অভিজিৎ হত্যা
লেখক
অভিজিৎ রায় হত্যার তিন বছর পার হলেও মূল অপরাধীদের এখনো ধরা যায়নি। এ নিয়ে
দেশীয় তদন্তকারী দলের সঙ্গে আমেরিকান তদন্তকারীরাও কাজ করেছেন। কিন্তু এখন
পর্যন্ত তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। যেহেতু অভিজিৎ
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন, সেহেতু সেই দেশের তদন্তকারীরাও এখানে
এসেছিলেন তদন্তকাজে সরকারকে সহায়তা করতে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ২৬
ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বইমেলা থেকে ফেরার পথে জঙ্গিগোষ্ঠী অভিজিৎকে হত্যা
করে। তাদের আক্রমণে তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে
যান। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এত দিন বলা
হয়েছিল যে অভিজিৎ হত্যাকারীদের কেউ কেউ ধরা পড়েছে, অন্যদের শনাক্ত ও পাকড়াও
করতে পারলেই আদালতে অভিযোগপত্র দায়ের করা হবে। অভিজিতের বাবা বিশিষ্ট
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক অজয় রায় শুরু থেকে বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন।
গণমাধ্যমে তিনি একাধিকবার তাঁর অসন্তুষ্টির কথাও জানিয়েছেন। পুলিশের পক্ষ
থেকে বলা হয়েছে, সন্দেহভাজন হিসেবে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা কেউ
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। তাঁদের দাবি, নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি
সংগঠন আনসার আল–ইসলামই (পুরোনো আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) অভিজিৎকে খুন
করেছে। এর নির্দেশদাতা এবং সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর
সৈয়দ জিয়াউল হকসহ খুনিরা চিহ্নিত হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের অপর নির্দেশদাতা
শরিফুল ওরফে মুকুল রানা খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’
নিহত হন। কিন্তু হত্যার পরিকল্পনাকারী চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া এবং আরেক
সমন্বয়ক মো. সেলিম ওরফে হাদী-২ সহ সাতজন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিজিৎ
হত্যার তদন্ত হচ্ছে অনেকটা অন্ধের হাতি দর্শনের মতো। তদন্তের দায়িত্বে
নিয়োজিত ব্যক্তিরা একেক সময় একেক কথা বলছেন। আদালতের কাছ থেকেও তাঁরা
বারবার সময় নিচ্ছেন। পরস্পরবিরোধী ও অসম্পূর্ণ তথ্য কখনো সত্য উদ্ঘাটনে
সহায়ক নয়।
দুজন নির্দেশদাতার মধ্যে যদি একজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ও অপরজন
পলাতক থাকে তাহলে রহস্য উদ্ঘাটিত হবে কী করে? এর আগে সরকারের
নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মেজর জিয়া নজরদারিতে আছেন। এ রকম
দুর্ধর্ষ জঙ্গি নজরদারিতে থাকার পরও গ্রেপ্তার হচ্ছে না কেন? শুরু থেকেই
সরকার জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর কথা বলে আসছে।
ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী বেশ কিছু সফল অভিযানের
খবরও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। এগুলোকে সরকারের সাফল্যের দৃষ্টান্ত
হিসেবে বিবেচনা করলে, হত্যা মামলাগুলোর তদন্ত শেষ না হওয়া ব্যর্থতা হিসেবেই
চিহ্নিত হবে। জঙ্গিদের হাতে অনেক মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু রাজীব হায়দার
ছাড়া আর কোনো হত্যা মামলার বিচার হয়নি। খুনিরা পলাতক থাকলে এবং তাদের ধরা
না গেলে তারা যে নতুন অঘটন ঘটাবে না বা ফের শক্তি সঞ্চয় করে মাঠে নামবে না,
তার নিশ্চয়তা কী? অভিজিৎ রায়ের পর জঙ্গিদের হাতে জীবন দিয়েছেন তাঁর বইয়ের
প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। সেই হত্যার তদন্তও ঝুলে আছে। মামলার তদন্তকাজ
শেষ না হলে বিচার শুরু হবে কবে? একটি মামলার তদন্তকাজ শেষ হওয়ার পর বিচার
পেতে অনেক সময় লাগে। তিন বছরেও অভিজিৎ হত্যার তদন্তকাজ শেষ হয়নি। তদন্তকাজ
শেষ ও অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য আর কত অপেক্ষা করতে হবে? অবিলম্বে অভিজিৎ
হত্যার তদন্ত শেষ করে যেসব আসামি পলাতক আছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করে বিচারের
মুখোমুখি দাঁড় করানো হোক। খুনের বিচারই পারে জঙ্গিদের শিকড় নির্মূল করতে।
No comments