নিয়াজির আত্মসমর্পণের আগে

৯ মাসের গেরিলা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট দুর্বল করে দিয়েছিল পাক বাহিনীকে। ৩ ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে পাকিস্তানি জান্তার জন্য পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হয়ে ওঠে। ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের দুর্বল দশা স্পষ্ট হতে থাকে। যৌথ বাহিনী বাংলাদেশের অনেকটা অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। তখন কার্যত পাকিস্তানি বিমান ও নৌবাহিনী অকেজো হয়ে পড়েছিল। এমন অবস্থায় নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। আত্মসমর্পণের সময়টি নিয়ে আরও নানা গুজব রয়েছে। এ গুজব থেকে রাজনৈতিক বিতর্কও তৈরি হয়েছে। এ কারণে প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের সামনে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করা। প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মালিক গভর্নর হাউসে জেনারেল নিয়াজিকে ডেকে পাঠান। এ সময়ের সেনাবাহিনীর প্রেস কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি সংকটের চিত্র তুলে ধরেন তার গ্রন্থ Witness to Surrender-এ। তিনি বলেন, নিয়াজি গভর্নরের সামনে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। পাকবাহিনীর দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে গভর্নর জানান, তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে বার্তা পাঠাবেন যুদ্ধ বিরতির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে। পাকিস্তানি সামরিক অফিসাররাও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন, নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করতে থাকেন তারা। পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রেক্ষাপট রচিত হয় ৯ ডিসেম্বর থেকেই।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা শত্রুমুক্ত হচ্ছিল। অনেক শহরে হানাদার বাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। পাকবাহিনীর সৈন্যরা আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে আসছিল ঢাকার দিকে। এমন এক পরিস্থিতিতে ৯ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এম এ মালিক ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠান, এতে অতি দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। ইয়াহিয়া খান গভর্নর মালিক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক নিয়াজি উভয়কেই তাদের বিবেচনা মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার নির্দেশ দেন। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব মার্ক হেনরি পাঁচ দফার একটি প্রস্তাব পাঠান। এগুলো হচ্ছে, ১. অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, ২. সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে হবে, ৩. পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অন্যসব নাগরিক যারা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে ইচ্ছুক তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে হবে, ৪. ১৯৪৭ সাল থেকে যারা পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করছে সেসব নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে এবং ৫. নিশ্চয়তা দিতে হবে এদের কখনও দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে না। তবে এই প্রস্তাব যে তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পেরেছে তেমন মনে হয়নি। এদিকে গভর্নর মালিক পরবর্তী নির্দেশনার জন্য রাওয়ালপিন্ডির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় গভর্নর হাউসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটি সভা ডাকেন। এই সংবাদ সকাল সাড়ে নয়টায় ভারতীয় বাহিনীর সিগন্যাল ইন্টিলিজেন্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লে. কর্নেল পি সি ভাল্লা পেয়ে যান। তিনি তা দ্রুত টেলিফোনে এয়ার ভাইস মার্শাল দেবাসেরকে জানান। তারা সিদ্ধান্ত নেন এই সময় গভর্নর হাউসে বিমান আক্রমণ করলে আত্মসমর্পণের বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে। সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী সভায় কর্মকর্তারা যোগ দেয়ার আগেই ভারতীয় বিমান আক্রমণে গভর্নর হাউসে বেশ কয়েকটি বোমা নিক্ষিপ্ত হয়।
গভর্নর মালিক ভীত হয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন। ১৩ অথবা ১৪ ডিসেম্বর রাতে নিয়াজি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদকে অনুরোধ করেন যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ বন্ধের পদক্ষেপ নেন। ১৪ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান নিয়াজির কাছে বার্তা পাঠিয়ে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন। নিয়াজির কাছে প্রেসিডেন্টের বার্তা এসে পৌঁছায় বিকেল তিনটায়। এরপর নিয়াজি এবং রাও ফরমান আলী ছুটে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভেক-এর কাছে। তারা অনুরোধ করেন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাতে যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা করেন। স্পিভেক জানান এ ধরনের আলোচনার যথাযোগ্য পদমর্যাদার তিনি নন। রাও ফরমান আলী প্রাসঙ্গিক একটি বার্তা প্রস্তুত করে এনেছিলেন। তারা বার্তাটি স্পিভেকের কাছে দিয়ে চলে আসেন। বার্তাটিতে তারা যুদ্ধে সাধারণ মানুষের জীবনহানির কথা বলে একটি মানবিক আবেদন জানান। এর সম্মানজনক সমাধানের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই প্রস্তাবনার একটি কপি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাও ফরমান আলীর হাতে দেয়া হয় গভর্নরের কাছে পৌঁছানোর জন্য। তবে বার্তাটি ভারতের কর্তৃপক্ষের কাছে না দিয়ে একটি কপি ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৭১-এ ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান লে. জেনারেল জ্যাক জ্যাকব তার গ্রন্থে বলেছেন, ১৪ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কলকাতার কনসুলার অফিসের একজন কূটনীতিক তাকে স্পিভেকের সঙ্গে নিয়াজির সাক্ষাৎ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি জানান, এই সময় যুদ্ধ বন্ধ বা আত্মসমর্পণ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হয়। জ্যাকব তখন কলকাতায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের কনসুল জেনারেল হার্বার্ট গর্ডনকে টেলিফোন করেন। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তবুও জ্যাকব বিষয়টি আবার খোঁজ নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু কনসুল জেনারেল নতুন কোনো তথ্য দেননি। এরপর জ্যাকব সেনাবাহিনী প্রধান মানেকশকে টেলিফোন করে অনুরোধ জানান তিনি যাতে দিল্লিতে নিয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডরের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করেন। অ্যাম্বাসেডর জানান, এ ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে তার জানামতে স্পিভেক তার বার্তাটি পাকিস্তানে নিয়োজিত তাদের অ্যাম্বাসেডরকে পাঠিয়েছেন এবং অ্যাম্বাসেডর তা পাঠিয়ে দিয়েছেন ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টে। পরে কিসিঞ্জার স্বীকার করেছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রস্তাবটি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে একদিন অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। বার্তাটি মানেকশ ১৫ ডিসেম্বর পান। পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে তিনি তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিয়াজি আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া দেন। এখানে এই তথ্যটিও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা যায় যে ১৫ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো সক্রিয় হয়ে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স ভারতের কাছে যুদ্ধ বিরতির পক্ষে অভিমত প্রকাশ করে। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা থেকে পরদিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর প্রথমে সকাল ৯টা পরে তা বাড়িয়ে বিকেল তিনটা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এসময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ বিরতিতে (যা বস্তুতপক্ষে আত্মসমর্পণ হিসেবে গৃহীত হবে) সম্মতি দান করেন। তবে পাকিস্তান পক্ষ ‘আত্মসমর্পণ’ (ঝঁৎৎবহফবৎ) শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য চেষ্টা করেছিল। স্পিভেকের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের দলিলটি নিয়াজি পান এবং এতে তার সম্মতি প্রকাশ করেন। জ্যাকব লিখেছেন জেনারেল মানেকশ ১৬ ডিসেম্বর সকাল সোয়া নয়টায় তাকে আদেশ দেন দ্রুত ঢাকায় চলে যেতে এবং সন্ধ্যার মধ্যে আত্মসমর্পণের কাজ সম্পন্ন করতে। তিনি জানিয়ে দেন ইতিমধ্যে ব্রিগেডিয়ার সান্থ লে. জেনারেল অরোরাকে নিয়ে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত দলিল প্রস্তুত করেছেন। জ্যাকব ঢাকা পৌঁছে নিয়াজির সদর দফতরে যান। এখানে তিনি মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের না আসার পরামর্শ দেন। তার মতে এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা খুবই উত্তেজিত ছিল। ফলে যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তার সঙ্গে শুধু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কয়েকজন সংবাদকর্মী যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে বলছিলেন আমরা ভেতরে যেতে চাই, আমরা নিয়াজি ও তার সহযোগীদের ওপর প্রতিশোধ নেব। ঘৃণা ভরা নানা শব্দে তারা স্লোগান দিচ্ছিলেন। জ্যাকব মুক্তিযোদ্ধাদের বোঝালেন কিছুক্ষণের মধ্যে আত্মসমর্পণ সম্পন্ন হবে। তারা বরং চারদিকের পরিবেশ শান্ত রাখার ব্যবস্থা যেন করেন। এখন যুদ্ধবিরতি চলছে। আর সবারই জেনেভা কনভেনশনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানও উচিত। মুক্তিযোদ্ধারা বিষয়টি বুঝতে পেরে সেখান থেকে চলে যান। জ্যাকব দুপুর একটায় নিয়াজির দফতরে পৌঁছান। নিয়াজি অভ্যর্থনা জানান ভারতীয় জেনারেলকে। এ সময় নিয়াজি ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জমশেদ, নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল শরিফ, এয়ার কমডোর ইমাম এবং ব্রিগেডিয়ার বাকার সিদ্দিক। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল জি. সি. নাগরার মেসেজ আসে। যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। বার্তায় তিনি নিয়াজিকে জানান, তিনি তার বাহিনী নিয়ে মিরপুর ব্রিজের কাছে চলে এসেছেন। তিনি যাতে তার প্রতিনিধি পাঠান। নাগরা একটি সাদা পতাকা ওড়ান। পাকিস্তানি সৈন্যরা নাগরাকে স্কট করে নিয়াজির সদর দফতরে নিয়ে যায়। জ্যাকব নিয়াজিকে জানান, টঙ্গীসহ কয়েকটি স্থানে এখনও বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চলছে। এটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন। নিয়াজি তখন একটি নির্দেশনামা পাঠিয়ে দিলেন। জ্যাকব নাগরাকে কয়েকটি কাজ বুঝিয়ে দিলেন। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তিনি যাতে প্রয়োজনীয় সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন, দ্বিতীয়ত, আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি যাতে সম্পন্ন করেন। জ্যাকব মনে করলেন ঢাকার অধিবাসী বাঙালিরা অত্যাচারিত হয়েছে, তাই জনসমক্ষে এই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান করলে সবার কষ্ট অনেকটা প্রশমিত হবে। যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে কয়েক ঘণ্টা লেগে গেল। কাছাকাছি কোথাও মাঝে মাঝেই গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এ সময় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে জাতিসংঘ এবং রেডক্রসের কর্মকর্তা ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও বিদেশি কর্মকর্তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তাদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। সভাকক্ষে আত্মসমর্পণের শর্ত পড়ে শোনানো হয়। ঘরটি মৃতপুরীর মতো নিস্তব্ধ হয়ে যায়। নিয়াজির গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। অন্যরা নিশ্চল হয়ে যায়। তাদের ধারণা ছিল ১৪ ডিসেম্বর স্পিভেক যেভাবে খসড়া তৈরি করেছিলেন তেমনই একটি যুদ্ধবিরতির কথা লেখা থাকবে। এটি যে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ হিসেবে নির্ধারিত হয়ে গেল তা মেনে নেয়া তাদের জন্য খুব কষ্টের ছিল। পাকিস্তানি অফিসাররা কিছু শব্দ পরিবর্তনের কথা বলেন। ভারতীয় ও বাংলাদেশি সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরিবর্তে তারা যুদ্ধ বন্ধের মধ্যে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের এই আবেদন রক্ষা করা যায়নি। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যেই তাদের সম্মতি জানাতে হয়। ঠিক হল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। ঢাকার পতন নিয়ে সিদ্দিক সালিকের একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি লিখেছেন, নিয়াজি মেজর জেনারেল নাগরার বার্তাটি যখন পান তখন তার পাশে ছিলেন মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল ফরমান ও রিয়ার এডমিরার শরিফ। ফরমান জিজ্ঞেস করলেন জেনারেল নাগরা কি আলোচকদের কেউ? জবাবে নিয়াজি বললেন, না। তাহলে তাকে কি অভ্যর্থনা জানান হবে, না মোকাবেলা করা হবে। মোকাবেলা করতে হলে সামরিক শক্তির প্রয়োজন। ফরমান আলী নিয়াজিকে জিজ্ঞেস করলেন তার রিজার্ভ বাহিনী আছে কিনা। নিশ্চুপ রইলেন নিয়াজি। উত্তর খোঁজার জন্য নিয়াজি ঢাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত জামশেদের দিকে তাকালেন। জামশেদ এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে না সূচক ভাব প্রকাশ করলেন। হতাশ নিয়াজি তখন জামশেদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তাহলে আর কী করা। নাগরার ইচ্ছেই পূরণ করতে হবে। জেনারেল নিয়াজি নাগরাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠালেন। তিনি মিরপুর সেতুতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের যুদ্ধবিরতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও নাগরার নির্বিঘ্ন আগমনের পথ সুগম করার আদেশ দিলেন। ভারতীয় জেনারেল কয়েকজন সৈন্য নিয়ে গৌরবের শিরোপা ধারণ করে ঢাকা প্রবেশ করেন। বস্তুত এভাবেই পাকিস্তানি দখলদারিত্ব থেকে ঢাকার পতন ঘটে। এদিন সকালের দিকে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে বার্তা আসে যে আজই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যাতে প্রতিনিধি পাঠানো হয়। তাজউদ্দীন আহমদের অফিসের কাছেই প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর অফিস।
প্রধানমন্ত্রী এখানে এসে জেনারেল ওসমানীকে অনুরোধ করেন তিনি যাতে এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু জেনারেল ওসমানী সম্মত হলেন না। তিনি তার আত্মসম্মান বোধ থেকে বললেন, যেখানে ভারতের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানেকশ এই অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না সেখানে বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি হিসেবে আমিও যেতে পারি না। এমন যুক্তিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ফিরে এলেন। তাই সঙ্গত কারণেই ঠিক হল মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকেই পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ কে খন্দকার কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে রওয়ানা হয়ে ঢাকা চলে এলেন। ইতিমধ্যে অসংখ্য বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধা জড় হয়েছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ভারতীয় বাহিনীর জওয়ানরাও সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়েছেন। চারদিক থেকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান মুখরিত করে তুলছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিলে পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষর করবেন লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি এবং বাংলাদেশের পক্ষে যৌথবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরা। প্রতীকী প্রতিনিধি হিসেবে পাকবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের একটি দল একদিকে দাঁড়িয়েছিলেন। পাকবাহিনীর একটি দল জেনারেল অরোরাকে গার্ড অব অনার জানাল। যৌথ বাহিনীর আরেকটি দল পাকবাহিনীর পাহারায় রইল। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.