নির্বিচার গ্রেপ্তার, সেন্সরশিপ নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়নি -মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি
আইনবহির্ভূত
বা খেয়ালখুশিমতো হত্যাকাণ্ড ঘটে বাংলাদেশে। এখানে জোরপূর্বক গুম করা হয়।
করা হয় নির্যাতনও। সরকার বা সরকারের পক্ষে খেয়ালখুশিমতো বা বেআইনিভাবে
নাগরিকদের আটক রাখা হয়। জেলখানাতেও কঠোর বা জীবনের প্রতি হুমকি এমন পরিবেশ
বিরাজমান। আছেন রাজনৈতিক বন্দি। বাংলাদেশে খেয়ালখুশিমতো বা বেআইনিভাবে
মানুষের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা হয়। আরোপ করা হয় সেন্সরশিপ।
বন্ধ করে দেয়া হয় ওয়েবসাইট। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও জনসভা করার স্বাধীনতার অধিকারেও রয়েছে অযাচিত হস্তক্ষেপ। আছে বেসরকারি সংগঠন এনজিও বিষয়ক অতিমাত্রায় বিধিনিষেধমূলক কঠোর আইন। আছে তাদের কার্যক্রমে বিধিনিষেধ।
আন্দোলনের স্বাধীনতায় আছে উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণেও আছে বিধিনিষেধ, যেখানে নির্বাচনগুলো কোনোভাবেই খাঁটি, অবাধ ও সুষ্ঠু নয়। আছে দুর্নীতি। আছে মানবপাচার। সমকামী নারী, সমকামী পুরুষ, উভকামী, হিজড়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রয়েছে সহিংসতা। এখানে সমলিঙ্গে যৌনতা অপরাধ। নিরপেক্ষ ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকদের অধিকারে আছে বিধিনিষেধ। এ ছাড়া শিশু শ্রমের সবচেয়ে বাজে ফর্মটির ব্যবহার করা হয় বাংলাদেশে।
২০১৮ সালে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে এসব কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সারাবিশ্বের মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৮ প্রকাশ করেন বুধবার। সেখানে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারটি ৫০ পৃষ্ঠার। এতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার ও সহিংসতার কথা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, এসব কারণে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের প্রচারণা কঠিন হয়ে উঠেছিল। তাদের সমর্থকরা সভা করতে পারেন নি, কোনো র্যালি করতে পারেন নি। অবাধে প্রচারণা চালাতে পারেন নি। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা নানা অনিয়মের পরও ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি পেয়েছেন বলে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
নির্বাচন ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: ২০১৮ সালের শেষে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ওই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। এতে বাছবিচারহীনভাবে ব্যালট বাক্স ভর্তি, বিরোধীদলীয় নির্বাচনী এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ ও নির্বাচনী মিত্র দলগুলো ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয় পেয়েছে। যেখানে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো পেয়েছে মাত্র সাতটি আসন। এর আগে, নির্বাচনী প্রচারণার সময় হয়রানি, ভীতিপ্রদর্শন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট রয়েছে। এতে বিরোধী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের জন্য সভা-সমাবেশ ও নির্বাচনী প্রচারণা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। বেসরকারি সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুসারে, নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে বিএনপি ও অন্য বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ১২৩৪টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ২১১টি।
বাংলাদেশের সরকার সঠিক সময়ে আনফ্রেলের পর্যবেক্ষকদের পরিচয়পত্র ও ভিসা প্রদান করেনি। এ বিষয়ে আনফ্রেল গত ২৩শে ডিসেম্বর একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে সংস্থাটি অভিযোগ করেছে, তারা বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ৩২টি আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল। কিন্তু ২১শে ডিসেম্বর সরকার মাত্র ১৩ জনকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়। নির্বাচন কমিশন, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব করার কারণে আনফ্রেল ২২শে ডিসেম্বর তাদের পর্যবেক্ষণ মিশন বাতিল করতে বাধ্য হয়। একই বছরে খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই নির্বাচনগুলোতেও বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর একই ধরনের হয়রানি, গ্রেপ্তার, ভীতিপ্রদর্শন ও সহিংসতা চালানোর বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট রয়েছে। এমনকি নির্বাচনের দিনেও ভোট কারচুপি, জালিয়াতি ও নানা অনিয়ম ঘটেছে। ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৪টিতেই জয় পেয়েছে। শুধু সিলেটে ক্ষমতাসীন দল বিএনপির কাছে হেরেছে।
বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে উস্কে দিয়েছে। বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে গত ৮ই ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির অভিযোগে সাজা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। ওই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল ২০০৮ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এ ছাড়া, গত কয়েক বছরে সরকার তার বিরুদ্ধে আরো দু’ডজনেরও বেশি মামলা দায়ের করেছে। ফলে খালেদা জিয়া জামিনের সুবিধাও ভোগ করতে পারছেন না। শুধু তাই না, সংসদ নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে প্রায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার বিএনপি কর্মীকে অপরাধ মামলায় জড়ানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেককে আটকও করা হয়েছে। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের দাবি, এগুলোর অনেক অভিযোগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গত কয়েক বছরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৬টি অপরাধ মামলা দেয়া হয়েছে। এগুলোর এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। মির্জা ফখরুল বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি পোড়ানো ও বোমা নিক্ষেপের অভিযোগও রয়েছে।
অন্য সরকার-বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধেও একই ধরনের মামলা দেয়া হয়েছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ব্যাপক হয়রানির কারণে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা তাদের সংবিধান স্বীকৃত বাক-স্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকার চর্চা করতে পারছে না। সরকার রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। কিন্তু দলটির নেতাকর্মীদের সংবিধান স্বীকৃত বাক-স্বাধীনতা ও সমাবেশের মৌলিক অধিকার অব্যাহতভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সরকারের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি না হওয়ার জন্য গণমাধ্যমগুলোও সেল্ফ সেন্সরশিপের চর্চা করছে।
সরকারের দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব: বাংলাদেশের আইনে দুর্নীতির দায়ে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু সরকার ওই আইনের কার্যকর প্রয়োগ করছে না। ফলে সরকারি কর্মকর্তারা অব্যাহতভাবে দুর্নীতি করছে। এতে তাদেরকে দায়মুক্তিও দেয়া হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৮ সালের জরিপ অনুসারে, সরকারের ১৮টি বিভাগের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির দিক দিয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া অন্য দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগগুলো হলো- বিচার বিভাগ, ভূমি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও কর এবং শুল্ক বিভাগ।
গত বছরের ২০শে আগস্ট সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি আইন পাস করে মন্ত্রিসভা। সুশাসন ও স্বচ্ছতার জন্য আন্দোলনকারীরা ওই আইনের সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। তারা বলছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিতে ও দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য ওই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
এদিকে, অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা করার কারণে ব্যবসায়ী, সংবাদপত্রের মালিক, বিরোধীদলীয় কর্মী ও সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে দুদককে দিয়ে তদন্ত করানো বা তদন্তের ভয় দেখানো হচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট দুদককে তিরস্কার করে। যা হোক, সরকার কমিউনিটি পুলিশিং প্রোগ্রাম ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশ বিভাগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি লাঘবের উদ্যোগ নিয়েছে।
শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা: বছরজুড়ে বিএনপিকে কোনো মিছিল ও সমাবেশ করতে দেয়নি সরকার। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গত বছরের মার্চ মাসের ১১, ১৯ ও ২৯ তারিখে বিএনপির সমাবেশ করার আবেদন বাতিল করা হয়েছে। কারণ হিসেবে নিরাপত্তাজনিত কারণ উল্লেখ করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই সমাবেশের জন্য ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বিএনপিকে তখন অন্য স্থানে সমাবেশ করতে বাধ্য করা হয়।
বিএনপি জানিয়েছে, ১লা সেপ্টেম্বর মৌখিকভাবে তাদেরকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে ১০ই সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তারা মানববন্ধন করেছিল। এই দুই কর্মসূচিতে দলটির শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো বছরজুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ তাদের পছন্দমত সকল স্থানে সমাবেশ করেছে।
১৫ই সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিনি সকল দলকে সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশের অনুমতি দিতে ডিএমপি কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর ২৯শে সেপ্টেম্বর ডিএমপি ২২টি শর্তের মধ্যে থেকে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান। তা সত্ত্বেও সরকার অথবা তার এজেন্টরা খেয়ালখুশিমতো অথবা বেআইনিভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে বহু রিপোর্ট পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে সারা বছরই আইনপ্রয়োগকারীরা ঘেরাও অভিযান চালিয়েছে। প্রথমত তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এটা শুরু করে। তবে কিছু ঘেরাও, গ্রেপ্তার ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগ বিষয়ক অপারেশনের সময় সন্দেহজনক অনেক মৃত্যু হয়েছে। এসব মৃত্যু হয়েছে বন্দুকযুদ্ধে এমনটা দাবি করে আইনপ্রয়োগকারীরা। এসব হত্যাকে র্যাব অথবা পুলিশের অন্য ইউনিটের সঙ্গে অপরাধী গ্যাংদের ‘ক্রসফায়ারে মুত্যু’, ‘গান ফাইট’ অথবা ‘এনকাউন্টারে মৃত্যু’ বলে উল্লেখ করে তারা। মিডিয়াও অনেক সময় এসব হত্যাকে বৈধতা দেয় পুলিশি ভাষায়।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ও মিডিয়াগুলো এসব হত্যার অনেকগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে বর্ণনা করে।
ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার গত বছর মে মাসে দেশে মাদক সমস্যা মোকাবিলার জন্য মাদকবিরোধী পদক্ষেপ নেয়। এতে অন্য বছরের তুলনায় গত বছর দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যায়। স্থানীয় মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ অভিযানে প্রায় ২৩০ জন মাদকের ডিলারকে হত্যা করা হয়েছে। গত বছর মে মাস থেকে শুরু হয়ে জুন পর্যন্ত এই অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭০০০ মানুষকে। বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ড ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো ও নাগরিক সমাজ। তারা দাবি করেছে, ভিকটিমদের অনেকে ছিলেন নিরপরাধ। তাদের দাবি, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করার জন্য সরকার মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়েছে।
গুম: মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো ও মিডিয়ার রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে চলমান গুম ও অপহরণের তথ্য। এসব গুম বা অপহরণের বেশির ভাগই ঘটিয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী সার্ভিসগুলো। এমন সব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ বা তদন্তে সীমিত উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গুমের অভিযোগের পর নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কিছু ব্যক্তিকে অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি দিয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তার করেছে। কাউকে পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়। আবার অনেকে আছেন যাদেরকে আর কখনোই পাওয়া যায় নি। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে ৫৮ জনকে। অধিকার বলেছে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে ৮৩ জনকে। বিরোধী দলীয় সাবেক তিন নেতা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্ত হন। তাদের ছেলেদের ২০১৬ সালে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয় কর্তৃপক্ষ।
তাদেরকে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে অপরাধের কারণে আটক বা অভিযুক্ত দেখানো হয় নি আনুষ্ঠানিকভাবে। সাত মাস পরে কর্তৃপক্ষ মুক্তি দেয় হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে। কিন্তু মীর আহমেদ বিন কাসিম ও আমান আজমি ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্তও ছিলেন নিখোঁজ। ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুমতি চায় এ দেশ সফর করতে। কিন্তু সরকার তাদের সেই আবেদনে কোনো সাড়া দেয় নি।
এমন অবস্থায় বার বার জোরপূর্বক গুমের ঘটনা প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। তারা উল্টো দাবি করেন, ভিকটিমরা নিজের স্বার্থে আত্মগোপন করে আছেন। ২০১৭ সালে বিচার বিভাগীয় এক তদন্তে বলা হয়, জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে। এ জন্য গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে নির্দেশ দেয়া হয়। ২০১৮ সাল জুড়েই এসব গুমের তদন্ত আইন অব্যাহত রাখা হয়েছিল বলে জানায় আইনপ্রয়োগকারীরা।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকায় আন্দোলন চলছিল। এ আন্দোলন নিয়ে উস্কানিমূলক মন্তব্য করার অভিযোগে ৫ই আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় ফটোসাংবাদিক ড. শহিদুল আলমকে। তাকে পরের দিন ৬ই আগস্ট আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় দেখা যায় তিনি কারো সহায়তা ছাড়া হাঁটতে সক্ষম হচ্ছেন না। দেখেই বোঝা যায় তিনি আহত হয়েছেন বা তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তিনি বক্তব্য দেন। এতে শহিদুল আলম অভিযোগ করেন যে, আটক করার প্রথম রাতে তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল। মাথার ওপর ভারি কিছু রাখা হয়েছিল।
তার মুখে আঘাত করা হয়েছিল। আইনগতভাবে একটি সরকারি হাসপাতালে তার মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট জমা দেয়ার একদিন পরে ৯ই আগস্ট আদালতে জমা দেয়া হয় ওই রিপোর্ট। তাতে বলা হয়, শহিদুল আলম ‘শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ’ আছেন বলে মনে হয়। শহিদুল আলমের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ ২২শে আগস্ট একটি বিবৃতি দেন। এতে তিনি তার স্বামীকে হাসপাতালে স্থানান্তরের দাবি জানান। তিনি জেলখানায় শহিদুল আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে শহিদুল আলম তাকে বলেন, তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন দাঁতে ব্যথা ও দৃষ্টিশক্তির জটিলতায় ভুগছিলেন। আটকের আগে তার এসব সমস্যা ছিল না। অবশেষে ২০শে নভেম্বর শহিদুল আলমকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়।
ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ভূমিকা থাকার কারণে ৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকার ডিবি কর্মকর্তারা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে তাদের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। কর্তৃপক্ষ কিছু শিক্ষার্থীকে ছেড়ে দিয়েছে। একজন বিচারকের সামনে তোলার আগে ১২ জন শিক্ষার্থীকে রাখা হয় নিরাপত্তা হেফাজতে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এসব গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করে ডিবি। তাদের এমন গ্রেপ্তার ও তাদেরকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে ব্যর্থতার জন্য ব্যাপক সমালোচনা করেছেন মানবকাধিকার বিষয়ক কর্মীরা। ১১ই সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টার পত্রিকা একটি তালিকা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, তালিকায় থাকা বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ভুয়া ফৌজদারি অভিযোগ করেছে। এর মধ্যে নাম ছিল হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী ৮২ বছর বয়সী একজন ব্যক্তির। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন বিদেশে। এ ছাড়া ওই তালিকায় এমন এক ব্যক্তির নাম ছিল, যিনি মারা গেছেন অপরাধের প্রায় দুই বছর আগে। নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে ১০৪৬টি মিথ্যা মামলার আংশিক তালিকা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে জমা দেয় বিএনপি।
রাজনৈতিক বন্দি:
২০১৮ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দিত্ব ও আটকের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে বিরোধী দলীয় সদস্যদের অনেক সময় গ্রেপ্তার ও বিচার করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির জবাবে অনেক মিথ্যা অভিযোগেও এমনটা করা হয়েছে। সারা বছরে খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিরোধী দল বিএনপির কয়েক হাজার সদস্যকে।
৮ই ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথমে এ বিষয়ে মামলা করা হয়েছিল। এ অভিযোগকে সমর্থন করতে তথ্যপ্রমাণের যে ঘাটতি রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক ও দেশের ভিতরকার আইনি বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, এটা হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বিরোধীদলীয় এই নেতাকে সরিয়ে রাখার জন্য একটি রাজনৈতিক পটভূমি। তার জামিন পাওয়ার আবেদনে আদালত ধীর গতিতে অগ্রসর হয়েছে।
একই পরিস্থিতিতে একজন অভিযুক্ত সাধারণত তাৎক্ষণিক জামিন পেয়ে থাকেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি প্রায় এক মাসের মতো স্থগিত রাখা হয়েছিল। হাইকোর্ট ১২ই মার্চ তাকে জামিন দেন। কিন্তু বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশন সেই আদেশে অবিলম্বে দুই মাসের জন্য স্টে অর্ডার দেন। অভিযোগ গঠনের প্রায় তিন মাস পরে জামিনের আদেশ নিশ্চিত হওয়ার পর সরকার অন্যান্য মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, খালেদা জিয়ার শাস্তি প্রক্রিয়ার আট দিনে বিএনপির ১৭৮৬ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির একজন মুখপাত্র হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ও কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন এমন কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাদের এই দাবি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা যায় নি।
প্রেস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা
বাংলাদেশের সংবিধান গণমাধ্যমসহ সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু সরকার সেই অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। হয়রানি ও প্রতিশোধের ভয়ে সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে কিছু সাংবাদিক সেলফ-সেন্সরশিপ প্রয়োগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, সংবিধানের সমলোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আইন ঘৃণামূলক বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ করেছে। তবে এটা পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করে নি, কোনো রকম বক্তব্যকে ঘৃণামূলক বক্তব্য বলা হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিরুদ্ধে, আইনশৃঙ্খলা, আদর্শের বিরুদ্ধে, আদালত অবমাননা, মানহানিকর অথবা উস্কানিমূলক বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ করতে পারে সরকার। সাংবিধানিক পরিষদের যেকোনো সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ফরেন ডোনেশন অ্যাক্টে। ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ব্যবহার করা হয়েছে বিরোধী দলীয় ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের বিচারে।
ওই রিপোর্টে সেলফ সেন্সরশিপ ও বিধিনিষেধের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, আর্থিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে মিডিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এমন অভিযোগ করেছেন নিরপেক্ষ সাংবাদিকরা। তারা আরো বলেছেন, এক্ষেত্রে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও একই উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন দেয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে ওইসব গোয়েন্দা সংস্থা। আরএসএফ অভিযোগ করেছে, সাংবাদিক ও মিডিয়া আউটলেটের বিরুদ্ধে ‘মহামারী আকারে সহিংসতা’ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেলফ সেন্সরশিপ। আর যারা এ জন্য দায়ী তারা ভোগ করছে দায়মুক্তি। সাধারণত বেসরকারি সংবাদপত্রগুলো বিভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক মেরূকরণ ও সেলফ সেন্সরশিপ একটি সমস্যা রয়েই গেছে।
জাতীয় সংসদ সেপ্টেম্বর মাসে পাস করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। দাবি করা হয়, সাইবার অপরাধ দমনের জন্য এটা করা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতাকে গলা টিপে ধরতে ও মুক্ত মত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে দেখানোর জন্য এই আইন করা হয়েছে বলে এর নিন্দা জানায় মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো, সাংবাদিকরা, মিডিয়া আউটলেটগুলো ও রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে অথবা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়ানোর শাস্তি এই আইনে রাখা হয়েছে ১০ বছর পর্যন্ত জেল। তবে এ আইন দিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করার সমালোচনা করেছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো।
যেসব মিডিয়া সরকারের সমালোচনা করে অথবা বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড ও বিবৃতি করে সম্প্রচার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলতক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। আগস্টে ছাত্রদের নিরাপদ সদকের দাবির আন্দোলনের সময় সরকার ওই আন্দোলনকে সীমিত করতে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। টেলিভিশন স্টেশনগুলো রিপোর্ট করেছে যে, রাজপথে ছাত্র আন্দোলনের রিপোর্ট সম্প্রচার না করতে তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। কিছু সাংবাদিক ও মানবাধিকার বিষয়ক এনজিওগুলোর মতো, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিশোধ নেয়ার আতঙ্কে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানোর ভয়ে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপে লিপ্ত। যদিও সরকারের সমালোচনা সাধারণ বিষয়, তথাপি সরকারের হয়রানির ভয়ে মিডিয়ার অনেকে আতঙ্কিত।
বন্ধ করে দেয়া হয় ওয়েবসাইট। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও জনসভা করার স্বাধীনতার অধিকারেও রয়েছে অযাচিত হস্তক্ষেপ। আছে বেসরকারি সংগঠন এনজিও বিষয়ক অতিমাত্রায় বিধিনিষেধমূলক কঠোর আইন। আছে তাদের কার্যক্রমে বিধিনিষেধ।
আন্দোলনের স্বাধীনতায় আছে উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণেও আছে বিধিনিষেধ, যেখানে নির্বাচনগুলো কোনোভাবেই খাঁটি, অবাধ ও সুষ্ঠু নয়। আছে দুর্নীতি। আছে মানবপাচার। সমকামী নারী, সমকামী পুরুষ, উভকামী, হিজড়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রয়েছে সহিংসতা। এখানে সমলিঙ্গে যৌনতা অপরাধ। নিরপেক্ষ ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকদের অধিকারে আছে বিধিনিষেধ। এ ছাড়া শিশু শ্রমের সবচেয়ে বাজে ফর্মটির ব্যবহার করা হয় বাংলাদেশে।
২০১৮ সালে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে এসব কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সারাবিশ্বের মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৮ প্রকাশ করেন বুধবার। সেখানে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারটি ৫০ পৃষ্ঠার। এতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার ও সহিংসতার কথা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, এসব কারণে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের প্রচারণা কঠিন হয়ে উঠেছিল। তাদের সমর্থকরা সভা করতে পারেন নি, কোনো র্যালি করতে পারেন নি। অবাধে প্রচারণা চালাতে পারেন নি। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা নানা অনিয়মের পরও ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি পেয়েছেন বলে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
নির্বাচন ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: ২০১৮ সালের শেষে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ওই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। এতে বাছবিচারহীনভাবে ব্যালট বাক্স ভর্তি, বিরোধীদলীয় নির্বাচনী এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ ও নির্বাচনী মিত্র দলগুলো ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয় পেয়েছে। যেখানে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো পেয়েছে মাত্র সাতটি আসন। এর আগে, নির্বাচনী প্রচারণার সময় হয়রানি, ভীতিপ্রদর্শন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট রয়েছে। এতে বিরোধী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের জন্য সভা-সমাবেশ ও নির্বাচনী প্রচারণা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। বেসরকারি সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুসারে, নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে বিএনপি ও অন্য বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ১২৩৪টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ২১১টি।
বাংলাদেশের সরকার সঠিক সময়ে আনফ্রেলের পর্যবেক্ষকদের পরিচয়পত্র ও ভিসা প্রদান করেনি। এ বিষয়ে আনফ্রেল গত ২৩শে ডিসেম্বর একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে সংস্থাটি অভিযোগ করেছে, তারা বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ৩২টি আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল। কিন্তু ২১শে ডিসেম্বর সরকার মাত্র ১৩ জনকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়। নির্বাচন কমিশন, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব করার কারণে আনফ্রেল ২২শে ডিসেম্বর তাদের পর্যবেক্ষণ মিশন বাতিল করতে বাধ্য হয়। একই বছরে খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই নির্বাচনগুলোতেও বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর একই ধরনের হয়রানি, গ্রেপ্তার, ভীতিপ্রদর্শন ও সহিংসতা চালানোর বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট রয়েছে। এমনকি নির্বাচনের দিনেও ভোট কারচুপি, জালিয়াতি ও নানা অনিয়ম ঘটেছে। ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৪টিতেই জয় পেয়েছে। শুধু সিলেটে ক্ষমতাসীন দল বিএনপির কাছে হেরেছে।
বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে উস্কে দিয়েছে। বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে গত ৮ই ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির অভিযোগে সাজা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। ওই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল ২০০৮ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এ ছাড়া, গত কয়েক বছরে সরকার তার বিরুদ্ধে আরো দু’ডজনেরও বেশি মামলা দায়ের করেছে। ফলে খালেদা জিয়া জামিনের সুবিধাও ভোগ করতে পারছেন না। শুধু তাই না, সংসদ নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে প্রায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার বিএনপি কর্মীকে অপরাধ মামলায় জড়ানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেককে আটকও করা হয়েছে। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের দাবি, এগুলোর অনেক অভিযোগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গত কয়েক বছরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৬টি অপরাধ মামলা দেয়া হয়েছে। এগুলোর এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। মির্জা ফখরুল বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি পোড়ানো ও বোমা নিক্ষেপের অভিযোগও রয়েছে।
অন্য সরকার-বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধেও একই ধরনের মামলা দেয়া হয়েছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ব্যাপক হয়রানির কারণে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা তাদের সংবিধান স্বীকৃত বাক-স্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকার চর্চা করতে পারছে না। সরকার রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। কিন্তু দলটির নেতাকর্মীদের সংবিধান স্বীকৃত বাক-স্বাধীনতা ও সমাবেশের মৌলিক অধিকার অব্যাহতভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সরকারের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি না হওয়ার জন্য গণমাধ্যমগুলোও সেল্ফ সেন্সরশিপের চর্চা করছে।
সরকারের দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব: বাংলাদেশের আইনে দুর্নীতির দায়ে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু সরকার ওই আইনের কার্যকর প্রয়োগ করছে না। ফলে সরকারি কর্মকর্তারা অব্যাহতভাবে দুর্নীতি করছে। এতে তাদেরকে দায়মুক্তিও দেয়া হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৮ সালের জরিপ অনুসারে, সরকারের ১৮টি বিভাগের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির দিক দিয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া অন্য দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগগুলো হলো- বিচার বিভাগ, ভূমি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও কর এবং শুল্ক বিভাগ।
গত বছরের ২০শে আগস্ট সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি আইন পাস করে মন্ত্রিসভা। সুশাসন ও স্বচ্ছতার জন্য আন্দোলনকারীরা ওই আইনের সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। তারা বলছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিতে ও দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য ওই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
এদিকে, অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা করার কারণে ব্যবসায়ী, সংবাদপত্রের মালিক, বিরোধীদলীয় কর্মী ও সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে দুদককে দিয়ে তদন্ত করানো বা তদন্তের ভয় দেখানো হচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট দুদককে তিরস্কার করে। যা হোক, সরকার কমিউনিটি পুলিশিং প্রোগ্রাম ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশ বিভাগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি লাঘবের উদ্যোগ নিয়েছে।
শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা: বছরজুড়ে বিএনপিকে কোনো মিছিল ও সমাবেশ করতে দেয়নি সরকার। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গত বছরের মার্চ মাসের ১১, ১৯ ও ২৯ তারিখে বিএনপির সমাবেশ করার আবেদন বাতিল করা হয়েছে। কারণ হিসেবে নিরাপত্তাজনিত কারণ উল্লেখ করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই সমাবেশের জন্য ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বিএনপিকে তখন অন্য স্থানে সমাবেশ করতে বাধ্য করা হয়।
বিএনপি জানিয়েছে, ১লা সেপ্টেম্বর মৌখিকভাবে তাদেরকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে ১০ই সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তারা মানববন্ধন করেছিল। এই দুই কর্মসূচিতে দলটির শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো বছরজুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ তাদের পছন্দমত সকল স্থানে সমাবেশ করেছে।
১৫ই সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিনি সকল দলকে সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশের অনুমতি দিতে ডিএমপি কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর ২৯শে সেপ্টেম্বর ডিএমপি ২২টি শর্তের মধ্যে থেকে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান। তা সত্ত্বেও সরকার অথবা তার এজেন্টরা খেয়ালখুশিমতো অথবা বেআইনিভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে বহু রিপোর্ট পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে সারা বছরই আইনপ্রয়োগকারীরা ঘেরাও অভিযান চালিয়েছে। প্রথমত তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এটা শুরু করে। তবে কিছু ঘেরাও, গ্রেপ্তার ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগ বিষয়ক অপারেশনের সময় সন্দেহজনক অনেক মৃত্যু হয়েছে। এসব মৃত্যু হয়েছে বন্দুকযুদ্ধে এমনটা দাবি করে আইনপ্রয়োগকারীরা। এসব হত্যাকে র্যাব অথবা পুলিশের অন্য ইউনিটের সঙ্গে অপরাধী গ্যাংদের ‘ক্রসফায়ারে মুত্যু’, ‘গান ফাইট’ অথবা ‘এনকাউন্টারে মৃত্যু’ বলে উল্লেখ করে তারা। মিডিয়াও অনেক সময় এসব হত্যাকে বৈধতা দেয় পুলিশি ভাষায়।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ও মিডিয়াগুলো এসব হত্যার অনেকগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে বর্ণনা করে।
ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার গত বছর মে মাসে দেশে মাদক সমস্যা মোকাবিলার জন্য মাদকবিরোধী পদক্ষেপ নেয়। এতে অন্য বছরের তুলনায় গত বছর দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যায়। স্থানীয় মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ অভিযানে প্রায় ২৩০ জন মাদকের ডিলারকে হত্যা করা হয়েছে। গত বছর মে মাস থেকে শুরু হয়ে জুন পর্যন্ত এই অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭০০০ মানুষকে। বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ড ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো ও নাগরিক সমাজ। তারা দাবি করেছে, ভিকটিমদের অনেকে ছিলেন নিরপরাধ। তাদের দাবি, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করার জন্য সরকার মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়েছে।
গুম: মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো ও মিডিয়ার রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে চলমান গুম ও অপহরণের তথ্য। এসব গুম বা অপহরণের বেশির ভাগই ঘটিয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী সার্ভিসগুলো। এমন সব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ বা তদন্তে সীমিত উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গুমের অভিযোগের পর নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কিছু ব্যক্তিকে অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি দিয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তার করেছে। কাউকে পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়। আবার অনেকে আছেন যাদেরকে আর কখনোই পাওয়া যায় নি। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে ৫৮ জনকে। অধিকার বলেছে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে ৮৩ জনকে। বিরোধী দলীয় সাবেক তিন নেতা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্ত হন। তাদের ছেলেদের ২০১৬ সালে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয় কর্তৃপক্ষ।
তাদেরকে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে অপরাধের কারণে আটক বা অভিযুক্ত দেখানো হয় নি আনুষ্ঠানিকভাবে। সাত মাস পরে কর্তৃপক্ষ মুক্তি দেয় হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে। কিন্তু মীর আহমেদ বিন কাসিম ও আমান আজমি ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্তও ছিলেন নিখোঁজ। ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুমতি চায় এ দেশ সফর করতে। কিন্তু সরকার তাদের সেই আবেদনে কোনো সাড়া দেয় নি।
এমন অবস্থায় বার বার জোরপূর্বক গুমের ঘটনা প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। তারা উল্টো দাবি করেন, ভিকটিমরা নিজের স্বার্থে আত্মগোপন করে আছেন। ২০১৭ সালে বিচার বিভাগীয় এক তদন্তে বলা হয়, জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে। এ জন্য গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে নির্দেশ দেয়া হয়। ২০১৮ সাল জুড়েই এসব গুমের তদন্ত আইন অব্যাহত রাখা হয়েছিল বলে জানায় আইনপ্রয়োগকারীরা।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকায় আন্দোলন চলছিল। এ আন্দোলন নিয়ে উস্কানিমূলক মন্তব্য করার অভিযোগে ৫ই আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় ফটোসাংবাদিক ড. শহিদুল আলমকে। তাকে পরের দিন ৬ই আগস্ট আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় দেখা যায় তিনি কারো সহায়তা ছাড়া হাঁটতে সক্ষম হচ্ছেন না। দেখেই বোঝা যায় তিনি আহত হয়েছেন বা তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তিনি বক্তব্য দেন। এতে শহিদুল আলম অভিযোগ করেন যে, আটক করার প্রথম রাতে তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল। মাথার ওপর ভারি কিছু রাখা হয়েছিল।
তার মুখে আঘাত করা হয়েছিল। আইনগতভাবে একটি সরকারি হাসপাতালে তার মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট জমা দেয়ার একদিন পরে ৯ই আগস্ট আদালতে জমা দেয়া হয় ওই রিপোর্ট। তাতে বলা হয়, শহিদুল আলম ‘শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ’ আছেন বলে মনে হয়। শহিদুল আলমের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ ২২শে আগস্ট একটি বিবৃতি দেন। এতে তিনি তার স্বামীকে হাসপাতালে স্থানান্তরের দাবি জানান। তিনি জেলখানায় শহিদুল আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে শহিদুল আলম তাকে বলেন, তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন দাঁতে ব্যথা ও দৃষ্টিশক্তির জটিলতায় ভুগছিলেন। আটকের আগে তার এসব সমস্যা ছিল না। অবশেষে ২০শে নভেম্বর শহিদুল আলমকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়।
ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ভূমিকা থাকার কারণে ৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকার ডিবি কর্মকর্তারা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে তাদের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। কর্তৃপক্ষ কিছু শিক্ষার্থীকে ছেড়ে দিয়েছে। একজন বিচারকের সামনে তোলার আগে ১২ জন শিক্ষার্থীকে রাখা হয় নিরাপত্তা হেফাজতে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এসব গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করে ডিবি। তাদের এমন গ্রেপ্তার ও তাদেরকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে ব্যর্থতার জন্য ব্যাপক সমালোচনা করেছেন মানবকাধিকার বিষয়ক কর্মীরা। ১১ই সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টার পত্রিকা একটি তালিকা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, তালিকায় থাকা বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ভুয়া ফৌজদারি অভিযোগ করেছে। এর মধ্যে নাম ছিল হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী ৮২ বছর বয়সী একজন ব্যক্তির। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন বিদেশে। এ ছাড়া ওই তালিকায় এমন এক ব্যক্তির নাম ছিল, যিনি মারা গেছেন অপরাধের প্রায় দুই বছর আগে। নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে ১০৪৬টি মিথ্যা মামলার আংশিক তালিকা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে জমা দেয় বিএনপি।
রাজনৈতিক বন্দি:
২০১৮ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দিত্ব ও আটকের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে বিরোধী দলীয় সদস্যদের অনেক সময় গ্রেপ্তার ও বিচার করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির জবাবে অনেক মিথ্যা অভিযোগেও এমনটা করা হয়েছে। সারা বছরে খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিরোধী দল বিএনপির কয়েক হাজার সদস্যকে।
৮ই ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথমে এ বিষয়ে মামলা করা হয়েছিল। এ অভিযোগকে সমর্থন করতে তথ্যপ্রমাণের যে ঘাটতি রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক ও দেশের ভিতরকার আইনি বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, এটা হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বিরোধীদলীয় এই নেতাকে সরিয়ে রাখার জন্য একটি রাজনৈতিক পটভূমি। তার জামিন পাওয়ার আবেদনে আদালত ধীর গতিতে অগ্রসর হয়েছে।
একই পরিস্থিতিতে একজন অভিযুক্ত সাধারণত তাৎক্ষণিক জামিন পেয়ে থাকেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি প্রায় এক মাসের মতো স্থগিত রাখা হয়েছিল। হাইকোর্ট ১২ই মার্চ তাকে জামিন দেন। কিন্তু বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশন সেই আদেশে অবিলম্বে দুই মাসের জন্য স্টে অর্ডার দেন। অভিযোগ গঠনের প্রায় তিন মাস পরে জামিনের আদেশ নিশ্চিত হওয়ার পর সরকার অন্যান্য মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, খালেদা জিয়ার শাস্তি প্রক্রিয়ার আট দিনে বিএনপির ১৭৮৬ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির একজন মুখপাত্র হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ও কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন এমন কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাদের এই দাবি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা যায় নি।
প্রেস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা
বাংলাদেশের সংবিধান গণমাধ্যমসহ সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু সরকার সেই অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। হয়রানি ও প্রতিশোধের ভয়ে সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে কিছু সাংবাদিক সেলফ-সেন্সরশিপ প্রয়োগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, সংবিধানের সমলোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আইন ঘৃণামূলক বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ করেছে। তবে এটা পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করে নি, কোনো রকম বক্তব্যকে ঘৃণামূলক বক্তব্য বলা হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিরুদ্ধে, আইনশৃঙ্খলা, আদর্শের বিরুদ্ধে, আদালত অবমাননা, মানহানিকর অথবা উস্কানিমূলক বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ করতে পারে সরকার। সাংবিধানিক পরিষদের যেকোনো সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ফরেন ডোনেশন অ্যাক্টে। ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ব্যবহার করা হয়েছে বিরোধী দলীয় ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের বিচারে।
ওই রিপোর্টে সেলফ সেন্সরশিপ ও বিধিনিষেধের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, আর্থিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে মিডিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এমন অভিযোগ করেছেন নিরপেক্ষ সাংবাদিকরা। তারা আরো বলেছেন, এক্ষেত্রে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও একই উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন দেয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে ওইসব গোয়েন্দা সংস্থা। আরএসএফ অভিযোগ করেছে, সাংবাদিক ও মিডিয়া আউটলেটের বিরুদ্ধে ‘মহামারী আকারে সহিংসতা’ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেলফ সেন্সরশিপ। আর যারা এ জন্য দায়ী তারা ভোগ করছে দায়মুক্তি। সাধারণত বেসরকারি সংবাদপত্রগুলো বিভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক মেরূকরণ ও সেলফ সেন্সরশিপ একটি সমস্যা রয়েই গেছে।
জাতীয় সংসদ সেপ্টেম্বর মাসে পাস করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। দাবি করা হয়, সাইবার অপরাধ দমনের জন্য এটা করা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতাকে গলা টিপে ধরতে ও মুক্ত মত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে দেখানোর জন্য এই আইন করা হয়েছে বলে এর নিন্দা জানায় মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো, সাংবাদিকরা, মিডিয়া আউটলেটগুলো ও রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে অথবা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়ানোর শাস্তি এই আইনে রাখা হয়েছে ১০ বছর পর্যন্ত জেল। তবে এ আইন দিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করার সমালোচনা করেছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো।
যেসব মিডিয়া সরকারের সমালোচনা করে অথবা বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড ও বিবৃতি করে সম্প্রচার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলতক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। আগস্টে ছাত্রদের নিরাপদ সদকের দাবির আন্দোলনের সময় সরকার ওই আন্দোলনকে সীমিত করতে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। টেলিভিশন স্টেশনগুলো রিপোর্ট করেছে যে, রাজপথে ছাত্র আন্দোলনের রিপোর্ট সম্প্রচার না করতে তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। কিছু সাংবাদিক ও মানবাধিকার বিষয়ক এনজিওগুলোর মতো, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিশোধ নেয়ার আতঙ্কে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানোর ভয়ে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপে লিপ্ত। যদিও সরকারের সমালোচনা সাধারণ বিষয়, তথাপি সরকারের হয়রানির ভয়ে মিডিয়ার অনেকে আতঙ্কিত।
No comments