তারা স্বেচ্ছায় শপথ নিয়েছেন -গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির
কোনো বিষয়ে সরকারের চাপ নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বলেছেন, যারা শপথ নিয়েছেন তারা স্বেচ্ছায় শপথ নিয়েছেন। এ নিয়ে সরকারের কোনো
চাপ নেই। যারা তাদের নির্বাচিত করেছেন তারাই শপথ নেয়ার বিষয়ে তাদের চাপ
দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো দল ভাঙা আমার নীতি না। প্রস্তাব আমরা
অনেক পাই, কিন্তু ওসবের মধ্যে যাব না। যার যার দল, সে সেই দল করুক। বিএনপির
রাজনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা নিয়েও সরকারের কোনো চাপ বা চেষ্টা নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে সরকারের চাপ থাকার কারণ নেই।
কেননা প্যারোলে মুক্ত হবেন কি না সেটা নির্ভর করে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির আবেদনের ওপর। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো আবেদন আসেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বুঝতে হবে বিএনপির জন্ম কোথায়। বিএনপি স্বর্ণলতার মতো। দেখতে সুন্দর কিন্তু শেকড় নেই। নিজের দল সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ পোড় খাওয়া দল। এই দলের সুবিধাভোগী বা অনুপ্রবেশকারী আছে বলে মনে করি না। কিছু লোক আসবে যাবে, এটা রাজনীতিতে স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের যথেষ্ট লোকবল আছে। আমার নতুন লোকবলের দরকার নেই। আওয়ামী লীগ একাই একশো।
ব্রুনাই সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে গতকাল বিকেলে গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও এতে উপস্থিত ছিলেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ব্রুনাই সফরের বিভিন্ন চুক্তি, সমঝোতা ও সফরের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ঘণ্টাব্যাপী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়ার আমন্ত্রণে ২১ থেকে ২৩ এপ্রিল ব্রুনাই সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরে দুই দেশের মধ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং একটি বিনিময় নোট স্বাক্ষরিত হয়। ব্রুনাইতে এটাই ছিল প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপিকে রাজনীতিতে পুনরুজ্জীবিত করাটা কি আমি বুঝি না। বিএনপির কোনো ব্যাপারেই সরকার চাপ দিচ্ছে না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আদালত দুর্নীতির কারণে তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাও আওয়ামী লীগ সরকার করেনি। ১০ বছর আগে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তিনি বলেন, বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। তারা তাদের সিদ্ধান্তে দল পরিচালনা করে। এখানে সিদ্ধান্ত বিএনপির। সরকারের চাপ থাকবে কেন?
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ নিয়ে সব সময়ই উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। তবে তা নিয়ন্ত্রণে আছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। বৃহস্পতিবার রাতেও আমি আইনশৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছি। রাত আটটা থেকে ১১টা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তবে সবার আগে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ডের মতো জায়গায় সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে। সেখানে খ্রিষ্টানরা করেছে। শ্রীলঙ্কায় মুসলিমরা। এ জন্য আমি বলি জঙ্গিবাদের কোনো ধর্ম নেই। দেশ নেই। এদের বিরুদ্ধে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। কিন্তু তারপরও শঙ্কা আছে। এটা এখন আন্তর্জাতিক একটা বিষয় হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে জনমত সৃষ্টি ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি এই নৃশংস হামলার নিন্দা জানিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীকে শোকবার্তা পাঠাই।
এই কাপুরুষোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণ করছি। এ হামলায় আমার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম এমপি’র নাতি আট বছরের নিষ্পাপ শিশু জায়ান চৌধুরী নিহত হয়েছে। তিনি বলেন, জায়ানের বাবা মশিউল হক চৌধুরী গুরুতর আহত অবস্থায় এখনও শ্রীলঙ্কায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তিপূর্ণ একটা দেশ সেখানে পুলিশও ব্যবহার করা লাগে না। ওই রকম একটা দেশে যখন এ ধরনের জঙ্গিবাদী ঘটনা ঘটাতে পারে আর বাংলাদেশে তো সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ লেগেই আছে। শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরে যেভাবে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয় এবং ৩ নভেম্বর জেলখানায় হত্যা এগুলো তো সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের পর্যায়ে পড়ে। যখন থেকে মিলিটারি ডিক্টেটররা ছিল তখন থেকে অনবরত ক্যু হতো, মানুষ হত্যা হতো। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর কীভাবে মানুষের ওপর অত্যাচার হয়েছে? তারপর আসেন অগ্নিসন্ত্রাস। ২০১৩ সালের শেষের দিকে এবং ২০১৪ ও ২০১৫ সালে।
সব থেকে বড় কথা প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করা। যে গ্রেনেড ব্যবহার করা হয় যুদ্ধে, সে গ্রেনেড ব্যবহার করা হলো আমাদের একটা র্যালিতে। সেই র্যালিটিও ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, আমরা তো সেই সন্ত্রাসের শিকার। ১৫ আগস্ট সব হারালাম আমরা। তারপর শ্রীলঙ্কায় আমাদের পরিবারের একজন মারা গেল আমাদের আপনজন। প্রধানমন্ত্রী বলেন,অগ্নিসন্ত্রাস তো আরেকটা পথ দেখালো সেই ২০১৫ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আগুন দিয়ে দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা। নুসরাতকেও অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হতে হলো। তারই শিক্ষক তাকে আগুন দিয়ে পোড়ানোর ব্যবস্থা করলো।
ভারত, রাশিয়া, জাপান ও চীন চায় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হোক কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের জোরালো ভূমিকা নেই মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন,আমরা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে চেয়েছি। কিন্তু তারা যেতে চায় না। জোরও করতে পারি না। এর সঙ্গে বিদেশি সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও চায় না কক্সবাজার ছাড়তে। অথচ ভাসানচরে নেয়া গেলে রোহিঙ্গারা ভালো থাকতে পারত। তাদের জীবন এতটা অমানবিক হতো না।
তিনি বলেন, অনেক সংস্থা এদের ভাসানচরে পাঠাতে চায় না। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। আমার মনে হয়, সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি নিজেদের থাকা, খাওয়ার সুব্যবস্থা চান। সহজ যাতায়াত চান। এ কারণে তারা কক্সবাজার ছাড়তে চান না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাসানচরে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে সুন্দরভাবে রাখা যাবে। সুপেয় পানি, সেনিটেশনের ব্যবস্থা আছে। সাইক্লোন শেল্টার করে দিয়েছি। পর্যটনের ভালো ব্যবস্থা আছে। এদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেবো। এরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজেদের মধ্যেও সংঘাত করছে। বেকার থাকাটা খুব খারাপ দিক। খুব সহজে এদের জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এদের হায়ার করা যেতে পারে। ৪০ হাজারের বেশি বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এগুলোও আমাদের দেখতে হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম ‘অর্থনৈতিক দুরবস্থার’ মধ্যে পড়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান সাংবাদিকরা। এক সাংবাদিক বলেন, বিজ্ঞাপনের অভাবে টেলিভিশন শিল্প রুগ্ন শিল্পে পরিণত হচ্ছে। আরেক সাংবাদিক জানান, প্রিন্ট মিডিয়ার মরণ দশা হয়ে গেছে। সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা দেয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, এই খাত এখন রুগ্ন শিল্পের মতো ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিজ্ঞাপনের বাজারটা চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছিল দেশের আইন ভঙ্গ করে। এছাড়া নতুন নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে ফেইসবুক, ইউটিউব। এগুলোতে অনেক বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে। আর এতে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আর্থিক সংকটে রুগ্ন হয়ে পড়ছে। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন,আপনি বলছেন রুগ্ন শিল্প হচ্ছে।
কিন্তু দেখছি এখনও অনেকে নতুন চ্যানেল চাচ্ছে। কালকে আমার তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হল, আমি বললাম যত চাচ্ছে সবই দিয়ে দাও। আর কিছু না হোক কিছু লোকের তো চাকরি হবে। কর্মসংস্থান হবে। তিনি বলেন, কেবল অপারেটরদের চ্যানেল যত সামনে থাকবে তত আগে মানুষ দেখবে। কেবল অপারেটরদের খুশি করার সেটাও তো একটা বিষয় আছে। অনেকে তো আবার খুশি করে সামনেও নিয়ে আসে। ওই টেকনিক্যাল ব্যাপারও তো আছে। আছে অনেক কিছুই। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক সংবাদপত্র থাকার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দৈনিক পত্রিকা প্রায় ৭০০- এর ওপরে। মফস্বলে আমাদের প্রচুর পত্রিকা। এত পত্রিকা মনে হয় পৃথিবীর কোনও দেশে চলে না। কোনও দেশে নাই। সিঙ্গাপুরে একটি মাত্র কোম্পানি। তাদের পত্রিকা। সেটাও সরকার স্পন্সরড। তাদেরই বিভিন্ন ভাগাভাগি। ব্যবসা, খবর, বিনোদন, স্পোর্টস এ রকম ভাগাভাগি। অন্যান্য সব দেশেও। আমাদের প্রতিটি আশপাশের দেশে দেখেন। আমাদের মতো এত পত্রিকা কিন্তু কোনও দেশে নেই।
গণমাধ্যমের বিশেষ করে কাগুজে পত্রিকার খারাপ সময় নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন যুগের চাহিদা বা প্রযুক্তির চাহিদা হলো অনলাইন সংবাদপত্রের। বিশ্বের অনেক দেশে বড় বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো এখন কেবল অনলাইনে আছে। কাগুজে পত্রিকা বের করে না। ছাপা পত্রিকার সামনে প্রযুক্তি যে বাস্তবতা দাঁড় করিয়েছে সেটা সংশ্লিষ্টদের মানতেই হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কেবল বাংলাদেশে নয়, প্রযুক্তি সারাবিশ্বের মানুষের জন্য নানা সুযোগ সৃষ্টি করেছে, আধুনিকতার জায়গায় নিয়ে গেছে। সেজন্য এক ধরনের ধারাবাহিকতায় চলতে থাকলে হবে না। আধুনিকতা ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তিনি বলেন, সারাবিশ্বে অনেক নামিদামি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পত্রিকা কেবল অনলাইন চলে এসেছে। ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে তাদের, সোজা কথা অনলাইনে চলে এসেছে।
এখন কাগজের ব্যবহার হয় না। এটা প্রযুক্তির প্রভাব। প্রযুক্তি এবং আধুনিকাতর প্রভাবে এভাবে বিবর্তন আসতে থাকবে। তাই বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তিনি বলেন, আমরা সবকিছু ডিজিটালাইজড করে দিয়েছি, স্যাটেলাইটও হয়েছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও টিভি চালানো যায়। তিন মাসের জন্য বিনা পয়সায় (টিভি চ্যানেল) চালানোর প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। কিন্তু চ্যানেলগুলো সেভাবে নিচ্ছে না। অথচ বিদেশি জায়গায় অনেক টাকা দিচ্ছে। কিভাবে আমাদের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অল্প খরচে টেলিভিশন চালাতে পারে সেজন্য কথা চলছে। আর ভালো অনুষ্ঠান যারা করবে, মানুষ তাদের দেখবে। আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষ, সুতরাং গ্রাহক কখনো কমবে না। তিনি বলেন,ওয়েজ বোর্ডের ব্যাপারে সরকারের যা করণীয়, তা সরকার করেছে, বাকিটা মালিকপক্ষের, সেখান থেকে সাংবাদিকরা যা আদায় করে নিতে পারেন, সেটা তাদের ব্যাপার।
সরকারের এই মেয়াদের একশো দিন নিয়ে সিপিডির বক্তব্যের জেরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একশো দিনে উল্লাস নাই, উচ্ছ্বাস নাই, হেন নাই, তেন নাই অনেকে বলে। আসলে যারা সবসময় নিরানন্দে ভোগে তারা তো উচ্ছ্বাস-উল্লাস দেখবেই না। আর এখানে উচ্ছ্বাস-উল্লাসের কি আছে আমি বুঝলাম না? আমি ১০০দিন টার্গেট করে কিছু বলিনি। কিন্তু তারপরও প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগ এনেছি। গ্রাম বাংলায় একটা কথা আছে, গেল গেল আমার মুরগি গেল, আমি শিয়ালটা তো চিনে রাখলাম। যাই হোক, এটা আবার অন্যভাবে লিখেন না। গ্রাম্য প্রবাদ সেই হিসাবে বললাম। চিনি আমি সবাইকে। আমার অচেনা কেউ না। সব থেকে প্রবীণ কিন্তু এখানে আমি, এইটুকু মনে রাখেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন,আমরা একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আছি। এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশটাই যেন বজায় থাকে। তার জন্য আমার মনে হয় গণমাধ্যমেরও অনেক দায়িত্ব আছে। আপনারা সেই দায়িত্বটা যথাযথ পালন করবেন, সেটাই আমরা চাই।
দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে সেটা আপনারা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারেন, দেখতে পারেন। তবে মনে রাখবেন বাংলাদেশের দূর্ভাগ্য হলো, দেশ যখন খুব ভালো অবস্থায় যায়, তখনি কিন্তু আঘাতটা আসে। জাতির পিতাকে যখন হত্যা করা হলো, তখন কিন্তু তিনি যুদ্ধবিধস্ত দেশ গড়ে মাত্র তিন বছরের মধ্যে ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন। আর আমরা এখন আটের ঘরে পৌঁছে গেছি। এই বছরে ৮.১৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলে তো আর এটা নিতে পারবে না, ষড়যন্ত্র তখন হবে। আর রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রত্যেকটি দলের স্বকীয়তা আছে, স্বাধীনতা আছে সিদ্ধান্ত নেয়ার। দেশের জনগণের কল্যাণ করার জন্য আওয়ামী লীগই যথেষ্ট। আওয়ামী লীগই করবে। আর কেউ করে নাই, করবেও না।
এটাও আমার মনে হয় দেশবাসীর ভাবা উচিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত কিন্তু এ দেশের উন্নতি হয়নি। কোনো মানুষের উন্নতি হয়নি। আগে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি হতো প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে তো প্রতিনিয়ত গোলাগুলি আর বোমার আওয়াজ পাওয়া যেত। আমরা সেটাও বন্ধ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটার পরে কোনো ক্লাসই হতো না। এখন তো সন্ধ্যাতেও ক্লাশ হয়। আমরা পড়াশোনার ওপরে গুরুত্ব দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস করি। আমরা জঙ্গিবাদ পছন্দ করি না। বাংলাদেশের অন্য ধর্মের লোকেরা সবচেয়ে ভালো আছে। সব ধর্মের লোকেরা মিলেমিশে আমরা বসবাস করছি। খ্রিস্টানদের সম্পর্কে গণমাধ্যমে যা লেখা হয়েছে তা সঠিক নয়। তারা সবচেয়ে বেশি নিরাপদে আছে।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে কে আসবেন তা দল ঠিক করবে বলে জানান দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন,আমি একসময় অবসরে চলে যাবো। তখন দলে নতুন নেতৃত্ব আসবে। তবে কে নেতৃত্বে আসবেন তা ঠিক করবে দল। আওয়ামী লীগ ঠিক করবে দলের নেতৃত্ব দেবেন কে। সেটা আমি ঠিক করবো না। গঠনতন্ত্র আমাকে সে ক্ষমতা দেয়নি। আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,তৃণমূল থেকে দলকে সম্মেলনের মাধ্যমেই ঢেলে সাজাতে হবে। একেকটি সম্মেলন আয়োজন করতে অনেক খরচাপাতি আছে। আয়োজনের ব্যাপার আছে। সামনে সম্মেলন হবে। কখনও কেউ আসে, কেউ চলে যায়, রাজনীতিতে এটা হয়। দলকে ডিজিটাল করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,তৃণমূল থেকে শুরু করে দলের সবকিছু ডাটাবেজ করা হবে। আমি অবসর নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় চলে গেলেও সুইচ টিপে সব তথ্য পাবো। প্রধানমন্ত্রী বলেন,আমার ৭২ বছর বয়সের ৬০ বছরই কেটেছে রাজনীতিতে। স্কুল থেকে রাজনীতি শুরু করেছি এখনো অব্যাহত আছে।
রাজনীতিতে কে কী করেছে অনেক ঘটনা চোখে দেখেছি। আরেক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,বাইরে থেকে আওয়ামী লীগে এসে কারা সুবিধা লুটছে বা অনুপ্রবেশ ঘটেছে এর একটা তালিকা যদি আপনারা দিতে পারেন তাহলে ভালো হয়। আর মন্ত্রিসভায় যারা আছেন তারা যদি কেউ দুর্নীতি করে তাহলে তথ্য-প্রমাণসহ আমাকে দেবেন, আমি ব্যবস্থা নেব। ফাঁকা কথা বলে কোনো কাজ হবে না। একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। তিনি প্রশ্নকারী সাংবাদিককে উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের ছেলে- মেয়েদের কি ভালো থাকার অধিকার নেই?
প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন,আপনারা একটু চোখ মেলে দেখেন। ২০০৮ সালের আগে বাংলাদেশের কী অবস্থা ছিল। আর এখন কোন অবস্থায় আছে। সূচকগুলো দেখুন। গ্রামের মানুষ কেমন আছে। অবশ্য আমরা জিয়াউর রহমানের মতো এলিট শ্রেণি তৈরি করতে পারিনি। কারণ আওয়ামী লীগের নীতি সেটা না। আওয়ামী লীগ শহরের এবং গ্রামের উন্নয়ন সমানভাবে করে। একবার চিন্তা করে দেখুন কোন জায়গার বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গেছি। আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশ একটা সম্মানজনক অবস্থায় আছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে সরকারের চাপ থাকার কারণ নেই।
কেননা প্যারোলে মুক্ত হবেন কি না সেটা নির্ভর করে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির আবেদনের ওপর। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো আবেদন আসেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বুঝতে হবে বিএনপির জন্ম কোথায়। বিএনপি স্বর্ণলতার মতো। দেখতে সুন্দর কিন্তু শেকড় নেই। নিজের দল সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ পোড় খাওয়া দল। এই দলের সুবিধাভোগী বা অনুপ্রবেশকারী আছে বলে মনে করি না। কিছু লোক আসবে যাবে, এটা রাজনীতিতে স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের যথেষ্ট লোকবল আছে। আমার নতুন লোকবলের দরকার নেই। আওয়ামী লীগ একাই একশো।
ব্রুনাই সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে গতকাল বিকেলে গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও এতে উপস্থিত ছিলেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ব্রুনাই সফরের বিভিন্ন চুক্তি, সমঝোতা ও সফরের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ঘণ্টাব্যাপী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়ার আমন্ত্রণে ২১ থেকে ২৩ এপ্রিল ব্রুনাই সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরে দুই দেশের মধ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং একটি বিনিময় নোট স্বাক্ষরিত হয়। ব্রুনাইতে এটাই ছিল প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপিকে রাজনীতিতে পুনরুজ্জীবিত করাটা কি আমি বুঝি না। বিএনপির কোনো ব্যাপারেই সরকার চাপ দিচ্ছে না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আদালত দুর্নীতির কারণে তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাও আওয়ামী লীগ সরকার করেনি। ১০ বছর আগে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তিনি বলেন, বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। তারা তাদের সিদ্ধান্তে দল পরিচালনা করে। এখানে সিদ্ধান্ত বিএনপির। সরকারের চাপ থাকবে কেন?
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ নিয়ে সব সময়ই উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। তবে তা নিয়ন্ত্রণে আছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। বৃহস্পতিবার রাতেও আমি আইনশৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছি। রাত আটটা থেকে ১১টা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তবে সবার আগে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ডের মতো জায়গায় সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে। সেখানে খ্রিষ্টানরা করেছে। শ্রীলঙ্কায় মুসলিমরা। এ জন্য আমি বলি জঙ্গিবাদের কোনো ধর্ম নেই। দেশ নেই। এদের বিরুদ্ধে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। কিন্তু তারপরও শঙ্কা আছে। এটা এখন আন্তর্জাতিক একটা বিষয় হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে জনমত সৃষ্টি ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি এই নৃশংস হামলার নিন্দা জানিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীকে শোকবার্তা পাঠাই।
এই কাপুরুষোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণ করছি। এ হামলায় আমার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম এমপি’র নাতি আট বছরের নিষ্পাপ শিশু জায়ান চৌধুরী নিহত হয়েছে। তিনি বলেন, জায়ানের বাবা মশিউল হক চৌধুরী গুরুতর আহত অবস্থায় এখনও শ্রীলঙ্কায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তিপূর্ণ একটা দেশ সেখানে পুলিশও ব্যবহার করা লাগে না। ওই রকম একটা দেশে যখন এ ধরনের জঙ্গিবাদী ঘটনা ঘটাতে পারে আর বাংলাদেশে তো সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ লেগেই আছে। শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরে যেভাবে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয় এবং ৩ নভেম্বর জেলখানায় হত্যা এগুলো তো সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের পর্যায়ে পড়ে। যখন থেকে মিলিটারি ডিক্টেটররা ছিল তখন থেকে অনবরত ক্যু হতো, মানুষ হত্যা হতো। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর কীভাবে মানুষের ওপর অত্যাচার হয়েছে? তারপর আসেন অগ্নিসন্ত্রাস। ২০১৩ সালের শেষের দিকে এবং ২০১৪ ও ২০১৫ সালে।
সব থেকে বড় কথা প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করা। যে গ্রেনেড ব্যবহার করা হয় যুদ্ধে, সে গ্রেনেড ব্যবহার করা হলো আমাদের একটা র্যালিতে। সেই র্যালিটিও ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, আমরা তো সেই সন্ত্রাসের শিকার। ১৫ আগস্ট সব হারালাম আমরা। তারপর শ্রীলঙ্কায় আমাদের পরিবারের একজন মারা গেল আমাদের আপনজন। প্রধানমন্ত্রী বলেন,অগ্নিসন্ত্রাস তো আরেকটা পথ দেখালো সেই ২০১৫ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আগুন দিয়ে দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা। নুসরাতকেও অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হতে হলো। তারই শিক্ষক তাকে আগুন দিয়ে পোড়ানোর ব্যবস্থা করলো।
ভারত, রাশিয়া, জাপান ও চীন চায় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হোক কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের জোরালো ভূমিকা নেই মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন,আমরা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে চেয়েছি। কিন্তু তারা যেতে চায় না। জোরও করতে পারি না। এর সঙ্গে বিদেশি সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও চায় না কক্সবাজার ছাড়তে। অথচ ভাসানচরে নেয়া গেলে রোহিঙ্গারা ভালো থাকতে পারত। তাদের জীবন এতটা অমানবিক হতো না।
তিনি বলেন, অনেক সংস্থা এদের ভাসানচরে পাঠাতে চায় না। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। আমার মনে হয়, সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি নিজেদের থাকা, খাওয়ার সুব্যবস্থা চান। সহজ যাতায়াত চান। এ কারণে তারা কক্সবাজার ছাড়তে চান না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাসানচরে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে সুন্দরভাবে রাখা যাবে। সুপেয় পানি, সেনিটেশনের ব্যবস্থা আছে। সাইক্লোন শেল্টার করে দিয়েছি। পর্যটনের ভালো ব্যবস্থা আছে। এদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেবো। এরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজেদের মধ্যেও সংঘাত করছে। বেকার থাকাটা খুব খারাপ দিক। খুব সহজে এদের জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এদের হায়ার করা যেতে পারে। ৪০ হাজারের বেশি বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এগুলোও আমাদের দেখতে হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম ‘অর্থনৈতিক দুরবস্থার’ মধ্যে পড়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান সাংবাদিকরা। এক সাংবাদিক বলেন, বিজ্ঞাপনের অভাবে টেলিভিশন শিল্প রুগ্ন শিল্পে পরিণত হচ্ছে। আরেক সাংবাদিক জানান, প্রিন্ট মিডিয়ার মরণ দশা হয়ে গেছে। সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা দেয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, এই খাত এখন রুগ্ন শিল্পের মতো ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিজ্ঞাপনের বাজারটা চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছিল দেশের আইন ভঙ্গ করে। এছাড়া নতুন নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে ফেইসবুক, ইউটিউব। এগুলোতে অনেক বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে। আর এতে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আর্থিক সংকটে রুগ্ন হয়ে পড়ছে। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন,আপনি বলছেন রুগ্ন শিল্প হচ্ছে।
কিন্তু দেখছি এখনও অনেকে নতুন চ্যানেল চাচ্ছে। কালকে আমার তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হল, আমি বললাম যত চাচ্ছে সবই দিয়ে দাও। আর কিছু না হোক কিছু লোকের তো চাকরি হবে। কর্মসংস্থান হবে। তিনি বলেন, কেবল অপারেটরদের চ্যানেল যত সামনে থাকবে তত আগে মানুষ দেখবে। কেবল অপারেটরদের খুশি করার সেটাও তো একটা বিষয় আছে। অনেকে তো আবার খুশি করে সামনেও নিয়ে আসে। ওই টেকনিক্যাল ব্যাপারও তো আছে। আছে অনেক কিছুই। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক সংবাদপত্র থাকার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দৈনিক পত্রিকা প্রায় ৭০০- এর ওপরে। মফস্বলে আমাদের প্রচুর পত্রিকা। এত পত্রিকা মনে হয় পৃথিবীর কোনও দেশে চলে না। কোনও দেশে নাই। সিঙ্গাপুরে একটি মাত্র কোম্পানি। তাদের পত্রিকা। সেটাও সরকার স্পন্সরড। তাদেরই বিভিন্ন ভাগাভাগি। ব্যবসা, খবর, বিনোদন, স্পোর্টস এ রকম ভাগাভাগি। অন্যান্য সব দেশেও। আমাদের প্রতিটি আশপাশের দেশে দেখেন। আমাদের মতো এত পত্রিকা কিন্তু কোনও দেশে নেই।
গণমাধ্যমের বিশেষ করে কাগুজে পত্রিকার খারাপ সময় নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন যুগের চাহিদা বা প্রযুক্তির চাহিদা হলো অনলাইন সংবাদপত্রের। বিশ্বের অনেক দেশে বড় বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো এখন কেবল অনলাইনে আছে। কাগুজে পত্রিকা বের করে না। ছাপা পত্রিকার সামনে প্রযুক্তি যে বাস্তবতা দাঁড় করিয়েছে সেটা সংশ্লিষ্টদের মানতেই হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কেবল বাংলাদেশে নয়, প্রযুক্তি সারাবিশ্বের মানুষের জন্য নানা সুযোগ সৃষ্টি করেছে, আধুনিকতার জায়গায় নিয়ে গেছে। সেজন্য এক ধরনের ধারাবাহিকতায় চলতে থাকলে হবে না। আধুনিকতা ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তিনি বলেন, সারাবিশ্বে অনেক নামিদামি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পত্রিকা কেবল অনলাইন চলে এসেছে। ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে তাদের, সোজা কথা অনলাইনে চলে এসেছে।
এখন কাগজের ব্যবহার হয় না। এটা প্রযুক্তির প্রভাব। প্রযুক্তি এবং আধুনিকাতর প্রভাবে এভাবে বিবর্তন আসতে থাকবে। তাই বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তিনি বলেন, আমরা সবকিছু ডিজিটালাইজড করে দিয়েছি, স্যাটেলাইটও হয়েছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও টিভি চালানো যায়। তিন মাসের জন্য বিনা পয়সায় (টিভি চ্যানেল) চালানোর প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। কিন্তু চ্যানেলগুলো সেভাবে নিচ্ছে না। অথচ বিদেশি জায়গায় অনেক টাকা দিচ্ছে। কিভাবে আমাদের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অল্প খরচে টেলিভিশন চালাতে পারে সেজন্য কথা চলছে। আর ভালো অনুষ্ঠান যারা করবে, মানুষ তাদের দেখবে। আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষ, সুতরাং গ্রাহক কখনো কমবে না। তিনি বলেন,ওয়েজ বোর্ডের ব্যাপারে সরকারের যা করণীয়, তা সরকার করেছে, বাকিটা মালিকপক্ষের, সেখান থেকে সাংবাদিকরা যা আদায় করে নিতে পারেন, সেটা তাদের ব্যাপার।
সরকারের এই মেয়াদের একশো দিন নিয়ে সিপিডির বক্তব্যের জেরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একশো দিনে উল্লাস নাই, উচ্ছ্বাস নাই, হেন নাই, তেন নাই অনেকে বলে। আসলে যারা সবসময় নিরানন্দে ভোগে তারা তো উচ্ছ্বাস-উল্লাস দেখবেই না। আর এখানে উচ্ছ্বাস-উল্লাসের কি আছে আমি বুঝলাম না? আমি ১০০দিন টার্গেট করে কিছু বলিনি। কিন্তু তারপরও প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগ এনেছি। গ্রাম বাংলায় একটা কথা আছে, গেল গেল আমার মুরগি গেল, আমি শিয়ালটা তো চিনে রাখলাম। যাই হোক, এটা আবার অন্যভাবে লিখেন না। গ্রাম্য প্রবাদ সেই হিসাবে বললাম। চিনি আমি সবাইকে। আমার অচেনা কেউ না। সব থেকে প্রবীণ কিন্তু এখানে আমি, এইটুকু মনে রাখেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন,আমরা একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আছি। এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশটাই যেন বজায় থাকে। তার জন্য আমার মনে হয় গণমাধ্যমেরও অনেক দায়িত্ব আছে। আপনারা সেই দায়িত্বটা যথাযথ পালন করবেন, সেটাই আমরা চাই।
দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে সেটা আপনারা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারেন, দেখতে পারেন। তবে মনে রাখবেন বাংলাদেশের দূর্ভাগ্য হলো, দেশ যখন খুব ভালো অবস্থায় যায়, তখনি কিন্তু আঘাতটা আসে। জাতির পিতাকে যখন হত্যা করা হলো, তখন কিন্তু তিনি যুদ্ধবিধস্ত দেশ গড়ে মাত্র তিন বছরের মধ্যে ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন। আর আমরা এখন আটের ঘরে পৌঁছে গেছি। এই বছরে ৮.১৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলে তো আর এটা নিতে পারবে না, ষড়যন্ত্র তখন হবে। আর রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রত্যেকটি দলের স্বকীয়তা আছে, স্বাধীনতা আছে সিদ্ধান্ত নেয়ার। দেশের জনগণের কল্যাণ করার জন্য আওয়ামী লীগই যথেষ্ট। আওয়ামী লীগই করবে। আর কেউ করে নাই, করবেও না।
এটাও আমার মনে হয় দেশবাসীর ভাবা উচিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত কিন্তু এ দেশের উন্নতি হয়নি। কোনো মানুষের উন্নতি হয়নি। আগে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি হতো প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে তো প্রতিনিয়ত গোলাগুলি আর বোমার আওয়াজ পাওয়া যেত। আমরা সেটাও বন্ধ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটার পরে কোনো ক্লাসই হতো না। এখন তো সন্ধ্যাতেও ক্লাশ হয়। আমরা পড়াশোনার ওপরে গুরুত্ব দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস করি। আমরা জঙ্গিবাদ পছন্দ করি না। বাংলাদেশের অন্য ধর্মের লোকেরা সবচেয়ে ভালো আছে। সব ধর্মের লোকেরা মিলেমিশে আমরা বসবাস করছি। খ্রিস্টানদের সম্পর্কে গণমাধ্যমে যা লেখা হয়েছে তা সঠিক নয়। তারা সবচেয়ে বেশি নিরাপদে আছে।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে কে আসবেন তা দল ঠিক করবে বলে জানান দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন,আমি একসময় অবসরে চলে যাবো। তখন দলে নতুন নেতৃত্ব আসবে। তবে কে নেতৃত্বে আসবেন তা ঠিক করবে দল। আওয়ামী লীগ ঠিক করবে দলের নেতৃত্ব দেবেন কে। সেটা আমি ঠিক করবো না। গঠনতন্ত্র আমাকে সে ক্ষমতা দেয়নি। আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,তৃণমূল থেকে দলকে সম্মেলনের মাধ্যমেই ঢেলে সাজাতে হবে। একেকটি সম্মেলন আয়োজন করতে অনেক খরচাপাতি আছে। আয়োজনের ব্যাপার আছে। সামনে সম্মেলন হবে। কখনও কেউ আসে, কেউ চলে যায়, রাজনীতিতে এটা হয়। দলকে ডিজিটাল করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,তৃণমূল থেকে শুরু করে দলের সবকিছু ডাটাবেজ করা হবে। আমি অবসর নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় চলে গেলেও সুইচ টিপে সব তথ্য পাবো। প্রধানমন্ত্রী বলেন,আমার ৭২ বছর বয়সের ৬০ বছরই কেটেছে রাজনীতিতে। স্কুল থেকে রাজনীতি শুরু করেছি এখনো অব্যাহত আছে।
রাজনীতিতে কে কী করেছে অনেক ঘটনা চোখে দেখেছি। আরেক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,বাইরে থেকে আওয়ামী লীগে এসে কারা সুবিধা লুটছে বা অনুপ্রবেশ ঘটেছে এর একটা তালিকা যদি আপনারা দিতে পারেন তাহলে ভালো হয়। আর মন্ত্রিসভায় যারা আছেন তারা যদি কেউ দুর্নীতি করে তাহলে তথ্য-প্রমাণসহ আমাকে দেবেন, আমি ব্যবস্থা নেব। ফাঁকা কথা বলে কোনো কাজ হবে না। একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। তিনি প্রশ্নকারী সাংবাদিককে উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের ছেলে- মেয়েদের কি ভালো থাকার অধিকার নেই?
প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন,আপনারা একটু চোখ মেলে দেখেন। ২০০৮ সালের আগে বাংলাদেশের কী অবস্থা ছিল। আর এখন কোন অবস্থায় আছে। সূচকগুলো দেখুন। গ্রামের মানুষ কেমন আছে। অবশ্য আমরা জিয়াউর রহমানের মতো এলিট শ্রেণি তৈরি করতে পারিনি। কারণ আওয়ামী লীগের নীতি সেটা না। আওয়ামী লীগ শহরের এবং গ্রামের উন্নয়ন সমানভাবে করে। একবার চিন্তা করে দেখুন কোন জায়গার বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গেছি। আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশ একটা সম্মানজনক অবস্থায় আছে।
No comments