আপনারা বিদায় হোন -আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বাংলাদেশে
আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা ত্রাণকর্মীসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের
প্রতিনিধিদের মিয়ানমারে যেতে বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।
জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ তিন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে যৌথ বৈঠকের পর মন্ত্রী
সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘আমি তাদের বলেছি আপনাদের এখানে কাজ নাই,
মিয়ানমারে যান। আমি বেশ শক্তভাবে বলেছি। আপনারা ওখানে বেশি জোর দেন, এখানে
না। আমি জিজ্ঞাসা করেছি আপনারা কতবার মিয়ানমার গেছেন? সেখানে আপনাদের কত
লোক কাজ করে? এখানে তো হাজারেরও বেশি লোক কাজ করে, ওখানে বেশি কাজ করেন,
আপনারা এখান থেকে বিদায় হোন।’ মন্ত্রী কোন রকম রাখঢাক না করে একাধিকবার
বলেন, ‘আমি তাদের বলেছি আপনারা মিয়ানমার যান, এখানে আপনাদের কোন কাজ নেই।
এখানে আমরা ঠিক আছি। যা যা করার তা করছি, করতেছি।
আপনারা মিয়ানমারকে কনভিন্স করেন।
যাতে তারা তাদের লোক নিয়ে যায় এবং ওখানে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে কাজ করেন।’ বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে সফররত জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর প্রধান (হাইকমিশনার) ফিলিপো গ্রাান্ডি, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম মহাপরিচালক অ্যান্টনিও ভিটোরিনো এবং জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক লোকক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান। মন্ত্রীর দপ্তর সংলগ্ন অতিথি কক্ষে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ বৈঠক শেষে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন মন্ত্রী। ১৩ মিনিটের ওই ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। কোনো রকম যুদ্ধে জড়াতে চায় না।
সমস্যা মিয়ানমার তৈরি করেছে, সমাধান তাদেরই করতে হবে। তিনি বলেন, আপনি শক্ত অবস্থানের কথা বলছেন, আপনি কি যুদ্ধ করতে যাবেন? না, আমরা যুদ্ধ করবো না। আমাকে পাওয়ারফুলদের কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন, যদি আমরা চাই তাহলে তারা সেখানে কিছু একটা মহড়া করে দেখাবেন। এই ‘পাওয়ারফুল’ কে? ব্যক্তি না দেশ? জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, দেশ। ব্যক্তি না। আমরা খুব একটা পাত্তা দেইনি। তারা বলেছেন তোমরা চাইলে আমরা তোমাদের হয়ে ক্ষমতা দেখাতে পারি। আমরা বলেছি না। কারণ আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এ সমস্যার সমাধান চাই। এ সময় মন্ত্রী বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আমি আশাবাদী, মিয়ানমার এর আগে লোক নিয়ে গেছে। এবারও নেবে। তারা নেবে না এটা কখনও বলেনি। মিয়ানমারের মন্ত্রী এখানে এসেছেন, তিনি বলেছেন তারা তাদের লোক নিতে চান। আমরা তার কথায় বিশ্বাস রাখছি। তবে তাদের বলেছি, কয়েক জন নয়, লোক দেখানোর জন্য নয়। কয়েক লাখ নিলে আপত্তি নাই।
লোক মরলে দায় আপনাদের, বাংলাদেশের না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন সাফ জানিয়ে দিলেন, সরকার জোর করে কাউকে ভাষানচরে পাঠাবে না। তবে ভাষানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে না পারলে এবং আসন্ন বর্ষায় কক্সবাজারে ভূমিধসে কোনো সমস্যা হলে তার দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বহন করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, আবহাওয়া অফিস বলছে, এবার বেশি বৃষ্টিপাত হবে। এতে পাহাড়ধস হলে মানুষ মারা যাবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় কেউ মারা গেলে বাংলাদেশের কোনো দায় থাকবে না। যারা বাঁধা দিচ্ছে, তারাই এ মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন। এ সময় মন্ত্রী আরও বলেন, ভাষানচরে রোহিঙ্গারা গেলে অর্থনৈতিকভাবে কাজ করার সুবিধা পাবে।
মাছ ধরতে পারবে, গরু পালন করতে পারবে। ভাসানচরে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য বাড়িঘর, আশ্রয় কেন্দ্র এবং অন্যান্য সুবিধাদি তৈরি করেছে সরকার। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে যাওয়ায় সরকার প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গাকে আপাতত কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ভাষানচরে পূনর্বাসন করতে চায়। কিন্তু জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দুনিয়া, যারা রোহিঙ্গা সংকটের সূচনা থেকে বাংলাদেশের পাশে আছে, তাদের এতে এখনও সায় নেই। এ অবস্থায় আগামী বর্ষায় কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে পারে এবং সেখানে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন সরকার। সফররত জাতিসংঘের ৩ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, যারা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় এই মুহুর্তে ঢাকায় রয়েছে।
শুক্রবার তারা কক্সবাজার যাচ্ছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সরজমিনে দেখবেন। বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ কমানোর বিষয়ে তারা মন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করেছেন। সরকারের তরফেও এ নিয়ে ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগের দিনে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপিও দুর্ভোগ লাঘবে লাখো রোহিঙ্গাকে ভাষানচরে অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরে সরকারের আন্তরিক ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী গতকাল তার বৈঠকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের বলেছেন, রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে ঝামেলা তৈরি করছে। স্থানীয় জনগণ খুব আপসেট যে এরা দিনে দিনে ঝামেলার সৃষ্টি করছে। মন্ত্রী বলেন, আমরা তাদের বলেছি ওদের সংখ্যা এত যে তারা আমাদের বন-জঙ্গল সব উজাড় করে দিচ্ছে।
চাপ বাড়ানোর আহ্বান মন্ত্রীর: রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘের তিন সংস্থার প্রধানকে বলেন, এতবড় সংস্থার প্রধান আপনারা। আপনারা চাইলে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করতে পারেন। মন্ত্রী বলেন, আমার ধারণা জনমত তৈরি করতে পারলে সবচেয়ে বড় অত্যাচারী শাসকেরও পতন হয়।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরতা চালিয়েছে বর্মী বাহিনী তার বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সেখানে শান্তি পূণঃপ্রতিষ্ঠা বিশেষ করে সেখানে থাকা এবং ফিরতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের মাঝে আস্থা বাড়াতে বেসামরিক লোকজনকে দিয়ে সেফ জোন করার প্রস্তাব পূনরুল্লেখ করেন মন্ত্রী। বলেন, আমরা চাই সেখানে একটি জোন হোক। সেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেসামরিক লোকজন তত্ত্ববধান করবে। এতে মিয়ানমারও থাকবে। আসিয়ান দেশগুলোও থাকতে পারে। প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা বলেছি দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। আমরা তাদের এটাও বলেছি আপনাদের যে বন্ধুপ্রতিম দেশ যেমন- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মাধ্যমে তাদের ওপর চাপ বাড়ানো যায়।
মিয়ানমারের বেশিরভাগ ব্যবসা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে, জাপান সেখানে বিনিয়োগ করেই চলেছে, ব্যাংকিং চালায় সিঙ্গাপুর। আপনারা সেখানে চাপ দেন যাতে করে তারা মিয়ানমারকে চাপ দেয় তাদের লোককে ফেরত নেয়ার জন্য। মন্ত্রী বলেন, আমরা তাদের বলেছি রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধান জরুরি। তা না হলে সেখানে যে যুবকরা আছে তারা উগ্রবাদের পকেটে পরিণত হতে পারে। আর এখানে উগ্রবাদের পকেট হলে এটা গোটা অঞ্চলের জন্য খারাপ হবে। মন্ত্রী বলেন, উগ্রপন্থার ঝুঁকিতে পড়লে মিয়ানমারের দুঃখ আছে। সেখানে চীনের উদ্দেশ্যও সেটা সফল হবে না, অর্থনৈতিক কোনও কাজ হবে না। রাখাইনে বর্মী বর্বরতার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি সেখানে যেসব সহিংস গোষ্ঠির অস্তিত্ব রয়েছে মর্মে খবর প্রকাশিত হয় তাদের অস্ত্র ও রসদের যোগান কোত্থেকে আসে তা খুজে বের করার তাগিদও দেন মন্ত্রী। বলেন, আমি তাদের বলেছি, কারা সেখানে অস্ত্র সরবরাহ করছে? সেটি খুঁজে বের করুন। যদি তা করা যায় তাহলে দুনিয়া জানতে পারবে কে বা কারা তাদের মদদ দিচ্ছে? এ সময় মন্ত্রী গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে বলেন, বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে এবং বিভিন্ন তথ্য আমরা পাই।
কিন্তু মিডিয়াতে কখনো আসে না অস্ত্র কোন দেশের তৈরি, কোন কোম্পানির তৈরি বুলেটে বা শ্রাপনেলে লোকটা মারা গেছে! মন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি মিডিয়া যদি ওই অস্ত্র কোম্পানির নাম প্রকাশ করে তাহলে অস্ত্র সরবরাহকারী ধরা পড়বে, সন্ত্রাসও কমে যাবে।’ এ সময় রোহিঙ্গা শিশুদের স্কুলিংয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের তাগিদ অস্বীকার বা অগ্রাহ্য না করে মন্ত্রী বলেন, আমরা জানি ওখানে অনেক বাচ্চা আছে এবং তাদের স্কুলিং হওয়া উচিত। কিন্তু তাদের তো মিয়ানমার ভাষা শিখাতে হবে। তাদের মিয়ানমারের ইতিহাস জানা উচিত। আমাদের এখানে এ ধরনের কোনও ব্যবস্থা নাই। সুতরাং তাদের দ্রুত ফেরত যাওয়া উচিৎ। মিয়ানমারকে তা বুঝতে হবে এই শিশুরা তাদের দেশের ভবিষ্যত। এ সময় আইনস্টাইনও শরনার্থী ছিলেন উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ওই বাচ্ছাদের এবং তাদের পরিবারগুলোকে মিয়ানমারের ফেরত নিয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ‘গতি’ নিয়ে অসন্তোষ, হাল ছাড়ছে না বিশ্বসম্প্রদায়: এদিকে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল বৈঠকের পরই প্রথম গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন ঢাকা সফরকারী জাতিসংঘের ৩ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দপ্তরের বাইরে উপস্থিত গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপে তারা প্রায় অভিন্ন ভাষায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়ে চলেছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি কমে আসায় বিশেষ করে রাখাইনে কাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টি এখনও না হওয়ায় খানিক হতাশা প্রকাশ করেন তারা। তবে এ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিশ্ব সম্প্রদায়ের যোগাযোগ বাড়ানো এবং দেশটির ওপর ধারাবাহিকভাবে চাপ সৃষ্টির তাগিদও অনুভব করেন ওই তিন কর্মকর্তা। তারা জানান, তারা সফরের চেষ্টায় রয়েছে। একজন বলেন, শিগগির তিনি সফর করতে পারবেন বলে আশা করছেন। তবে ওই ৩ কর্মকর্তা যেটা বলার চেষ্টা করেন তা হল- সমস্যাটা পুরনো। প্রায় ৩ দশক ধরে রাখাইনে অস্থিরতা চলছে। রোহিঙ্গারা বঞ্চনার শিকার। তাদের নাগরিক অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। বর্বরতার মুখে ২০১৭ সালের আগষ্টের পর প্রায় ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। চুক্তি হয়েছে, সমাধানের আশ্বাসও মিলেছে। তবে মিয়ানমারের কূটকৌশলে এখন পর্যন্ত প্রাপ্তির খাতা কার্যত শূন্য। কিন্তু তাতেও সমাধান সূত্র খুজে পেতে বাংলাদেশের সঙ্গে থেকে অব্যাহত ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এর অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ সফরে এসেছেন জাতিসংঘের তিনটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিরা। সফরের আজ সমাপনী দিন।
এ দিনে কক্সবাজার যাচ্ছেন তারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে তারা তাদের বাংলাদেশ সফর এবং আগামী পরিকল্পনা শেয়ার করেছেন। সাক্ষাৎ শেষে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থার প্রধান মার্ক লোকোক বলেন, বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা সংগঠনের উচিত এ দেশকে সমর্থন এবং আরও ঘনিষ্ঠভাবে পাশে থাকা। আইওএম মহাপরিচালক এন্তোনিও ভিটোরিনো বলেন, আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যেমন দেখতে চাই, তেমনি ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগও কম দেখতে চাই। এ লক্ষ্যেই আমাদের সমস্ত প্রয়াস। ইউএনএইচসিআর প্রধান হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি বাস্তবায়নে গতি কম। এছাড়া রাখাইনে এখনও সেনাবাহিনীর অভিযান চলমান থাকায় জটিলতা কমছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
আপনারা মিয়ানমারকে কনভিন্স করেন।
যাতে তারা তাদের লোক নিয়ে যায় এবং ওখানে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে কাজ করেন।’ বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে সফররত জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর প্রধান (হাইকমিশনার) ফিলিপো গ্রাান্ডি, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম মহাপরিচালক অ্যান্টনিও ভিটোরিনো এবং জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক লোকক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান। মন্ত্রীর দপ্তর সংলগ্ন অতিথি কক্ষে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ বৈঠক শেষে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন মন্ত্রী। ১৩ মিনিটের ওই ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। কোনো রকম যুদ্ধে জড়াতে চায় না।
সমস্যা মিয়ানমার তৈরি করেছে, সমাধান তাদেরই করতে হবে। তিনি বলেন, আপনি শক্ত অবস্থানের কথা বলছেন, আপনি কি যুদ্ধ করতে যাবেন? না, আমরা যুদ্ধ করবো না। আমাকে পাওয়ারফুলদের কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন, যদি আমরা চাই তাহলে তারা সেখানে কিছু একটা মহড়া করে দেখাবেন। এই ‘পাওয়ারফুল’ কে? ব্যক্তি না দেশ? জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, দেশ। ব্যক্তি না। আমরা খুব একটা পাত্তা দেইনি। তারা বলেছেন তোমরা চাইলে আমরা তোমাদের হয়ে ক্ষমতা দেখাতে পারি। আমরা বলেছি না। কারণ আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এ সমস্যার সমাধান চাই। এ সময় মন্ত্রী বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আমি আশাবাদী, মিয়ানমার এর আগে লোক নিয়ে গেছে। এবারও নেবে। তারা নেবে না এটা কখনও বলেনি। মিয়ানমারের মন্ত্রী এখানে এসেছেন, তিনি বলেছেন তারা তাদের লোক নিতে চান। আমরা তার কথায় বিশ্বাস রাখছি। তবে তাদের বলেছি, কয়েক জন নয়, লোক দেখানোর জন্য নয়। কয়েক লাখ নিলে আপত্তি নাই।
লোক মরলে দায় আপনাদের, বাংলাদেশের না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন সাফ জানিয়ে দিলেন, সরকার জোর করে কাউকে ভাষানচরে পাঠাবে না। তবে ভাষানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে না পারলে এবং আসন্ন বর্ষায় কক্সবাজারে ভূমিধসে কোনো সমস্যা হলে তার দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বহন করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, আবহাওয়া অফিস বলছে, এবার বেশি বৃষ্টিপাত হবে। এতে পাহাড়ধস হলে মানুষ মারা যাবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় কেউ মারা গেলে বাংলাদেশের কোনো দায় থাকবে না। যারা বাঁধা দিচ্ছে, তারাই এ মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন। এ সময় মন্ত্রী আরও বলেন, ভাষানচরে রোহিঙ্গারা গেলে অর্থনৈতিকভাবে কাজ করার সুবিধা পাবে।
মাছ ধরতে পারবে, গরু পালন করতে পারবে। ভাসানচরে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য বাড়িঘর, আশ্রয় কেন্দ্র এবং অন্যান্য সুবিধাদি তৈরি করেছে সরকার। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে যাওয়ায় সরকার প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গাকে আপাতত কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ভাষানচরে পূনর্বাসন করতে চায়। কিন্তু জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দুনিয়া, যারা রোহিঙ্গা সংকটের সূচনা থেকে বাংলাদেশের পাশে আছে, তাদের এতে এখনও সায় নেই। এ অবস্থায় আগামী বর্ষায় কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে পারে এবং সেখানে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন সরকার। সফররত জাতিসংঘের ৩ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, যারা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় এই মুহুর্তে ঢাকায় রয়েছে।
শুক্রবার তারা কক্সবাজার যাচ্ছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সরজমিনে দেখবেন। বর্ষা মৌসুমে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ কমানোর বিষয়ে তারা মন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করেছেন। সরকারের তরফেও এ নিয়ে ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগের দিনে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপিও দুর্ভোগ লাঘবে লাখো রোহিঙ্গাকে ভাষানচরে অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরে সরকারের আন্তরিক ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী গতকাল তার বৈঠকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের বলেছেন, রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে ঝামেলা তৈরি করছে। স্থানীয় জনগণ খুব আপসেট যে এরা দিনে দিনে ঝামেলার সৃষ্টি করছে। মন্ত্রী বলেন, আমরা তাদের বলেছি ওদের সংখ্যা এত যে তারা আমাদের বন-জঙ্গল সব উজাড় করে দিচ্ছে।
চাপ বাড়ানোর আহ্বান মন্ত্রীর: রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘের তিন সংস্থার প্রধানকে বলেন, এতবড় সংস্থার প্রধান আপনারা। আপনারা চাইলে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করতে পারেন। মন্ত্রী বলেন, আমার ধারণা জনমত তৈরি করতে পারলে সবচেয়ে বড় অত্যাচারী শাসকেরও পতন হয়।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরতা চালিয়েছে বর্মী বাহিনী তার বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সেখানে শান্তি পূণঃপ্রতিষ্ঠা বিশেষ করে সেখানে থাকা এবং ফিরতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের মাঝে আস্থা বাড়াতে বেসামরিক লোকজনকে দিয়ে সেফ জোন করার প্রস্তাব পূনরুল্লেখ করেন মন্ত্রী। বলেন, আমরা চাই সেখানে একটি জোন হোক। সেটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেসামরিক লোকজন তত্ত্ববধান করবে। এতে মিয়ানমারও থাকবে। আসিয়ান দেশগুলোও থাকতে পারে। প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা বলেছি দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। আমরা তাদের এটাও বলেছি আপনাদের যে বন্ধুপ্রতিম দেশ যেমন- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মাধ্যমে তাদের ওপর চাপ বাড়ানো যায়।
মিয়ানমারের বেশিরভাগ ব্যবসা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে, জাপান সেখানে বিনিয়োগ করেই চলেছে, ব্যাংকিং চালায় সিঙ্গাপুর। আপনারা সেখানে চাপ দেন যাতে করে তারা মিয়ানমারকে চাপ দেয় তাদের লোককে ফেরত নেয়ার জন্য। মন্ত্রী বলেন, আমরা তাদের বলেছি রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধান জরুরি। তা না হলে সেখানে যে যুবকরা আছে তারা উগ্রবাদের পকেটে পরিণত হতে পারে। আর এখানে উগ্রবাদের পকেট হলে এটা গোটা অঞ্চলের জন্য খারাপ হবে। মন্ত্রী বলেন, উগ্রপন্থার ঝুঁকিতে পড়লে মিয়ানমারের দুঃখ আছে। সেখানে চীনের উদ্দেশ্যও সেটা সফল হবে না, অর্থনৈতিক কোনও কাজ হবে না। রাখাইনে বর্মী বর্বরতার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি সেখানে যেসব সহিংস গোষ্ঠির অস্তিত্ব রয়েছে মর্মে খবর প্রকাশিত হয় তাদের অস্ত্র ও রসদের যোগান কোত্থেকে আসে তা খুজে বের করার তাগিদও দেন মন্ত্রী। বলেন, আমি তাদের বলেছি, কারা সেখানে অস্ত্র সরবরাহ করছে? সেটি খুঁজে বের করুন। যদি তা করা যায় তাহলে দুনিয়া জানতে পারবে কে বা কারা তাদের মদদ দিচ্ছে? এ সময় মন্ত্রী গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে বলেন, বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে এবং বিভিন্ন তথ্য আমরা পাই।
কিন্তু মিডিয়াতে কখনো আসে না অস্ত্র কোন দেশের তৈরি, কোন কোম্পানির তৈরি বুলেটে বা শ্রাপনেলে লোকটা মারা গেছে! মন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি মিডিয়া যদি ওই অস্ত্র কোম্পানির নাম প্রকাশ করে তাহলে অস্ত্র সরবরাহকারী ধরা পড়বে, সন্ত্রাসও কমে যাবে।’ এ সময় রোহিঙ্গা শিশুদের স্কুলিংয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের তাগিদ অস্বীকার বা অগ্রাহ্য না করে মন্ত্রী বলেন, আমরা জানি ওখানে অনেক বাচ্চা আছে এবং তাদের স্কুলিং হওয়া উচিত। কিন্তু তাদের তো মিয়ানমার ভাষা শিখাতে হবে। তাদের মিয়ানমারের ইতিহাস জানা উচিত। আমাদের এখানে এ ধরনের কোনও ব্যবস্থা নাই। সুতরাং তাদের দ্রুত ফেরত যাওয়া উচিৎ। মিয়ানমারকে তা বুঝতে হবে এই শিশুরা তাদের দেশের ভবিষ্যত। এ সময় আইনস্টাইনও শরনার্থী ছিলেন উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ওই বাচ্ছাদের এবং তাদের পরিবারগুলোকে মিয়ানমারের ফেরত নিয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ‘গতি’ নিয়ে অসন্তোষ, হাল ছাড়ছে না বিশ্বসম্প্রদায়: এদিকে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল বৈঠকের পরই প্রথম গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন ঢাকা সফরকারী জাতিসংঘের ৩ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দপ্তরের বাইরে উপস্থিত গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপে তারা প্রায় অভিন্ন ভাষায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়ে চলেছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি কমে আসায় বিশেষ করে রাখাইনে কাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টি এখনও না হওয়ায় খানিক হতাশা প্রকাশ করেন তারা। তবে এ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিশ্ব সম্প্রদায়ের যোগাযোগ বাড়ানো এবং দেশটির ওপর ধারাবাহিকভাবে চাপ সৃষ্টির তাগিদও অনুভব করেন ওই তিন কর্মকর্তা। তারা জানান, তারা সফরের চেষ্টায় রয়েছে। একজন বলেন, শিগগির তিনি সফর করতে পারবেন বলে আশা করছেন। তবে ওই ৩ কর্মকর্তা যেটা বলার চেষ্টা করেন তা হল- সমস্যাটা পুরনো। প্রায় ৩ দশক ধরে রাখাইনে অস্থিরতা চলছে। রোহিঙ্গারা বঞ্চনার শিকার। তাদের নাগরিক অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। বর্বরতার মুখে ২০১৭ সালের আগষ্টের পর প্রায় ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। চুক্তি হয়েছে, সমাধানের আশ্বাসও মিলেছে। তবে মিয়ানমারের কূটকৌশলে এখন পর্যন্ত প্রাপ্তির খাতা কার্যত শূন্য। কিন্তু তাতেও সমাধান সূত্র খুজে পেতে বাংলাদেশের সঙ্গে থেকে অব্যাহত ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এর অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ সফরে এসেছেন জাতিসংঘের তিনটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিরা। সফরের আজ সমাপনী দিন।
এ দিনে কক্সবাজার যাচ্ছেন তারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে তারা তাদের বাংলাদেশ সফর এবং আগামী পরিকল্পনা শেয়ার করেছেন। সাক্ষাৎ শেষে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থার প্রধান মার্ক লোকোক বলেন, বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা সংগঠনের উচিত এ দেশকে সমর্থন এবং আরও ঘনিষ্ঠভাবে পাশে থাকা। আইওএম মহাপরিচালক এন্তোনিও ভিটোরিনো বলেন, আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যেমন দেখতে চাই, তেমনি ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগও কম দেখতে চাই। এ লক্ষ্যেই আমাদের সমস্ত প্রয়াস। ইউএনএইচসিআর প্রধান হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি বাস্তবায়নে গতি কম। এছাড়া রাখাইনে এখনও সেনাবাহিনীর অভিযান চলমান থাকায় জটিলতা কমছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
No comments