পাহাড়ের স্বাভাবিক গড়ন নষ্ট করার কারণেই ঘটছে প্রাণহানি by হুমায়ুন মাসুদ
পাহাড়
ধসের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন পরিবেশবাদীরা। তবে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য,মানুষ তার কৃতকর্মের কারণেই আজ
পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে পড়েছে। পাহাড়ের স্বাভাবিক গড়ন নষ্ট করার কারণেই মূলত
মানুষ এখন মাটিচাপা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
গত বছর রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছেন ১১২ জন। সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আজ (১২ জুন) একই জেলায় আবারও পাহাড় ধসে প্রাণ গেল ১১ জনের। শুধু রাঙামাটি নয়,এভাবে প্রতিবছর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। দিন দিন মৃত্যুর এই মিছিল বাড়ছেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড়ের বেশিরভাগ মাটি বালু নির্ভর। ওই মাটি যখন অতিরিক্ত পানি শোষণ করে নেয়, তখন তার গড়ন নড়বড়ে হয়ে যায়। শক্ত গড়ন নষ্ট হয়ে মাটি সরে যায়। তখন মাটি ধসে পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বালু নির্ভর হলেও পাহাড়গুলো যদি তাদের নিজস্ব গড়নে থাকে, তখন সেগুলো ধসে পড়ার আশংকা কম থাকে। পাহাড় তার নিজস্ব গড়নে থাকলে বৃষ্টির পানি দ্রুত গড়িয়ে নিচে চলে যায়। কিন্তু যখন মানুষ পাহাড় কেটে বা অন্য কোনোভাবে পাহাড়ের গড়ন নষ্ট করে, তখন পাহাড়ের মাটি অধিকমাত্রায় পানি শোষণ করার সুযোগ পায়। এ কারণেই কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়ে।’
ড. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘শুধু বসবাস করার জন্য পাহাড় কাটা হচ্ছে অথবা মাটির গড়ন নষ্ট করা হচ্ছে তা নয়। পাহাড়ে চাষাবাদ করতে গিয়েও এর মাটির গড়ন নষ্ট করা হচ্ছে। যে কারণে এখন অনেক জনবসতিহীন পাহাড়ও ধসে পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘থাকার জন্য হোক আর চাষাবাদের জন্য হোক কোনোভাবেই পাহাড়ের মাটির গড়ন নষ্ট করা উচিত নয়। পাহাড়ের গড়ন নষ্ট করলে পাহাড় ধসে পড়বেই।’
গোলাম কিবরিয়ার মতো একই মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মতো পাহাড়কেও সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে যদি আইন প্রণয়ন করা যায় এবং আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায়, তবে পাহাড় ধসে প্রাণহানি রোধ করা যাবে; অন্যাথায় এটি রোধ করা সম্ভব নয়।’
ড. মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘মাইকিং করে, উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে পাহাড়ে বসতিরোধ করা সম্ভব নয়। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের কিছু লোক একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে পাহাড়গুলো দখল করে। পরে সেখানে ঘর তুলে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে তা ভাড়া দিয়ে দেয়। পাহাড়ে বসতিরোধ করতে হলে ওইসব লোককে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ভূমিদুস্যরা প্রথমে গ্রামীণ জনপদ থেকে আসা ভাসমান মানুষকে পাহাড়ের পাদদেশে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। এরপর পাহাড় কেটে জায়গাটা সম্প্রসারিত করে। তারপর সেখানে ঘর তুলে ভাড়া দিতে থাকে এবং একপর্যায়ে নিজেকে ওই জায়গার মালিক দাবি করে।’
মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ পাহাড় এই প্রক্রিয়ায় দখল হয়ে গেছে। পাহাড় বিলীন হয়ে সেসব এলাকায় এখন বড় বড় অট্টালিকা গড়ে উঠেছে।’
ড. মাকসুদুর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের মিল পাওয়া গেছে। নগরীর মতিঝরনা, টাংকির পাহাড়, খুলশী পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, একেখান পাহাড়, বাটালী হিল, আকবরশাহ –এসব পাহাড়ে দিন দিন জনবসতি বাড়ছে। পাঁচ বছর আগে যে পাহাড়ে একশ’ পরিবার থাকতো, এখন সেসব পাহাড়ে কয়েক শত পরিবার বসবাস করছে। পাহাড় ধসে প্রাণহানির পরও সেখানে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠছে।
অন্যদিকে, পাহাড়ে বসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিলও বাড়ছে। গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে চার শতাধিক মানুষ পাহাড় ধসে মারা গেছেন। যদিও এ বিষয়ে বিভাগীয় কার্যালয়ে সুর্নিদিষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পত্র-পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১০ বছর চট্টগ্রাম বিভাগে ৪১৩ জন পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছেন।
২০০৭ সালের ১১ জুন মধ্যরাত থেকে প্রবল বর্ষণের পর একযোগে নগরীর কুসমবাগ, কাইচ্যাঘোনা, সেনানিবাসের লেডিস ক্লাব সংলগ্ন লেবুবাগান, বায়েজিদ বোস্তামী, লালখান বাজারের মতিঝরনা পাহাড়সহ সাতটি পৃথক স্থানে পাহাড় ধসে নিহত হন ১২৭ জন।
২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট নগরীল লালখান বাজার মতিঝরনা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যায় চার পরিবারের ১২ জন। এরপর ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেওয়াল ধসে মারা যায় একই পরিবারের পাঁচ জনসহ মোট ১৭ জন।
২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর আকবর শাহ, উত্তর পাহাড়তলীর বিশ্বকলোনি, মক্কীঘোণা ও বাঁশখালীতে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে মারা যায় ২৩ জন। একই বছরের ২৬ এবং ২৭ জুন কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেটে পাহাড় ধসে মারা যান আরও ৬১ জন।
২০১৫ সালের ২৬ এবং ২৭ জুন ধস আর পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে মারা যান ১৯ জন। ২০১৭ সালের ২০ মে আনোয়ারায় পাহাড় কাটার সময় মাটি চাপায় নিহত হন এক শ্রমিক। একই বছরের ১৩ জুন রাঙামাটিতে ১১০ জন, চট্টগ্রামে ২৩ জন, বান্দরবানে ছয় জন, কক্সবাজারে দুই জন ও খাগড়াছড়িতে একজনের প্রাণহানি ঘটে। সর্বশেষ আজ (১২ জুন) রাঙামাটির নানিয়ারচরে পাহাড় ধসে মারা যান ১১ জন।
পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরিফ চৌহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে পাহাড় ধসে মৃত্যুরোধ করা যাচ্ছে না। বর্ষা এলে প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু বর্ষা চলে গেলে আর তাদের কোনও খোঁজ খবর থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে কতজন লোক বসবাস করছে, সেই তালিকা পর্যন্ত প্রশাসনের কাছে নেই। বর্ষা এলে জরিপ শুরু হয় প্রশাসনের। জরিপ শেষ হওয়ার আগেই আবার পেরিয়ে যায় বর্ষা। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি বছরে দুয়েকটি বৈঠক করে। বৈঠকে পাহাড়ে বসতিরোধে তারা বিভিন্ন সুপারিশ দেয়। কিন্তু এসব সুপারিশ কার্যকর হয় না।
এ সম্পর্কে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) শংকর রঞ্জন সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি। অভিযান চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতঘরগুলো উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তারপরও পাহাড়ে বসতিরোধ করা যাচ্ছে না। আর যতদিন পাহাড়ে বসতিরোধ করা যাবে না ততদিন পাহাড় ধসে প্রাণহানি রোধ করা যাবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্পেশাল কোনও আইন না থাকায় যারা পাহাড় বসতি স্থাপন করে তাদের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত মামলা দায়ের করি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অধীনে এনে এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে পাহাড়ে বসতি অনেক কমে যেতো।’
এসময় পাহাড় ধসে হতাহতের তালিকার বিষয়ে সন্তোষজনক কোনও উত্তর দিতে পারেননি অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার। তবে তিনি বলেন,‘এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনও তালিকা আমাদের কাছে নেই। যখন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে, তখন আমরা নিহতদের তালিকা প্রস্তুত করি, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই তালিকা আমাদের কাছেও থাকে। তবে সেটি রিপোর্ট আকারে সংরক্ষণ করে রাখা হয় না।’
এসময় তিনি পাহাড় ধসে নিহতদের তালিকার জন্য অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) নুরুল আলম নোমানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ১০ বছরে পাহাড় ধসে নিহতদের কোনও পরিসংখ্যান তালিকাবদ্ধভাবে নেই। বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তথ্য ঘেঁটে নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে।’
গত বছর রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছেন ১১২ জন। সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আজ (১২ জুন) একই জেলায় আবারও পাহাড় ধসে প্রাণ গেল ১১ জনের। শুধু রাঙামাটি নয়,এভাবে প্রতিবছর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। দিন দিন মৃত্যুর এই মিছিল বাড়ছেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড়ের বেশিরভাগ মাটি বালু নির্ভর। ওই মাটি যখন অতিরিক্ত পানি শোষণ করে নেয়, তখন তার গড়ন নড়বড়ে হয়ে যায়। শক্ত গড়ন নষ্ট হয়ে মাটি সরে যায়। তখন মাটি ধসে পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বালু নির্ভর হলেও পাহাড়গুলো যদি তাদের নিজস্ব গড়নে থাকে, তখন সেগুলো ধসে পড়ার আশংকা কম থাকে। পাহাড় তার নিজস্ব গড়নে থাকলে বৃষ্টির পানি দ্রুত গড়িয়ে নিচে চলে যায়। কিন্তু যখন মানুষ পাহাড় কেটে বা অন্য কোনোভাবে পাহাড়ের গড়ন নষ্ট করে, তখন পাহাড়ের মাটি অধিকমাত্রায় পানি শোষণ করার সুযোগ পায়। এ কারণেই কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়ে।’
ড. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘শুধু বসবাস করার জন্য পাহাড় কাটা হচ্ছে অথবা মাটির গড়ন নষ্ট করা হচ্ছে তা নয়। পাহাড়ে চাষাবাদ করতে গিয়েও এর মাটির গড়ন নষ্ট করা হচ্ছে। যে কারণে এখন অনেক জনবসতিহীন পাহাড়ও ধসে পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘থাকার জন্য হোক আর চাষাবাদের জন্য হোক কোনোভাবেই পাহাড়ের মাটির গড়ন নষ্ট করা উচিত নয়। পাহাড়ের গড়ন নষ্ট করলে পাহাড় ধসে পড়বেই।’
গোলাম কিবরিয়ার মতো একই মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মতো পাহাড়কেও সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে যদি আইন প্রণয়ন করা যায় এবং আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায়, তবে পাহাড় ধসে প্রাণহানি রোধ করা যাবে; অন্যাথায় এটি রোধ করা সম্ভব নয়।’
ড. মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘মাইকিং করে, উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে পাহাড়ে বসতিরোধ করা সম্ভব নয়। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের কিছু লোক একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে পাহাড়গুলো দখল করে। পরে সেখানে ঘর তুলে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে তা ভাড়া দিয়ে দেয়। পাহাড়ে বসতিরোধ করতে হলে ওইসব লোককে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ভূমিদুস্যরা প্রথমে গ্রামীণ জনপদ থেকে আসা ভাসমান মানুষকে পাহাড়ের পাদদেশে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। এরপর পাহাড় কেটে জায়গাটা সম্প্রসারিত করে। তারপর সেখানে ঘর তুলে ভাড়া দিতে থাকে এবং একপর্যায়ে নিজেকে ওই জায়গার মালিক দাবি করে।’
মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ পাহাড় এই প্রক্রিয়ায় দখল হয়ে গেছে। পাহাড় বিলীন হয়ে সেসব এলাকায় এখন বড় বড় অট্টালিকা গড়ে উঠেছে।’
ড. মাকসুদুর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের মিল পাওয়া গেছে। নগরীর মতিঝরনা, টাংকির পাহাড়, খুলশী পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, একেখান পাহাড়, বাটালী হিল, আকবরশাহ –এসব পাহাড়ে দিন দিন জনবসতি বাড়ছে। পাঁচ বছর আগে যে পাহাড়ে একশ’ পরিবার থাকতো, এখন সেসব পাহাড়ে কয়েক শত পরিবার বসবাস করছে। পাহাড় ধসে প্রাণহানির পরও সেখানে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠছে।
অন্যদিকে, পাহাড়ে বসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিলও বাড়ছে। গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে চার শতাধিক মানুষ পাহাড় ধসে মারা গেছেন। যদিও এ বিষয়ে বিভাগীয় কার্যালয়ে সুর্নিদিষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পত্র-পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১০ বছর চট্টগ্রাম বিভাগে ৪১৩ জন পাহাড় ধসে প্রাণ হারিয়েছেন।
২০০৭ সালের ১১ জুন মধ্যরাত থেকে প্রবল বর্ষণের পর একযোগে নগরীর কুসমবাগ, কাইচ্যাঘোনা, সেনানিবাসের লেডিস ক্লাব সংলগ্ন লেবুবাগান, বায়েজিদ বোস্তামী, লালখান বাজারের মতিঝরনা পাহাড়সহ সাতটি পৃথক স্থানে পাহাড় ধসে নিহত হন ১২৭ জন।
২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট নগরীল লালখান বাজার মতিঝরনা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যায় চার পরিবারের ১২ জন। এরপর ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেওয়াল ধসে মারা যায় একই পরিবারের পাঁচ জনসহ মোট ১৭ জন।
২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর আকবর শাহ, উত্তর পাহাড়তলীর বিশ্বকলোনি, মক্কীঘোণা ও বাঁশখালীতে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে মারা যায় ২৩ জন। একই বছরের ২৬ এবং ২৭ জুন কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেটে পাহাড় ধসে মারা যান আরও ৬১ জন।
২০১৫ সালের ২৬ এবং ২৭ জুন ধস আর পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে মারা যান ১৯ জন। ২০১৭ সালের ২০ মে আনোয়ারায় পাহাড় কাটার সময় মাটি চাপায় নিহত হন এক শ্রমিক। একই বছরের ১৩ জুন রাঙামাটিতে ১১০ জন, চট্টগ্রামে ২৩ জন, বান্দরবানে ছয় জন, কক্সবাজারে দুই জন ও খাগড়াছড়িতে একজনের প্রাণহানি ঘটে। সর্বশেষ আজ (১২ জুন) রাঙামাটির নানিয়ারচরে পাহাড় ধসে মারা যান ১১ জন।
পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরিফ চৌহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে পাহাড় ধসে মৃত্যুরোধ করা যাচ্ছে না। বর্ষা এলে প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু বর্ষা চলে গেলে আর তাদের কোনও খোঁজ খবর থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে কতজন লোক বসবাস করছে, সেই তালিকা পর্যন্ত প্রশাসনের কাছে নেই। বর্ষা এলে জরিপ শুরু হয় প্রশাসনের। জরিপ শেষ হওয়ার আগেই আবার পেরিয়ে যায় বর্ষা। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি বছরে দুয়েকটি বৈঠক করে। বৈঠকে পাহাড়ে বসতিরোধে তারা বিভিন্ন সুপারিশ দেয়। কিন্তু এসব সুপারিশ কার্যকর হয় না।
এ সম্পর্কে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) শংকর রঞ্জন সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি। অভিযান চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতঘরগুলো উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তারপরও পাহাড়ে বসতিরোধ করা যাচ্ছে না। আর যতদিন পাহাড়ে বসতিরোধ করা যাবে না ততদিন পাহাড় ধসে প্রাণহানি রোধ করা যাবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্পেশাল কোনও আইন না থাকায় যারা পাহাড় বসতি স্থাপন করে তাদের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত মামলা দায়ের করি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অধীনে এনে এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে পাহাড়ে বসতি অনেক কমে যেতো।’
এসময় পাহাড় ধসে হতাহতের তালিকার বিষয়ে সন্তোষজনক কোনও উত্তর দিতে পারেননি অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার। তবে তিনি বলেন,‘এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনও তালিকা আমাদের কাছে নেই। যখন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে, তখন আমরা নিহতদের তালিকা প্রস্তুত করি, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই তালিকা আমাদের কাছেও থাকে। তবে সেটি রিপোর্ট আকারে সংরক্ষণ করে রাখা হয় না।’
এসময় তিনি পাহাড় ধসে নিহতদের তালিকার জন্য অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) নুরুল আলম নোমানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ১০ বছরে পাহাড় ধসে নিহতদের কোনও পরিসংখ্যান তালিকাবদ্ধভাবে নেই। বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তথ্য ঘেঁটে নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে।’
No comments