টাকার বিনিময়ে ছাত্রদল-শিবির নিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি? by হুমায়ুন মাসুদ
ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে উত্তপ্ত চট্টগ্রাম
কলেজ। কলেজ ছাত্রলীগের এক পক্ষ অভিযোগ করছে, টাকার বিনিময়ে কমিটি করা
হয়েছে এবং এই কমিটিতে ছাত্রদল ও শিবিরকে পদায়ন করা হয়েছে। কমিটি বাতিলের
দাবিতে কলেজে অস্ত্রসহ বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে ছাত্রলীগের এই অংশের
নেতাকর্মীদের। তবে টাকা নিয়ে কমিটি করার অভিযোগ অস্বীকার করেছে নগর
ছাত্রলীগ। তারা বলছে, নতুন কমিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আন্দোলনকারীরা এসব
অভিযোগ তুলছে। একটি পক্ষের ইন্ধনে কিছু অছাত্র ও বহিরাগত আন্দোলনের নামে এ
বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। ছাত্রলীগের এই অংশের নেতাদের দাবি, যারা
আন্দোলন করছে এবং যাদের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে তাদের কেউ চট্টগ্রাম কলেজের
শিক্ষার্থী নন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও তাদের কোনও সম্পৃক্ততা নেই।
গত সোমবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে মাহমুদুল করিমকে সভাপতি ও সুভাষ মল্লিক
সবুজকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করে নগর ছাত্রলীগ।
নতুন কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে সহ-সভাপতিরা হলেন– কমর উদ্দিন, খালেদ
মাহমুদ চৌধুরী টুটুল, মনিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, মো. ওবায়েদুল হক,
মোস্তফা কামাল, জাবেদুল ইসলাম জিতু, মোক্তার হোসেন রাজু ও শাজাহান সম্রাট।
যুগ্ম সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন চৌধুরী, ইউসুফ কবির, স্বরূপ রায় সৌরভ ও উথিলা
মারমা। সাংগঠনিক সম্পাদক খাদেমুল ইসলাম দুর্জয়, হায়দার আলী, মোহাম্মদ বেলাল
ও আনন্দ মজুমদার।
দফতর সম্পাদক আবদুল কাদের হাওলাদার, প্রচার সম্পাদক জামাল উদ্দিন সোহেল,
উপ-প্রচার সম্পাদক আবু নাঈম মো. হাসান, তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক তারেকুল
ইসলাম খান, শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক খন্দকার নায়েবুল আজম, উপ-শিক্ষা ও
পাঠচক্র সম্পাদক রিফাত হোসেন।
এদের মধ্যে সহ-সভাপতি পদে চারজন, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দুজন, যুগ্ম
সাধারণ সম্পাদক পদে একজনসহ মোট ৭ জন পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগকারী নেতাদের
সবাই নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের
অনুসারী। অভিযোগ রয়েছে, এই পক্ষ থেকে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক পদে কাউকে না
রাখায় এই অংশের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে।
কমিটিতে শিবির ও ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা কয়েকজনকে স্থান
দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ এনে এই কমিটি বাতিলের দাবিতে মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে
আন্দোলন করেন পদবঞ্চিতরা। একই দাবিতে বুধবার পদবঞ্চিতরা দ্বিতীয় দফায়
ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের কয়েকজনকে অস্ত্র হাতে ফাঁকা
গুলি করতে দেখা গেছে।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত নেতারা অভিযোগ করেন, সদ্য
ঘোষিত চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিমের বিরুদ্ধে ইভটিজিং ও
নারী লাঞ্ছনার অভিযোগ রয়েছে। একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক
সবুজের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতার অভিযোগ আনেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এম কায়সার উদ্দিন বলেন,
‘নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থাকা খাদেমুল ইসলাম দুর্জয় ছাত্রদলের
রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার বাবা পেকুয়া উপজেলা বিএনপির নেতৃত্বে আছেন। একই
কমিটির উপ-প্রচার সম্পাদক আবু নাঈম হাসান ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে
জড়িত।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে ত্যাগের বিনিময়ে শিবির অধ্যুষিত এই চট্টগ্রাম
কলেজকে শিক্ষার্থী এবং চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শিবিরমুক্ত
করেছে সেই প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার
কোনও প্রশ্নই আসে না। শিগগির এই কমিটি বাতিল করা না হলে একই দাবিতে কঠোর
আন্দোলন হবে।’
তবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সদ্য ঘোষিত চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের
সভাপতি মাহমুদুল করিম বলেন, “আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি
করতে জামায়াত-শিবিরের ইন্ধনে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে কলেজের সুষ্ঠু পরিবেশ
নষ্ট করার পাঁয়তারা করছে। এই পক্ষের ওপর ভর করে জামায়াত শিবির তাদের ‘মিনি
ক্যান্টনমেন্ট’ হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ পুনরায় উদ্ধার
করতে এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। যারা আন্দোলন করছে তারা তাদেরই দোসর।"
মাহমুদুল করিম বলেন, ‘যারা কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন
আমরা তাদের সবাইকে চিনি। কিন্তু গত দুই দিন যারা কলেজে আন্দোলন করছে তাদের
কাউকে ছাত্রলীগের কোনও কর্মসূচিতে এর আগে দেখিনি। এরা বহিরাগত, অছাত্র।’
তিনি আরও বলেন, ‘জীবন বাজি রেখে শিবিরকে এই ক্যাম্পাস থেকে হটিয়েছি।
২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর শিবিরকে বিতাড়িত করে আমরা কলেজে জয়বাংলার পতাকা
ওড়াই। তখন থেকেই আমরা কলেজে সক্রিয় রাজনীতি করে আসছি। ছাত্রলীগের কোনও
কর্মসূচিতে ছিলাম না এ ধরনের ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি। যারা আজ নিজেদের পদবঞ্চিত
বলে দাবি করছেন তাদের কাউকে ২০১৫ সালে শিবিরের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে
দেখিনি। যারা আজ সংবাদ সম্মেলন করেছে তাদের কারও ছাত্রত্ব নেই। তারা
চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থীও না। কাল যারা ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেছে,
মামলার আসামি-ছিনতাইকারীকেও তাদের সঙ্গে দেখা গেছে।’
একই কথা জানিয়েছেন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজ। সবুজ বাংলা
ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করেছে তারা কারা? যারা দা,
কিরিচ নিয়ে মহড়া দিয়েছে তারা কারা? যারা ককটেল ফাটিয়েছে তারা কারা? তারা কি
চট্টগ্রাম কলেজের স্টুডেন্ট? এরা কেউ চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী নয়,
তারা সবাই বহিরাগত।’
তিনি বলেন, ‘কলেজ ছাত্রলীগ নিয়ে মাথা খাটানোর জন্য কোনও বুড়া লীগকে
দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয়
ছাত্রলীগের নির্দেশনায় নগর ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এই কমিটি
দিয়েছেন। তারা অনেক যাছাই-বাছাই করে এ কমিটি দিয়েছেন। এখানে কাউকে বঞ্চিত
করা হয়নি। যারা প্রকৃতপক্ষে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন,
তাদেরকেই কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগির
বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'আন্দোলনকারী অছাত্র, ছাত্রদল ও শিবিরকে পদ দেওয়ার
যে অভিযোগ করছেন তার কোনও ভিত্তি নেই। এটি ছাত্রলীগের কার্যক্রম
প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না। দীর্ঘদিন যাছাই-বাছাই করার পর
কমিটি প্রদান করা হয়েছে। কমিটিতে ছাত্রদল-শিবির থাকার প্রশ্নই আসে না।'
তিনি বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছেন তাদের সংবাদ সম্মেলনের ছবি দেখেছি।
ছবিতে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রলীগ কর্মীদের চেয়ে সাবেক নেতাদের বেশি দেখা
গেছে।’ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে শিবির-ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের দেখা গেছে বলে
তিনি জানান।
জাকারিয়া দস্তগির বলেন, সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক যাদের করা হয়েছে তারা
চট্টগ্রাম কলেজকে শিবিরমুক্ত করার সংগ্রামে সবসময় অগ্রবর্তী থেকে আন্দোলনে
নেতৃত্ব দিয়েছে। খোঁজখবর নিয়েই আমরা তাদেরকে নেতা বানিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবারই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রত্যাশা থাকে।
কিন্তু এ দুটি পদে তো আর সবাইকে রাখা যাবে না। এরপরও আমরা বলছি যদি কোনও
ছাত্রলীগ কর্মীর যৌক্তিক দাবি থাকে আমরা বিবেচনায় নেব।’
নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজ বলেন, ‘কমিটির সভাপতি,
সাধারণ সম্পাদক পদে নাছির ভাইয়ের গ্রুপের কাউকে না রাখায় তারা এই আন্দোলন
করছে। এই কারণে তারা কমিটি থেকে পদত্যাগ করে কমিটিকে বির্তকিত করার
অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বহিরাগতদের নিয়ে ওই পক্ষের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।’
চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ প্রকাশ্যে অস্ত্রধারী সেই ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার -মানবজমিন
চট্টগ্রাম
সরকারি কলেজে ঘোষিত কমিটি নিয়ে সংঘাতের সময় প্রতিপক্ষের দিকে প্রকাশ্যে
অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা ছাত্রলীগের সেই নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল
বৃহ¯পতিবার রাত ৮টার পর চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালী থানার রাজাপুর লেইন
থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ছাত্রলীগের ওই নেতার নাম মুহাম্মদ
সাব্বির সাদেক। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক এবং বর্তমান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত বলে জানিয়েছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. কামরুজ্জামান। কামরুজ্জামান বলেন, ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধের জেরে গত বুধবার দুপুরে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় চট্টগ্রাম কলেজের সামনের সড়ক। সংঘর্ষে যোগ দেয় বিপুল সংখ্যক বহিরাগত তরুণ। তাদের কারও কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা ও কিরিচ দেখা যায়। বেলা পৌনে ১টার দিকে গণি বেকারি মোড়ে কাপড়ে মুখ ঢাকা ১৫ থেকে ২০ জন বহিরাগত যুবক অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় সাদা শার্ট পরিহিত ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সাব্বির সাদিককে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর পুলিশের নজরে আসে। এরপর তাকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হয়। তার অস্ত্রটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সংঘর্ষে অস্ত্রধারী সকলকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অস্ত্রধারী যেই হোক তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। প্রসঙ্গত, গত সোমবার রাতে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের ২৫ সদস্যের আংশিক কমিটির অনুমোদন দেন নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর। কমিটিতে মাহমুদুল করিমকে সভাপতি এবং সুভাষ মল্লিক সবুজকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। মাহমুদুল প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী এবং সবুজ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির অনুসারী। এর প্রতিবাদে মেয়রের অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মঙ্গলবার ও বুধবার দুইদিন ধরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। এ সময় তারা ত্রিমুখী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। দলীয় সূত্র জানায়, ১৯৮৪ সালে সর্বশেষ চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি হয়েছিল। ছাত্র শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হওয়া ছাত্রলীগের প্রায় তিন দশক ধরে কোনো কর্মকাণ্ডই ছিল না ওই কলেজে। ২০১৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম কলেজ ও সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজ ক্যাম্পাস দখলে নেয়। এরপর থেকে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলে আসছিল। এরমধ্যেও প্রায় সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগের বিবদমান তিনটি গ্রুপ। সোমবার কমিটি ঘোষণার পর তা রণক্ষেত্রে পরিণত হয় চট্টগ্রাম কলেজ। |
No comments