ভোটযুদ্ধের আগে সরগরম বাকযুদ্ধ
ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি গত দু’দিন থেকে একটু ভিন্ন উত্তাপে মোড় নিয়েছে। মঙ্গলবার এক ইফতার পার্টিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, ২০১৮ সাল হবে জনগণের বছর। ওই সময় দেশ থেকে সব অন্যায়-অত্যাচার বিদায় নেবে। বিএনপি চেয়ারপারসনের এ বক্তব্যের সোজাসাপ্টা বিশ্লেষণ হল- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে আগামী বছর বিদায় নিতে হবে। চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই বুধবার সকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ধানমণ্ডিতে সাংবাদিকদের বলেন, পরবর্তী একাদশ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। সেটা হবে আওয়ামী লীগের হ্যাটট্রিক বিজয়, আর বিএনপির হ্যাটট্রিক পরাজয়। এরপর দুপুর না গড়াতেই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এক অনুষ্ঠান শেষে বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের পায়ের তলায় মাটি নেই। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা (সরকারি দল) ৩০টির বেশি আসন পাবে না। বুধবার সন্ধ্যায় এক ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে দেশের মানুষ এক কাপড়ে বিদায় করে দেবে। এদিকে জাতীয় নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর বাকি থাকতে প্রধান দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের এমন সব বক্তব্যকে কীভাবে বিশ্লেষণ করছেন জানতে চাইলে কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাদের সারমর্ম মন্তব্যে যুগান্তরকে বলেন, কে ক্ষমতায় যাবে তা ঠিক করবে জনগণ। সময় এলেই কোন দলের কেমন জনপ্রিয়তা তা প্রমাণিত হবে। এজন্য প্রয়োজন সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে এখন দুই প্রধান দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা যা বলছেন তা শুধুই নিজ দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা ছাড়া আর কিছু নয়। এগুলো মাঠ গরম করার বক্তৃতা। জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘দুই প্রধান দলের শীর্ষ নেতাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আসলে তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য জোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা বিজয় ধরে রাখতে চাইবে। বিএনপিও নির্বাচন বর্জনের মতো ভুল দ্বিতীয়বার করতে চাইবে না। তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করবে।
আর এসব চিন্তা মাথায় রেখেই মূলত দুই দলের শীর্ষ নেতারা মাঠ গরম করা বক্তৃতা দিচ্ছেন। আশার বাণী শোনাচ্ছেন। আসলে তাদের কথাবার্তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে- মাঠের কর্মীদের উজ্জীবিত রাখা।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতেই দুই দলের শীর্ষ নেতারা গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছেন। এটা নতুন কিছু নয়। অতীতেও এ রকম হয়েছে।’ তিনি বলেন, যারা ক্ষমতায় আছে, তারা ক্ষমতায় থাকতে চায়। যারা ক্ষমতায় নেই, তারা ক্ষমতায় আসতে চায়। আর এই আসা-যাওয়ার খেলা মাঝখানে থেকে দেখছে জনগণ।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে দু’পক্ষই নির্বাচনে প্রস্তুতি নেয়ার পাশাপাশি মাঠ গরমের রাজনীতি শুরু করেছে। ঈদের পর পরই এ বিষয়টি আরও খোলাসা ও স্পস্ট হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন থেকে যা হবে তার সবই নির্বাচনকেন্দ্রিক। দু’পক্ষই মাঠ গরম করতে মাঠে নামবে। জনমত গড়ে তুলতে যে যার মতো করে কৌশল প্রয়োগ করবে। আওয়ামী লীগ টানা বিজয় চাইবে। বিএনপিও আগের মতো আর নির্বাচন বর্জন করবে না।’ এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ২০১৮ সালে দেশে একটি নির্বাচন হওয়ার কথা। ওই নির্বাচনে জনগণের বিজয় হবে। আর অবসান হবে বর্তমান অত্যাচারী সরকারের। তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালে যে নির্বাচন হবে সেটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হবে। নির্বাচনকালীন ওই সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা রাজপথে নামব। তবে কখন, কিভাবে নামব তা সময় হলেই দেশের মানুষ দেখতে পাবে। সে আন্দোলনেও দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবে এবং নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা হবে। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ওনারা একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে দেখুক, আওয়ামী লীগের অবস্থা কী হয়। জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কোন পর্যায়ে আছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে বিএনপি মহাসচিবের দুপুরে দেয়া বক্তব্যের জবাবে বুধবার বিকালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ওবায়দুল কাদের বলেন, সামনের নির্বাচনে তারা (বিএনপি) ৩০টির বেশি আসন পাবেন কিনা তা জানি না, তবে বিএনপির পরাজয় নিশ্চিত। তিনি বলেন, বিএনপি মনে করছে ২০০১ সালে যা হয়েছে আবার ২০১৮ সালে তাই হবে। এই মনে করে থাকলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ২০১৪ সালে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। কিন্তু ২০১৮ সালে যে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে সেখানে তারা তাদের পছন্দের মানুষকে ভোট দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার তাই করবে। মোশাররফ বলেন, ভোটের দাবিতে দেশের জনগণ এখন সোচ্চার। এরই প্রতিফলন ঘটছে দেশে ও বিদেশে। বিদেশি বন্ধুরাও এখন এসে বলে যাচ্ছেন সব দলের অংশগ্রহণে একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন একবার ধোঁকা দিয়ে করা যায়। বারবার করা যায় না।
এখন দেশের জনগণ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের স্বার্থে রাজি না হয়, তাহলে জনগণই তাদের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। অর্থাৎ ২০১৮ সালে জনগণ যা চাইবে, তাই হবে। এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে এটা শুধু কথার কথা কিংবা রাজনৈতিক বুলি নয়। আগামী নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে। এর কারণ আওয়ামী লীগ দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান ও আয় বেড়েছে। বর্তমান সরকারের অধীনেই বাংলাদেশ নিন্ম-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। আমরা যেখানেই যাচ্ছি মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক দেশ-বিদেশে নানা কর্মসূচিতে মানুষের সাড়া পেয়েছেন। এসব কারণেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আবারও ক্ষমতায় আনবে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, দেশের জনগণও চায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু সরকার যদি শেষ পর্যন্ত জনগণের এ চাওয়ার সঙ্গে একমত না হয়, তাহলে বিএনপি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে নামবে। এজন্য দলের নেতাকর্মীদেরও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
No comments