জাতীয় ঐক্য কার্যকরে আন্দোলন শুরুর আহ্বান নাগরিক সমাবেশে রাজনীতিবিদদের by সালমান তারেক শাকিল ও আদিত্য রিমন

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে দাবি আদায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘বৃহত্তর ঐক্য একধাপ এগিয়ে গেছে’ বলে মনে করেন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। তাদের দাবি, আগামী নির্বাচন সু্ষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে ও সেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার দাবিতে প্রায় সব দলই ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এখন দরকার—এই ঐক্যকে কার্যকর করার মধ্য দিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা। আগামী ১ অক্টোবর থেকে সারাদেশে সভা-সমাবেশ কর্মসূচিরও ঘোষণা করা হয় সমাবেশ থেকে। শনিবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৩ টায় রাজধানীর গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে আয়োজিত ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার’ সমাবেশে আসা বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্যে এমন দাবি উঠে আসে। তারা আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার প্রাথমিক শর্ত হিসেবে বর্তমান দশম সংসদ ভেঙে দেওয়ারও দাবি জানান। একইসঙ্গে দাবি আদায়ে সারাদেশে জাতীয় ঐক্য কার্যকর করতে কমিটি গঠন করে নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ গণজাগরণ গড়ে তোলার আহ্বান জানান এই নেতারা।
প্রসঙ্গত, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশকে ঘিরে প্রায় মাসখানেক ধরেই চলছিল নানা ধরনের অনিশ্চয়তা। কখনও ভেন্যু নিয়ে, কখনও  সমাবেশ নিয়ে। যদিও সব ধরনের শঙ্কা ও সন্দেহ উজিয়ে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। 
‘কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলুন’ শীর্ষক দাবিতে নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে লিখিত বক্তব্যে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও সমাবেশের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের এ জাতীয় ঐক্যের প্রচেষ্টায় ক্ষমতায় যাওয়ার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন কেউ-কেউ। আমরা প্রকাশ্য সভা করছি। কোনও গোপন বৈঠক করছি না।’ তিনি বলেন, ‘মৌলিক বিষয়ে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। এখন সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার সময় এসেছে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রচেষ্টা সফল হবে। অতীতে জনগণের বিজয়কে কেউ ঠেকাতে পারেনি ভবিষ্যতেও পারবে না।’ 
সমাবেশের শেষ দিকে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দররক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ঘোষণাপত্রে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তফসিল ঘোষণার পূর্বে বর্তমান দশম সংসদ ভেঙে দিতে হবে। ঘোষণাপত্রে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনগত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।
নাগরিক সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন একিউম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
নাগরিক সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন একিউম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘আগামী দিনে যেন বর্তমান সরকারের মতো সরকার না আসে, সেজন্য রক্ষাকবচ তৈরি করতে হবে। অনেকে আমাদের কাজে গন্ধ পান, তারাই গন্ধ পান, যাদের নাক পচা। আমরা সংবিধানের বাইরের কোনও প্রসেসে বিশ্বাস করি না।’ ড. কামাল হোসেন ও বিএনপিনেতাদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এখানে কারোই এ ধরনের চিন্তা নেই।’ 
কারাবন্দি খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে বিএনপির সাবেক মহাসচিব বি চৌধুরী বলেন, ‘খালেদা জিয়া আমার চেয়ে ১৫ বছরের ছোট। তিনি অসুস্থ। তিনি কোন চিকিৎসককে দিয়ে তার স্বাস্থ্য দেখাবেন, সে বিষয়ে তার রাইট আছে। তার কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টে কীভাবে হাত দেন অন্য চিকিৎসকরা?’   
বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে জানিয়ে বি চৌধুরী বলেন, ‘শুধু স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ভারসাম্যের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য বেগবান হতে পারে। আমরা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করছি। আশা করি, ফলপ্রসূ হবে। আসুন, সবাই ইতিবাচক স্বপ্নে জেগে উঠি। স্বপ্নভঙ্গের অধ্যায় রচনা করার জন্য নয়।’ 
‘জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া’ একধাপ এগিয়ে গেছে দাবি করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আজ যদি এই সরকারকে আমরা সরিয়ে দিতে না পারি এবং জনগণের  ঐক্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারি,  তাহলে দেশের স্বাধীনতাও থাকবে না। এজন্য কারাগার থেকে খালেদা জিয়া খবর দিয়েছেন, যেকোনও মূল্যে জাতীয় ঐক্য গড়তে হবে।’
4
নাগরিক সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন ড. কামালা হোসেন
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজ যেসব দাবি এসেছে, প্রায় সবার দাবিই এক। আমাদের প্রধান শর্ত হচ্ছে—এই সরকারকে পদত্যাগ করাতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে। এ কারণে ইসি পুনর্গঠন করতে হবে।’ ইভিএমের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এদেশের মানুষ ইভিএমের সঙ্গে পরিচিত নয়, তাই আগামী নির্বাচনে ইভিএম চলবে না।’ 
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এই প্ল্যাটফরম থেকে জাতীয় ঐক্যের সূচনা হয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটাবো। ঐক্যপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করবো।’ 
দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘নতুন মাইলফলক ও নতুন যাত্রা শুরু করেছি, এই যাত্রায় আলো আসবেই। মানুষকে সংগঠিত করে এ সরকারকে হটাতে পারবো।’   
জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, ‘বদ্ধ ঘরে থাকতে চাই না। আমরা মাঠে নামবো। আমাদের মাঠে যেতেই হবে।’ 
2
নাগরিক সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দেশের সব বিরোধী রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি করেছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক, যুক্তফন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। সবার মুক্তি দাবি করছি। এ মুক্তি দিতে হবে। যদি কেউ মনে করেন জোর করে লাঠি দিয়ে, পুলিশ দিয়ে বন্ধ করবেন, তাহলে এত জোরে কথা বলবো, কেউ টিকবে না।’ 
গণসংহতির প্রধানসমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘একাত্তরের পর থেকে সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামো কাজে লাগিয়ে স্বৈরতন্ত্র কার্যকর ছিল। আমরা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আছি, এই ব্যবস্থা কোনও ব্যক্তির নয়, ব্যবস্থাগত স্বৈরতন্ত্রের। সরকার যেভাবে কথা বলছে, এই ভাষা সংঘাতের ভাষা। সরকার যদি সমঝোতা না করে, বুঝতে হবে তারা জনগণকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর তাহলে জনগণই আন্দোলনের মাধ্যমে সমাধান করবে।’ 
শনিবার দুপুর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা তাদের দাবি সংবলিত ব্যানার নিয়ে মিছিলযোগে সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন। সমাবেশ কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। মিলনায়তনের ভেতরে ছিল সাদা পোশাকের গোয়েন্দা বাহিনী। সমাবেশ শুরুর আগে ও পরে বিদ্যুৎবিভ্রাট ও জেনারেটরে সমস্যা দেখা দেয় বলেও জানান জাতীয় ঐক্যের নেতারা।
কামাল হোসেনের ডাকা সমাবেশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান জয়নাল আবদীন, যুক্তফ্রন্ট নেতা ও জেএসডি সভাপতি আসম রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মুনসুর আহমদ, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন প্রমুখ।
 ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে সমাবেশে মঞ্চে বসে থাকেন বিজেপি সভাপতি আন্দালিভ রহমান পার্থ, জমিয়ত একাংশের মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের প্রমুখ। 
সমাবেশ শেষ হওয়ার পর বিএনপি জোটের শরিক এলডিপির যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বাংলা ট্রিবিউনকে ফোন করে জানান,  ‘ড. কামালের সমাবেশে এলডিপি, ন্যাপ, কল্যাণ পার্টি যায়নি।’
পরে ন্যাপ মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম।’
এদিকে, সমাবেশে বিপুল সংখ্যক বিএনপির নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলো। বক্তাদের বক্তব্যের শুরু ও শেষ দিকে তারা বহুবার খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে স্লোগান দেন।
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

No comments

Powered by Blogger.