সরকারের দাবি ৭.২৪ শতাংশ বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ৬.৮
চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দাবি করেছেন, বিশ্বের মাত্র দুটি দেশ ৭ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তার মধ্যে একটি ভারত, অপরটি বাংলাদেশ। যদিও চলতি বছরের বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। অপরদিকে বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এর ফলে সরকারের ঘোষণার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বড় গরমিল দেখা দিয়েছে। রোববার প্রকাশিত সংস্থাটির বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে, চলতি বছরের তুলনায় আগামী বছরেও প্রবৃদ্ধি কমবে। যা হতে পারে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছর দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। সেই সঙ্গে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরে এ আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৫ মার্কিন ডলার। এ হিসাবে এক বছরে আয় বেড়েছে ১৩৭ মার্কিন ডলার। রোববার এনইসি পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এসব তথ্য প্রকাশ করেন। তবে বিশ্বব্যাংক বলেছে,
বিনিয়োগ পরিবেশে অবনতি, প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের পতন ও রফতানি আয়ের বৃদ্ধি মন্থর হয়ে আসায় এবার সার্বিক প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক কম হবে। ডলার, ইউরোসহ অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় দেশীয় মুদ্রা টাকার মান বেড়ে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধি আগের মতো বাড়বে না। রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এ সময় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান, সিনিয়র ডাইরেক্টর কার্লোস ফিলিপে হ্যারমিলো বক্তব্য রাখেন। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থার লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থনীতির জন্য দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরের ছয়টি বিষয়কে ঝুঁকি হিসেবে দেখা হয়েছে। তবে সরকারি বিনিয়োগ দক্ষতা, কর্মবাজারে নারীদের অন্তর্ভুক্তি ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বর্তমান অবস্থা থেকে আগামী ১০-১২ বছরে আরও ৩ শতাংশ যোগ করা সম্ভব। অপরদিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী গত কয়েক বছরের প্রবৃদ্ধির তথ্যও তুলে ধরেন। এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক সব সময় কম প্রক্ষেপণ করলেও এবারেই প্রথম ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বলেছে। এটি উদারতার বিষয়। প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনোরকম ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয় না। রেমিটেন্স সংক্রান্ত অপর এক প্রশ্নের উত্তরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, রেমিটেন্স কমেনি বরং বেড়েছে। আমরা না বুঝে হিসাব করি বলেই কম মনে হয়।
হিসাবের সময় শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ধরা হয়। কিন্তু বিকাশসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচুর রেমিটেন্স দেশে আসছে। এ দেশেই তো খরচ হচ্ছে। কিন্তু সেটি হিসাবে আসছে না। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়লেও এসব আমদানি পণ্যের সঠিক মূল্য ও শিল্প খাতে এ সবের সঠিক ব্যবহার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, আর্থিক ও কর্পোরেট খাতে আগামীতে স্থিতিশীলতার আরও অবনতি হতে পারে। আর্থিক সংস্কার কার্যক্রমেও ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ২০১৯ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। দেশীয় এ তিন চ্যালেঞ্জের বাইরে বিশ্ব অর্থনীতির তিন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য বড় বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এর ফলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এ বাজারে ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশি পণ্য। এ অঞ্চল থেকে রফতানি আয়ের পাশাপাশি প্রবাসী আয়ও কমবে। তা ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার কারণেও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতিতেও সাম্প্রতিক সময়ে স্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন। তবে মুদ্রার বিনিময় হার, রাজস্ব আহরণ ও তারল্য ব্যবস্থাপনায় কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। জাহিদ হোসেন বলেন, গত অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ১ শতাংশ বেড়েছে।
এর আগের কয়েক বছরে বেসরকারি খাতে এত বিনিয়োগ বৃদ্ধির নজির নেই। বিনিয়োগ পরিবেশের অবনতি সত্ত্বেও বেসরকারি খাতের এ বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন তিনি। তবে বিনিয়োগের মান ও প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে চিমিয়াও ফান বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায়ের হার বাংলাদেশে অত্যন্ত কম। সেদিক থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব আয় বাড়বে এবং রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, শিল্প খাতে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। জিডিপির আকার হচ্ছে ১৯ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরে ছিল ১৭ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে সার্বিক মূল্যস্ফীতির কথা বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল ও স্বস্তিদায়ক হলেও চালের দাম বাড়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। যা কিছুটা অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। রির্জাভের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, রির্জাভে স্বস্তি আছে কিন্তু তুষ্টির কোনো কারণ নেই।
No comments