রস রচনা: ভাড়াটের কষ্ট by আদনান মুকিত
আপনি চাইলে ঢাকা শহরের বাড়িওয়ালাদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করতে পারবেন।
১. কড়া বাড়িওয়ালা: যাঁরা ঠিক রাত ১১টায় বাড়ির গেট বন্ধ করে দেন।
২. মোটামুটি কড়া বাড়িওয়ালা: তাঁরা বাড়ির গেট বন্ধ করেন ঠিক রাত সাড়ে ১১টায়।
৩. হালকা কড়া বাড়িওয়ালা: এই শ্রেণির বাড়িওয়ালারা গেট বন্ধ করেন রাত ১২টায়।
এই তিন শ্রেণির বাইরেও কেউ কেউ আছেন, তবে তাঁরা বাড়িওয়ালা নন। আপনার–আমার মতোই সাধারণ মানুষ। আপনি হয়তো এই শ্রেণিবিভাগের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন (আর যদি বাড়িওয়ালা হয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে ‘কী সব লেখে’ বলে পত্রিকা গুটিয়ে ফেলেছেন)। আসলে কুঁচকানো ছাড়া ভ্রু দুটির তেমন কোনো কাজ নেই। অনেকে পুরো মাথা ন্যাড়া করে ফেলে, কিন্তু রেখে দেয় ভ্রু দুটি। ভ্রু ছাড়া বিরক্তি প্রকাশ করবে কী করে?
আমরা যারা ভাড়া থাকি, সাধারণত তাদের প্রতি ভ্রু কুঁচকে তাকান দুজন। বাড়ির দারোয়ান ও স্বয়ং বাড়িওয়ালা। নিম্নলিখিত কারণে দারোয়ানের কুঁচকানো ভ্রু দেখার সৌভাগ্য অর্জন করবেন আপনি—
খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হলে।
কোনো কারণে ভারী মেইন গেটটা খুলতে হলে (যেমন আপনি ফ্রিজ বা আলমারি কিনে এনেছেন, গেট খুলতে হবে। দারোয়ানকে খুঁজেই পাবেন না। আর পেলেও ‘চাবি লইয়া আইতাসি’ বলে কোথায় যেন হারিয়ে যাবেন তিনি)।
আপনার কোনো অতিথি এলে (এসব ক্ষেত্রে অতিথি যখন আপনার নাম বলেন, তখন না চেনার ভান করেন দারোয়ান)।
সেই অতিথি চলে যাওয়ার সময়।
এবং রাতে নির্ধারিত সময়ের পর বাড়িতে এলে।
সবগুলো বিরক্তি প্রকাশই নিশ্চয়ই যৌক্তিক। নইলে আমরা এত দিন ধরে মেনে নিচ্ছি কেন (নিচ্ছি কারণ আমরা ভাড়াটে)? বিস্ময়কর হলো, নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট পর এলেই আপনি খেয়াল করবেন, দারোয়ান ঘুমিয়ে গেছেন। যেন গেট বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখও বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের। শুধু আমি না, চোরও দুবার এসে আমার বারান্দা থেকে কাপড়চোপড় চুরি করে নিয়ে গেছে। কিন্তু দারোয়ানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে পারেনি, কারণ তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন।
পরদিন সকালে ভ্রু কুঁচকে দারোয়ান বলেছিলেন, ‘কাপড়চোপড় রাইতে ঘরে ঢুকায় রাখবেন না? দিনকাল খারাপ!’
বাড়িওয়ালার ভ্রু কুঁচকানোর কথা আলাদা করে বলা কঠিন। সবকিছুতেই ভ্রু কুঁচকানোর বিস্ময়কর ক্ষমতা তাঁদের। ব্যাচেলর, বিবাহিত, তরুণ, কিশোর যা-ই হন, বাড়িওয়ালা শুধু ভ্রু কুঁচকে তাকাবেন। আপনি আমার কথাটা উড়িয়ে দিচ্ছেন তো? একটা উদাহরণ দিলে ঠিকই একমত হবেন আশা করি।
একবার গুনগুন করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা। ভদ্রলোক ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘এই একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি।’
‘যান। হাঁটাহাঁটি করা খুব ভালো। তবে, কোনো কমপ্লেন যেন না আসে।...আপনার ভাড়াটে আমার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করে—এই টাইপ আরকি।’
‘না না। কী বলেন!’
‘গুড। আর সিঁড়ি দিয়ে একটু আস্তে ওঠা–নামা করবেন। এমনভাবে হাঁটবেন, যেন শব্দ না হয়। অনেকে বিরক্ত হতে পারে, তাই না? অন্যভাবে নেবেন না, আপনি ছোট ভাইয়ের মতো, তাই বললাম।’
‘জি, ঠিক আছে।’
সিঁড়িতে নতুন টাইলস বসিয়েছেন, সে জন্য বোধ হয় এই চিন্তা। মানুষের প্রতি মায়া থাক না থাক, টাইলসের প্রতি তো আছে। সেটাইবা কজনের থাকে? সেদিন থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে ওঠা–নামার অনুশীলন শুরু করলাম। কঠিন কিছু তো না। তা ছাড়া সিঁড়িতে কারও পায়ের শব্দ শুনলে আমারও বিরক্ত লাগে। তো নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, হঠাৎ আবার দেখা বাড়িওয়ালার সঙ্গে। দেখামাত্র ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। কিন্তু কিছুই বললেন না। পরদিন মা ডেকে বললেন, ‘কিরে, তুই নাকি পা টিপে টিপে সন্দেহজনকভাবে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলি? ব্যাপার কী? কী করেছিস? তোদের জন্য তো সমাজে মুখ দেখানো যাবে না!’
এই হলো ব্যাপার। মাসের প্রথম সপ্তাহটা ছাড়া বাকি সব দিনই ভ্রু কুঁচকে থাকে বাড়িওয়ালাদের। কারণ, প্রথম সপ্তাহেই ভাড়াটা আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের হাতে তুলে দিই আমরা।
বাড়িওয়ালারা সাধারণ মানুষ নন। ঢাকা শহরের মতো একটা জায়গায় যাঁর পাঁচ–দশতলা বাড়ি, তাঁকে সাধারণের কাতারে ফেলব—এত সাহস আমার নেই। সাধারণ মানুষ হলে গেট বন্ধ করা নিয়ে আরেকটু চিন্তাভাবনা তাঁরা করতেন নিশ্চয়ই। যে শহরে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুর যেতে কতক্ষণ লাগবে, সেখানে রাত ১১টায় বাড়ির দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিতে কঠোর হওয়া লাগে। শুধু তালা নয়, অনেকে তো সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে দেন বাড়ির দরজায়, ‘রাত ১১টার পর থেকে গেট বন্ধ—আদেশক্রমে বাড়িওয়ালা।’ ধরুন, গভীর রাতে ভূমিকম্প হলো, দ্রুত বাড়ি থেকে বের হতে হবে, তাই না? কিন্তু পারবেন না। গেট তো বন্ধ। ভূমিকম্প হলে প্রথমে যেতে হবে বাড়িওয়ালার কাছে (সাধারণত তাঁরা ভূমিকম্প টের পান না, দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন তো, ঘুম হয় গাঢ়)। চাবি খুঁজে সবাইকে নিয়ে তিনি যখন গেট খুলবেন, ততক্ষণে ভূমিকম্প শেষ, ভাগ্য খারাপ থাকলে আপনিও। আমার ধারণা, ঢাকার বাসায় ভাড়া থাকলে কবির সুমন গাইতেন, ‘কতটা কঠোর হলে তারে বাড়িওয়ালা বলা যায়...।’
শহরে এমন অসংখ্য দুর্ভাগা আছেন, যাঁরা সপ্তাহে অন্তত তিন দিন অফিস থেকে ৯টা–১০টার আগে বেরোতে পারেন না। অনেকের বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব বস থেকে কর্মচারীর দূরত্বের সমানুপাতিক। তার মধ্যে অফিস থেকে বেরিয়ে কতক্ষণ পর বাহন পাবেন, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অবস্থায় প্রতিটি ভাড়াটে চাকরিজীবীর মাথায় একটা ভয়ংকর চাপ, ‘গেট লাগায় দিবে ভাই।’
কদিন আগে পাঠাও বাইকে করে বাড়ি ফিরছি। রাত পৌনে ১১টা, তবু ভয়ংকর জ্যাম। রাইডার করুণ মুখে বললেন, ‘ভাই, কিছু মনে না করলে আপনি আরেকটা বাইকে চলে যাবেন? আমাকে টাকা দেওয়া লাগবে না। বাসার গেট আটকায় দিবে সাড়ে ১১টায়। আমি পৌঁছাতে পারব না ভাই, প্লিজ।’
তাঁর কষ্টটা বুঝে ওই জ্যামের মধ্যেই নেমে গেলাম। ভদ্রলোক গেট খোলা পেয়েছিলেন কি না, জানি না, তবে আমি পাইনি। ফোন করে বাড়িওয়ালার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলাম। তালা খুলে ‘ওয়ার্নিং’ দিতে ভুলে যাননি তিনি। তবু আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ আমি ভাড়াটে। তিনি এসে তালা খুলে না দিলে রাস্তায় বসে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ ধরনের গান গাওয়া ছাড়া কীই–বা করতাম আমি?
তবে একটা ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটেছিল কদিন আগে। সে রাতেও আমি দেরি করে ফেলেছি। বাস থেকে নেমেই ছুটছিলাম বাড়ির দিকে। এলাকার মার্কেটটা পেরোতেই শুনি পাশের কলাপসিবল গেটে ধাক্কা দিচ্ছে কে যেন। গিয়ে দেখি সেই চেনা মুখ! আমাদের বাড়িওয়ালা! ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাকে যেন ফোন দিচ্ছেন বারবার। এই মার্কেটের শেষ মাথায় কিসের যেন একটা অফিস আছে তাঁর। চিন্তিত মুখে তিনি বললেন, ‘দেখো তো, পাশের দোকানটা খোলা আছে না? ওখানে জলিল নামে একজন আছে। ওকে একটু ডাকো।’
‘কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘না, মানে অফিসে কাজের মধ্যে ছিলাম, ওরা ভেবেছে আমি চলে গেছি। গাধাটা গেটে তালা দিয়ে দিয়েছে।’
আরেকটি ছুটির ঘণ্টা কেস। পাশের দোকানে গিয়ে দেখি এক বৃদ্ধ শাটার নামাচ্ছেন। জলিল কোথায় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘হ্যায় তো গেসেগা।’ দ্রুত বাড়িওয়ালাকে জানালাম সে কথা, ‘আংকেল, জলিল তো নাই।’
‘নাই মানে?’ চমকে উঠলেন বাড়িওয়ালা।
‘দোকানের বৃদ্ধ আংকেল বলল, উনি চলে গেছেন।’
বাড়িওয়ালার মুখে উদ্বেগের ছাপ, ‘ওই বুড়াকে আমার কথা বলো। বলো যে আমি মানে মকবুল সাহেব (বাড়িওয়ালার নাম) বের হবেন। চাবিটা নিয়ে আসতে।’
‘জি’ বলেই আমি আবার গেলাম সেই দোকানে। বৃদ্ধকে বললাম। বৃদ্ধ আরও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘জলিল তো চাবি দিয়া যায় নাই।’
‘হায় হায়! এ তো “চাবি মাইরা দিসে ছাইড়া” টাইপ অবস্থা!’
আবার কলাপসিবল গেটের কাছে ছুটে গিয়ে দেখি অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারী করছেন বাড়িওয়ালা। বললাম, ‘আংকেল, জলিল ভাই তো চাবি নিয়ে চলে গেছেন।’
বাড়িওয়ালা অসহায় হয়ে বললেন, ‘হায় হায়! কী বলো! বের হব কী করে? ছাগলটা তো ফোনও ধরছে না।’ একটু পর পাশের দোকানের বৃদ্ধ এসে বললেন, ‘কলা–রুটি কিছু দিয়া যামু, স্যার? সারা রাইত না খাইয়া থাকবেন কেমনে?’
বাড়িওয়ালা ধমকে বিদায় করে দিলেন বৃদ্ধকে। আমিও চলে যাচ্ছিলাম, ভদ্রলোক বললেন, ‘ইয়ে, তুমি একটু থাকো না, মানে জলিলের বাসা তো কাছেই। ও চলে আসবে।’
‘কিন্তু আংকেল, সাড়ে ১১টা তো বেজে গেছে, গেট তো বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘আরে না না। আমি ফোন করে দিয়েছি তো। কোনো সমস্যা হবে না। আর ইয়াংম্যান, এখনই তো রাত করে বাসায় ফেরার বয়স...ইয়ে, তুমি একটু জলিলের নম্বরে কল দেবে? আমারটা ধরছে না।’
আমি খুব চাচ্ছিলাম চলে যেতে। তালা–চাবির চক্করে পড়লে কেমন লাগে, তা বুঝুক বাড়িওয়ালা। কিন্তু তবু আমি বাড়িওয়ালাকে ছেড়ে গেলাম না। কারণ ওই যে, আমি তো ভাড়াটে।
১. কড়া বাড়িওয়ালা: যাঁরা ঠিক রাত ১১টায় বাড়ির গেট বন্ধ করে দেন।
২. মোটামুটি কড়া বাড়িওয়ালা: তাঁরা বাড়ির গেট বন্ধ করেন ঠিক রাত সাড়ে ১১টায়।
৩. হালকা কড়া বাড়িওয়ালা: এই শ্রেণির বাড়িওয়ালারা গেট বন্ধ করেন রাত ১২টায়।
এই তিন শ্রেণির বাইরেও কেউ কেউ আছেন, তবে তাঁরা বাড়িওয়ালা নন। আপনার–আমার মতোই সাধারণ মানুষ। আপনি হয়তো এই শ্রেণিবিভাগের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন (আর যদি বাড়িওয়ালা হয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে ‘কী সব লেখে’ বলে পত্রিকা গুটিয়ে ফেলেছেন)। আসলে কুঁচকানো ছাড়া ভ্রু দুটির তেমন কোনো কাজ নেই। অনেকে পুরো মাথা ন্যাড়া করে ফেলে, কিন্তু রেখে দেয় ভ্রু দুটি। ভ্রু ছাড়া বিরক্তি প্রকাশ করবে কী করে?
আমরা যারা ভাড়া থাকি, সাধারণত তাদের প্রতি ভ্রু কুঁচকে তাকান দুজন। বাড়ির দারোয়ান ও স্বয়ং বাড়িওয়ালা। নিম্নলিখিত কারণে দারোয়ানের কুঁচকানো ভ্রু দেখার সৌভাগ্য অর্জন করবেন আপনি—
খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হলে।
কোনো কারণে ভারী মেইন গেটটা খুলতে হলে (যেমন আপনি ফ্রিজ বা আলমারি কিনে এনেছেন, গেট খুলতে হবে। দারোয়ানকে খুঁজেই পাবেন না। আর পেলেও ‘চাবি লইয়া আইতাসি’ বলে কোথায় যেন হারিয়ে যাবেন তিনি)।
আপনার কোনো অতিথি এলে (এসব ক্ষেত্রে অতিথি যখন আপনার নাম বলেন, তখন না চেনার ভান করেন দারোয়ান)।
সেই অতিথি চলে যাওয়ার সময়।
এবং রাতে নির্ধারিত সময়ের পর বাড়িতে এলে।
সবগুলো বিরক্তি প্রকাশই নিশ্চয়ই যৌক্তিক। নইলে আমরা এত দিন ধরে মেনে নিচ্ছি কেন (নিচ্ছি কারণ আমরা ভাড়াটে)? বিস্ময়কর হলো, নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট পর এলেই আপনি খেয়াল করবেন, দারোয়ান ঘুমিয়ে গেছেন। যেন গেট বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখও বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের। শুধু আমি না, চোরও দুবার এসে আমার বারান্দা থেকে কাপড়চোপড় চুরি করে নিয়ে গেছে। কিন্তু দারোয়ানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে পারেনি, কারণ তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন।
পরদিন সকালে ভ্রু কুঁচকে দারোয়ান বলেছিলেন, ‘কাপড়চোপড় রাইতে ঘরে ঢুকায় রাখবেন না? দিনকাল খারাপ!’
বাড়িওয়ালার ভ্রু কুঁচকানোর কথা আলাদা করে বলা কঠিন। সবকিছুতেই ভ্রু কুঁচকানোর বিস্ময়কর ক্ষমতা তাঁদের। ব্যাচেলর, বিবাহিত, তরুণ, কিশোর যা-ই হন, বাড়িওয়ালা শুধু ভ্রু কুঁচকে তাকাবেন। আপনি আমার কথাটা উড়িয়ে দিচ্ছেন তো? একটা উদাহরণ দিলে ঠিকই একমত হবেন আশা করি।
একবার গুনগুন করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা। ভদ্রলোক ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘এই একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি।’
‘যান। হাঁটাহাঁটি করা খুব ভালো। তবে, কোনো কমপ্লেন যেন না আসে।...আপনার ভাড়াটে আমার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করে—এই টাইপ আরকি।’
‘না না। কী বলেন!’
‘গুড। আর সিঁড়ি দিয়ে একটু আস্তে ওঠা–নামা করবেন। এমনভাবে হাঁটবেন, যেন শব্দ না হয়। অনেকে বিরক্ত হতে পারে, তাই না? অন্যভাবে নেবেন না, আপনি ছোট ভাইয়ের মতো, তাই বললাম।’
‘জি, ঠিক আছে।’
সিঁড়িতে নতুন টাইলস বসিয়েছেন, সে জন্য বোধ হয় এই চিন্তা। মানুষের প্রতি মায়া থাক না থাক, টাইলসের প্রতি তো আছে। সেটাইবা কজনের থাকে? সেদিন থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে ওঠা–নামার অনুশীলন শুরু করলাম। কঠিন কিছু তো না। তা ছাড়া সিঁড়িতে কারও পায়ের শব্দ শুনলে আমারও বিরক্ত লাগে। তো নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, হঠাৎ আবার দেখা বাড়িওয়ালার সঙ্গে। দেখামাত্র ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। কিন্তু কিছুই বললেন না। পরদিন মা ডেকে বললেন, ‘কিরে, তুই নাকি পা টিপে টিপে সন্দেহজনকভাবে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলি? ব্যাপার কী? কী করেছিস? তোদের জন্য তো সমাজে মুখ দেখানো যাবে না!’
এই হলো ব্যাপার। মাসের প্রথম সপ্তাহটা ছাড়া বাকি সব দিনই ভ্রু কুঁচকে থাকে বাড়িওয়ালাদের। কারণ, প্রথম সপ্তাহেই ভাড়াটা আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের হাতে তুলে দিই আমরা।
বাড়িওয়ালারা সাধারণ মানুষ নন। ঢাকা শহরের মতো একটা জায়গায় যাঁর পাঁচ–দশতলা বাড়ি, তাঁকে সাধারণের কাতারে ফেলব—এত সাহস আমার নেই। সাধারণ মানুষ হলে গেট বন্ধ করা নিয়ে আরেকটু চিন্তাভাবনা তাঁরা করতেন নিশ্চয়ই। যে শহরে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুর যেতে কতক্ষণ লাগবে, সেখানে রাত ১১টায় বাড়ির দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিতে কঠোর হওয়া লাগে। শুধু তালা নয়, অনেকে তো সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে দেন বাড়ির দরজায়, ‘রাত ১১টার পর থেকে গেট বন্ধ—আদেশক্রমে বাড়িওয়ালা।’ ধরুন, গভীর রাতে ভূমিকম্প হলো, দ্রুত বাড়ি থেকে বের হতে হবে, তাই না? কিন্তু পারবেন না। গেট তো বন্ধ। ভূমিকম্প হলে প্রথমে যেতে হবে বাড়িওয়ালার কাছে (সাধারণত তাঁরা ভূমিকম্প টের পান না, দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন তো, ঘুম হয় গাঢ়)। চাবি খুঁজে সবাইকে নিয়ে তিনি যখন গেট খুলবেন, ততক্ষণে ভূমিকম্প শেষ, ভাগ্য খারাপ থাকলে আপনিও। আমার ধারণা, ঢাকার বাসায় ভাড়া থাকলে কবির সুমন গাইতেন, ‘কতটা কঠোর হলে তারে বাড়িওয়ালা বলা যায়...।’
শহরে এমন অসংখ্য দুর্ভাগা আছেন, যাঁরা সপ্তাহে অন্তত তিন দিন অফিস থেকে ৯টা–১০টার আগে বেরোতে পারেন না। অনেকের বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব বস থেকে কর্মচারীর দূরত্বের সমানুপাতিক। তার মধ্যে অফিস থেকে বেরিয়ে কতক্ষণ পর বাহন পাবেন, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অবস্থায় প্রতিটি ভাড়াটে চাকরিজীবীর মাথায় একটা ভয়ংকর চাপ, ‘গেট লাগায় দিবে ভাই।’
কদিন আগে পাঠাও বাইকে করে বাড়ি ফিরছি। রাত পৌনে ১১টা, তবু ভয়ংকর জ্যাম। রাইডার করুণ মুখে বললেন, ‘ভাই, কিছু মনে না করলে আপনি আরেকটা বাইকে চলে যাবেন? আমাকে টাকা দেওয়া লাগবে না। বাসার গেট আটকায় দিবে সাড়ে ১১টায়। আমি পৌঁছাতে পারব না ভাই, প্লিজ।’
তাঁর কষ্টটা বুঝে ওই জ্যামের মধ্যেই নেমে গেলাম। ভদ্রলোক গেট খোলা পেয়েছিলেন কি না, জানি না, তবে আমি পাইনি। ফোন করে বাড়িওয়ালার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলাম। তালা খুলে ‘ওয়ার্নিং’ দিতে ভুলে যাননি তিনি। তবু আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ আমি ভাড়াটে। তিনি এসে তালা খুলে না দিলে রাস্তায় বসে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ ধরনের গান গাওয়া ছাড়া কীই–বা করতাম আমি?
তবে একটা ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটেছিল কদিন আগে। সে রাতেও আমি দেরি করে ফেলেছি। বাস থেকে নেমেই ছুটছিলাম বাড়ির দিকে। এলাকার মার্কেটটা পেরোতেই শুনি পাশের কলাপসিবল গেটে ধাক্কা দিচ্ছে কে যেন। গিয়ে দেখি সেই চেনা মুখ! আমাদের বাড়িওয়ালা! ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাকে যেন ফোন দিচ্ছেন বারবার। এই মার্কেটের শেষ মাথায় কিসের যেন একটা অফিস আছে তাঁর। চিন্তিত মুখে তিনি বললেন, ‘দেখো তো, পাশের দোকানটা খোলা আছে না? ওখানে জলিল নামে একজন আছে। ওকে একটু ডাকো।’
‘কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘না, মানে অফিসে কাজের মধ্যে ছিলাম, ওরা ভেবেছে আমি চলে গেছি। গাধাটা গেটে তালা দিয়ে দিয়েছে।’
আরেকটি ছুটির ঘণ্টা কেস। পাশের দোকানে গিয়ে দেখি এক বৃদ্ধ শাটার নামাচ্ছেন। জলিল কোথায় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘হ্যায় তো গেসেগা।’ দ্রুত বাড়িওয়ালাকে জানালাম সে কথা, ‘আংকেল, জলিল তো নাই।’
‘নাই মানে?’ চমকে উঠলেন বাড়িওয়ালা।
‘দোকানের বৃদ্ধ আংকেল বলল, উনি চলে গেছেন।’
বাড়িওয়ালার মুখে উদ্বেগের ছাপ, ‘ওই বুড়াকে আমার কথা বলো। বলো যে আমি মানে মকবুল সাহেব (বাড়িওয়ালার নাম) বের হবেন। চাবিটা নিয়ে আসতে।’
‘জি’ বলেই আমি আবার গেলাম সেই দোকানে। বৃদ্ধকে বললাম। বৃদ্ধ আরও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘জলিল তো চাবি দিয়া যায় নাই।’
‘হায় হায়! এ তো “চাবি মাইরা দিসে ছাইড়া” টাইপ অবস্থা!’
আবার কলাপসিবল গেটের কাছে ছুটে গিয়ে দেখি অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারী করছেন বাড়িওয়ালা। বললাম, ‘আংকেল, জলিল ভাই তো চাবি নিয়ে চলে গেছেন।’
বাড়িওয়ালা অসহায় হয়ে বললেন, ‘হায় হায়! কী বলো! বের হব কী করে? ছাগলটা তো ফোনও ধরছে না।’ একটু পর পাশের দোকানের বৃদ্ধ এসে বললেন, ‘কলা–রুটি কিছু দিয়া যামু, স্যার? সারা রাইত না খাইয়া থাকবেন কেমনে?’
বাড়িওয়ালা ধমকে বিদায় করে দিলেন বৃদ্ধকে। আমিও চলে যাচ্ছিলাম, ভদ্রলোক বললেন, ‘ইয়ে, তুমি একটু থাকো না, মানে জলিলের বাসা তো কাছেই। ও চলে আসবে।’
‘কিন্তু আংকেল, সাড়ে ১১টা তো বেজে গেছে, গেট তো বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘আরে না না। আমি ফোন করে দিয়েছি তো। কোনো সমস্যা হবে না। আর ইয়াংম্যান, এখনই তো রাত করে বাসায় ফেরার বয়স...ইয়ে, তুমি একটু জলিলের নম্বরে কল দেবে? আমারটা ধরছে না।’
আমি খুব চাচ্ছিলাম চলে যেতে। তালা–চাবির চক্করে পড়লে কেমন লাগে, তা বুঝুক বাড়িওয়ালা। কিন্তু তবু আমি বাড়িওয়ালাকে ছেড়ে গেলাম না। কারণ ওই যে, আমি তো ভাড়াটে।
No comments