১৫০০ কলেজ প্রকল্প: ১২০ কোটি টাকার অনিয়ম by নূর মোহাম্মদ
সারা
দেশে নির্বাচিত বেসরকারি ১৫০০ কলেজ প্রকল্পে অর্থ নয়ছয়ের ঘটনা ঘটেছে।
মালামাল সরবরাহ করার আগেই নিয়মবহির্ভূতভাবে ঠিকাদারদের ১২০ কোটি টাকার বিল
দেয়া হয়েছে। পুরো টাকা বিলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে সরকারি ছুটির দিনে। তাও
প্রকল্প পরিচালকের অনুপস্থিতিতে। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তোলপাড় চলছে।
অভিযোগ খতিয়ে দেখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির সমন্বয়ে তিন সদস্যের তদন্ত
কমিটি। গতকাল থেকে তদন্ত শুরু করেছে কমিটি। অভিযুক্তদের ওএসডি বা কোনো
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়েই কাজ শুরু করছে কমিটি। গতকাল থেকে শুরু হওয়ার
কমিটির ওপর প্রভাবশালী মহল দিয়ে নানা চাপ বিস্তার শুরু করেছে অভিযুক্তরা।
বাধ্য হয়ে বিষয়টি এখন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও মাধ্যমিক ও উচ্চ
শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন নিজেই তদারকি করছেন। আর নড়েচড়ে বসেছেন
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য
জানা গেছে।
সূত্রমতে, সারা দেশে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজের উন্নয়নের জন্য এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ২০১৩ সালে। আসছে ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। শেষ বছরে এসে প্রকল্পের অর্থ নয়ছয়ের ঘটনা হাতেনাতে ধরেন নতুন যোগ দেয়া প্রকল্প পরিচালক। এতেই প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দিতে তার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লাগে একটি মহল। অন্যদিকে এ অনিয়ম ধরার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে বদলি করা হয়েছে বলে ওই দপ্তরে আলোচনা রয়েছে। মাউশির একজন পরিচালকের নাম নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে তদন্ত কমিটি। ফিন্যান্স ও প্রকিউরমেন্ট শাখার পরিচালক প্রফেসর মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে মাউশির আরেকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে এসব অনিয়মকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এ অভিযোগে তাকেও ওই পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার গুঞ্জন আছে।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত ৩রা জানুয়ারি অবসরে যান ওই প্রকল্পের সর্বশেষ পরিচালক (পিডি) প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম। আর গত ২০শে জুন প্রকল্পের পিডি হিসেবে নিয়োগ পান প্রফেসর ড. এসএম আলমগীর কবীর। তিনি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ২১শে জুন। প্রকল্প পরিচালক না থাকাকালীন সময়ে রুটিন দায়িত্বে ছিলেন উপ-প্রকল্প (ডিপিডি) পরিচালক মীর আবদুল হালিম। নতুন পিডি নিয়োগ পেয়েছেন এমন খবর পেয়ে ভারপ্রাপ্ত পিডি দুই দিনে ৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে মোট ১২০ কোটি টাকা অগ্রিম দিয়ে দেন। এক্ষেত্রে মাউশির মহাপরিচালক ও প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তাকে কিছু জানানো হয়নি। তড়িঘড়ি করে ওই টাকা ছাড় করার বিষয়টি গত ৩১শে জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা সভায় এ আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ে। এ ছাড়াও আকতার ফার্নিচারের চাহিদা মোতাবেক পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে প্রকল্প থেকে। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই কোনো প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র দেয়ার বিধান নেই। নিয়মবহির্ভূত ভাবে এ কাজটি করেছেন মীর আব্দুল হালিম।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বিল পরিাশোধের ক্ষেত্রে ফাইলে কমপক্ষে তিনজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ ফাইলে স্বাক্ষর করেছেন দুইজন। ফাইল উঠিয়েছেন সহকারী পরিচালক মো. মনসুর হেলাল এবং অনুমোদন দিয়েছেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক মীর আবদুল হালিম। কম গুরুত্বপূর্ণ ফাইল উঠিয়েছেন হিসাব রক্ষক অথবা একজন কম্পিউটার অপারেটর। প্রকল্পে পঞ্চম গ্রেডের আরো ৫ জন কর্মকর্তা থাকলেও তাদের রাখা হয়েছে এক ধরনের অগোচরে। শুধু তাই নয় যেসব ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ বেশি সেখানে শুধু বিলের নাম্বার উল্লেখ করে টাকার বিষয়টি গোপন রাখা হয়। প্রকল্প সূত্র আরো জানায়, গত ২১, ২২, ২৯ ও ৩০শে জুন শুক্র ও শনিবার অফিস বন্ধের সময় পিছনে তারিখে ১৮ কোটি ৫৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকার ৭টি বিল জমা দেন। বিষয়টি প্রকল্পের হিসাব রক্ষক কর্মকর্তার নজরে এলে তিনি আপত্তি দেন। এরপর মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়নের পরিচালক এগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিল বিধায় ব্যবস্থা নিতে নিষেধ করেন। এরপর তিনি হজে চলে যান। অগ্রিম বিল পরিাশোধের কোনো আর্থিক বিধান না থাকার পর এসব বিল দেয়া হয়েছে মাউশির মহাপরিচালকের অগোচরে। কোনো বিলে মহাপরিচালকের স্বাক্ষর নেই।
নতুন প্রকল্প পরিচালক যোগদান করার পর বিষয়টি তার নজরে আসে। তিনি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করার চেষ্টা করেও পারেননি। অভিযুক্ত দুইজন তাকে নানা জায়গা থেকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। পরে মাউশির ডিজির অনুমতি নিয়ে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করানো হয়। অন্যদিকে সরকারি অডিট বিভাগ নিরীক্ষা করেও একই ধরনের অনিয়ম পেয়েছে। তারপর নতুন পিডিকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তাকে বিএনপি জামায়াত সমর্থিত ও জুনিয়র কর্মকর্তা বলে সরকারি বিভিন্ন অফিসে অভিযোগ করতে থাকে। পিডির অভিযোগ আমলে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত সচিব বেলায়েত হোসেন তালুকদার, পরিকল্পনা শাখার যুগ্ম প্রধান কাজী মনিরুল ইসলাম এবং মাউশির ফিন্যান্স ও প্রকিউরমেন্ট শাখার পরিচালক প্রফেসর মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, পুরো অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে অভিযুক্তদের এবার আর ছাড় নয় বলে জানান তিনি। একই সময় তার রুমে থাকা মাউশির পরিচালককে প্রকল্পের সব নথি একটি করে দেখে একটি প্রতিবেদন তৈরি করার নির্দেশ দেন। প্রকল্পগুলোকে আরো কঠোর নজরধারী প্রয়োজনে নিজে প্রকল্প অফিসে গিয়ে ফাইল দেখার জন্য ডিজিকে নির্দেশ দেন।
প্রকল্পের নথি সূত্রে জানা গেছে, আগাম বিল নেয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে ফ্লোরা লিমিটেড, ইউনিক বিজনেস সিস্টেম, স্মার্ট টেকনোলজি লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানগুলো এসব কলেজে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া উপকরণ সরবরাহ করার কাজ পায়। প্রতিষ্ঠানগুলো আগাম ৯৪ কোটি ১২ লাখ টাকা নিয়েছে। এর মধ্যে ফ্লোরা লিমিটেডে ৪টি লটে ৩৭৭টি কলেজ আইসিটি ল্যাব স্থাপনের জন্য ৬৮ কোটি ৬৩ লাখ ২১ হাজার টাকার চুক্তি হয়। একটি প্রতিষ্ঠানেও মালামাল সরবরাহ না করার আগেই এ প্রতিষ্ঠানকে ৫৯ কোটি ৮৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা অগ্রিম বিল দেয়া হয়েছে। একই ভাবে ৭৫৬টি কলেজে ৫ হাজার ৯৭৫টি কক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর স্থাপনের জন্য ৪টি প্যাকেজে ফ্লোরা লিমিটেড, ইউনিক বিজনেস, ওরিয়েন্টাল কোম্পানির সঙ্গে মোট ৬৮ কোটি ১৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকার চুক্তি হয়। এর মধ্যে ২টি প্যাকেজে বিল বাবদ ৩৪ কোটি ২৬ লাখ টাকার বেশি বিল দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আইসিটি ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্ট বাবদ অগ্রিম সর্বমোট ৯৪ কোটি ১১ লাখ ৯৯ হাজার ১৬১ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফার্নিচার খাতে ই-জিপির মাধ্যমে মোট ৪টি প্যাকেজে ৩৭৫টি প্রতিষ্ঠানে ফার্নিচার সরবরাহের জন্য ১৯ কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭১৬ টাকার চুক্তি হয়। এর মধ্যে ৭৫টি প্রতিষ্ঠানে আখতার ফার্নিচার সরবরাহ করার পর দেয়া হয়েছে। এসব ফার্নিচার অত্যন্ত নিম্নমানের ছিল বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তৎকালীন যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) এবং মাউশি ও প্রকল্প সমন্বয়ে পরিদর্শন প্রতিবেদন বলা হয়েছে। তারপরও আরো ১০০ প্রতিষ্ঠানের ফার্নিচার সরবরাহ করার জন্য এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। বাকি ২টি প্যাকেজের মধ্যে পারটেক্স ও আরএফএল গ্রুপকে অগ্রিম ১০ কোটি ১৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা অগ্রিম দেয়া হয়েছে। আর বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের ৭টি ইউনিটের সঙ্গে ডিপিএম পদ্ধতিতে ৮২০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য ৫০ কোটি ৬২ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকার চুক্তি হয়। এ প্রতিষ্ঠানকে অগ্রিম দেয়া হয়েছে ১৫ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৮ টাকা। অর্থাৎ ফার্নিচার খাতে অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছে ২৬ কোটি ১০ লাখ ৫১ হাজার ৪০৮ টাকা। আইসিটি ও ফার্নিচার খাতে বিধিবহির্ভূতভাবে মোট ১২০ কোটি টাকা অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছে।
পুরো অভিযোগের ব্যাপারে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পিডি মীর আবদুল হালিম মানবজমিনকে বলেন, এত বড় কোম্পানিগুলো অগ্রিম টাকা দিলে মেরে দিবে বা নিম্নমানের মাল দিবে এটা বিশ্বাস করা যায়? তিনি প্রতিবেদকের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, আপনি কী বিশ্বাস করেন। আগের পিডি একই ভাবে অগ্রিম বিল দিয়েছেন সে সূত্র ধরেই আমিও দিয়েছি। ওই সময়ের কাগজপত্র দেখাতে পারবেন এমন প্রশ্নে নির্বাক হয়ে তিনি বলেন, আমার কাছে নেই। আপনি সংগ্রহ করে নেন। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি ভালো দেখানোর জন্য আমি এ কাজ করেছি।
সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ড. এসএম আলমগীর কবীর মানবজমিনকে বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। পিছনের তারিখ দিয়ে বিল দেয়ার বিষয়টি খুঁজতে গিয়ে এ জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরেছি। এরপর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েও বাধার মুখে পড়েছি। পরে ডিজি স্যারের অনুমতি নিয়ে কাজ করেছি। একই নিরীক্ষা এজি (সরকারি নিরীক্ষা বিভাগ) অফিসও করেছে। সব নিরীক্ষায় জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণিত। তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের অগ্রিম বিল দেয়ার জন্য মাউশির পরিকল্পনা শাখার আপত্তি আসলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো অডিট আপত্তি আসেনি। বিষয়টি রহস্যজনক।
সূত্রমতে, সারা দেশে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজের উন্নয়নের জন্য এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ২০১৩ সালে। আসছে ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। শেষ বছরে এসে প্রকল্পের অর্থ নয়ছয়ের ঘটনা হাতেনাতে ধরেন নতুন যোগ দেয়া প্রকল্প পরিচালক। এতেই প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দিতে তার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লাগে একটি মহল। অন্যদিকে এ অনিয়ম ধরার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে বদলি করা হয়েছে বলে ওই দপ্তরে আলোচনা রয়েছে। মাউশির একজন পরিচালকের নাম নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে তদন্ত কমিটি। ফিন্যান্স ও প্রকিউরমেন্ট শাখার পরিচালক প্রফেসর মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে মাউশির আরেকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে এসব অনিয়মকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এ অভিযোগে তাকেও ওই পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার গুঞ্জন আছে।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত ৩রা জানুয়ারি অবসরে যান ওই প্রকল্পের সর্বশেষ পরিচালক (পিডি) প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম। আর গত ২০শে জুন প্রকল্পের পিডি হিসেবে নিয়োগ পান প্রফেসর ড. এসএম আলমগীর কবীর। তিনি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ২১শে জুন। প্রকল্প পরিচালক না থাকাকালীন সময়ে রুটিন দায়িত্বে ছিলেন উপ-প্রকল্প (ডিপিডি) পরিচালক মীর আবদুল হালিম। নতুন পিডি নিয়োগ পেয়েছেন এমন খবর পেয়ে ভারপ্রাপ্ত পিডি দুই দিনে ৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে মোট ১২০ কোটি টাকা অগ্রিম দিয়ে দেন। এক্ষেত্রে মাউশির মহাপরিচালক ও প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তাকে কিছু জানানো হয়নি। তড়িঘড়ি করে ওই টাকা ছাড় করার বিষয়টি গত ৩১শে জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা সভায় এ আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ে। এ ছাড়াও আকতার ফার্নিচারের চাহিদা মোতাবেক পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে প্রকল্প থেকে। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই কোনো প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র দেয়ার বিধান নেই। নিয়মবহির্ভূত ভাবে এ কাজটি করেছেন মীর আব্দুল হালিম।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বিল পরিাশোধের ক্ষেত্রে ফাইলে কমপক্ষে তিনজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ ফাইলে স্বাক্ষর করেছেন দুইজন। ফাইল উঠিয়েছেন সহকারী পরিচালক মো. মনসুর হেলাল এবং অনুমোদন দিয়েছেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক মীর আবদুল হালিম। কম গুরুত্বপূর্ণ ফাইল উঠিয়েছেন হিসাব রক্ষক অথবা একজন কম্পিউটার অপারেটর। প্রকল্পে পঞ্চম গ্রেডের আরো ৫ জন কর্মকর্তা থাকলেও তাদের রাখা হয়েছে এক ধরনের অগোচরে। শুধু তাই নয় যেসব ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ বেশি সেখানে শুধু বিলের নাম্বার উল্লেখ করে টাকার বিষয়টি গোপন রাখা হয়। প্রকল্প সূত্র আরো জানায়, গত ২১, ২২, ২৯ ও ৩০শে জুন শুক্র ও শনিবার অফিস বন্ধের সময় পিছনে তারিখে ১৮ কোটি ৫৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকার ৭টি বিল জমা দেন। বিষয়টি প্রকল্পের হিসাব রক্ষক কর্মকর্তার নজরে এলে তিনি আপত্তি দেন। এরপর মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়নের পরিচালক এগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিল বিধায় ব্যবস্থা নিতে নিষেধ করেন। এরপর তিনি হজে চলে যান। অগ্রিম বিল পরিাশোধের কোনো আর্থিক বিধান না থাকার পর এসব বিল দেয়া হয়েছে মাউশির মহাপরিচালকের অগোচরে। কোনো বিলে মহাপরিচালকের স্বাক্ষর নেই।
নতুন প্রকল্প পরিচালক যোগদান করার পর বিষয়টি তার নজরে আসে। তিনি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করার চেষ্টা করেও পারেননি। অভিযুক্ত দুইজন তাকে নানা জায়গা থেকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। পরে মাউশির ডিজির অনুমতি নিয়ে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করানো হয়। অন্যদিকে সরকারি অডিট বিভাগ নিরীক্ষা করেও একই ধরনের অনিয়ম পেয়েছে। তারপর নতুন পিডিকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তাকে বিএনপি জামায়াত সমর্থিত ও জুনিয়র কর্মকর্তা বলে সরকারি বিভিন্ন অফিসে অভিযোগ করতে থাকে। পিডির অভিযোগ আমলে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত সচিব বেলায়েত হোসেন তালুকদার, পরিকল্পনা শাখার যুগ্ম প্রধান কাজী মনিরুল ইসলাম এবং মাউশির ফিন্যান্স ও প্রকিউরমেন্ট শাখার পরিচালক প্রফেসর মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, পুরো অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে অভিযুক্তদের এবার আর ছাড় নয় বলে জানান তিনি। একই সময় তার রুমে থাকা মাউশির পরিচালককে প্রকল্পের সব নথি একটি করে দেখে একটি প্রতিবেদন তৈরি করার নির্দেশ দেন। প্রকল্পগুলোকে আরো কঠোর নজরধারী প্রয়োজনে নিজে প্রকল্প অফিসে গিয়ে ফাইল দেখার জন্য ডিজিকে নির্দেশ দেন।
প্রকল্পের নথি সূত্রে জানা গেছে, আগাম বিল নেয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে ফ্লোরা লিমিটেড, ইউনিক বিজনেস সিস্টেম, স্মার্ট টেকনোলজি লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানগুলো এসব কলেজে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া উপকরণ সরবরাহ করার কাজ পায়। প্রতিষ্ঠানগুলো আগাম ৯৪ কোটি ১২ লাখ টাকা নিয়েছে। এর মধ্যে ফ্লোরা লিমিটেডে ৪টি লটে ৩৭৭টি কলেজ আইসিটি ল্যাব স্থাপনের জন্য ৬৮ কোটি ৬৩ লাখ ২১ হাজার টাকার চুক্তি হয়। একটি প্রতিষ্ঠানেও মালামাল সরবরাহ না করার আগেই এ প্রতিষ্ঠানকে ৫৯ কোটি ৮৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা অগ্রিম বিল দেয়া হয়েছে। একই ভাবে ৭৫৬টি কলেজে ৫ হাজার ৯৭৫টি কক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর স্থাপনের জন্য ৪টি প্যাকেজে ফ্লোরা লিমিটেড, ইউনিক বিজনেস, ওরিয়েন্টাল কোম্পানির সঙ্গে মোট ৬৮ কোটি ১৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকার চুক্তি হয়। এর মধ্যে ২টি প্যাকেজে বিল বাবদ ৩৪ কোটি ২৬ লাখ টাকার বেশি বিল দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আইসিটি ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্ট বাবদ অগ্রিম সর্বমোট ৯৪ কোটি ১১ লাখ ৯৯ হাজার ১৬১ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফার্নিচার খাতে ই-জিপির মাধ্যমে মোট ৪টি প্যাকেজে ৩৭৫টি প্রতিষ্ঠানে ফার্নিচার সরবরাহের জন্য ১৯ কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭১৬ টাকার চুক্তি হয়। এর মধ্যে ৭৫টি প্রতিষ্ঠানে আখতার ফার্নিচার সরবরাহ করার পর দেয়া হয়েছে। এসব ফার্নিচার অত্যন্ত নিম্নমানের ছিল বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তৎকালীন যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) এবং মাউশি ও প্রকল্প সমন্বয়ে পরিদর্শন প্রতিবেদন বলা হয়েছে। তারপরও আরো ১০০ প্রতিষ্ঠানের ফার্নিচার সরবরাহ করার জন্য এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। বাকি ২টি প্যাকেজের মধ্যে পারটেক্স ও আরএফএল গ্রুপকে অগ্রিম ১০ কোটি ১৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা অগ্রিম দেয়া হয়েছে। আর বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের ৭টি ইউনিটের সঙ্গে ডিপিএম পদ্ধতিতে ৮২০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য ৫০ কোটি ৬২ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকার চুক্তি হয়। এ প্রতিষ্ঠানকে অগ্রিম দেয়া হয়েছে ১৫ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৮ টাকা। অর্থাৎ ফার্নিচার খাতে অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছে ২৬ কোটি ১০ লাখ ৫১ হাজার ৪০৮ টাকা। আইসিটি ও ফার্নিচার খাতে বিধিবহির্ভূতভাবে মোট ১২০ কোটি টাকা অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছে।
পুরো অভিযোগের ব্যাপারে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পিডি মীর আবদুল হালিম মানবজমিনকে বলেন, এত বড় কোম্পানিগুলো অগ্রিম টাকা দিলে মেরে দিবে বা নিম্নমানের মাল দিবে এটা বিশ্বাস করা যায়? তিনি প্রতিবেদকের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, আপনি কী বিশ্বাস করেন। আগের পিডি একই ভাবে অগ্রিম বিল দিয়েছেন সে সূত্র ধরেই আমিও দিয়েছি। ওই সময়ের কাগজপত্র দেখাতে পারবেন এমন প্রশ্নে নির্বাক হয়ে তিনি বলেন, আমার কাছে নেই। আপনি সংগ্রহ করে নেন। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি ভালো দেখানোর জন্য আমি এ কাজ করেছি।
সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ড. এসএম আলমগীর কবীর মানবজমিনকে বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। পিছনের তারিখ দিয়ে বিল দেয়ার বিষয়টি খুঁজতে গিয়ে এ জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরেছি। এরপর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েও বাধার মুখে পড়েছি। পরে ডিজি স্যারের অনুমতি নিয়ে কাজ করেছি। একই নিরীক্ষা এজি (সরকারি নিরীক্ষা বিভাগ) অফিসও করেছে। সব নিরীক্ষায় জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণিত। তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের অগ্রিম বিল দেয়ার জন্য মাউশির পরিকল্পনা শাখার আপত্তি আসলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো অডিট আপত্তি আসেনি। বিষয়টি রহস্যজনক।
No comments