বৃহত্তর ঐক্যের পরীক্ষায় বিএনপি by সালমান তারেক শাকিল ও আদিত্য রিমন
আগামী
নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে প্রথমবারের মতো
দৃশ্যমান পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে বিএনপি। বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে সমন্বয় করে
দেশের স্বার্থরক্ষা এবং দল ও ২০ দলীয় জোটের স্বার্থ রক্ষা করে অভ্যন্তরীণ
রাজনীতিতে বৃহত্তর ঐক্য বাস্তবায়ন করাই এখন দলটির বর্তমান নেতৃত্বের মূল
চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্য নিয়ে আগামীকাল শনিবার (২২ সেপ্টেম্বর) ড. কামাল
হোসেনের ডাকা নাগরিক সমাবেশে যোগ দেবে বিএনপির প্রতিনিধি। শুক্রবারও (২১
সেপ্টেম্বর) বৃহত্তর ঐক্যকে আরও বেগবান করতে বিকল্প ধারার সভাপতি বি
চৌধুরীর বাসায় গিয়ে ফের ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে এসেছেন দলটির তিন জন নীতি
নির্ধারক। একইসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া হয়েছে একটি চিঠি, যেখানে
রয়েছে বিএনপির দাবি ও দফাগুলো।
এদিকে, প্রথমবারের মতো দেশের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন রাজনীতিক শনিবার সরকারবিরোধী এই সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন। এদিন বিকালে মহানগর নাট্যমঞ্চে নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে। ইতোমধ্যে প্রধান অতিথি হিসেবে সমাবেশে উপস্থিত হতে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী সম্মতি জানিয়েছেন। সমাবেশে অংশ নেবে বিএনপির একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তবে বামদলগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জোটগতভাবে এই সমাবেশে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার। তবে কোনও কোনও বাম দলের এককভাবে সংহতি জানাতে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
পরীক্ষায় বিএনপি
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, বিগত প্রায় আট মাস ধরে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু করার তাগিদে একটি বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ড. কামাল হোসেন ও বি চৌধুরীর ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে এর একটি প্রাথমিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শনিবার এই প্রক্রিয়া বৃহত্তর ঐক্যের দিকে যাত্রা শুরু করবে।
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার সমাবেশ থেকে কোনও কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না। যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার সম্মিলিত ৫ দফা ও ৯ লক্ষ্যকেই সামনে রাখা হবে। এক্ষেত্রে সমাবেশ থেকে আবারও সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতিনিধিরা নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার দাবিগুলো বক্তব্যে আসবে।
যুক্তফ্রন্ট সূত্র বলছে, শনিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সমাবেশের পর একমঞ্চে আসা সবগুলো দলের মধ্যে সমন্বিতভাবে আলোচনা শুরু করে দ্রুত বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। ইতোমধ্যে বিএনপির তরফে ড. কামাল হোসেনকে নেতৃত্বে রেখে সামনে আগানোর সিদ্ধান্ত হলেও দলের অধিকাংশ নেতা তা নাকচ করে দিয়েছেন। তারা বলছেন, জোটগত আন্দোলন সুনির্দিষ্ট কোনও নেতার অধীনে হয় না।
যুক্তফ্রন্ট-জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার অন্যতম নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমেই আপাতত জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা হচ্ছে। নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান বি. চৌধুরী এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন রয়েছেন। শনিবারের নাগরিক সমাবেশে তারা যোগ দেবেন। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুশাসনের জন্য বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। হয়তো এ মাসেই তা চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, ঐক্য প্রক্রিয়াকে বৃহত্তর অবয়ব দিতে বিএনপির ছাড় দেওয়ার কোনও বিকল্প নেই। শনিবারের সমাবেশ থেকে সুনির্দিষ্ট যৌথ কর্মসূচি বা দাবি উত্থাপিত না হলেও প্রক্রিয়াটি কার্যকর করতে বিএনপিকেই সর্বোচ্চ ছাড় দিতে হবে। এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে দলটিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মতি মিলেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর ইচ্ছা বা চাহিদার সঙ্গে দেশি স্বার্থের সম্মিলন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি দল ও ২০ দলীয় জোটের স্বার্থ মাথায় রেখেই বৃহত্তর ঐক্য সফল করতে হবে। আর এই লক্ষ্যে শনিবার ড. কামাল হোসেনের ডাকে অনুষ্ঠেয় সমাবেশে যোগ দেবে বিএনপি। এই সমাবেশে আসা ব্যক্তিদের উপস্থিতি ও তাদের বক্তব্য ব্যাখ্যা করেই সামনের দিনের রূপকল্প তৈরি করবে দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট যেমন আছে, তেমনি আরেকটি জোট একটি প্রোগ্রাম করবে শনিবার। সে সমাবেশে যাওয়ার জন্য ২০ দলীয় জোটের অনেককেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অনেকে যাবেনও অতিথি হিসেবে। এর মানে এই নয় যে, ওখানে গিয়ে সেই জোটে যোগ দেবে। কিন্তু তাদের যে দাবি, যে লক্ষ্য, তাতে করে আমাদের দাবি ও লক্ষ্যের অনেক মিল আছে। বিএনপির দাবি, যুক্তফ্রন্ট-জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া বা বাম জোট— সবার দাবি কিন্তু কাছাকাছি ও এক। সংসদ ভেঙে দেওয়া, ইভিএম ব্যবহার না করা, সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো তো একই। কাজেই সবাই একসঙ্গে আন্দোলন করতে পারবো।’
২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘বহুদিন আগে আমাদের নেত্রী (খালেদা জিয়া) হোটেল ওয়েস্টিনের সংবাদ সম্মেলনে যে দাবিগুলো বলেছিলেন, সেই দাবিগুলো ও যুক্তিগুলো কিন্তু সবার কণ্ঠেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফলে, আমরা যা চাই, তার সঙ্গে যদি সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তাদের সঙ্গে মিলে যুগপৎ কাজ করতে কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু শনিবার কয়েকটা দল মিলে একটি জোট হওয়ার জন্য সম্মেলন করছে। তারা প্রায় সবাইকে দাওয়াত করেছে। যাদের দাওয়াত করেছে তাদের অনেকেই যাবেন, তারা স্বাগত জানাবেন, সংহতি জানাবেন। কিন্তু এই মিটিংয়ের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ঐক্য হয়ে গেল, ব্যাপারটা তা না। চিন্তাভাবনায় বৃহত্তর ঐক্যের একটি ধারণা আসবে যে, তারা আগামী দিনে এক সঙ্গে কাজ করবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবীর খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি শুনেছি, শনিবারের সমাবেশে বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতা যেতে পারেন।’
শনিবারের সমাবেশে আসার জন্য দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রক্রিয়ার অন্যতম নেতা, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘প্রায় সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে স্বাধীনতাবিরোধীদের দাওয়াত দেওয়া হয়নি।’
গণফোরামের তথ্য ও গণমাধ্যম বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পথিক বলেন, ‘শনিবারের সমাবেশ থেকে কর্মসূচি আসার সম্ভাবনা নেই। সমাবেশে কয়েকটি বিষয়ে কথা বলা হবে। বিশিষ্টজনেরা আলোচনা করবেন, আগামী নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হবে, একসঙ্গে চলার পথ কী হবে— তা বেরিয়ে আসবে।’
নাগরিক ঐক্যের নেতা ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘শনিবার সমাবেশের পর দ্রুততার সঙ্গে চেষ্টা করা হবে ঐক্যকে একটি বড় পরিসরে সামনে এনে কর্মসূচিতে যাওয়ার।’
যাবেন ২০ দলীয় জোটের নেতারা
সমাবেশে অংশ নিতে বিএনপির মতো ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে ২০ দলীয় জোটও। জোটের শরিক নেতারা বলছেন, তারা সমাবেশে অংশ নেবেন। এবং সুযোগ পেলে দলীয় ও দেশের জনগণের হয়ে কথা বলবেন। খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, ‘আমি অসুস্থতার কারণে সমাবেশে যাবো না। তবে দলের মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যাবে।’
বিজেপির সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনের সমাবেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমি আমার দলের পক্ষ থেকে এই সমাবেশে যাবো।’
জোট নয়, দলীয়ভাবে যেতে পারেন বাম নেতারা
গণতান্ত্রিক বামজোটের নেতারা জানিয়েছেন, তারা জোটগতভাবে ড. কামাল হোসেনের সমাবেশে যাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেন ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও জোটগতভাবে তারা সেখানে যাচ্ছেন না। তবে এককভাবে কয়েকটি দলের এই সমাবেশে অংশগ্রহণ অনেকটাই নিশ্চিত।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক দল গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ফিরোজ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জোটগতভাবে যাবে না বা যাবে—এ ধরনের সিদ্ধান্ত হয়নি। যদি কেউ যায়, তাহলে আলাদা-আলাদাভাবে যাবেন। বাংলাদেশের সংকট-সংঘাত উত্তরণে ন্যূনতম জাতীয় ঐক্যমত দরকার। তার ভিত্তিতেই হয়তো বামনেতারা যাবেন।’ ফিরোজ আহমেদ এও জানান, ‘তার দলের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির সমাবেশে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
বামজোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে যাবে না। তবে জোটের কোনও দল চাইলে দলীয় উদ্যোগে যেতে পারে।’
গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু বলেন, ‘আমি এই সমাবেশে যাচ্ছি না। আমাদের জোটেরও না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে।’
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বা বিএনপি জোটের সঙ্গে রাজনীতি করবে না বাম গণতান্ত্রিক জোট। এই দুই দলের বাইরে আমাদের রাজনীতি। আমরা যতটুকু জানি ড. কামাল হোসেনের সমাবেশে বিএনপি আসবে। সুতরাং এই সমাবেশে আমরা যাচ্ছি না। এছাড়া, বাম গণতান্ত্রিক জোটের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে আগামীকাল (২২ সেপ্টেম্বর) আমাদের বিক্ষোভ সমাবেশে রয়েছে।’
এদিকে, ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শনিবার ড. কামাল হোসেনের ডাকা সমাবেশে আমরা যাচ্ছি না। আমরা তো কোনও জোটে নেই, তাই যাওয়া হবে না।’
বি চৌধুরীর বাসায় ফখরুল-মোশাররফ-মওদুদ
সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসায় দেখা করে এসেছেন বিএনপির সিনিয়র তিন নেতা। তারা হলেন— মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। শুক্রবার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকাল পাঁচটার দিকে তারা চৌধুরীর বারিধারার বাসায় যান এবং ফিরে আসেন সন্ধ্যা সাতটার কিছু আগে। বি চৌধুরীর ছেলে বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বি চৌধুরীর বাসায় যান বিএনপির তিন নেতা। তারা একটি খামে করে বিএনপির দফা ও লক্ষ্যগুলোকে বি চৌধুরীর হাতে দেন। ওই সময় বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর অব. মান্নান, যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র আরও জানায়, বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বি চৌধুরীর আলোচনা হয়েছে দুটি বিষয়ে। একটি ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি ও দ্বিতীয়টি জামায়াত প্রসঙ্গে। এ দুটি বিষয়েই আরও আলোচনা হতে পারে,এমন ইঙ্গিত মিলেছে।
এদিকে, প্রথমবারের মতো দেশের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন রাজনীতিক শনিবার সরকারবিরোধী এই সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন। এদিন বিকালে মহানগর নাট্যমঞ্চে নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে। ইতোমধ্যে প্রধান অতিথি হিসেবে সমাবেশে উপস্থিত হতে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী সম্মতি জানিয়েছেন। সমাবেশে অংশ নেবে বিএনপির একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তবে বামদলগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জোটগতভাবে এই সমাবেশে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার। তবে কোনও কোনও বাম দলের এককভাবে সংহতি জানাতে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
পরীক্ষায় বিএনপি
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, বিগত প্রায় আট মাস ধরে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু করার তাগিদে একটি বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ড. কামাল হোসেন ও বি চৌধুরীর ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে এর একটি প্রাথমিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শনিবার এই প্রক্রিয়া বৃহত্তর ঐক্যের দিকে যাত্রা শুরু করবে।
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার সমাবেশ থেকে কোনও কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না। যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার সম্মিলিত ৫ দফা ও ৯ লক্ষ্যকেই সামনে রাখা হবে। এক্ষেত্রে সমাবেশ থেকে আবারও সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতিনিধিরা নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার দাবিগুলো বক্তব্যে আসবে।
যুক্তফ্রন্ট সূত্র বলছে, শনিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সমাবেশের পর একমঞ্চে আসা সবগুলো দলের মধ্যে সমন্বিতভাবে আলোচনা শুরু করে দ্রুত বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। ইতোমধ্যে বিএনপির তরফে ড. কামাল হোসেনকে নেতৃত্বে রেখে সামনে আগানোর সিদ্ধান্ত হলেও দলের অধিকাংশ নেতা তা নাকচ করে দিয়েছেন। তারা বলছেন, জোটগত আন্দোলন সুনির্দিষ্ট কোনও নেতার অধীনে হয় না।
যুক্তফ্রন্ট-জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার অন্যতম নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমেই আপাতত জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা হচ্ছে। নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান বি. চৌধুরী এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন রয়েছেন। শনিবারের নাগরিক সমাবেশে তারা যোগ দেবেন। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুশাসনের জন্য বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। হয়তো এ মাসেই তা চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, ঐক্য প্রক্রিয়াকে বৃহত্তর অবয়ব দিতে বিএনপির ছাড় দেওয়ার কোনও বিকল্প নেই। শনিবারের সমাবেশ থেকে সুনির্দিষ্ট যৌথ কর্মসূচি বা দাবি উত্থাপিত না হলেও প্রক্রিয়াটি কার্যকর করতে বিএনপিকেই সর্বোচ্চ ছাড় দিতে হবে। এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে দলটিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মতি মিলেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর ইচ্ছা বা চাহিদার সঙ্গে দেশি স্বার্থের সম্মিলন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি দল ও ২০ দলীয় জোটের স্বার্থ মাথায় রেখেই বৃহত্তর ঐক্য সফল করতে হবে। আর এই লক্ষ্যে শনিবার ড. কামাল হোসেনের ডাকে অনুষ্ঠেয় সমাবেশে যোগ দেবে বিএনপি। এই সমাবেশে আসা ব্যক্তিদের উপস্থিতি ও তাদের বক্তব্য ব্যাখ্যা করেই সামনের দিনের রূপকল্প তৈরি করবে দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট যেমন আছে, তেমনি আরেকটি জোট একটি প্রোগ্রাম করবে শনিবার। সে সমাবেশে যাওয়ার জন্য ২০ দলীয় জোটের অনেককেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অনেকে যাবেনও অতিথি হিসেবে। এর মানে এই নয় যে, ওখানে গিয়ে সেই জোটে যোগ দেবে। কিন্তু তাদের যে দাবি, যে লক্ষ্য, তাতে করে আমাদের দাবি ও লক্ষ্যের অনেক মিল আছে। বিএনপির দাবি, যুক্তফ্রন্ট-জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া বা বাম জোট— সবার দাবি কিন্তু কাছাকাছি ও এক। সংসদ ভেঙে দেওয়া, ইভিএম ব্যবহার না করা, সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো তো একই। কাজেই সবাই একসঙ্গে আন্দোলন করতে পারবো।’
২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘বহুদিন আগে আমাদের নেত্রী (খালেদা জিয়া) হোটেল ওয়েস্টিনের সংবাদ সম্মেলনে যে দাবিগুলো বলেছিলেন, সেই দাবিগুলো ও যুক্তিগুলো কিন্তু সবার কণ্ঠেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফলে, আমরা যা চাই, তার সঙ্গে যদি সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তাদের সঙ্গে মিলে যুগপৎ কাজ করতে কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু শনিবার কয়েকটা দল মিলে একটি জোট হওয়ার জন্য সম্মেলন করছে। তারা প্রায় সবাইকে দাওয়াত করেছে। যাদের দাওয়াত করেছে তাদের অনেকেই যাবেন, তারা স্বাগত জানাবেন, সংহতি জানাবেন। কিন্তু এই মিটিংয়ের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ঐক্য হয়ে গেল, ব্যাপারটা তা না। চিন্তাভাবনায় বৃহত্তর ঐক্যের একটি ধারণা আসবে যে, তারা আগামী দিনে এক সঙ্গে কাজ করবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবীর খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি শুনেছি, শনিবারের সমাবেশে বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতা যেতে পারেন।’
শনিবারের সমাবেশে আসার জন্য দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রক্রিয়ার অন্যতম নেতা, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘প্রায় সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে স্বাধীনতাবিরোধীদের দাওয়াত দেওয়া হয়নি।’
গণফোরামের তথ্য ও গণমাধ্যম বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পথিক বলেন, ‘শনিবারের সমাবেশ থেকে কর্মসূচি আসার সম্ভাবনা নেই। সমাবেশে কয়েকটি বিষয়ে কথা বলা হবে। বিশিষ্টজনেরা আলোচনা করবেন, আগামী নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হবে, একসঙ্গে চলার পথ কী হবে— তা বেরিয়ে আসবে।’
নাগরিক ঐক্যের নেতা ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘শনিবার সমাবেশের পর দ্রুততার সঙ্গে চেষ্টা করা হবে ঐক্যকে একটি বড় পরিসরে সামনে এনে কর্মসূচিতে যাওয়ার।’
যাবেন ২০ দলীয় জোটের নেতারা
সমাবেশে অংশ নিতে বিএনপির মতো ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে ২০ দলীয় জোটও। জোটের শরিক নেতারা বলছেন, তারা সমাবেশে অংশ নেবেন। এবং সুযোগ পেলে দলীয় ও দেশের জনগণের হয়ে কথা বলবেন। খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, ‘আমি অসুস্থতার কারণে সমাবেশে যাবো না। তবে দলের মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যাবে।’
বিজেপির সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনের সমাবেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমি আমার দলের পক্ষ থেকে এই সমাবেশে যাবো।’
জোট নয়, দলীয়ভাবে যেতে পারেন বাম নেতারা
গণতান্ত্রিক বামজোটের নেতারা জানিয়েছেন, তারা জোটগতভাবে ড. কামাল হোসেনের সমাবেশে যাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেন ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও জোটগতভাবে তারা সেখানে যাচ্ছেন না। তবে এককভাবে কয়েকটি দলের এই সমাবেশে অংশগ্রহণ অনেকটাই নিশ্চিত।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক দল গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ফিরোজ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জোটগতভাবে যাবে না বা যাবে—এ ধরনের সিদ্ধান্ত হয়নি। যদি কেউ যায়, তাহলে আলাদা-আলাদাভাবে যাবেন। বাংলাদেশের সংকট-সংঘাত উত্তরণে ন্যূনতম জাতীয় ঐক্যমত দরকার। তার ভিত্তিতেই হয়তো বামনেতারা যাবেন।’ ফিরোজ আহমেদ এও জানান, ‘তার দলের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির সমাবেশে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
বামজোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে যাবে না। তবে জোটের কোনও দল চাইলে দলীয় উদ্যোগে যেতে পারে।’
গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু বলেন, ‘আমি এই সমাবেশে যাচ্ছি না। আমাদের জোটেরও না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে।’
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বা বিএনপি জোটের সঙ্গে রাজনীতি করবে না বাম গণতান্ত্রিক জোট। এই দুই দলের বাইরে আমাদের রাজনীতি। আমরা যতটুকু জানি ড. কামাল হোসেনের সমাবেশে বিএনপি আসবে। সুতরাং এই সমাবেশে আমরা যাচ্ছি না। এছাড়া, বাম গণতান্ত্রিক জোটের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে আগামীকাল (২২ সেপ্টেম্বর) আমাদের বিক্ষোভ সমাবেশে রয়েছে।’
এদিকে, ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শনিবার ড. কামাল হোসেনের ডাকা সমাবেশে আমরা যাচ্ছি না। আমরা তো কোনও জোটে নেই, তাই যাওয়া হবে না।’
বি চৌধুরীর বাসায় ফখরুল-মোশাররফ-মওদুদ
সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসায় দেখা করে এসেছেন বিএনপির সিনিয়র তিন নেতা। তারা হলেন— মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। শুক্রবার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকাল পাঁচটার দিকে তারা চৌধুরীর বারিধারার বাসায় যান এবং ফিরে আসেন সন্ধ্যা সাতটার কিছু আগে। বি চৌধুরীর ছেলে বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বি চৌধুরীর বাসায় যান বিএনপির তিন নেতা। তারা একটি খামে করে বিএনপির দফা ও লক্ষ্যগুলোকে বি চৌধুরীর হাতে দেন। ওই সময় বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর অব. মান্নান, যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র আরও জানায়, বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বি চৌধুরীর আলোচনা হয়েছে দুটি বিষয়ে। একটি ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি ও দ্বিতীয়টি জামায়াত প্রসঙ্গে। এ দুটি বিষয়েই আরও আলোচনা হতে পারে,এমন ইঙ্গিত মিলেছে।
No comments