁচ বছরে ভারত দুইবার আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করেছে। উরি এবং পুলওয়ামায় হামলার জেরে দুইবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে ভারত। প্রথমটি ছিল স্থল হামলা আর পরেরটি ছিল বিমান হামলা। এসব হামলায় কতজন নিহত হয়েছিল বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কেমন তা এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
প্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তান এ অভিযানের সফলতাকে অস্বীকার করেছে। আইএনসি ও টিএমসিসহ ভারতের বিরোধী দলগুলো পাকিস্তানের অবস্থানের পক্ষ নিয়ে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরেছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এ সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে ভারতের হামলার পর ৪১ দিন পর্যন্ত সাংবাদিক ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদেরকে হামলাস্থল পরিদর্শন করতে দেয়নি পাকিস্তানিরা।
কার্গিল যুদ্ধের দিনগুলোর পর থেকে এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে, তা কি ভারতকে তার পারমাণবিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অনুপ্রাণিত করেছে? বিশ্লেষকরা বলেছেন, দিল্লির খুব বেশি কিছু করার ছিল না। এটি শুধু কাশ্মিরে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাস মোকাবিলার প্রশ্ন নয়। যখন মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার শুরু করেছে তখন কী ঘটতে যাচ্ছে সেটাও একটা প্রশ্ন। নতুন করে ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে কাবুল ও দিল্লি উদ্বিগ্ন। কাশ্মিরে যারা সীমিত আকারে হামলা ও উত্তেজনার সঙ্গে জড়িত তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনে চড়া মূল্য আদায় করে নিতে ভারত প্রস্তুত আছে এবং চ্যালেঞ্জ নিতে চায়-এ বার্তাটি যতটা সম্ভব স্পষ্ট করে পৌঁছে দিতে হবে।
এ বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য যে, গত পাঁচ বছরে ইসরায়েলের সঙ্গে অনেকবারই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ভারতের বিশদ আলোচনা হয়েছে। এক বিশ্লেষক বলেন, ‘প্রথমে স্থলভাগে চালানো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং পরবর্তীতে পুলওয়ামা হামলায় ভারতের পক্ষ থেকে যে জবাব দেওয়া হয়েছে তা মধ্যপ্রাচ্য ও অন্য জায়গায় ইসরায়েলের বিশেষায়িত সামরিক হামলারই পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয়েছে।’ ধারণাটি একইরকমের। তাহলো-সন্ত্রাসের মদতদাতাদেরকে এ কথা বোঝানো যে নিজস্ব ভূখণ্ড থেকে অভিযান পরিচালনাকারী অনিষ্টকর নন স্টেট অ্যাক্টরদেরকে দায়ী করে তারা সাজা থেকে বাঁচতে পারে না।
এ ধরনের হামলা চালিয়ে ‘কাশ্মির সমস্যা’র সমাধান করা যাবে কিনা সে বিতর্ক কেউ তুলছে না। তবে সত্যিকার অর্থে নির্বাচন যখন চলছে, তখন সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কাশ্মির উপত্যকায় পাথর ছোড়া কিংবা পাকিস্তান থেকে উস্কানিমূলক তৎপরতা চালাতে দেখা যায়নি বললেই চলে।
মমতা বন্দোপাধ্যায় ও অন্য নেতৃত্বের সমন্বয়ে গঠিত বিরোধী জোট অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজেপির ব্যর্থতাকে তুলে ধরে আক্রমণ করে যাচ্ছে বলে এ নিবন্ধে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের কিছু অংশে গো হত্যার মতো ইস্যুতে ডানপন্থী উগ্র হিন্দুদের প্রকোপ নিয়েও আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছে তারা। তবে একান্তে তারা যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা প্রকাশ করেছে, তাতে মনে হচ্ছে দীর্ঘ প্রচারণার মধ্যে মোদি তার পালে নতুন হাওয়া পেয়েছেন। আগের চেয়ে অনেক বেশি স্থির ও দৃঢ়চিত্ত নিয়ে হাজির হচ্ছেন তিনি। এমনকি যখন পশ্চিমবঙ্গে সমাবেশ করছেন তখনও। তিনি যেখানে যাচ্ছেন সব জায়গাতেই বিপুল মানুষের সমাগম হচ্ছে, যা তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৯ সালের নির্বাচনের সমস্যাগুলোর কথা বুঝতে পেরে মোদি তাকে ভালোভাবে প্রস্তুত করেছেন। যে ২০টি রাজ্যে তিনি প্রচারণা চালাচ্ছেন সেগুলোর প্রত্যেকটির সুনির্দিষ্ট সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন তিনি। বেশিরভাগ জাতীয় নেতাদের মতো নিজেকে সাধারণীকরণ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বিরোধী দলগুলোর কাজকে সহজ করে দেননি তিনি। উড়িষ্যা কিংবা ত্রিপুরা, তামিল নাড়ু কিংবা পশ্চিমবঙ্গ সব জায়গাতেই মোদি বিরোধীদের স্থানীয় দুর্নীতির মূল জায়গাকে সামনে এনেছেন।
কলকাতাভিত্তিক বিশ্লেষক চারুব্রত রায় বলেন, ‘আগে থেকে নিখুঁতভাবে সাজানো এ ধরনের নিবিড় কৌশলের মধ্য দিয়ে মোদি অনেক বিরোধী দলীয় নেতাকেই তাদের নিজ নিজ ঠেকিয়ে দিতে পারেন। মমতাকেই দেখুন না। তিনি গোটা ভারতে প্রচারণা চালানোর কথা বলেছিলেন। অথচ, পশ্চিম বঙ্গেই কঠোর লড়াই চালাচ্ছেন তিনি। রাহুল গান্ধীকে বাদ দিলে জাতীয় পর্যায়ের কোনও বিরোধী দলীয় নেতা নেই। আর ভাবমূর্তি, রাজনৈতিক প্রভাব ও অন্যান্য দিক দিয়ে মোদির চেয়ে পিছিয়ে আছেন রাহুল। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির চেয়ে এবং উড়িষ্যায় বিজেডি’র চেয়ে এখনও বেশি আসন পেতে পারে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে অন্য রাজ্যগুলোতে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে মোদি অনেক বেশি ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন যা উপেক্ষা করার নয়।’
নির্বাচন হিসেবে এখনও এটি অনেক কঠিন এক প্রতিযোগিতা। তবে এখনকার জন্য সুযোগ সুবিধাগুলো মোদির পক্ষেই রয়েছে।
No comments