মৌলভীবাজারে বন্যা: বিশুদ্ধ পানি স্যানিটেশন ও খাদ্য সংকট চরমে by ইমাদ উদ দীন
বসত
ভিটা বানের পানির নিচে। প্রাণ বাঁচাতে মানুষজন ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়
কেন্দ্র কিংবা বাসাবাড়ির ছাদে। চারদিকে পানি আর পানি। তারপরও খাওয়ার মতো
বিশুদ্ধ পানির জন্য চলছে হাহাকার। নেই সেনিটেশন ব্যবস্থা। আর খাদ্য সংকটও
চরমে। মানুষের মতো দুর্ভোগে পড়েছে গবাদি পশুও। বন্যাকবলিতরা অন্তহীন
দুর্ভোগে চরম অসহায়। চারদিকে শুধু নেই আর নেই। সব কেড়ে নিয়েছে আকস্মিক
বন্যা। সহায় সম্বল হারিয়ে এখন তারা নিঃস্ব। গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করেছে
বানের পানি। ডুবেছে টয়লেট, টিউবওয়েল, ধান আর সবজি ক্ষেত। ১৩ই জুন দুপুর
থেকে মৌলভীবাজারে আকস্মিক বন্যায় দুর্ভোগের যাত্রা শুরু। গ্রামের মতো শহরের
বাসিন্দাদেরও দুর্ভোগের অবস্থা আরো ভয়াবহ। শহরের বন্যাকবলিত এলাকার
প্রতিটি বাসাবাড়িতে পৌরসভাকর্তৃক সরবরাহকৃত বিশুদ্ধ পানির রিজার্ভার এখন
কয়েক ফুট পানির নিচে। আর নলকূপের পানি ট্যাংকিতে রিজার্ভ রাখার ব্যবস্থাও
এখন অচল। কারণ বন্যাকবলিত শহর ও গ্রামের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন।
তাই খাওয়ার বিশুদ্ধ পানির যেমন চরম সংকট তেমনি গোসল, রান্নাবান্না ও
প্রয়োজনীয় কাজের ব্যবহারের জন্য মিলছে না পানি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়
বাসিন্দারা জানিয়েছেন অতীতের সকল বন্যার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবারকার বন্যা।
মৌলভীবাজার শহরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন ১৯৮৪ সালে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল
এবারকার বন্যা অনেকটা তারই প্রতিচ্ছবি। আকস্মিক বন্যা হওয়ায় চোখের সামনেই
সবকিছু তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে পৌর এলাকার বাসাবাড়িতে অনেকের ঘরে খাদ্য
থাকার পরও পানি ও বিদ্যুৎ না থাকায় তারা অর্ধাহারে অনাহারে দিনযাপন করছেন।
গ্রাম কিংবা শহরে গাড়ি চলাচলের রাস্তায় ৩ থেকে ৪ ফুট পানি থাকায় সেখানে
নৌকা চলাচল করছে। মৌলভীবাজার শহরের বন্যাকবলিত ৩টি ওয়ার্ডের প্রতিটি বাসায়
নৌকা ছাড়া বের হওয়া যাচ্ছে না। একতলার বাসিন্দারা বাসার ছাদে কিংবা
অন্যান্য উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। শহর এবং গ্রামের বন্যাকবলিত অনেকেই
বানের পানি ঠেলে পায়ে হেঁটে অথবা নৌকাযোগে দূর দূরান্ত থেকে বিশুদ্ধ পানি
সংগ্রহ করছেন। তবে অনেক এলাকায়ই বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা না
থাকায় বানের পানিই তাদের একমাত্র সম্বল। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়
আকস্মিক বন্যায় এ পর্যন্ত জেলার ৪টি উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ৩০টি ইউনিয়নের ৪০
হাজার পরিবারের ১ লাখ ৯৩ হাজার ৪শ’ জন মানুষ আক্রান্ত। এ পর্যন্ত ৯.৭শ’ টন
বরাদ্দকৃত চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বন্যাকবলিত এলাকায় বিতরণ করা হয়েছে। এ
ছাড়াও আরো ৫শ’ টন চাল ও নগদ টাকা ত্রাণ সহায়তার জন্য চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
খোলা হয়েছে ৫০টি আশ্রয় কেন্দ্র। তাছাড়া জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে
৭৪টি মেডিকেল টিম বন্যাকবলিত এলাকায় কাজ করছে। তবে নতুন করে কোনো এলাকা
প্লাবিত হলে আশ্রয় কেন্দ্র ও মেডিকেল টিমের সংখ্যা বাড়ানো হবে। এমন
প্রস্তুতিও রয়েছে তাদের। এ ছাড়া যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের
তালিকাও করা হচ্ছে। যাতে বানের পানি চলে গেলে সরকারি তরফে তাদের ঘর বাড়ি
মেরামতে সহযোগিতা করা যায়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন জানিয়েছেন কুলাউড়া,
কমলগঞ্জ, রাজনগর ও মৌলভীবাজারের মনু ও ধলাই নদীর তীরবর্তী প্রায় ৪০টি
ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার প্রায় চার শতাধিক গ্রামের ৪ লক্ষাধিক মানুষ এখন
পানিবন্দি। তাদের ধারণা উজানের পানি আসা না কমলে ও ভারি বৃষ্টিপাত বন্ধ না
হলে এই পরিসংখ্যান দ্বিগুণ হবে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান বন্যাকবলিত
অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকার পানি জেলার হাকালুকি ও কাউয়াদিঘি হাওরে গিয়ে পড়ায়
এখন নতুন করে হাওর তীরবর্তী এলাকাও বন্যাকবলিত হচ্ছে। বানভাসি মানুষের
অভিযোগ সরকারি তরফে তারা পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী। তবে বেসরকারি
বিভিন্ন সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তা ছাড়া দেশ ও প্রবাসে থাকা অনেকেই
ব্যক্তি উদ্যোগে এসব বন্যার্ত অসহায় মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। তারা
রান্না করা খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওরস্যালাইন, মোমবাতি, ম্যাচ ও
শুকনো খাবার বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করছেন। মৌলভীবাজার পৌর সভার উদ্যোগে
শহরের বন্যাকবলিতদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে রান্নাকরা খাবার ও বিশুদ্ধ
পানি। বন্যার শুরু থেকে বিষয়টি তদারকি করছেন পৌর মেয়র মো. ফজলুর রহমান।
গতকাল ব্যক্তি উদ্যোগে শহরের বন্যাকবলিতদের রান্নাকরা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি
সরবরাহ করেন সাবেক পৌর মেয়র ফয়জুল করিম ময়ূন ও পৌর কাউন্সিলর মসুদ আহমদ। এ
ছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠনগুলোও
বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। প্রতিদিনই তারা সাধ্যানুযায়ী খাবার ও
বিশুদ্ধ পানি বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করছেন। বন্যা শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর
একটি দল পুরো জেলায় বন্যাকবলিতদের উদ্ধার, নদীর ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিরক্ষা বাঁধ
মেরামত ও ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তাদের এমন প্রশংসনীয়
নিরবচ্ছিন্ন সেবা কাজে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে বন্যার্তদের। মৌলভীবাজার
শহরের ধরকাপন এলাকার সৈয়দ মাহমুদ আলী, সৈয়দ হুমায়েদ আলী শাহিন, শাহ ইমরুল
আক্তার কয়েছ ও বড়হাট এলাকার আ.স.ম সালেহ সুহেল জানান, গেল ২-৩ দিন থেকে
তারা বিশুদ্ধ পানির জন্য চরম সংকটে ভোগছেন। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায়
প্লাবনের পানিতে নিমজ্জিত থাকা বাসা যেমন আলোহীন অন্ধকার। তেমনি বিশুদ্ধ
পানিহীনতায় খাবার পানিসহ রান্নাবান্নার কাজও অচল। তাছাড়া পানিবন্দি থাকায়
বাসা থেকে বের হওয়াও যেমন কষ্টকর। তেমনি রাত দিন বন্দি অবস্থায় অন্ধকার
বাসায় থাকাও যন্ত্রণার। বলতে গেলে বিশুদ্ধ পানি সংকট আর বাসায় খাবার থাকার
পরও তা পানির অভাবে রান্নাবান্না না করতে পারায় চরম সংকটে শহরের
বন্যাকবলিতরা। কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের মো. আব্দুস ছালাম, মো. কনর
মিয়া, শাহীদ আহমেদ ও মাছুম আহমদ জানান তাদের এলাকায় বন্যার পানি কিছুটা
কমতে শুরু করেছে। তবে রাস্তাঘাটের উপর দিয়ে প্রবাহিত বানের পানি অনেকটা
কমলেও বসতবাড়ি থেকে এখন সরেনি পানি। তারা জানান তাদের এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার
পানি, স্যানিটেশন ও খাদ্য সংকট চরমে। তাদের মতো একই অবস্থা জেলার অন্যান্য
উপজেলার বন্যাদুর্গতদের। জানা যায়, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারি
বর্ষণ মনু ও ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের অন্তত ৩৫-৪০টি স্থান ভাঙন ও এখনো
ভাঙার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়ন বোর্ড
মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন সোমবার
দুপুর থেকে জেলার বন্যা পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতি হচ্ছে। নতুন করে কুশিয়ারা
নদীর ১-২টি স্থানে ভাঙন দেখা দিলেও উজান থেকে ঢলের পানি কম আসায় ও ভারি
বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভাঙার ঝুঁকি
অনেকটাই কমছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায় বন্যাকবলিতদের স্বাস্থ্য সেবা
দিতে জেলা জুড়ে ৭৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। তারা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট,
ওরস্যালাইন সহ প্রাথমিক চিকিৎসা ও ঔষধ দিচ্ছেন। এবং পানিবাহিত নানা
রোগবালাই থেকে নিরাপদ থাকতে বন্যাকবলিতদের পরামর্শও দিচ্ছেন।
No comments