পুরুষ কবে ‘মানুষ’ হয়ে উঠবে? by নিশাত সুলতানা

সারা দিনের কর্মক্লান্তি শেষে সন্ধ্যায় সবে বাসায় ফিরেছি। একটু বাদে কলবেলের অস্থির শব্দ। দরজা খুলতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পাশের ফ্ল্যাটের গৃহকর্মে সাহায্যকারী মেয়েটি। বয়সে সবে তরুণী হয়ে উঠলেও নয় ও চার বছর বয়সী দুটি সন্তানের মা তিনি।
মেয়েটি কেন জানি যেকোনো আনন্দে কিংবা দুঃখে আমার কাছেই প্রথমে আসেন। দেখলাম তাঁর সারা শরীরে আঘাতের অসংখ্য চিহ্ন। কপালের পাশে একটি জায়গা থেঁতলানো, পুরো কপাল গেছে ফুলে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই কান্নার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। কান্না কিছুটা প্রশমিত হলে তাঁর কাছ থেকে যা জানতে পারলাম তা হলো, কয়েকটি বাসায় কাজ করে মেয়েটি যা উপার্জন করেন তার প্রায় সম্পূর্ণটাই তিনি তাঁর স্বামীর হাতে তুলে দেন। বাকি সামান্য অর্থটুকু তিনি তাঁর নিজের ও সন্তানের কথা ভেবে স্বামীর অগোচরে ঘরের কোনো এক কোনায় জমা করেছিলেন। সেই যত্সামান্য গুপ্তধন সেদিন তাঁর স্বামীটি উদ্ধার করে ফেলেন, আর এতেই বেধে যায় তুলকালাম কাণ্ড। অর্থের উৎস হিসেবে প্রথমত মেয়েটির চরিত্র নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করা হয়। সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে না পেরে মেয়েটিকে অপরাধী করা হয় কেন তিনি তাঁর স্বামীকে প্রকৃত আয়ের প্রতিবেদন গোপন করে এই অর্থ জমা করেছেন। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাঁর সঞ্চিত টাকাপয়সা তো কেড়ে নেওয়া হয়ই, উপরন্তু তাঁকে এমন মার দেওয়া হয় যেন ভবিষ্যতে তিনি এ ধরনের কাজ করার আগে সাতবার ভাবনাচিন্তা করেন।
প্রতিদিন সকালে অফিস সহকারী মেয়েটির মিষ্টি হাসিমুখ দেখে কর্মদিবসের শুভসূচনা হয় আমার। কিন্তু সেদিন মেয়েটির মুখের হাসি কোথায়! হাসির বদলে তাঁর মুখে একরাশ বিষণ্নতা। কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি অকপটে জানালেন, স্বামী তাঁকে আগের রাতে মারধর করেছেন। মারধরের কারণ সন্তানেরা পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েছে। তাই দোষ তো নিশ্চিতভাবেই সন্তানগুলোর মায়ের! মেয়েটি খুব বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেননি, কোনো রকমে এসএসসি পাস করেছেন। কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় খুব একটা অবদান রাখার সক্ষমতা তাঁর না থাকলেও সন্তানের ব্যাপারে তাঁর মধ্যে কখনো কোনো উদাসীনতা দেখিনি। তাঁকে তাঁর স্বামী নিষ্ঠুরভাবে মেরেছেন আর বলেছেন সামনের পরীক্ষায় ছেলেমেয়েদের ফলাফলের অবনতি হলে তাঁকে বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত করা হবে এবং এটাই তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ‘কীভাবে সন্তানদের পড়ালেখার উন্নতি হবে’-এ প্রশ্ন করায় মেয়েটি কয়েকটি অতিরিক্ত পিটুনি খেয়েছেন। মেয়েটির স্বামী সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান, অনেক ব্যস্ততা তাঁর। এসব ভিত্তিহীন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় কোথায় তাঁর?
সমাজের চোখে অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ও খুবই সম্মানজনক এক পেশায় রয়েছেন আমার আরেক পরিচিতা। সন্তানকে স্কুলে রাখার সময় কিংবা স্কুল থেকে নেওয়ার সময় কখনো কখনো দেখা হয় আমাদের। সন্তানের স্কুলসংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের সূত্র ধরে আমাদের মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। ভদ্রমহিলার স্বামীও সমাজের উঁচুতলার মানুষ এবং সবাই তাঁকে বেশ সমীহ করেই চলে। সেই ভদ্রমহিলার কাছ থেকে প্রায়ই শুনি স্বামী কর্তৃক আরেক কদর্য নির্যাতনের কথা। প্রায়ই স্বামী তাঁকে ধর্ষণ করেন। আর এ বিষয়টি তিনি নীরবে সয়ে যান, কাউকেই বলতে পারেন না। কারণ স্বামী কর্তৃক যৌন নির্যাতনকে এ সমাজ ধর্ষণ বলে স্বীকার করে না। তাই বল প্রয়োগের এই বিষয়টিতে যতই কদর্যতা বা পাশবিকতা থাকুক না কেন আমাদের সমাজে এটি স্বীকৃত এবং একে নীরবে মেনে নেওয়ার শিক্ষাই মেয়েদের দেওয়া হয়। ধর্ষণের পাশাপাশি এই ভদ্রমহিলা মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হন। প্রায়ই তিনি বিবাহবিচ্ছেদের কথা ভাবলেও শেষ পর্যন্ত সমাজ, সংসার আর সন্তানদের কথা ভেবে পিছিয়ে যান। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে শতকরা আশি ভাগ নারীই তাঁদের বিবাহিত জীবনে অন্তত একবার হলেও তাঁদের স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে যৌন নির্যাতন, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নির্যাতন। এর মধ্যে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের মাত্রা সবচেয়ে ভয়ংকর। প্রতিবেদনটিতে পুরুষের কর্তৃত্বমূলক মনোভাবই এই নির্যাতনগুলোর অন্যতম বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই যে সমাজের নিম্ন স্তর থেকে উচ্চ স্তরের তিনটি নারীর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরলাম, তাঁদের প্রত্যেককেই পরামর্শ দিয়েছিলাম স্বামীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু তাঁরা তা করতে অনিচ্ছুক।
এই তিনজন নারীই কিন্তু আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী, স্বামীর ওপর নির্ভরশীল নন। কিন্তু এত নির্যাতনের পরও তাঁরা চান না তাঁদের স্বামীরা শ্রীঘরে যাক, কষ্ট পাক। এই যে এত অত্যাচার আর নির্যাতন সহ্য করার পরও, নারী পুরুষের প্রতি উদার সেটি প্রত্যক্ষ করার পরও পুরুষ নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হননি। বরং তা পুরুষকে নারীর প্রতি আরও বেশি সহিংস করে তুলছে। বিবিএসের জরিপে আরও দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ নির্যাতনের বিপরীতে মাত্র ২.৬ শতাংশ বিবাহিত নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। এই বাস্তবতায় আমরা কী করে আশা করতে পারি যে সামনের দিনগুলোতে পারিবারিক সহিংসতা কমে আসবে? এত অত্যাচার আর নির্যাতন সহ্য করার পরও পুরুষকে বারবার নারী ক্ষমা করেছে মানবিকতার কারণে এবং বৃহত্তর পারিবারিক স্বার্থে। কিন্তু অধিকাংশ পুরুষ তলিয়ে দেখেন না যে পুরুষকে বারবার ক্ষমা করার পেছেনে শুধু উদারতা নয়, বরং পুরুষের প্রতি নারীর করুণাও মিশে আছে। সংবেদনশীল ও প্রকৃত পুরুষেরা নিশ্চিতভাবেই এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করেন। নারীকে তাঁরা মানুষ হিসেবে সম্মান করেন। কিন্তু বাকি এবং আমাদের সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাকথিত পুরুষেরা তা বুঝবে কবে? কবে তারা ‘মানুষ’ হয়ে উঠবে?
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
purba_du@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.