স্বাধীনতার মাসকে স্বাগত জানাতে কিছু প্রিয়-অপ্রিয় কথা by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম
পরাজিত শত্রু ও অপরাজিত শত্রু
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স এখন ৪৬ বছর শেষ হয়ে আরো আড়াই মাস পার হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার গুরুত্ব, তাৎপর্যপূর্ণ যেই একটি মহান কারণে, সেটি হলো, ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। একটি ব্যতিক্রমী যুগপৎ ইতিহাসগত ও কৌশলগত ঘটনা উল্লেখ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে। ওই তারিখে এবং তার পরবর্তী দিনগুলোতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যেই অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে তথা নতুন (সদ্য স্বাধীনতা ঘোষিত) বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থান করছিল, তাদের অবস্থানটি ছিল অবৈধ এবং তাদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল দখলদার ও হানাদার হিসেবে। সেই দখলদার ও হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। তাই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। অর্থাৎ, আমরা স্বাধীনতা ঘোষণার পর যুদ্ধ করেছি। আমি উল্লেখ করেছি : ‘শত্রুমুক্ত করা হয়েছিল।’ সেই শত্রুগুলো ছিল সৈন্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তি তথা মানুষ। কিন্তু এই ৪৬টি বছরে আমরা অনেক বিষয়ে অনেক উন্নতি করেছি সত্য কিন্তু আমরা অন্য অনেক ধরনের শত্রুকে পরাভূত করতে পারিনি যথা- দুর্নীতি, মানুষে মানুষে বৈষম্য, অঞ্চলে অঞ্চলে বৈষম্য, রাজনৈতিক দলে দলে প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক খুন এবং ক্ষমতা ক্ষুক্ষিগত করার প্রবণতা ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধ করেছেন; মুক্তিযুদ্ধ করেননি
মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক কর্মীগণ এবং রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা ব্যতীত আরো প্রচুর লোক এই মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। যথা : সঙ্গীতশিল্পী, সাংবাদিক, ভারতের মাটিতে ও বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে কর্মরত কূটনীতিক, ভারতে ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিকারী নেতাকর্মী, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের সাহায্য প্রদানের নিমিত্তে অর্থ সংগ্রহকারী ও জনমত সৃষ্টিকারী নেতাকর্মী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাঠে-ময়দানে কোনো-না-কোনো পেশায় লিপ্ত কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে স্বাধীনতা কামনা করে ও সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছের এরূপ ব্যক্তিরা। ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন এমন রাজনৈতিক শক্তি তখন বিদ্যমান ছিল, সুযোগ পেয়েও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি এমন আমলা বা সরকারি কর্মকর্তাও তখন প্রচুর ছিলেন এবং মাঠে-ময়দানে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে ভূমিকা রেখেছেন এমন ব্যক্তিরাও তখন ছিলেন। যেমন কিনা ছিলেন লাখ লাখ অন্যান্য প্রকৃতির ও পেশার মানুষ, যারা বয়সের কারণে, সাংসারিক কারণে, অসুস্থতার কারণে, জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশের মাটি ত্যাগ করে ভারতের মাটিতে যেতে পারেননি; কিন্তু মনে মনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছেন। এটাও আমরা ভুলিনি যে, প্রচুর তরুণ ও যুবক বাংলাদেশের ভেতরে থেকে গেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেননি, ভারতে যেতেও চেষ্টা করেননি তাদের চরম কাপুরুষতার কারণে অথবা তাদের চরম সুবিধাবাদী চেতনার কারণে। আজকের কলামের উদ্দেশ্য মোটেই এটা নয় যে, কারা মুক্তিযোদ্ধা এবং তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত অথবা কারা মুক্তিযোদ্ধা নয় অথবা কারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা; সেটা অন্য দিন। যে যে নিয়মেই যুদ্ধ করে থাকি না কেন, যে যেভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখে থাকি না কেন, তার মধ্যেও কম এবং বেশি পার্থক্য অবশ্যই করা যাবে; সেই পার্থক্য আলোচনা করাটাও আজকের কলামের উদ্দেশ্য নয়। আজকের কলামের উদ্দেশ্য, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবার স্বপ্নের কথা একটু বলা; সেই স্বপ্নের বিধ্বস্ত অবস্থার করুণ কাহিনী বলা এবং আবেদন করা আমরা সেই ভগ্নস্তূপ থেকে পুনরায় ফিরে দাঁড়াতে পারি কি না। কলামটির আকার বা দৈর্ঘ্য, আমার অন্যান্য কলামের মতোই।
স্বাধীনতার লক্ষ্য এবং সংবিধানের মূলনীতি
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্স গৃহীত, ঘোষিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, ওই প্রোক্লামেশনের অনুসরণে একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল। যার নাম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার বা মুজিবনগর সরকার। যুদ্ধের শেষে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত এবং গৃহীত ও কার্যকর করা হয়েছিল। আজকের সংক্ষিপ্ত কলামে বিস্তারিত বর্ণনা দেবো না। তবে, সেই ঘোষণাপত্রের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদের পরে এবং ১২ নম্বর অনুচ্ছেদের আগে লেখা আছে এরূপ একটি কথা : ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম...।’ এইমাত্র উদ্ধৃত বাক্যটিতে বলা আছে স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজের কী বৈশিষ্ট্য হবে; বৈশিষ্ট্য হবে সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। ইংরেজি পরিভাষায় ইকুয়ালিটি, হিউম্যান ডিগনিটি এবং সোশ্যাল জাস্টিস। ১৯৭১-এর এপ্রিলের প্রোক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্সের পূর্ণ বিবরণ বা সেখানে কী ছিল বা তার শব্দ ও বাক্যগুলো কী, সেটা যদি কোনো আগ্রহী ব্যক্তি জানতে চান, তাহলে তিনি উপযুক্ত বই সংগ্রহ করবেন অথবা ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ করে, গুগল সার্চ দিয়ে জানতে চেষ্টা করবেন। ১৯৭২ সালে রচিত গৃহীত ও কার্যকর করা বাংলাদেশের সংবিধানে কী ছিল বা আছে সেটা জানার জন্য ইন্টারনেট জগতের সাহায্য নেয়া যায় অথবা, উন্মুক্ত বাজার থেকে বাংলাদেশের একটি হালনাগাদ সংবিধান ক্রয় করা যায়। এই কলাম যতসংখ্যক সম্মানিত ব্যক্তি পাঠ করবেন, তার মধ্যে সবাই অবশ্যই এতটুকু পরিশ্রম করতে পারবেন না বা করবেন না; এটা আমি অনুমান করি; এতে কোনো আফসোসও নেই; সবার দ্বারা সব কিছু সম্ভব নয়; সবার জন্য সব কিছু জানা প্রয়োজনও নয়। সেই সংবিধানে সব কিছুর শুরুতে আছে প্রস্তাবনা। প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ মোতাবেক যেই চারটি মহান আদর্শ বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদেরকে প্রাণ-উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল সেগুলো হলোÑ এক. জাতীয়তাবাদ, দুই. সমাজতন্ত্র, তিন. গণতন্ত্র ও চার. ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় অনুচ্ছেদে লেখা আছে : ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ যদিও সংবিধান থেকে বিস্তারিত উদ্ধৃতি দিইনি, সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি দিয়েছি, তথাপি আমি সারমর্ম হিসেবে উপস্থাপন করতে পারি যে, ১৯৭১ বা ১৯৭২-এ যে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বপ্নগুলো আমাদের নেতারা বা গুরুজনেরা দেখেছিলেন এবং লিপিবদ্ধ করেছিলেন, ২০১৮ সালে এসে আমরা সেগুলোতে প্রবল বিচ্যুতি দেখি বা সেগুলোর মধ্যে প্রবল ঘাটতি দেখি। তরুণদের স্বপ্নের কথা একটু পরেই আছে।
১৯৭১-এর ত্যাগ এবং আজকের ত্যাগ
৯ মাসব্যাপী যারা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, অস্ত্র হাতে বা অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে, তাদের ৯০ শতাংশের বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত ছিল। সেই তরুণেরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে তথা হাসিমুখে শত্রুর গুলির মুখে দাঁড়িয়ে নয়টি মাস পার করেছেন। প্রতিটি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, কতবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, সেটি তিনি নিজেও সম্ভবত নিখুঁতভাবে জানেন না; মহান সৃষ্টিকর্তাই জানেন। সেই অকুতোভয় তরুণদের মনে একটি স্বপ্ন ছিল। সেই ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের তরুণ যোদ্ধাদের ত্যাগের কথা আজকের তরুণেরা খুব কমই জানেন, জানলেও ছাপার অক্ষরে ১০-২০টি লাইনে সেটি পড়ার মাধ্যমে সেই ত্যাগের তাৎপর্য অনুধাবন করতে অপারগ হন। একই কারণে, আজকের তরুণেরা সে দিনের রণাঙ্গনের তরুণদের স্বপ্নকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সে দিনের তরুণদের স্বপ্নের মধ্যে অন্যতম ছিলÑ একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ, যে দেশের মালিক হবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ; যে দেশে তরুণেরা উদ্যোগ নিয়ে নিজের পেশাগত জীবন গড়ার জন্য স্বাধীনতা ভোগ করবেন। আজকে (১৯৭১-এর তরুণ এবং) ২০১৮ সালের প্রবীণ ইবরাহিম, আজকের তরুণদের কাছে প্রশ্ন করতেই পারেন, আপনারা কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য বদ্ধ পরিকর; যদি আপনারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে তাহলে আপনাদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং যুগপৎ আদালত, অফিস, স্কুল-কলেজে, রাজপথে আন্দোলন করতে হবে। ১৯৭১-এ ইবরাহিম এবং তার মতো তরুণদের সংগ্রাম ছিল অস্ত্রের মাধ্যমে; আপনাদের সংগ্রাম হবে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ অবশ্যই বিনা অস্ত্রের।
গণতন্ত্র ও সমাজের রূপের বর্ণনা
আপনারা যারা আজকের তরুণ, আপনারা কী বলবেন জানি না, কিন্তু আমার মতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অপূর্ণ, আঘাতপ্রাপ্ত, প্রতিবন্ধী। এই অপূর্ণ আঘাতপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী গণতন্ত্রের কারণেই আমাদের বর্তমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয় এত বেশি যে, অনৈতিকতাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অপূর্ণ আঘাতপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী গণতন্ত্রের কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এত ব্যাপক এবং বিস্তর যে, দুর্নীতিতে এখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও অবলীলাক্রমে দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই অপূর্ণ আঘাতপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী গণতন্ত্রের কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আর্থিক অঙ্গনে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতার প্রচণ্ড ঘাটতি আমরা লক্ষ করছি। এই অপূর্ণ আঘাতপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী গণতন্ত্রের কারণেই আজকের সমাজ মাদকাসক্ত, নকলাসক্ত ও প্রতারণা-আসক্ত। আজকের সমাজ লুটতরাজমুখী। এখন সমাজের দু’টি চেহারা, যথাÑ দিনে একটি এবং রাতে আরেকটি। আমরা কোনোমতেই বলতে পারি না, আজকের সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য অর্থনৈতিক উন্নতি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে কি আমরা এমন কোনো শর্ত জুড়ে দিয়েছিলাম যে, অর্থনৈতিক উন্নতির বিনিময়ে, আমরা নৈতিকতা বিসর্জন দেবো, আমরা প্রতারণার আশ্রয় নেবো, আমরা মাদকে সয়লাব করে নেবো এবং আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেবো? আমাকে যদি উত্তর দিতে হয়, আমি উত্তর দেবো : আমরা এরকম কোনো প্রতিশ্রুতি দিইনি; তাহলে যারা এরূপ অবস্থা সৃষ্টি করেছেন তারা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্ম করছেন না?
প্রতীকী অর্থে আমার পরিচয় ও করণীয়
আজকের কলামের উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টভাবে কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো ব্যক্তিকে হেয় করা নয় বা আক্রমণ করা নয়। আমি প্রথমে একজন মানুষ, অতঃপর একজন মুসলমান, একজন বাঙালি, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন বাংলাদেশী। পেশাগতভাবে আমি ছিলাম সাবেক সৈনিক, এক যুগ ঘুরেছি-ফিরেছি সুশীল বা নাগরিক সমাজের একজন হয়ে। গত এক দশক ধরে পরিশ্রম করছি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। সব পরিচয়ের সমন্বিত নির্যাস হলো মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে; বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে; যেই দেশের জন্য বা যে মানুষের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে; মুসলিম উম্মাহর ভাবমূর্তি ও স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে হবে; বাংলাদেশ নামক প্রিয় মাতৃভূমির স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে আমি রাজনীতিকে আমার কর্মপন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছি। আমার এই সিদ্ধান্তকে কেউ পছন্দ করতে পারেন, আবার কেউ পছন্দ না-ও করতে পারেন; এটাই স্বাভাবিক। যেকোনো সম্মানিত ব্যক্তি আমার সিদ্ধান্ত পছন্দ করুন বা না করুন, এতে আমার কোনো মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক হলো, প্রত্যেক ব্যক্তিকেই একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তটি কী? সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট হলো, আমি দেশ ও দেশের মানুষ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি ও নিয়েছি; সিদ্ধান্ত হলো : আমি কী নিয়মে দেশের প্রতি ও মানুষের প্রতি সেই ঋণ শোধ করব? আমরা সবাই যদি এটা চিন্তা করি, নিশ্চিতভাবেই আজকের বাংলাদেশের পরিবর্তনের জন্য একটি সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
পাঁচটি দেশের প্রাসঙ্গিকতা
আমাদের সবার সুপরিচিত অনেক দেশের মধ্যে কয়েকটির নাম উল্লেখ করছি। আমেরিকা, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার বা বার্মা ইত্যাদি। ১৭৮৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর, ছোট ছোট অনেক রাজনৈতিক ও জাতিগঠনমূলক সঙ্কট পার হয়েছিল আমেরিকা নামক দেশটি; তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সঙ্কট ছিল ১৮৬২-৬৩ সালের গৃহযুদ্ধ; গৃহযুদ্ধের মৌলিক কারণ ছিল যে, দাস প্রথা থাকবে কি থাকবে না; বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট আততায়ীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন। কারণ তারা ছিলেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে; ১৯৬০ দশকেও আমেরিকায় কালো মানুষের মানবাধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে কালো মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে; আজকের উজ্জ্বল আমেরিকা অনেক ত্যাগের ও আন্দোলনের ফসল। জাপান নামক আমাদের অতি পরিচিত দেশটি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমনভাবে পরাজিত হয়েছিল এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, তারা যুদ্ধবিগ্রহ থেকে দূরে থাকার শপথ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের জাতীয় মর্যাদাবোধ এত বেশি যে, সেই মর্যাদাবোধের স্ফুলিঙ্গ সমরে প্রস্ফুটিত না হলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে হয়েছে; জাপান পৃথিবীতে প্রথম পাঁচটি অর্থনৈতিক শক্তির একটি; প্রথম পাঁচটি কারিগরি শক্তির একটি। ভিয়েতনাম নামে যে দেশটি এখন পরিচিত একটি দেশ হিসেবে, সেই দেশটি ১৯৭৩-এর আগে ছিল উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম; প্রথমে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে এবং পরে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এই দেশটি একতাবদ্ধ হয়। সেই দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা আমরা একটু চেষ্টা করলেই জানতে পারব। তাদের উন্নতির অন্যতম কারণ, জাতীয় ঐক্য এবং জনজীবনে অভ্যাসগত শৃঙ্খলা। মালয়েশিয়া নামক দেশটি চার দশক আগেও বাংলাদেশ থেকে তুলনায় অনুন্নত ছিল; আজ সেখানে বাংলাদেশীরা শ্রমিক হিসেবে যায় বৈধ এবং অবৈধ উভয় নিয়মে; বাংলাদেশীদের এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে বন্দী করে অত্যাচার করা হয়; সেই মালয়েশিয়ার উন্নতির অন্যতম কারণ জাতীয় ঐক্য এবং বিদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনা। মিয়ানমার নামক দেশটি, আমাদের বিরুদ্ধে এত প্রকারের অত্যাচারমূলক ও অপমানমূলক কর্মকাণ্ড করছে একমাত্র কারণ তারা সামরিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং পৃথিবীর অন্তত একটি পরাশক্তির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট গাঁটছড়া বেঁধেছে।
জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতা
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে যে অবস্থানে আছে; সেটা অবশ্যই যুগপৎ সুবিধাজনক ও সঙ্কটপূর্ণ। আমাদের এ কথাটা মনে রেখেই আগামী দিনের পথ স্থির করতে হবে। আগামী দিনের পথের রচয়িতা কে? আগামী দিনের পথ রচনা করবে আজকের জ্ঞানী ও গুণীজন, আজকের রাজনৈতিক নেতারা। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আবেদন করছি, আহ্বান জানাচ্ছি, এ বছর আমরা একটা ব্যতিক্রমী কাজ করতে চেষ্টা করি। জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে জাতীয় সমঝোতা গড়ে তুলতে চেষ্টা করি; যেমনটি করেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। বাংলাদেশে কালো-সাদা মানুষের বিভেদ নেই; বাংলাদেশে আছে রাজনৈতিক দর্শনের বিভেদ। এক দিকে আছে মধ্য-ডানপন্থী বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট, অন্য দিকে মধ্য-বামপন্থী আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন জোট। দু’টি জোটের বাইরে আছে কিছু মধ্যপন্থী দল ও কিছু ডানপন্থী দল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন অতএব সুবিধা ভোগ করছে বেশি ও অতএব তাদের দায়িত্বও বেশি। জাতীয় ঐক্য বা জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হচ্ছে কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা জোট অন্য কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা জোটকে রাজনীতির ময়দান থেকে নির্মূল করতে চাইবে না; উদ্যোগ নেবে না। এ জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার অনেক উপাত্ত থাকতে পারে কিন্তু আমার বিবেচনায় ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত আমি উল্লেখ করলাম। যথাÑ এক. ২০১৭-১৮ সালের ব্যাখ্যা নয়, ১৯৭১-৭২ সালের ব্যাখ্যা মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দুই. সব ধর্মের ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা, তিন. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনা, চার. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী বড়-ছোট সব জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার ও প্রস্ফুটিত হওয়ার চেতনা, পাঁচ. অর্থনৈতিক কর্মে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা এবং সেই অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা, ছয়. সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনা করা। এ পর্যায়ে আমার নিবেদন : সমগ্র বাংলাদেশী জাতিকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই ২০১৮ সালকে আমরা কী পরিচয়ে ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য করতে চাই? গণতন্ত্র চূড়ান্ত ধ্বংসের বছর? গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বছর? গণতন্ত্র পুনর্গঠনের বছর? জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার বছর? জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করার সর্বোত্তম বছর?
ঐক্য ও সমঝোতা না হলে কী হতে পারে?
আমরা যদি জাতীয় সমঝোতা গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে আজ থেকে দশ-বিশ বছর পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বরূপ অতি দুর্বল ও ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমরা যদি জাতীয় সমঝোতা গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে আজ থেকে দশ-বিশ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের বা হুমকির (বা উভয়ের) সম্মুখীন হতে পারে। আজ বা আগামীকাল বা আগামী দশকে যারা ক্ষমতায় আছেন বা থাকবেন তারা চলে যাবেন; দশ-বিশ বছর পর তারা হয়ে যাবেন অতীত; তাদের নাম হয় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে অথবা স্বর্ণালি অক্ষরে ইতিহাসের পাতায় লিখিত থাকবে। কোন জায়গায় নিক্ষিপ্ত হবেন বা নাম লিপিবদ্ধ করাবেন সেই অপশন বা পছন্দ কোনটা গ্রহণ করব বা করবেন, সেটার বছর এই ২০১৮ সাল। জিডিপি ৬ শতাংশ থেকে ঐতিহাসিক ৭ শতাংশের ঘরে পৌঁছানো, ঐতিহাসিক সমুদ্রসীমা জয়, ঐতিহাসিক পদ্মা সেতু, ঐতিহাসিক মেট্রোরেল, ঐতিহাসিক মোবাইল ফোনের ফোরজি, ঐতিহাসিক মাতারবাড়ি মহেশখালী প্রজেক্ট, ঐতিহাসিক পায়রাবন্দর প্রজেক্ট, ঐতিহাসিক সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল ইত্যাদির সাথে ঐতিহাসিক বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ঐতিহাসিক বেসিক ব্যাংকের লুটপাট, ঐতিহাসিক জনতা ব্যাংকের লুটপাট, ঐতিহাসিক মানুষগুলোর ঐতিহাসিক খুন, গুম ও অপহরণ, ঐতিহাসিক প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি সব কিছুই ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে নিশ্চিতভাবে। কিন্তু যে জাতি ও দেশের ইতিহাসে এগুলো লেখা থাকবে, সেই জাতি ও দেশের মানুষের মর্যাদা কতটুকু নির্ণীত হবে এবং মর্যাদা কতটুকু ইতিহাসে লেখা থাকবে, সেটাই আলোচ্য বিষয়।
আজকের কলামটি কেন এরূপভাবে লিখলাম?
আজকের কলামটি কেন এরূপভাবে লিখলাম? ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের আগে আগে, অনেক টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত সাধারণ মানুষের ইন্টারভিউ দেখলাম। অনেক চ্যানেলেই বিভিন্ন দিনে অনুরূপ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়েছে, কিন্তু আমি একটি অনুষ্ঠানকে (সময় টিভি) প্রতীকী অর্থে আজকের আলোচনায় রেফারেন্স হিসেবে রাখছি; ওইটা ফেসবুকে জমাও আছে। টেলিভিশনের প্রচারিত ওই অনুষ্ঠানে আটজন কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীর মধ্যে সাতজনই উত্তর দিতে পারেননি ২১ ফেব্রুয়ারি বা শহীদ দিবস বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কী ও কেন? যেসব উত্তর তারা দিয়েছে, সেগুলো শুনলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সচেতন অনেক ব্যক্তি নিজের গালে নিজে চড় মারবেন; দিবসটির প্রতি আমাদের অন্তর্নিহিত অবহেলার ব্যাপ্তি দেখে। তারা উত্তর দিয়েছে ০১. এই দিনে যুদ্ধ হয়েছিল ০২. এই দিনে আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট হয়েছিল ০৩. এই দিন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ইত্যাদি। আরো একটি কথা। পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারছি বিভিন্ন জায়গায় ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হচ্ছে, নাচ-গানের ডিসকো পার্টি দিয়ে মঞ্চ বানিয়ে। আমি উদ্বিগ্ন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও এই দশা হবে, আজ থেকে ১০ বা ২০ বছর পর। শেষ সাবধান বাণীটি এরূপ : যদি পররাষ্ট্র নীতির ভুলের কারণে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হয়, তাহলে মানুষ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কেই দোষারোপ করবে। তাই আমি এই কলাম লিখলাম; আমরা যেন সচেতন হই। আগামীকাল থেকে মার্চ মাস শুরু, এই মার্চ মাসে অনুরূপ কলাম আরো লিখব।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স এখন ৪৬ বছর শেষ হয়ে আরো আড়াই মাস পার হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার গুরুত্ব, তাৎপর্যপূর্ণ যেই একটি মহান কারণে, সেটি হলো, ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। একটি ব্যতিক্রমী যুগপৎ ইতিহাসগত ও কৌশলগত ঘটনা উল্লেখ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে। ওই তারিখে এবং তার পরবর্তী দিনগুলোতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যেই অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে তথা নতুন (সদ্য স্বাধীনতা ঘোষিত) বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থান করছিল, তাদের অবস্থানটি ছিল অবৈধ এবং তাদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল দখলদার ও হানাদার হিসেবে। সেই দখলদার ও হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। তাই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। অর্থাৎ, আমরা স্বাধীনতা ঘোষণার পর যুদ্ধ করেছি। আমি উল্লেখ করেছি : ‘শত্রুমুক্ত করা হয়েছিল।’ সেই শত্রুগুলো ছিল সৈন্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তি তথা মানুষ। কিন্তু এই ৪৬টি বছরে আমরা অনেক বিষয়ে অনেক উন্নতি করেছি সত্য কিন্তু আমরা অন্য অনেক ধরনের শত্রুকে পরাভূত করতে পারিনি যথা- দুর্নীতি, মানুষে মানুষে বৈষম্য, অঞ্চলে অঞ্চলে বৈষম্য, রাজনৈতিক দলে দলে প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক খুন এবং ক্ষমতা ক্ষুক্ষিগত করার প্রবণতা ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধ করেছেন; মুক্তিযুদ্ধ করেননি
মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক কর্মীগণ এবং রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা ব্যতীত আরো প্রচুর লোক এই মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। যথা : সঙ্গীতশিল্পী, সাংবাদিক, ভারতের মাটিতে ও বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে কর্মরত কূটনীতিক, ভারতে ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিকারী নেতাকর্মী, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের সাহায্য প্রদানের নিমিত্তে অর্থ সংগ্রহকারী ও জনমত সৃষ্টিকারী নেতাকর্মী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাঠে-ময়দানে কোনো-না-কোনো পেশায় লিপ্ত কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে স্বাধীনতা কামনা করে ও সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছের এরূপ ব্যক্তিরা। ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন এমন রাজনৈতিক শক্তি তখন বিদ্যমান ছিল, সুযোগ পেয়েও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি এমন আমলা বা সরকারি কর্মকর্তাও তখন প্রচুর ছিলেন এবং মাঠে-ময়দানে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে ভূমিকা রেখেছেন এমন ব্যক্তিরাও তখন ছিলেন। যেমন কিনা ছিলেন লাখ লাখ অন্যান্য প্রকৃতির ও পেশার মানুষ, যারা বয়সের কারণে, সাংসারিক কারণে, অসুস্থতার কারণে, জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশের মাটি ত্যাগ করে ভারতের মাটিতে যেতে পারেননি; কিন্তু মনে মনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছেন। এটাও আমরা ভুলিনি যে, প্রচুর তরুণ ও যুবক বাংলাদেশের ভেতরে থেকে গেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেননি, ভারতে যেতেও চেষ্টা করেননি তাদের চরম কাপুরুষতার কারণে অথবা তাদের চরম সুবিধাবাদী চেতনার কারণে। আজকের কলামের উদ্দেশ্য মোটেই এটা নয় যে, কারা মুক্তিযোদ্ধা এবং তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত অথবা কারা মুক্তিযোদ্ধা নয় অথবা কারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা; সেটা অন্য দিন। যে যে নিয়মেই যুদ্ধ করে থাকি না কেন, যে যেভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখে থাকি না কেন, তার মধ্যেও কম এবং বেশি পার্থক্য অবশ্যই করা যাবে; সেই পার্থক্য আলোচনা করাটাও আজকের কলামের উদ্দেশ্য নয়। আজকের কলামের উদ্দেশ্য, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবার স্বপ্নের কথা একটু বলা; সেই স্বপ্নের বিধ্বস্ত অবস্থার করুণ কাহিনী বলা এবং আবেদন করা আমরা সেই ভগ্নস্তূপ থেকে পুনরায় ফিরে দাঁড়াতে পারি কি না। কলামটির আকার বা দৈর্ঘ্য, আমার অন্যান্য কলামের মতোই।
স্বাধীনতার লক্ষ্য এবং সংবিধানের মূলনীতি
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্স গৃহীত, ঘোষিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, ওই প্রোক্লামেশনের অনুসরণে একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল। যার নাম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার বা মুজিবনগর সরকার। যুদ্ধের শেষে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত এবং গৃহীত ও কার্যকর করা হয়েছিল। আজকের সংক্ষিপ্ত কলামে বিস্তারিত বর্ণনা দেবো না। তবে, সেই ঘোষণাপত্রের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদের পরে এবং ১২ নম্বর অনুচ্ছেদের আগে লেখা আছে এরূপ একটি কথা : ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম...।’ এইমাত্র উদ্ধৃত বাক্যটিতে বলা আছে স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজের কী বৈশিষ্ট্য হবে; বৈশিষ্ট্য হবে সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। ইংরেজি পরিভাষায় ইকুয়ালিটি, হিউম্যান ডিগনিটি এবং সোশ্যাল জাস্টিস। ১৯৭১-এর এপ্রিলের প্রোক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্সের পূর্ণ বিবরণ বা সেখানে কী ছিল বা তার শব্দ ও বাক্যগুলো কী, সেটা যদি কোনো আগ্রহী ব্যক্তি জানতে চান, তাহলে তিনি উপযুক্ত বই সংগ্রহ করবেন অথবা ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ করে, গুগল সার্চ দিয়ে জানতে চেষ্টা করবেন। ১৯৭২ সালে রচিত গৃহীত ও কার্যকর করা বাংলাদেশের সংবিধানে কী ছিল বা আছে সেটা জানার জন্য ইন্টারনেট জগতের সাহায্য নেয়া যায় অথবা, উন্মুক্ত বাজার থেকে বাংলাদেশের একটি হালনাগাদ সংবিধান ক্রয় করা যায়। এই কলাম যতসংখ্যক সম্মানিত ব্যক্তি পাঠ করবেন, তার মধ্যে সবাই অবশ্যই এতটুকু পরিশ্রম করতে পারবেন না বা করবেন না; এটা আমি অনুমান করি; এতে কোনো আফসোসও নেই; সবার দ্বারা সব কিছু সম্ভব নয়; সবার জন্য সব কিছু জানা প্রয়োজনও নয়। সেই সংবিধানে সব কিছুর শুরুতে আছে প্রস্তাবনা। প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ মোতাবেক যেই চারটি মহান আদর্শ বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদেরকে প্রাণ-উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল সেগুলো হলোÑ এক. জাতীয়তাবাদ, দুই. সমাজতন্ত্র, তিন. গণতন্ত্র ও চার. ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় অনুচ্ছেদে লেখা আছে : ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ যদিও সংবিধান থেকে বিস্তারিত উদ্ধৃতি দিইনি, সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি দিয়েছি, তথাপি আমি সারমর্ম হিসেবে উপস্থাপন করতে পারি যে, ১৯৭১ বা ১৯৭২-এ যে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বপ্নগুলো আমাদের নেতারা বা গুরুজনেরা দেখেছিলেন এবং লিপিবদ্ধ করেছিলেন, ২০১৮ সালে এসে আমরা সেগুলোতে প্রবল বিচ্যুতি দেখি বা সেগুলোর মধ্যে প্রবল ঘাটতি দেখি। তরুণদের স্বপ্নের কথা একটু পরেই আছে।
১৯৭১-এর ত্যাগ এবং আজকের ত্যাগ
৯ মাসব্যাপী যারা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, অস্ত্র হাতে বা অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে, তাদের ৯০ শতাংশের বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত ছিল। সেই তরুণেরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে তথা হাসিমুখে শত্রুর গুলির মুখে দাঁড়িয়ে নয়টি মাস পার করেছেন। প্রতিটি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, কতবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, সেটি তিনি নিজেও সম্ভবত নিখুঁতভাবে জানেন না; মহান সৃষ্টিকর্তাই জানেন। সেই অকুতোভয় তরুণদের মনে একটি স্বপ্ন ছিল। সেই ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের তরুণ যোদ্ধাদের ত্যাগের কথা আজকের তরুণেরা খুব কমই জানেন, জানলেও ছাপার অক্ষরে ১০-২০টি লাইনে সেটি পড়ার মাধ্যমে সেই ত্যাগের তাৎপর্য অনুধাবন করতে অপারগ হন। একই কারণে, আজকের তরুণেরা সে দিনের রণাঙ্গনের তরুণদের স্বপ্নকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সে দিনের তরুণদের স্বপ্নের মধ্যে অন্যতম ছিলÑ একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ, যে দেশের মালিক হবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ; যে দেশে তরুণেরা উদ্যোগ নিয়ে নিজের পেশাগত জীবন গড়ার জন্য স্বাধীনতা ভোগ করবেন। আজকে (১৯৭১-এর তরুণ এবং) ২০১৮ সালের প্রবীণ ইবরাহিম, আজকের তরুণদের কাছে প্রশ্ন করতেই পারেন, আপনারা কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য বদ্ধ পরিকর; যদি আপনারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে তাহলে আপনাদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং যুগপৎ আদালত, অফিস, স্কুল-কলেজে, রাজপথে আন্দোলন করতে হবে। ১৯৭১-এ ইবরাহিম এবং তার মতো তরুণদের সংগ্রাম ছিল অস্ত্রের মাধ্যমে; আপনাদের সংগ্রাম হবে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ অবশ্যই বিনা অস্ত্রের।
গণতন্ত্র ও সমাজের রূপের বর্ণনা
আপনারা যারা আজকের তরুণ, আপনারা কী বলবেন জানি না, কিন্তু আমার মতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অপূর্ণ, আঘাতপ্রাপ্ত, প্রতিবন্ধী। এই অপূর্ণ আঘাতপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী গণতন্ত্রের কারণেই আমাদের বর্তমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয় এত বেশি যে, অনৈতিকতাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অপূর্ণ আঘাতপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী গণতন্ত্রের কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এত ব্যাপক এবং বিস্তর যে, দুর্নীতিতে এখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও অবলীলাক্রমে দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই অপূর্ণ আঘাতপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী গণতন্ত্রের কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আর্থিক অঙ্গনে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতার প্রচণ্ড ঘাটতি আমরা লক্ষ করছি। এই অপূর্ণ আঘাতপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী গণতন্ত্রের কারণেই আজকের সমাজ মাদকাসক্ত, নকলাসক্ত ও প্রতারণা-আসক্ত। আজকের সমাজ লুটতরাজমুখী। এখন সমাজের দু’টি চেহারা, যথাÑ দিনে একটি এবং রাতে আরেকটি। আমরা কোনোমতেই বলতে পারি না, আজকের সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য অর্থনৈতিক উন্নতি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে কি আমরা এমন কোনো শর্ত জুড়ে দিয়েছিলাম যে, অর্থনৈতিক উন্নতির বিনিময়ে, আমরা নৈতিকতা বিসর্জন দেবো, আমরা প্রতারণার আশ্রয় নেবো, আমরা মাদকে সয়লাব করে নেবো এবং আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেবো? আমাকে যদি উত্তর দিতে হয়, আমি উত্তর দেবো : আমরা এরকম কোনো প্রতিশ্রুতি দিইনি; তাহলে যারা এরূপ অবস্থা সৃষ্টি করেছেন তারা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্ম করছেন না?
প্রতীকী অর্থে আমার পরিচয় ও করণীয়
আজকের কলামের উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টভাবে কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো ব্যক্তিকে হেয় করা নয় বা আক্রমণ করা নয়। আমি প্রথমে একজন মানুষ, অতঃপর একজন মুসলমান, একজন বাঙালি, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন বাংলাদেশী। পেশাগতভাবে আমি ছিলাম সাবেক সৈনিক, এক যুগ ঘুরেছি-ফিরেছি সুশীল বা নাগরিক সমাজের একজন হয়ে। গত এক দশক ধরে পরিশ্রম করছি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। সব পরিচয়ের সমন্বিত নির্যাস হলো মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে; বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে; যেই দেশের জন্য বা যে মানুষের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে; মুসলিম উম্মাহর ভাবমূর্তি ও স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে হবে; বাংলাদেশ নামক প্রিয় মাতৃভূমির স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে আমি রাজনীতিকে আমার কর্মপন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছি। আমার এই সিদ্ধান্তকে কেউ পছন্দ করতে পারেন, আবার কেউ পছন্দ না-ও করতে পারেন; এটাই স্বাভাবিক। যেকোনো সম্মানিত ব্যক্তি আমার সিদ্ধান্ত পছন্দ করুন বা না করুন, এতে আমার কোনো মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক হলো, প্রত্যেক ব্যক্তিকেই একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তটি কী? সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট হলো, আমি দেশ ও দেশের মানুষ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি ও নিয়েছি; সিদ্ধান্ত হলো : আমি কী নিয়মে দেশের প্রতি ও মানুষের প্রতি সেই ঋণ শোধ করব? আমরা সবাই যদি এটা চিন্তা করি, নিশ্চিতভাবেই আজকের বাংলাদেশের পরিবর্তনের জন্য একটি সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
পাঁচটি দেশের প্রাসঙ্গিকতা
আমাদের সবার সুপরিচিত অনেক দেশের মধ্যে কয়েকটির নাম উল্লেখ করছি। আমেরিকা, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার বা বার্মা ইত্যাদি। ১৭৮৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর, ছোট ছোট অনেক রাজনৈতিক ও জাতিগঠনমূলক সঙ্কট পার হয়েছিল আমেরিকা নামক দেশটি; তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সঙ্কট ছিল ১৮৬২-৬৩ সালের গৃহযুদ্ধ; গৃহযুদ্ধের মৌলিক কারণ ছিল যে, দাস প্রথা থাকবে কি থাকবে না; বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট আততায়ীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন। কারণ তারা ছিলেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে; ১৯৬০ দশকেও আমেরিকায় কালো মানুষের মানবাধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে কালো মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে; আজকের উজ্জ্বল আমেরিকা অনেক ত্যাগের ও আন্দোলনের ফসল। জাপান নামক আমাদের অতি পরিচিত দেশটি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমনভাবে পরাজিত হয়েছিল এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, তারা যুদ্ধবিগ্রহ থেকে দূরে থাকার শপথ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের জাতীয় মর্যাদাবোধ এত বেশি যে, সেই মর্যাদাবোধের স্ফুলিঙ্গ সমরে প্রস্ফুটিত না হলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে হয়েছে; জাপান পৃথিবীতে প্রথম পাঁচটি অর্থনৈতিক শক্তির একটি; প্রথম পাঁচটি কারিগরি শক্তির একটি। ভিয়েতনাম নামে যে দেশটি এখন পরিচিত একটি দেশ হিসেবে, সেই দেশটি ১৯৭৩-এর আগে ছিল উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম; প্রথমে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে এবং পরে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এই দেশটি একতাবদ্ধ হয়। সেই দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা আমরা একটু চেষ্টা করলেই জানতে পারব। তাদের উন্নতির অন্যতম কারণ, জাতীয় ঐক্য এবং জনজীবনে অভ্যাসগত শৃঙ্খলা। মালয়েশিয়া নামক দেশটি চার দশক আগেও বাংলাদেশ থেকে তুলনায় অনুন্নত ছিল; আজ সেখানে বাংলাদেশীরা শ্রমিক হিসেবে যায় বৈধ এবং অবৈধ উভয় নিয়মে; বাংলাদেশীদের এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে বন্দী করে অত্যাচার করা হয়; সেই মালয়েশিয়ার উন্নতির অন্যতম কারণ জাতীয় ঐক্য এবং বিদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনা। মিয়ানমার নামক দেশটি, আমাদের বিরুদ্ধে এত প্রকারের অত্যাচারমূলক ও অপমানমূলক কর্মকাণ্ড করছে একমাত্র কারণ তারা সামরিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং পৃথিবীর অন্তত একটি পরাশক্তির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট গাঁটছড়া বেঁধেছে।
জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতা
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে যে অবস্থানে আছে; সেটা অবশ্যই যুগপৎ সুবিধাজনক ও সঙ্কটপূর্ণ। আমাদের এ কথাটা মনে রেখেই আগামী দিনের পথ স্থির করতে হবে। আগামী দিনের পথের রচয়িতা কে? আগামী দিনের পথ রচনা করবে আজকের জ্ঞানী ও গুণীজন, আজকের রাজনৈতিক নেতারা। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আবেদন করছি, আহ্বান জানাচ্ছি, এ বছর আমরা একটা ব্যতিক্রমী কাজ করতে চেষ্টা করি। জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে জাতীয় সমঝোতা গড়ে তুলতে চেষ্টা করি; যেমনটি করেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। বাংলাদেশে কালো-সাদা মানুষের বিভেদ নেই; বাংলাদেশে আছে রাজনৈতিক দর্শনের বিভেদ। এক দিকে আছে মধ্য-ডানপন্থী বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট, অন্য দিকে মধ্য-বামপন্থী আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন জোট। দু’টি জোটের বাইরে আছে কিছু মধ্যপন্থী দল ও কিছু ডানপন্থী দল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন অতএব সুবিধা ভোগ করছে বেশি ও অতএব তাদের দায়িত্বও বেশি। জাতীয় ঐক্য বা জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হচ্ছে কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা জোট অন্য কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা জোটকে রাজনীতির ময়দান থেকে নির্মূল করতে চাইবে না; উদ্যোগ নেবে না। এ জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার অনেক উপাত্ত থাকতে পারে কিন্তু আমার বিবেচনায় ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত আমি উল্লেখ করলাম। যথাÑ এক. ২০১৭-১৮ সালের ব্যাখ্যা নয়, ১৯৭১-৭২ সালের ব্যাখ্যা মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দুই. সব ধর্মের ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা, তিন. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনা, চার. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী বড়-ছোট সব জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার ও প্রস্ফুটিত হওয়ার চেতনা, পাঁচ. অর্থনৈতিক কর্মে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা এবং সেই অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা, ছয়. সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনা করা। এ পর্যায়ে আমার নিবেদন : সমগ্র বাংলাদেশী জাতিকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই ২০১৮ সালকে আমরা কী পরিচয়ে ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য করতে চাই? গণতন্ত্র চূড়ান্ত ধ্বংসের বছর? গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বছর? গণতন্ত্র পুনর্গঠনের বছর? জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার বছর? জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করার সর্বোত্তম বছর?
ঐক্য ও সমঝোতা না হলে কী হতে পারে?
আমরা যদি জাতীয় সমঝোতা গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে আজ থেকে দশ-বিশ বছর পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বরূপ অতি দুর্বল ও ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমরা যদি জাতীয় সমঝোতা গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে আজ থেকে দশ-বিশ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের বা হুমকির (বা উভয়ের) সম্মুখীন হতে পারে। আজ বা আগামীকাল বা আগামী দশকে যারা ক্ষমতায় আছেন বা থাকবেন তারা চলে যাবেন; দশ-বিশ বছর পর তারা হয়ে যাবেন অতীত; তাদের নাম হয় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে অথবা স্বর্ণালি অক্ষরে ইতিহাসের পাতায় লিখিত থাকবে। কোন জায়গায় নিক্ষিপ্ত হবেন বা নাম লিপিবদ্ধ করাবেন সেই অপশন বা পছন্দ কোনটা গ্রহণ করব বা করবেন, সেটার বছর এই ২০১৮ সাল। জিডিপি ৬ শতাংশ থেকে ঐতিহাসিক ৭ শতাংশের ঘরে পৌঁছানো, ঐতিহাসিক সমুদ্রসীমা জয়, ঐতিহাসিক পদ্মা সেতু, ঐতিহাসিক মেট্রোরেল, ঐতিহাসিক মোবাইল ফোনের ফোরজি, ঐতিহাসিক মাতারবাড়ি মহেশখালী প্রজেক্ট, ঐতিহাসিক পায়রাবন্দর প্রজেক্ট, ঐতিহাসিক সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল ইত্যাদির সাথে ঐতিহাসিক বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ঐতিহাসিক বেসিক ব্যাংকের লুটপাট, ঐতিহাসিক জনতা ব্যাংকের লুটপাট, ঐতিহাসিক মানুষগুলোর ঐতিহাসিক খুন, গুম ও অপহরণ, ঐতিহাসিক প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি সব কিছুই ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে নিশ্চিতভাবে। কিন্তু যে জাতি ও দেশের ইতিহাসে এগুলো লেখা থাকবে, সেই জাতি ও দেশের মানুষের মর্যাদা কতটুকু নির্ণীত হবে এবং মর্যাদা কতটুকু ইতিহাসে লেখা থাকবে, সেটাই আলোচ্য বিষয়।
আজকের কলামটি কেন এরূপভাবে লিখলাম?
আজকের কলামটি কেন এরূপভাবে লিখলাম? ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের আগে আগে, অনেক টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত সাধারণ মানুষের ইন্টারভিউ দেখলাম। অনেক চ্যানেলেই বিভিন্ন দিনে অনুরূপ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়েছে, কিন্তু আমি একটি অনুষ্ঠানকে (সময় টিভি) প্রতীকী অর্থে আজকের আলোচনায় রেফারেন্স হিসেবে রাখছি; ওইটা ফেসবুকে জমাও আছে। টেলিভিশনের প্রচারিত ওই অনুষ্ঠানে আটজন কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীর মধ্যে সাতজনই উত্তর দিতে পারেননি ২১ ফেব্রুয়ারি বা শহীদ দিবস বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কী ও কেন? যেসব উত্তর তারা দিয়েছে, সেগুলো শুনলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সচেতন অনেক ব্যক্তি নিজের গালে নিজে চড় মারবেন; দিবসটির প্রতি আমাদের অন্তর্নিহিত অবহেলার ব্যাপ্তি দেখে। তারা উত্তর দিয়েছে ০১. এই দিনে যুদ্ধ হয়েছিল ০২. এই দিনে আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট হয়েছিল ০৩. এই দিন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ইত্যাদি। আরো একটি কথা। পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারছি বিভিন্ন জায়গায় ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হচ্ছে, নাচ-গানের ডিসকো পার্টি দিয়ে মঞ্চ বানিয়ে। আমি উদ্বিগ্ন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও এই দশা হবে, আজ থেকে ১০ বা ২০ বছর পর। শেষ সাবধান বাণীটি এরূপ : যদি পররাষ্ট্র নীতির ভুলের কারণে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হয়, তাহলে মানুষ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কেই দোষারোপ করবে। তাই আমি এই কলাম লিখলাম; আমরা যেন সচেতন হই। আগামীকাল থেকে মার্চ মাস শুরু, এই মার্চ মাসে অনুরূপ কলাম আরো লিখব।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
No comments