বাংলাকে ভালোবাসি

ঢাকার কিছু অভিজাত এলাকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে দেখি, কিছু শিশু-কিশোর অভিভাবক ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। অভিভাবকেরাও সন্তানদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন, কিংবা অর্ধেক ইংরেজি অর্ধেক বাংলায় কথা বলেন। বিল দেওয়ার সময় অভিভাবকদের দেখি বাংলায় কথা বলেন। তাঁরা যে বাঙালিই এতে কোনো সন্দেহ থাকে না। কিন্তু সন্তানদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন ইংরেজিতে। ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও এ রকম দেখি। তাদের কেউ পুরোপুরি ইংরেজিতে কথা বলে। কেউ ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে বলে। কেউ বাংলা উচ্চারণ করে ইংরেজির মতো করে। বাংলা পৃথিবীর সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর অন্যতম। রক্তের বিনিময়ে একটি ভাষার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির উদাহরণ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
তাই তো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা তার যোগ্য সম্মান থেকে অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। আজ সে বিকৃতিরও শিকার। বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা কার্যক্রমের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বাংলা ভাষায় শুদ্ধ উচ্চারণকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পরও আমরা কজনই-বা শুদ্ধ বাংলায় শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার বা লেখার যোগ্যতা অর্জন করি। ভাষায় আঞ্চলিকতার প্রভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবে শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার ও চর্চা সম্পর্কে সচেতনতা খুব জরুরি। অনেকেই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারেন না, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত বাংলা বলা, ইংরেজি-বাংলা মেশানো কিংবা ইংরেজি ধাঁচে বাংলা বলার চর্চা দেখা যাচ্ছে। এমনকি কর্মক্ষেত্রেও ইদানীং ইংরেজি কায়দায় ও ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলার চল লক্ষ করা যাচ্ছে। এই প্রবণতার পেছনে কিছু এফএম রেডিওর ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, চাকরিযুদ্ধে প্রায় সর্বত্রই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার প্রমাণ যে হারে নেওয়া হয় বাংলা ভাষায় তা নেওয়া হয় না। মৌখিক পরীক্ষাগুলো অধিকাংশই হয় ইংরেজিতে এবং সেখানে ইংরেজিতে কথা বলায় পারঙ্গম পরীক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। তারা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে বা লিখতে পারেন কি না, তা দেখা হয় না। কিন্তু কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় দক্ষতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হওয়া উচিত। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর জন্য একসঙ্গে দুটি কিংবা তিনটি ভাষা আয়ত্ত করা খুব কঠিন নয়। তবে প্রয়োজন হলো, প্রতিটি ভাষার স্বকীয়তার প্রতি হৃদয়ে শ্রদ্ধা রেখে তা আয়ত্ত করা এবং একটি ভাষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণে আরেকটি ভাষা যেন তার যোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। পরিবারগুলোকে এ বিষয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ মানুষের সব শিক্ষার ভিত্তিভূমি রচিত হয় পরিবারে। পরিবার থেকেই যদি শিশু এমন আভাস পায় যে বাংলার চেয়ে ইংরেজি শেখা অধিক গুরুত্বপূর্ণ,
তবে তার কাছে বাংলা ভাষাকে গৌণ মনে হবে। কিন্তু শিক্ষার শুরুতে মাতৃভাষার ভূমিকাই প্রধান। তাই আমাদের শিশুদের ইংরেজির আগে বাংলা শিখতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটি বলেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন।’ শিশুদের সঠিক ও শুদ্ধভাবে বাংলা শেখার ক্ষেত্রে পাঠ্যবই, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তবে একটা সমাজে যদি মাতৃভাষার মর্যাদা বিদেশি ভাষার চেয়ে কম হয়, তাহলে সেই সমাজের মানুষদের সঠিক ও শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা শেখা ও ব্যবহার করার আগ্রহ বেশি হয় না। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একদিন শ্রেণিকক্ষে বলেছিলেন, যে ব্যক্তি একটি ভাষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার কখনোই অন্য একটি ভাষা থেকে শব্দ ধার করে কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না।’ আমরা বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি তুলি, অথচ নিজেদের কাজেই বাংলা কতটা ব্যবহার করি, কীভাবে করি তা নিয়ে ভাবি না। মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে শেখা ও ব্যবহার করা অগৌরবের কিছু নয়। বরং উল্টোটাই সত্য। পৃথিবীর সব উন্নত ও সভ্য জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে মাতৃভাষায়। তারা বিদ্যাশিক্ষা করে মাতৃভাষায়, অফিস-আদালতের কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, পারস্পরিক যোগাযোগের সমস্ত ক্ষেত্রে তারা মাতৃভাষাই ব্যবহার করে। আবার তারা একাধিক বিদেশি ভাষাও শেখে। এভাবেই তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করেছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান ও চীনের দিকে তাকালেই আমরা তা দেখতে পাই। তাই আসুন, আমরা শুদ্ধ বাংলা জানি, শুদ্ধ বাংলার চর্চা করি, শুদ্ধ বাংলায়, শুদ্ধ উচ্চারণে পরিষ্কারভাবে কথা বলি। সব কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার করি। সর্বস্তরে বাংলা চালু করার যে কথা বলা হয়, তা শুধু কথার কথা হয়ে থাকবে আর কতকাল? শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রকৃত মর্যাদা তখনই প্রতিষ্ঠা পাবে, যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এই ভাষা ব্যবহার করা হবে।
নিশাত সুলতানা: শিক্ষা গবেষক; একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মসূচি সমন্বয়কারী।
purba_du@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.