রাজধানীতে নবাগত: আশার টানে ঢাকায় আসা by জিয়া চৌধুরী
ঢাকা।
চার শ’ বছরের পুরনো শহর। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ ঢুকছে
রাজধানীতে। বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট আর ট্রেন স্টেশন হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করছে
মানুষ। কারো জীবিকার তাগিদ, কারো চিকিৎসার প্রয়োজন, আবার কেউবা
ব্যবসা-উচ্চশিক্ষার কাজে ঢাকায় আসছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ঢাকায় ঢুকছেন অন্তত দুই হাজার মানুষ। আর বিশ্বব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যান বলছে ঢাকার জনসংখ্যা এখন প্রায় ২ কোটি ছুঁই ছুঁই। ২০২০ সাল নাগাদ যা গিয়ে ঠেকবে ২ কোটি ১০ লাখে।
এত মানুষ কেন ঢাকায় আসে, কী তাদের অভিলাষ? এ নিয়ে রয়েছে নানা কৌতূহল।
মো. আনোয়ার হোসেন, লক্ষ্মীপুর সদরের কুশাখালী ইউনিয়ন থেকে মাত্র দু’দিন হলো ঢাকায় এসেছেন। উদ্দেশ্য চাকরি। গত মঙ্গলবার রাত দশটার দিকে প্রথমবারের মতো ঢাকায় নামেন তিনি। লক্ষ্মীপুর থেকে সিএনজি অটোরিকশায় চাঁদপুর। সেখান থেকে লঞ্চে সদরঘাট। এই ছিল আনোয়ার হোসেনের প্রথম ঢাকা যাত্রার রুট। লক্ষ্মীপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে এখন চাকরির সন্ধানে রাজধানীতে।
আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে বুধবার কথা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি গেটে। কেন ঢাকা এলেন- এমন প্রশ্নে আনোয়ারের সহজ স্বীকারোক্তি, চাকরি-বাকরির জন্য তো ঢাকায় আসা লাগবে। একটা ভালো কোনো চাকরির জন্য ঢাকা ছাড়া গতি নেই। বাবা-মা, চার ভাই আর এক বোন রয়েছে আনোয়ারের। নিজে এখনো বিয়ে করেন নি। পরিবারের সবার চাওয়া তিনি ঢাকায় একটা ভালো চাকরি করবেন। আপাতত থাকছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে, সেখান থেকেই চাকরির জন্য চেষ্টা-তদবির করছেন। সিভিও বানিয়েছেন, চাকরির ভাইভা দিতে আলাদা পোশাক বানিয়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এখন শুধু একটা ফোনের অপেক্ষা। চাকরির ভাইভার ফোন! যা বদলে দেবে আনোয়ার হোসেনের জীবন। জীবিকার টানেই মূলত আনোয়ারের মতো অসংখ্য মানুষ জেলা শহরগুলো থেকে ঢাকা আসছেন।
ভাগ্য অন্বেষণে দক্ষিণের আরেকটি জেলা থেকে গত রোববার রাতে ঢাকায় এসেছেন আল-আমিন। বাসে ঢাকা আসার খরচ বেশি বলে টাকা বাঁচাতে তিনিও এসেছেন লঞ্চে। উঠেছেন ফকিরাপুল পানির টাঙ্কি এলাকায় খালার বাসায়। এসএমএস নামে একটি লেদার অ্যান্ড প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন। খালি হাতেই প্রক্রিয়াজাত করা চামড়া কাটতে হয় তাকে। এ ছাড়া ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চামড়াজাত পণ্য পৌঁছে দিতে হয়।
ফকিরাপুল এলাকায় আল-আমিনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে অফিস থেকে জরুরি ফোন আসে তার। পণ্য পৌঁছে দিতে তাকে যেতে হবে গাজীপুর টঙ্গী এলাকায়। এ যাত্রায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মুঠোফোন নম্বর চাইলাম আল-আমিনের। পরে রাতে কল দিলেও ধরেন না তিনি। কিছুক্ষণ পর একটি ক্ষুদেবার্তায় জানালেন, মুঠোফোনের স্পিকার নষ্ট। নতুন একটা হেডফোন না কেনা পর্যন্ত ফোনে কথা বলতে পারবেন না। আর্থিক সংকটে আছেন। পরে তার পরিচিত আরেক ভাইয়ের মাধ্যমে কথা হয় আল-আমিনের সঙ্গে। পাঁচজনের পরিবারে তিনিই সবার বড়। চাকরির আশায় দু’বার বিদেশে যাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বাবা আব্দুল হান্নান তিন মাস আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। তাকে দেখভাল ও আর ওষুধ কেনায় খরচ হয়ে যায় অনেক টাকা। এক মাস আগে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন আল-আমিনের মা। তিনিও বেশ অসুস্থ। টানাপড়েনের সংসার টিকিয়ে রাখতে আল-আমিন শেষমেশ ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত নেন।
এসএসসির গণ্ডি পেরোনো ২২ বছরের তরুণের কাঁধেই এখন পুরো পরিবারের ভার। ঢাকায় আসার প্রথম দুইদিন অঝোরে কেঁদেছেন তিনি। ঢাকার অলিগলি কোনো কিছুই চেনেন না। ভরাট গলায় আল-আমিন বলেন, কোথাও প্রডাক্ট ডেলিভারি দিতে গেলেও লোকজনকে জিজ্ঞেস করে যেতে হয়। মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে লেদার পৌঁছে দিয়ে আসা লাগে। বেশ খাটুনির কাজে মাস শেষে মাত্র আট হাজার টাকা বেতন পাবার কথা। ঢাকায় কাজ করা অনেক কষ্টের, আমি গ্রামেই ভালো ছিলাম। নিরুপায় হয়েই ঢাকা আসা। পরিবারের মুখগুলোর কথা ভেসে উঠে বার বার, বিশেষ করে দুই ছোটবোনকে। এসএসসির পর আর বেশিদূর পড়াশুনা না করায় এমন দুর্গতি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন আল-আমিন। তবে এখানেই দমে যেতে চান না। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন। বলেন, যে করেই হোক ঢাকায় টিকে থাকতে হবেই। দাঁড়াতে হবে পরিবারের পাশে।
দুই সপ্তাহ হলো প্রবাস জীবন ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন চুয়াডাঙ্গার সোহেল শেখ। পরিবারের তিন ভাই সবাই থাকতেন সৌদি আরবে। আয়-উন্নতির আশায় দুই বছর আগে তিনিও সৌদিতে পাড়ি জমান। সেখানে কনফেকশনারি দোকানে কাজ করতেন সোহেল। ব্যবসায় মন্দা যাওয়ায় সৌদি আরব থেকে দুই ভাই ফিরে আসেন বাংলাদেশে। ঢাকার পান্থপথের একটি মেস বাসায় উঠেছেন সোহেল শেখ। এখানে থেকে ব্যবসা করার চেষ্টা করবেন তিনি। জানান, সৌদিতে অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে তেমন উন্নতি নেই কারো। বরং খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। এর চেয়ে ঢাকায় থেকে ব্যবসার চেষ্টা করাটাকে ভালো মনে করছেন তিনি। এরমধ্যে কয়েক জায়গায় কথাও বলেছেন।
মনঃপূত হলেই ব্যবসায় পুরোদমে নেমে পড়বেন। তার ভাষায়, সৌদি আরব থেকে ঢাকাই ভালো। এক সপ্তাহ আগেই ঢাকায় আসেন টাঙ্গাইলের বাবু। নিজের জেলায় কাজের সুযোগ না মেলায় পাড়ি জমান ঢাকার উদ্দেশে। তার আগে, কথা বলে নেন ঢাকার একটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে। বইমেলার কারণে প্রকাশনীর কাজের চাপ বাড়ায় তাদের বাংলাবাজার অফিসে যোগ দেন বাবু। থাকছেন পুরান ঢাকায়। এর আগে কখনো ঢাকা আসেন নি তিনি। একেবারে জীবিকার তাগিদেই প্রথমবারের মতো ঢাকা আগমন তার। মাঝে মাঝে বাড়ির কথা মনে করে খারাপ লাগলেও ঢাকাতেই স্থায়ীভাবে থাকতে চান বাবু।
এত গেল জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসা মানুষের কথা। উচ্চ শিক্ষা আর নিজের ইচ্ছে পূরণ করতেও রাজধানীতে আসছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসছেন বেশির ভাগ। টাঙ্গাইলের পুটিয়াজানি এলাকা থেকে দুই সপ্তাহ হলো ঢাকা এসেছেন দুই খালাতো বোন নুসরাত জাহান খান নিঝুম ও মানজুর আলম স্বর্ণা। দু’জনেই থাকছেন মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদ পুলপাড় এলাকায়। মালয়েশিয়া প্রবাসী বাবা ও স্কুলশিক্ষক মায়ের পরিবারে একমাত্র সন্তান নিঝুম। ছোটবেলা থেকেই ইংরেজির শিক্ষক হবার স্বপ্ন। নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে ভর্তি হয়েছেন ধানমণিণ্ডর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। এর আগে, দু’একবার ঢাকা আসা হলেও থাকতেন আত্মীয়দের বাসায়। এবারই প্রথম নিজের মতো করে আবাস গড়েছেন।
শিক্ষক হওয়ার বাসনা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত থাকতে চান জাদুর শহরে। মাঝে মাঝে মায়ের জন্য মন খারাপ হয় নিঝুমের। কিন্তু শিক্ষক হতে গেলে তো কষ্ট করতে হবেই, এমন সান্ত্বনায় বুক বাঁধেন আশায়। ঢাকার যানজট খারাপ লাগে তার। চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে সপ্তাহ দুয়েক হলো ঢাকায় এসেছেন ইজমো আহমেদ ও আবুজার গিফারী। দুজনই স্নাতকে ভর্তি হয়েছেন তিতুমীর কলেজে। থাকছেন ঢাকার পান্থপথ এলাকায়। পরিবার ছেড়ে এতদূর আসার কারণও একটাই। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করা, পড়াশোনা শেষে পরিবারের দায়িত্ব নিতে চান এই দুই তরুণ। ডা. নাজমুল হাসান সবে ঢাকা এসেছেন সপ্তাহখানেক হলো।
এমবিবিএসের পাঠ চুকিয়েছেন বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে। কুমিল্লার দেবিদ্বার এলাকার ছেলে নাজমুল অবশ্য এর আগেও ঢাকা এসেছেন। তবে এবারের উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি ভিন্ন। এমবিবিএস কোর্স শেষে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে থাকবেন ঢাকায়। এর মধ্যে শাহবাগ এলাকার একটি বাসায় উঠেছেন নাজমুল হাসান। ভর্তি হয়েছেন কোচিংয়েও। পরিবারের সদস্যদের বুকভরা আশা ছেলে একদিন নামকরা ডাক্তার হবে। রোগীরা ভিড় করবেন তার কাছে। এমন হাজারো স্বপ্নের ঝুলি নিয়ে ঢাকায় আসার পথগুলোতে প্রতিনিয়ত মানুষের স্রোত। বাসে, লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে মানুষের সঙ্গে আসে তাদের হাজারো বাসনা। ঢাকা যেন স্বপ্ন পূরণের এক কারখানা। কারো হয়, কারো হয় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ঢাকায় ঢুকছেন অন্তত দুই হাজার মানুষ। আর বিশ্বব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যান বলছে ঢাকার জনসংখ্যা এখন প্রায় ২ কোটি ছুঁই ছুঁই। ২০২০ সাল নাগাদ যা গিয়ে ঠেকবে ২ কোটি ১০ লাখে।
এত মানুষ কেন ঢাকায় আসে, কী তাদের অভিলাষ? এ নিয়ে রয়েছে নানা কৌতূহল।
মো. আনোয়ার হোসেন, লক্ষ্মীপুর সদরের কুশাখালী ইউনিয়ন থেকে মাত্র দু’দিন হলো ঢাকায় এসেছেন। উদ্দেশ্য চাকরি। গত মঙ্গলবার রাত দশটার দিকে প্রথমবারের মতো ঢাকায় নামেন তিনি। লক্ষ্মীপুর থেকে সিএনজি অটোরিকশায় চাঁদপুর। সেখান থেকে লঞ্চে সদরঘাট। এই ছিল আনোয়ার হোসেনের প্রথম ঢাকা যাত্রার রুট। লক্ষ্মীপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে এখন চাকরির সন্ধানে রাজধানীতে।
আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে বুধবার কথা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি গেটে। কেন ঢাকা এলেন- এমন প্রশ্নে আনোয়ারের সহজ স্বীকারোক্তি, চাকরি-বাকরির জন্য তো ঢাকায় আসা লাগবে। একটা ভালো কোনো চাকরির জন্য ঢাকা ছাড়া গতি নেই। বাবা-মা, চার ভাই আর এক বোন রয়েছে আনোয়ারের। নিজে এখনো বিয়ে করেন নি। পরিবারের সবার চাওয়া তিনি ঢাকায় একটা ভালো চাকরি করবেন। আপাতত থাকছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে, সেখান থেকেই চাকরির জন্য চেষ্টা-তদবির করছেন। সিভিও বানিয়েছেন, চাকরির ভাইভা দিতে আলাদা পোশাক বানিয়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এখন শুধু একটা ফোনের অপেক্ষা। চাকরির ভাইভার ফোন! যা বদলে দেবে আনোয়ার হোসেনের জীবন। জীবিকার টানেই মূলত আনোয়ারের মতো অসংখ্য মানুষ জেলা শহরগুলো থেকে ঢাকা আসছেন।
ভাগ্য অন্বেষণে দক্ষিণের আরেকটি জেলা থেকে গত রোববার রাতে ঢাকায় এসেছেন আল-আমিন। বাসে ঢাকা আসার খরচ বেশি বলে টাকা বাঁচাতে তিনিও এসেছেন লঞ্চে। উঠেছেন ফকিরাপুল পানির টাঙ্কি এলাকায় খালার বাসায়। এসএমএস নামে একটি লেদার অ্যান্ড প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন। খালি হাতেই প্রক্রিয়াজাত করা চামড়া কাটতে হয় তাকে। এ ছাড়া ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চামড়াজাত পণ্য পৌঁছে দিতে হয়।
ফকিরাপুল এলাকায় আল-আমিনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে অফিস থেকে জরুরি ফোন আসে তার। পণ্য পৌঁছে দিতে তাকে যেতে হবে গাজীপুর টঙ্গী এলাকায়। এ যাত্রায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মুঠোফোন নম্বর চাইলাম আল-আমিনের। পরে রাতে কল দিলেও ধরেন না তিনি। কিছুক্ষণ পর একটি ক্ষুদেবার্তায় জানালেন, মুঠোফোনের স্পিকার নষ্ট। নতুন একটা হেডফোন না কেনা পর্যন্ত ফোনে কথা বলতে পারবেন না। আর্থিক সংকটে আছেন। পরে তার পরিচিত আরেক ভাইয়ের মাধ্যমে কথা হয় আল-আমিনের সঙ্গে। পাঁচজনের পরিবারে তিনিই সবার বড়। চাকরির আশায় দু’বার বিদেশে যাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বাবা আব্দুল হান্নান তিন মাস আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। তাকে দেখভাল ও আর ওষুধ কেনায় খরচ হয়ে যায় অনেক টাকা। এক মাস আগে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন আল-আমিনের মা। তিনিও বেশ অসুস্থ। টানাপড়েনের সংসার টিকিয়ে রাখতে আল-আমিন শেষমেশ ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত নেন।
এসএসসির গণ্ডি পেরোনো ২২ বছরের তরুণের কাঁধেই এখন পুরো পরিবারের ভার। ঢাকায় আসার প্রথম দুইদিন অঝোরে কেঁদেছেন তিনি। ঢাকার অলিগলি কোনো কিছুই চেনেন না। ভরাট গলায় আল-আমিন বলেন, কোথাও প্রডাক্ট ডেলিভারি দিতে গেলেও লোকজনকে জিজ্ঞেস করে যেতে হয়। মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে লেদার পৌঁছে দিয়ে আসা লাগে। বেশ খাটুনির কাজে মাস শেষে মাত্র আট হাজার টাকা বেতন পাবার কথা। ঢাকায় কাজ করা অনেক কষ্টের, আমি গ্রামেই ভালো ছিলাম। নিরুপায় হয়েই ঢাকা আসা। পরিবারের মুখগুলোর কথা ভেসে উঠে বার বার, বিশেষ করে দুই ছোটবোনকে। এসএসসির পর আর বেশিদূর পড়াশুনা না করায় এমন দুর্গতি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন আল-আমিন। তবে এখানেই দমে যেতে চান না। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন। বলেন, যে করেই হোক ঢাকায় টিকে থাকতে হবেই। দাঁড়াতে হবে পরিবারের পাশে।
দুই সপ্তাহ হলো প্রবাস জীবন ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন চুয়াডাঙ্গার সোহেল শেখ। পরিবারের তিন ভাই সবাই থাকতেন সৌদি আরবে। আয়-উন্নতির আশায় দুই বছর আগে তিনিও সৌদিতে পাড়ি জমান। সেখানে কনফেকশনারি দোকানে কাজ করতেন সোহেল। ব্যবসায় মন্দা যাওয়ায় সৌদি আরব থেকে দুই ভাই ফিরে আসেন বাংলাদেশে। ঢাকার পান্থপথের একটি মেস বাসায় উঠেছেন সোহেল শেখ। এখানে থেকে ব্যবসা করার চেষ্টা করবেন তিনি। জানান, সৌদিতে অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে তেমন উন্নতি নেই কারো। বরং খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। এর চেয়ে ঢাকায় থেকে ব্যবসার চেষ্টা করাটাকে ভালো মনে করছেন তিনি। এরমধ্যে কয়েক জায়গায় কথাও বলেছেন।
মনঃপূত হলেই ব্যবসায় পুরোদমে নেমে পড়বেন। তার ভাষায়, সৌদি আরব থেকে ঢাকাই ভালো। এক সপ্তাহ আগেই ঢাকায় আসেন টাঙ্গাইলের বাবু। নিজের জেলায় কাজের সুযোগ না মেলায় পাড়ি জমান ঢাকার উদ্দেশে। তার আগে, কথা বলে নেন ঢাকার একটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে। বইমেলার কারণে প্রকাশনীর কাজের চাপ বাড়ায় তাদের বাংলাবাজার অফিসে যোগ দেন বাবু। থাকছেন পুরান ঢাকায়। এর আগে কখনো ঢাকা আসেন নি তিনি। একেবারে জীবিকার তাগিদেই প্রথমবারের মতো ঢাকা আগমন তার। মাঝে মাঝে বাড়ির কথা মনে করে খারাপ লাগলেও ঢাকাতেই স্থায়ীভাবে থাকতে চান বাবু।
এত গেল জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসা মানুষের কথা। উচ্চ শিক্ষা আর নিজের ইচ্ছে পূরণ করতেও রাজধানীতে আসছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসছেন বেশির ভাগ। টাঙ্গাইলের পুটিয়াজানি এলাকা থেকে দুই সপ্তাহ হলো ঢাকা এসেছেন দুই খালাতো বোন নুসরাত জাহান খান নিঝুম ও মানজুর আলম স্বর্ণা। দু’জনেই থাকছেন মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদ পুলপাড় এলাকায়। মালয়েশিয়া প্রবাসী বাবা ও স্কুলশিক্ষক মায়ের পরিবারে একমাত্র সন্তান নিঝুম। ছোটবেলা থেকেই ইংরেজির শিক্ষক হবার স্বপ্ন। নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে ভর্তি হয়েছেন ধানমণিণ্ডর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। এর আগে, দু’একবার ঢাকা আসা হলেও থাকতেন আত্মীয়দের বাসায়। এবারই প্রথম নিজের মতো করে আবাস গড়েছেন।
শিক্ষক হওয়ার বাসনা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত থাকতে চান জাদুর শহরে। মাঝে মাঝে মায়ের জন্য মন খারাপ হয় নিঝুমের। কিন্তু শিক্ষক হতে গেলে তো কষ্ট করতে হবেই, এমন সান্ত্বনায় বুক বাঁধেন আশায়। ঢাকার যানজট খারাপ লাগে তার। চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে সপ্তাহ দুয়েক হলো ঢাকায় এসেছেন ইজমো আহমেদ ও আবুজার গিফারী। দুজনই স্নাতকে ভর্তি হয়েছেন তিতুমীর কলেজে। থাকছেন ঢাকার পান্থপথ এলাকায়। পরিবার ছেড়ে এতদূর আসার কারণও একটাই। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করা, পড়াশোনা শেষে পরিবারের দায়িত্ব নিতে চান এই দুই তরুণ। ডা. নাজমুল হাসান সবে ঢাকা এসেছেন সপ্তাহখানেক হলো।
এমবিবিএসের পাঠ চুকিয়েছেন বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে। কুমিল্লার দেবিদ্বার এলাকার ছেলে নাজমুল অবশ্য এর আগেও ঢাকা এসেছেন। তবে এবারের উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি ভিন্ন। এমবিবিএস কোর্স শেষে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে থাকবেন ঢাকায়। এর মধ্যে শাহবাগ এলাকার একটি বাসায় উঠেছেন নাজমুল হাসান। ভর্তি হয়েছেন কোচিংয়েও। পরিবারের সদস্যদের বুকভরা আশা ছেলে একদিন নামকরা ডাক্তার হবে। রোগীরা ভিড় করবেন তার কাছে। এমন হাজারো স্বপ্নের ঝুলি নিয়ে ঢাকায় আসার পথগুলোতে প্রতিনিয়ত মানুষের স্রোত। বাসে, লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে মানুষের সঙ্গে আসে তাদের হাজারো বাসনা। ঢাকা যেন স্বপ্ন পূরণের এক কারখানা। কারো হয়, কারো হয় না।
No comments