আবার আদালতে ধাক্কা খেলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
সান ফ্রান্সিসকোর ফেডারেল আপিল কোর্টের তিন বিচারক গত বৃহস্পতিবার সর্বসম্মতভাবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন-সংক্রান্ত আদেশ স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছেন। এই নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প সাতটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের ৯০ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেন। এই সাতটি দেশ হলো ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, সুদান, ইয়েমেন ও সোমালিয়া। এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি সিয়াটলের একটি ফেডারেল আদালত ওয়াশিংটন ও মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের অনুরোধে নির্বাহী আদেশটি পূর্ণ শুনানি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার পক্ষে মত দেন। এতে করে আটকে পড়া ওই সাত দেশের ভিসাধারী নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পথ খুলে যায়। তখন ট্রাম্প প্রশাসন সান ফ্রান্সিসকোর আপিল কোর্টে আবেদন করলে সেখানেও নির্বাহী আদেশটি প্রাথমিকভাবে স্থগিত রাখা হয়। বিশদ শুনানির পর বৃহস্পতিবার সর্বসম্মতভাবে স্থগিতাদেশ বহাল রাখেন আপিল আদালত। ক্ষমতা গ্রহণের তিন সপ্তাহের মাথায় বিচার বিভাগের নির্দেশে ক্ষমতা খর্ব হওয়ার এ ঘটনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রীতিমতো খেপিয়ে তুলেছে। সিয়াটলের যে আদালত তাঁর আদেশের প্রতি নিষেধাজ্ঞা দেন,
ট্রাম্প ওই বিচারপতিকে ‘তথাকথিত বিচারপতি’ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি টুইটারে বলেছিলেন, এখন যদি কোনো সন্ত্রাসী হামলা হয়, তো তার সব দায়দায়িত্ব সেই বিচারককে নিতে হবে। বৃহস্পতিবার আপিল কোর্টের রায় ঘোষণা হওয়ার পর ট্রাম্প সাংবাদিকদের এক তাৎক্ষণিক মন্তব্যে সিদ্ধান্তটি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করেন। পরে টুইটারে তিনি ঘোষণা করেন, ‘কোর্টেই দেখা হবে। দেশের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন।’ আপিল কোর্টের যে তিনজন বিচারক সর্বসম্মতভাবে রায়টি ঘোষণা করেন, তাঁদের দুজন ডেমোক্রেটিক এবং একজন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত। সিয়াটলের ফেডারেল বিচারপতিও জর্জ বুশের আমলে নিয়োগ পেয়েছেন। ফলে দুজন রিপাবলিকান ও দুজন ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট-সমর্থিত বিচারপতি ট্রাম্পের নির্দেশের ব্যাপারে অভিন্ন মত দিলেন। দীর্ঘ ২৯ পাতার রায়ে আপিল আদালত মূলত সিয়াটলের আদালতের নির্দেশটি বহাল রেখেছেন। সেই আদালত ট্রাম্পের নির্দেশটি মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক—এই যুক্তিতে তা স্থগিত রাখার পক্ষে মত দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তি দেখায়, জাতীয় নিরাপত্তা ও অভিবাসনের মতো প্রশ্নে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা পর্যালোচনা আদালতের এখতিয়ারভুক্ত নয়। আপিল আদালত সেই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন। আদালত বলেন, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে—সরকারপক্ষের এই দাবি অগণতান্ত্রিক। আদালত আরও বলেন, এই নির্দেশ এ মুহূর্তে কেন এত জরুরি, সরকারপক্ষ তার কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। মূল নির্বাহী নির্দেশে এই সাতটি দেশের গ্রিন কার্ডধারীদের আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, পরে এক ঘোষণায় হোয়াইট হাউসের কৌঁসুলি সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। আপিল আদালত জানান, প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশের অংশবিশেষ প্রত্যাহারের কোনো এখতিয়ার হোয়াইট হাউসের কৌঁসুলির নেই। সরকারপক্ষ দাবি করেছিল, এই নির্বাহী আদেশের ফলে মাত্র ১০৯ জন বিদেশির যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ ব্যাহত হয়। আদালত সেই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এর ফলে হাজার হাজার যাত্রী দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে আটকা পড়েন। অনেকে নিজ দেশের বিমানবন্দর থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তবে নির্বাহী আদেশটি মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক—এই দাবির ব্যাপারে আদালত এখন পর্যন্ত নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি।
আদালতে পূর্ণাঙ্গ শুনানি না হওয়া পর্যন্ত এই প্রশ্নে আদালত তাঁর রায় প্রদানে অসম্মত হন। ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত। অধিকাংশ আইন বিশেষজ্ঞের মত, ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে এই আদেশ বাতিল করে একটি আইনসম্মত নতুন আদেশ তৈরি করা। সিনেটে ডেমোক্রেটিক নেতা চাক শুমার সেই প্রস্তাবই করেছেন। তাঁর যুক্তি, এই প্রশ্নে কংগ্রেসে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক উভয় দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমর্থন রয়েছে এমন একটি নতুন আইন তৈরি করা হোক। বর্ষীয়ান ডেমোক্রেটিক সিনেটর প্যাট্রিক লেহিও একই কথা বলেছেন। কিন্তু সেটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য পরাজয় মেনে নেওয়া হবে। কেউ বিশ্বাস করে না ট্রাম্পের মতো আত্মম্ভরী মানুষ নিজের ‘ইগো’ সরিয়ে রেখে সমঝোতার পথ গ্রহণ করবেন। সিএনএনের আইনবিষয়ক ভাষ্যকার জেফ্রি টুবিন মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত ট্রাম্পকে যতটুকু দেখেছি, তা থেকে স্পষ্ট পরাজয় মানতে তিনি প্রস্তুত নন।’ গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটন, যিনি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর থেকে কার্যত নিশ্চুপ রয়েছেন, এক টুইটার বার্তায় লিখেছেন ৩-০। এখন বিষয়টি যদি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়, তাহলেও ট্রাম্প যে তাঁর আদেশের পক্ষে রায় পাবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। একজন বিচারকের আসন শূন্য থাকায় সর্বোচ্চ আদালত এ মুহূর্তে আদর্শগতভাবে ৪-৪ ভোটে বিভক্ত। অর্থাৎ আদালতের চারজন সদস্য রক্ষণশীল ও চারজন উদারনৈতিক হিসেবে পরিচিত। কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হলে আপিল আদালতের রায়টিই বহাল থাকবে। সে ক্ষেত্রে পরাজয় মেনে নেওয়া ছাড়া ট্রাম্পের অন্য কোনো পথ খোলা থাকবে না। তবে আপিল আদালতের গত বৃহস্পতিবারের রায় যে ট্রাম্পের জন্য বিশাল ধাক্কা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওয়াশিংটন পোস্ট মন্তব্য করেছে, এই রায় দেশের প্রেসিডেন্ট, যিনি নিজেকে সম্রাটের মতো ভাবেন এবং অত্যন্ত আনাড়ি, তাঁর জন্য মস্ত ঝাঁকুনি।
No comments