এমপি হারুন-পুত্রদের নিয়ে এলাকায় আলোড়ন
বনানীর অভিজাত রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণী ধর্ষণের সমালোচনার ঢেউ আছড়ে পড়েছে বরিশালের ঝালকাঠিতেও। প্রশ্ন উঠেছে, স্থানীয় এমপি আলহাজ আল্লামা বিএইচ হারুনের পুত্ররা বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল এ হোটেল করার টাকা পেলেন কোথায়? স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এমপি হারুণ এলাকায় ধর্মীয় লেবাসে নিজেকে অন্যরকম মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেন, কিন্তু তার যে অন্য একটি রূপও রয়েছে বনানীর ঘটনায় তা সামনে এলো। সামনেই সাধারণ নির্বাচন, এ অবস্থায় তার এ কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমপি হারুন তার গ্রামের বাড়ি কানুদাসকাঠিতে ইসলামী কমপ্লেক্স পর্যন্ত গড়েছেন। মসজিদ-মাদ্রাসা থেকে শুরু করে ধর্মীয় পাঠাগার এবং লিল্লাহ বোর্ডিংও গড়ে তুলেছেন। যতবার এলাকায় গেছেন ততবারই তিনি প্রকাশ্যে তার তিন পুত্রকে ইসলামী অনুশাসনে শাসন করেছেন। শোনাতেন ধর্মের কথা। স্থানীয়রা বলছেন, এমপি সাহেবের নামের আগে যদি কখনো কেউ আল্লামা শব্দটি ব্যবহার না করেন তা হলে তিনি ক্ষেপে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় বুলবুলে পাকিস্তান খেতাবপ্রাপ্ত এমপির বাবা মাওলানা আবদুল রব ও এমপি হারুণের নিজের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিয়া হায়দার খান লিটন এ প্রসঙ্গে বলেন, এমপি সাহেবের বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন। খোদ বিএইচ হারুনের ভূমিকাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। ধর্ম ব্যবসায়ীরা যে সব সময়েই ভেতরে এক আর বাইরে আরেক হয় তা ফের প্রমাণিত হল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকের সঙ্গেই কথা হয় যুগান্তরের এ প্রতিনিধির। তারা বলেছেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আল্লামা বিএইচ হারুনের বাবা আ. রব এলাকায় মাওলানা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পাকিস্তান আমলে সুবক্তা হিসেবে তিনি বুলবুলে পাকিস্তান খেতাব পান। স্বাধীন হওয়ার পর তাকে বলা হতো বুলবুলে বাংলাদেশ। বিএইচ হারুনের নানা ছিলেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার কাসেমাবাদ দরবার শরিফের প্রতিষ্ঠাতা। এলাকায় কঠোরভাবে মুসলিম অনুশাসনে পরিচালিত হিসেবে পরিচিত বিএইচ হারুনের পরিবার। কিন্তু এমপিপুত্রের বিলাসবহুল হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনা এবং হোটেলটির পক্ষ থেকে ধর্ষকদের রক্ষার নানা তৎপরতা, একই সঙ্গে প্রধান আসামি সাফাতের সঙ্গে যোগাযোগ এবং হোটেল কক্ষ ভাড়া দেয়ায় এমপিপুত্রের নাম জানাজানি হওয়ার পর এ নিয়ে রাজাপুরে নানা মুখরোচক আলোচনা চলছে। কথা হয় কাঁঠালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তরুন সিকদারের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আজ সবাই বিএইচ হারুন এবং তার পরিবারের ভেতরের রূপটা দেখছে। অথচ এ রূপটা আমরা অনেক আগে থেকেই চিনি। বাইরে ধর্মের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে পুরো পরিবারটিই ধর্ম ব্যবসায়ী। মুখে ধর্মের কথা বলার আড়ালে তারা এভাবে অনৈতিক এবং অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে।’ তিনি বলেন, ‘হারুন সাহেব এমপি হওয়ার আগে কাঁঠালিয়া উপজেলায় মাদকের কোনো চিহ্ন ছিল না। কিন্তু এখন এখানে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। আর যারা মাদকের ব্যবসা করে তারা সবাই এমপি সাহেবের লোক।’ রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিয়া হায়দার খান লিটন বলেন, ‘এতবড় হোটেল! তাদের আয়ের উৎস কি? পত্র-পত্রিকায় দেখেছি ঘটনার রাতে নাকি ওই দুই কক্ষে এমপি সাহেবের ছোট ছেলেও গিয়েছিল।
মালিকপক্ষ হিসেবে সেই নাকি ফোন করে ধর্ষকদের জন্য হোটেল কক্ষ ভাড়া করে দেয়। কথায় কথায় সৌদি আরবসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্যের প্রচার চালান। অথচ তার ছেলে এটা কি করল? তিনি যেভাবে ধর্মের কথা বলেন তাতে তো তার হোটেলে নামাজ-রোজার ব্যবস্থা থাকার কথা। আছে মদ কেনাবেচার হাট। অবশ্য এটাও ঠিক যে কলাগাছে কলাই হয় আম নয়।' রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন মাতুব্বর বলেন, ‘উনি কখনোই আওয়ামী লীগের ছিলেন না। উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী হওয়ায় শুরু থেকেই আমরা তার মনোনয়নের বিরুদ্ধে ছিলাম। তারপরও তাকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। আজ লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমাদের। সামনে নির্বাচন। এরকম একটি সময়ে তিনি এবং তার পরিবারের কারণে রাজাপুরে দল একটি বড় ধরনের ধাক্কা খেল। তাকে নিয়ে ছি ছি চলছে।' কথা বলার জন্য সংসদ সদস্য বিএইচ হারুনের মোবাইল ফোনে টানা ৩ দিন ধরে অসংখ্যবার ফোন এবং বেশ কয়েকটি ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি ফোন ধরেননি বা কল ব্যাক করেননি। হারুনের ভাই ঝালকাঠি জেলা পরিষদ সদস্য আজাদ হোসেন আরজুর সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'সৌদির স্পিকার এসেছেন। এমপি সাহেব তাকে নিয়ে ব্যস্ত। যে কারণে কথা বলতে পারছেন না।’ রেইনট্রিকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ও এমপি হারুনের ছেলে মাহির হারুনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে আজাদ বলেন, ‘হোটেলের মালিক এমপি সাহেবের পরিবার এটা ঠিক। তবে ঘটনার সঙ্গে মাহিরের সংশ্লিষ্টতা বা অন্য কোনো বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। যতদূর জানি বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই এটি পরিচালনা করেন। এমপি সাহেবের কাছে সবকিছুর খবরও থাকে না। সেখানে কি হয়েছে বা হয়নি তা কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই ভালো বলতে পারবেন। আমি কিছুই বলতে পারব না।’
No comments