রংপুর সিটি নির্বাচন : জিতবে কে?
আগামীকাল
অনুষ্ঠিতব্য রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও লড়াই হবে মূলত ধানের শীষ, নৌকা ও লাঙ্গলের মধ্যে।
মঙ্গলবার রাত ১২টা বাজার সাথে সাথেই দৃশ্যমান প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেলেও এই
ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হতে প্রার্থীদের চলছে শেষ কৌশল প্রয়োগের নানামুখী তৎপরতা।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রংপুর সিটি করপোরেশন
নির্বাচনে এবার মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে বিএনপি মনোনীত কাওছার জামান বাবলা
ধানের শীষ, জাতীয় পার্টি মনোনীত মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা লাঙ্গল, আওয়ামী
লীগ মনোনীত সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু নৌকা, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত এ
টি এম গোলাম মোস্তফা হাতপাখা, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি মনোনীত সেলিম আখতার
আম, বাসদ মনোনীত আব্দুল কুদ্দুস মই এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হোসেন মকবুল
শাহরিয়ার আসিফ হাতি প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। তবে লাঙ্গল নৌকা আর ধানের শীষের
মধ্যেই লড়াই হবে বলে মনে করছে নগরবাসী। সব কেন্দ্রীয় নেতা চলে গেলেও বিএনপি
প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা ও তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক
মহানগর বিএনপি সভাপতি মোজাফফর হোসেন, সদস্য সচিব ও সেক্রেটারি শহিদুল ইসলাম
মিজু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান সামু, জেলা সভাপতি সাইফুল ইসলাম,
সেক্রেটারি রইচ আহম্মেদ, সাবেক এমপি মহিলা সভাপতি শাহিদার রহমান জোছনা,
অ্যাডভোকেট রেজেকা সুলতানা ফেন্সি, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দল আহ্বায়ক আব্দুস
সালাম, যুবদল জেলা সভাপতি নাজমুল আলম নাজু, সেক্রেটারি শামসুল হক ঝন্টু,
যুবদল মহানগর সভাপতি মাহফুজ উন নবী ডন, জেলা ছাত্রদল সভাপতি মনিরুজ্জামান
হিজবুল, সেক্রেটারি শরীফ নেওয়াজ জোহা, মহানগর ছাত্রদল সভাপতি নুর হাসান
সুমন, সেক্রেটারি জাকারিয়া ইসলাম জিমসহ বিপুল নেতাকর্মী নগরীর বিভিন্ন
প্রান্তে ধানের শীষের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন।
নির্বাচন কমিশনের বেঁধে
দেয়া সময়সূচির ভেতরে মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত লাঙ্গল প্রতীকের
প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এবং তার সাথে জাতীয় পার্টির কো
চেয়ারম্যান জি এম কাদের, নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মহানগর জাতীয়
পার্টির সেক্রেটারি এস এম ইয়াসির, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির
সদস্য ও মহানগর যুব সংহতির সভাপতি হাজী আব্দুর রাজ্জাক, সেক্রেটারি
হাসানুজ্জামান নাজিম, মহানগর জাতীয় পার্টির যুগ্ম সম্পাদক লোকমান হোসেন,
সাংগঠনিক সম্পাদক জায়দুল ইসলাম, মহানগর ছাত্রসমাজের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত
আসিফ, সেক্রেটারি আমিনুল ইসলাম ছোট, সাংগঠনিক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আল আমিন
সুমন, জেলা ছাত্রসমাজ আহ্বায়ক আশরাফুল হক জবা, যুগ্ম আহ্বায়ক বিদ্যুৎ,
স্বেচ্ছাসেবক পার্টির শামীম সিদ্দিকীসহ মূল, সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের
নেতাকর্মী ও সমর্থকরা বিচ্ছিন্নভাবে পুরো নগরীতে প্রচারণা চালিয়েছেন। রাতে
মোস্তফা সিটি বাজারের সামনে পথসভায় প্রচারণা চালান। এদিকে নৌকা প্রতীকের
প্রার্থী সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু এবং তার পক্ষে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক
সম্পাদক আহমেদ হোসেন ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন,
সেক্রেটারি অ্যাডাভোকেট রেজাউল করিম, মহানগর সভাপতি সাফিউর রহমান সফি,
সেক্রেটারি তুষারকান্তি মণ্ডল, ছাত্রলীগ জেলা সভাপতি মেহেদী হাসান রনি,
সেক্রেটারি রাকিবুল হাসান কানান, মহানগর সভাপতি শাফিউর রহমান স্বাধীন,
সেক্রেটারী শেখ আসিফ হোসেন, যুবলীগের মহানগর আহ্বায়ক সিরাজুম মুনির বাশার,
জেলা আহ্বায়ক রাশেদুন্নবী জুয়েলসহ মূল, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও
সমর্থকরা পুরো নগরী চষে বেরিয়েছেন প্রচারণার কাজে। প্রথম দিকে বিএনপি
প্রচারণায় পিছিয়ে থাকলেও গত তিন দিন থেকে তাদের প্রচারণা নগরবাসীর মাঝে
চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। নির্বিঘœ ভোট নিশ্চিত করা হলে এই নির্বাচনে বিএনপির
প্রার্থী কাওছার জামান বাবলার বিজয় নিশ্চিত দাবি করে তার নির্বাচন পরিচালনা
কমিটির সদস্য সচিব শহিদুল ইসলাম মিজু নয়া দিগন্তকে জানান, নির্বাচন কমিশন
আমাদের সাথে বৈরী আচরণ করায় আমরা প্রথম দিকে প্রচার-প্রচারণায় সামান্য
পিছিয়ে ছিলাম। আমরা আইনের মধ্যে থেকেই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। হুমকি ধমকির
মধ্যেও আমরা মাঠেই আছি। শহিদুল ইসলাম মিজু বলেন, আমাদের পক্ষে মানুষের রব
উঠে গেছে। মানুষ এখন ধানের শীষের পক্ষে। খালেদা জিয়ার ধানের শীষে ভোট দিয়ে
তারা আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সিগন্যাল দিতে চান।
তিনি বলেন, এই
নির্বাচনে আমাদের বাড়তি সুবিধা হলো মহাজোটের দুই প্রার্থী। মহাজোটভুক্ত
ভোটার ও সমর্থকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। সে কারণে তারা ধানের শীষকেই বেছে
নিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, এরশাদের ভাতিজা এখানে প্রার্থী হওয়ায় আমরা আরো
একটা সুবিধা পেয়েছি। কারণ জাতীয় পার্টির প্রার্থী এবং এরশাদের ভাতিজা মাঠে
থাকায় জাতীয় পার্টি অনেক সমর্থক তাদের কাউকেই ভোট না দিয়ে আমাদের
প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেটিও আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট।
আর এই সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ সরব। সে কারণে আমরা মানুষের
সহানুভূতি পাচ্ছি। তারা ধানের শীষকেই মাথায় রেখেছেন। এ ছাড়াও আমাদের
প্রার্থী বিগত পাঁচ বছর থেকেই মাঠে ছিলেন। তার কিন ইমেজ আছে। সেদিক দিয়েও
আমাদের ভোট আছে অনেক। অন্য দিকে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা একত্র
হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেবেন বলে দাবি করেন এই বিএনপি নেতা। বিএনপির
পক্ষ থেকে প্রচারণায় এখন খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটা হয়েছে কেন্দ্রীয় টিম
আসার পর। সোমবার দুপুরে রংপুরে আসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম
আলমগীর। সিও বাজার থেকে স্টেশন পর্যন্ত প্রধান সড়কে প্রার্থী বাবলাকে নিয়ে
মির্জা ফখরুলের একটানা প্রচারণা নগরবাসীর দৃষ্টি কেড়েছে। এর আগে শুক্রবার
রংপুর আসেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক। এর
আগে বুধবার আসেন নির্বাচন পরিচালনা কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ও দলের ভাইস
চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সদস্য সচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল
হাবিব দুলু, সদস্য সহসাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম ও সামসুজ্জামান,
কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য আমিনুল ইসলাম ও আব্দুল খালেক। তারাও গণসংযোগে অংশ
নেন। কেন্দ্রীয় নেতারা রংপুরে আসার আগে বিএনপি মিডিয়ায় তেমন একটা গুরুত্ব
না পেলেও কেন্দ্রীয় নেতারা আসায় বিএনপি মিডিয়াতে সরব হয়ে ওঠে। সংবাদ
সম্মেলন এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি অভিযোগসহ একেক নেতা একেক সময় মিডিয়ায়
এই নির্বাচন নিয়ে সরব থাকায় ঘরে বসে থাকা ভোটাররাও বিএনপির সরব উপস্থিতি
দেখছেন। তবে সোমবার রাতেই এসব নেতা রংপুর ত্যাগ করেন। জাতীয় পার্টির
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক এস এম ইয়াসিরের দাবি, এক দিকে জাতীয়
পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মনোনয়ন ও আশীর্বাদ অন্য দিকে
লাঙ্গল প্রতীক। সাথে আছে প্রথমবার নির্বাচনে ব্যর্থতার পরও নগরবাসীর সাথে
গত পাঁচ বছর হাসিমুখ কানেকশনে গড়ে ওঠা মোস্তফার ব্যক্তি ইমেজ। এর বাইরে আছে
সরকার ও সাবেক মেয়র বিরোধী বিশাল জনগোষ্ঠী।
সাবেক পৌরমেয়র এ কে এম আব্দুর
রউফ মানিক নির্বাচনে না থাকায় তার সমর্থক এলিট, সুধী এবং মহিলা ও রিকশা-অটো
শ্রমিকদের সমর্থ আছে। সোমবার রংপুরে এসেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রংপুরে এসেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমীন
হাওলাদার, সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। তিনি ভোট
দেয়ার জন্য এলেও নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না। এ ছাড়াও শনিবার
এসেছেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তিনি মোস্তফাকে
নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচেছন। এদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা
কমিটি, তাদের নিজস্ব জরিপ ও নির্বাচনী মাঠে থাকা বিভিন্ন পর্যবেক্ষক এবং
সাধারণ ভোটারদের সাথে গত তিন দিনে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনে অন্যতম
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরফুদ্দীন আহম্মেদ
ঝন্টুকে বিজয়ী করতে কর্মী সমর্থকরা জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। জেলা ও মহানগর
আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার জন্য মাঠ চষে
বেড়াচ্ছেন। রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা তুষারকান্তি মণ্ডলের দাবি, নৌকা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতীক, উন্নয়নের প্রতীক আওয়ামী লীগের প্রতীক।
সেই প্রতীক তিনি দিয়েছেন ঝন্টুকে। পাশাপাশি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে রংপুরের উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু এনে দিয়েছেন।
এদিকে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়
সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন, কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক
সম্পাদক অ্যাডভোটকেট আফজাল হোসেন, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক
বিশ্বনাথ সরকার বিটু, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাকির হোসেন, সেক্রেটারি
সোহাগের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় টিম। বিভিন্নভাবে তারা মাঠে থাকার চেষ্টা
করছেন। প্রত্যেক মানুষের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। ২০১২ সালের ২০
ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন হয়েছিল। এতে দলীয় প্রতীকে
না হলেও সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু মোটরসাইকেল প্রতীকে এক লাখ ছয় হাজার ২৫৫
ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। ওই
নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সমর্থন ছাড়াই হাঁস প্রতীক নিয়ে মোস্তাফিজার রহমান
মোস্তফা পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট। এবারের নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির
মেয়র প্রার্থী। অন্য দিকে ওই নির্বাচনে কাওছার জামান বাবলা আনারস প্রতীক
নিয়ে অংশ নিলেও কারচুপির অভিযোগ তুলে আগের দিনই নির্বাচন বয়কট করেছিলেন।
তবুও ভোট পেয়েছিলেন ২৪ হাজারের বেশি। এবার তিনি ধানের শীষ প্রতীকের
প্রার্থী। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই নির্বাচনে তাকে একটি বড় ফ্যাক্টর মনে
করছে নগরবাসী। আগামীকাল অনুষ্ঠিত হবে এই নির্বাচন। এবার মেয়র পদে সাতজন,
সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬৫ এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২১১ জন
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
No comments